জ্বলদর্চি

কবি ও কথাসাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী’র সাক্ষাৎকার নিলেন গল্পকার মৌসুমী ঘোষ(উৎসব ১৪২৮)

কবি ও কথাসাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী’র সাক্ষাৎকার :  ‘জ্বলদর্চি’ পত্রিকার পক্ষে মৌসুমী ঘোষ

“আমি মনে করি, আমার মধ্যে অনেকগুলি মানুষ বাস করে একই সঙ্গে, অনেকগুলি সত্তা”  


“… যারা দেশান্তরে জন খাটতে যায়, আখ কাটাই-এর কাজে, তাদের ঘরে মেয়ে হলে বলে — ‘এক কইতা কমি’ মানে একটা কাস্তে কম হল। স্বামী-স্ত্রী মিলে এক কাস্তে, ব্যাটাছেলে সন্তান — সেও আধ বা সিকি কাস্তে। কিন্তু মেয়ে তো বাপের সংসারে থাকবে না। সে চলে যাবে পরের ঘর, তাদের ঘরের যে কাজের হাত, তাতে জুড়ে যাবে। বাপের ঘরে কম হবে একটি হাত, একখানা কাস্তে। … কাজেই মেয়েদের জন্ম না দেওয়াটাই বুদ্ধির কাজ। … হাজার টাকায় মেয়ে না ছেলে তার জাঁচ, তিন হাজার টাকায় মেয়ে খালাস। … চলতেই থাকে মারণযজ্ঞ।”  ( কাস্তে - অনিতা অগ্নিহোত্রী )
 
মৌসুমী : আপনার লেখক জীবনে মায়ের ভূমিকার কথা, মায়ের স্মৃতিতে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের কথা আমরা জানি। আপনার মানস পৃথিবীতে কবি বাবার কথা নিশ্চয়ই জমা হয়ে আছে। লেখক জীবনে মায়ের প্রভাব, সঙ্গে বাবার প্রভাবের কথাও যদি বলেন... 

অনিতাদি :  আমি ছিলাম বাবা-মার কনিষ্ঠ সন্তান। যখন ছোটো ছিলাম, অর্থাৎ পড়তে পারি লিখতে পারি না বা পড়তেও পারি না এমন একটা বয়সে (দাদারা আমার থেকে বড়ো ছিলেন) বাবা-মা চেষ্টা করতেন তিন জনকে একসঙ্গে বসিয়ে পড়ে শোনাতেন। মা রান্না ঘরের কাজ করতে করতে এসে পড়ে শোনাতেন। আর বাবা বেশিরভাগ সময় পাঠ করে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। বাবা অল্প বয়সে কবিতা লিখতেন। বাবার মনে হয়েছিল কবিতা লেখা আর সংসারের দায়িত্ব একসঙ্গে চালানো যায় না, তাই একটা সময় কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমরা পরে সেই কবিতার খাতা খুঁজে বার করেছি তোরঙ্গের মধ্যে থেকে। পরে বাবা আর কবিতা লেখেননি। তবে বাবা ইয়েটস, শেলী, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ , গোল্ড স্মিথ এঁদের কবিতা যেগুলোর কিছুটা আমাদের পড়ার বইতে ছিল পড়ে শোনাতেন এবং বুঝিয়েও দিতেন। আমার মনে হত কবিতা লেখার সঙ্গে বাবার মনের জগতের সহজ সম্পর্ক ছিল।

    লেখায় মায়ের প্রভাব ছিল খুব বড় অর্থে। মা নিজেই চোদ্দ বছর বয়সে নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সেই বয়সে তার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া কেউই পছন্দ করেননি। বিয়ের পর মায়ের আর স্কুল যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেটা পূরণ করতে মা খুব বই পড়তেন। মা চাইতেন ছেলে-মেয়েরা সাহিত্য পড়ুক এবং সন্তানদের মধ্যে একজন অন্তত লেখক হয়ে বড়ো হোক। এটা খুব আশ্চর্যের যদিও। আমি যখন লিখতাম, ডায়রি ফুরিয়ে গেলে মা ডায়রি আনতে বলতেন বাবাকে। যেহেতু আমি বাড়ি থেকে তেমন বেরোতাম না তাই আমার লেখার সরঞ্জাম এনে দেবার তাগিদ মায়েরই যেন বেশি ছিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারে আমার মায়ের এই চাহিদাটা খুবই অস্বাভাবিক ছিল যদিও এখনকার দিনে এটা কোনো মা চান না। আমরা এমন একটা পৃথিবীতে এসে গেছি যেখানে সম্পদটাই মূল চাহিদা তাই মায়েরা চান সন্তান বড়ো হোক উপার্জন করুক। অথচ আমার মা চাইছেন একজন সন্তান লেখক হোক। এটা শুনলে এখন মনে হয় খুবই আশ্চর্যের। 

বাবা সংসারে মাকে খুব সাহায্য করতেন। বাবা আমাকে ছোটোবেলায় বলেছিলেন খেয়ে দেয়ে উঠে যাবে না মাকে জিজ্ঞেস করবে তাঁর খাবার আছে কিনা। পুরুষ হবেন যেমন আমার বাবা ছিলেন। নরম অথচ তাঁর স্ত্রীকে সম্মান দেবেন ঘরে এবং বাইরে। সেই ব্যাপারটাই বাবার মধ্যে ছিল। আমার কাছে এটাই পুরুষের একটা আদর্শ।  

মৌসুমী : কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছোটোদের জন্য গল্প, প্রবন্ধ — কোনটি লিখতে আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন?

অনিতাদি :  আসলে এটা সময়ের সঙ্গে বদলেছে। আমি যখন লেখালিখি আরম্ভ করি তখন ধারণা ছিল কবি হবো, তাই আমার ডায়রি ভর্তি শুধু কবিতাই লিখেছি। সন্দেশেও কবিতাই লিখে পাঠিয়েছি। আমি তখন পুরোপুরি কবিই। তারপর বিমল কর যখন আমার গল্প পড়লেন এবং আমাকে বললেন গল্প লিখতে, তখন ছোটো গল্প লিখলাম। সন্দেশে অল্প অল্প গদ্য লিখেছি। আমার একটা প্রিয় ভাবনা, একটা ছোটো মেয়ে বাড়ি থেকে কোথাও চলে যাচ্ছে। তাকে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু যাকে গল্প লেখা বলে সেই ভাবনাটা আমাকে প্রথম দিলেন আমার মা। বললেন, শুধু কবিতা লিখলে হবে না গল্প লেখ। তখন লিখলাম ও বিমল করের চিঠি পেলাম। ছোটোগল্প লেখা আমি খুব এনজয় করেছি। পরে উপন্যাসও লিখেছি। আর প্রবন্ধও লিখেছি প্রচুর। এখন মনে হয় আর ছোটোখাটো কিছু লিখতে কেউ যেন আমায় না বলে। ইচ্ছে হয় শুধুই উপন্যাস লিখি। উপন্যাসে খুব বড়ো একটা দিগন্ত আছে, তার একটা বিস্তার, অনেক মানুষ। ‘কথাসাহিত্য’এ বেরোত, ‘আয়নায় মানুষ নাই’। ‘মহানদী’ লেখার সূত্রপাত (২০১০ সাল) হবার পর থেকে বড়ো পরিসরে লেখার ইচ্ছা বেড়েছে। ‘মহানদী’, ‘মহাকান্তার’এর পর নর্মদা বাঁধ আন্দোলনকে নিয়ে একটি বড় উপন্যাস লেখা হবে। তিনটি নিয়ে ট্রিলজি। সরকারের নিজস্ব সিদ্ধান্তে নদীর ওপর এতগুলো বাঁধ হয়। আমার উপন্যাসে নানা মানুষের মুখ ভাঙা গড়া করে নতুন চরিত্র তৈরি হয়। অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার বিস্তার করে তুমি উপন্যাসে তাকে পুনর্নিমাণ করতে পারো। তাই উপন্যাস লেখায় অনেক বিস্তার পাওয়া যায়।   

মৌসুমী : ১৯৬৯ এ ‘সন্দেশ'-এ প্রকাশ আপনার প্রথম কবিতা। ২০২০ তে সোপান থেকে প্রকাশ পায় আপনার বই ‘ছোটোদের গল্পমেলা’। দীর্ঘ এই ৫০ বছরে সে সময়ের শিশু পাঠক মন আর এখনকার জেন z  যুগের শিশু পাঠক মনের বিস্তর পার্থক্য ঘটেছে। শুধু মনের কেন সামাজিক প্রেক্ষাপটেরও। সেসময় আপনার 'রতন মাস্টারের পাঠশালা' গল্পে খুদে রতন গ্রামের সবাইকে স্বাক্ষর করতে চায়, ‘গুলকী’ গল্পে বনদপ্তরের জন্য শুকা আর বুটুর একা হয়ে যাওয়া, ‘ভাসানের পর’ গল্পে আকিম আর বুয়ামের পুজোর সময় একা থাকা। গল্প ছাড়াও একসময় আপনি ছেলে মেয়েদের নতুন নতুন গল্প বলে ঘুম পাড়াতেন বলেছেন। এখনও তো আপনি ছোটোদের গল্প লিখছেন, বাচ্চাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে কীভাবে পরিবর্তিত হতে হয়েছে, কীভাবে পরিবর্তন করতে হচ্ছে চৈতি, কুটুস, আকিম, কাজু, বুয়াম প্রভৃতি চরিত্রদের? 

অনিতাদি : আমি যে এখন খুব বেশি আমার লেখার ধরনকে ছোটোদের জন্য বদলেছি তা নয়। আমার মনের মধ্যে এদের জন্য একটা পৃথিবী আছে। সেটা একটু অন্যরকম। বাচ্চারা এখন ভিডিও গেম খেলে, কম্পিউটার ব্যবহার করে, সিরিজ দেখে। আমি কিন্তু চাই তাদের জন্য অন্য ধরনের পৃথিবী এঁকে রেখে যেতে সেটা যদি তাদের ভাল লাগে তবে ভাল। আমি গোয়েন্দা, গুপ্তধন উদ্ধার, থ্রিলার, ভূত এসব লেখা লিখি না। এগুলোতে আমি স্বচ্ছন্দ নই। আমাদের একটা শাশ্বত পৃথিবী আছে যেখানে আমরা বার বার ফিরে যাই, সেটা আমি বদলাইনি। ‘সন্দেশ’এ নতুন বেরিয়েছিল একটা গল্প, স্থল পদ্মের গাছ। শহরের একটা ছেলে তার ঠাকুমার সঙ্গে স্থল পদ্মের গাছ খুঁজছে। যেটা ঠাকুমা তার বাবার জন্মদিনে লাগিয়েছিল তা নিয়ে গল্পটা লিখেছি। আমি একটা জিনিস রাখতে চাই সেটা হল মানুষের সঙ্গে মানুষের যে টান। এতে যে খুব সচেতন ভাবে জ্ঞান দিই তা কিন্তু নয়। তবে এটা সত্যি খুব আধুনিক শিশুদের জন্য আমি কিন্তু নিজেকে ঠিক বদলাইনি। 

আমি যেখানেই যাই ছোটো পাঠকদের জন্য কিছু মনে করে ছবি স্মৃতি নিয়ে আসি। এই যেমন আকিমের চরিত্রটি একটি দ্বীপে চলে যাচ্ছে। এই দ্বীপ আসলে কোরাপুটের বালিমেলা অঞ্চল। ওড়িশা আর অন্ধ্রের সীমান্তে একটা পরিত্যক্ত অঞ্চল। এখানে জল আসায় এখানকার আদিবাসীরা আটকে গেছিল তবু তারা কোথাও যায়নি। আমি চেয়েছিলাম এই নতুন জায়গাটাকে ভারতবর্ষের মানুষ জানুক। আর একটা ব্যাপার আমি প্রকৃতিকে আমার লেখায় খুব গভীর ভাবে আনি। আমি মনে করি প্রকৃতি আর মানুষকে একসঙ্গে না দেখলে দেখা হয় না। 

অনেকদিন আগে আমি আকিমের চরিত্রটিকে তৈরি করেছিলাম, আশির দশকের শেষ দিকে। আকিম একটি আদিবাসী ছেলে। তার দাদা আচ্ছে, মা আছে। বাবা কাজের খোঁজে বাইরে চলে যান। সন্তানদের মা আগলে রাখেন। এরকম একটি পরিবার নিয়ে লেখা। আমাদের দেশ বিচিত্র, ভিন্নস্বরে মুখর। ছোটোদের কিন্তু এ কথা গোড়া থেকেই বলা দরকার।          

মৌসুমী :  বাংলার গ্রামগুলোর সঙ্গে ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্রের — মহুলডিহা, মুসৌরি, পালামৌ, সারান্ডা ঘাট, মারাঠাওয়ারার গ্রামগুলোর যে পার্থক্য আছে তা আমরা পাঠকরা আপনার লেখা পড়ে জেনেছি। এখন জিজ্ঞাস্য যেটা সেটা হল, আমরা মাঝে মাঝেই বলি গ্রামগুলো আর গ্রাম নেই। গ্রামগুলো ধীরে ধীরে মফফসল হয়ে উঠছে। একই ভাবে, একই গতিতে বাংলার বাইরে ঐ সমস্ত  প্রদেশের গ্রামগুলোর ক্ষেত্রেও রূপান্তর দেখা যাচ্ছে কি?

অনিতাদি :  পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালায় যত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে অন্য রাজ্যের গ্রাম এলাকায় যেমন ওড়িশায় একদমই তা নয়। কেরালায় তো গ্রাম বলে কিছু নেই। তার কারণ অবশ্য ঘনবসতি সমতল এলাকা। বিশেষত পশ্চিম ও উত্তর ওড়িশার গ্রামগুলো এখনো আগের মতোই গ্রাম আছে। হয়তো পাকা বাড়ি হয়েছে। মারাঠাতেও ধুলিধুসর গ্রাম এখনও আছে। জল নেই। স্কুল হয়তো আছে। গ্রামের চরিত্র এখনো বদলায়নি পশ্চিমবঙ্গের মতো। যেখানে যেখানে বদলেছে সেটা আলাদা। আমি যেখানে যেখানে গিয়ে আদিবাসী গ্রাম দেখেছি, তাদের কথা লিখেছি। আদিবাসী সমাজে এখনো সমাজবন্ধন আছে, গোষ্ঠীর অনুশাসন আছে। সেগুলোর কথাই লিখেছি। 

মারাঠাওয়ারার চিত্র অন্যরকম। সেখানে জলহীনতার শরীর। সেখানে মানুষের হাতে টাকা পয়সা এলেও তাদের যেতে হয় আখের মরসুমে আখ কাটতে। বড়ো চাষী হলেও তাদের খেতে জল নেই। টাকা দিলেও জল পায় না। তাই তাদেরও আখ কাটার মরশুমে পশ্চিমে যেতে হয়। একটা গ্রাম থেকে আশি শতাংশ সবল স্ত্রী পুরুষ মানুষ আখ কাটার মরসুমে চলে যায়। তাহলে গ্রাম কী করে ঠিক থাকবে? এটাকে ঠেকানো যে যায় না তা নয়। মহারাষ্ট্রের থেকেও কম বৃষ্টি রাজস্থানে। কিন্তু রাজস্থানে ততটা জলের সংকট নেই কারণ মারাঠাওয়ারায় জলের সংকট জেনেও সেখানে যে চাষে জল বেশি লাগে তার চাষ করা হচ্ছে।  আসলে রাজনৈতিক স্বার্থে জলের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও যে চাষে জল বেশী লাগবে অর্থাৎ আখ তাই চাষ হচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই ট্র্যাজিক! 

আমাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনায় একটা জায়গা কে নিয়ে পঁচিশ, পঞ্চাশ বা একশ বছর ধরে ভাবলে এটা চলতে পারে না। এটা নির্বাচনের চক্র। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের ক্ষেত্রে বাঁধ সমস্যা আলাদা কিন্তু সমাধানের কথা বললে একই দীর্ঘকালীন পরিবেশ পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে সরকারকে। মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেখানে বাঁধের জল যায় সেগুলি সজল এলাকা। তাই সমাধান হলনা। পরিবেশ পরিল্পনায় বৃহত্তর ভাবনা নেই। 
মৌসুমী : ‘যারা ভালোবেসেছিল’ উপন্যাসে সাতটি পরিচ্ছেদে কোনো নামকরণ হয়নি। অথচ শেষের পরিচ্ছেদের নামকরণ করেছেন ‘শেষের আগের কথা’। এ বিষয়ে আলোকপাত করলে পাঠক হিসেবে আমার মন গড়া কারণ গুলো খুঁজে পাবে নির্দিষ্ট দিশা।

অনিতাদি :  উপন্যাসটা যে শেষ হতে চলেছে সেটা পাঠককে আগাম জানাতেই বোধহয় লিখেছিলাম। এটা কলকাতার কাহিনি। কলকাতার একজন মানুষ ভারতের পটভূমিতে নিজেকে আবিষ্কার করল। এটার সমান্তরাল আমার জীবনের কাহিনিও আছে, যদিও এটাকে আমি অটোবায়োগ্রাফিক্যাল বলব তা নয়। কিন্তু কলকাতাকে হারিয়ে দেশকে পাওয়া। তার ভিত্তিতে জীবনকে তৈরি করা এটা এখানে আছে। 

মৌসুমী : মহানদী, দলিত খেতমজুর, ছোটোনাগপুরের মালভূমি, জঙ্গল মহল, পটুয়া পাড়া বা মারাঠাওয়ারা, আখ চাষের জন্য জন মুনিশ খাটা প্রান্তিক নারীরা বারে বারে আপনার লেখার চরিত্র হয়ে উঠেছে প্রতিটা উপন্যাসে। আপনি কলকাতার মতো নগরে বড়ো হয়ে দলিতদের কথা তুলে ধরতে একের পর এক প্রদেশের বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে উপন্যাস লিখছেন। ‘চন্দনরেখা’ য় আপনি বলেছেন, ‘কত তফাৎ পারিজাতের সঙ্গে আমাদের। অর্থে, শিক্ষায়, পদমর্যাদায়।’ আপনি কীভাবে এই তফাৎ অতিক্রম করেছেন?  ভাষাগত সমস্যাকেই বা কীভাবে অতিক্রম করেছেন?

অনিতাদি :  দু’ভাবে উত্তরটা দেব। যদিও আমি কলকাতায় বড়ো হয়েছি তবু আমার নাগরিক স্বভাব কখনই প্রবল ছিল না। তার কারণ আমার খুব অল্প বয়স থেকে এই চেতনা ছিল, এই কলকাতা ছেড়ে আমাকে বেরোতে হবে। কলকাতা আমাকে বেঁধে রাখছে। আমি সীমিত মনে করতাম নিজেকে। অর্থনীতি নিয়ে এম এ পাশ করার পর অধ্যাপনা করার যে সুযোগ এসেছিল তা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল দিনের পর দিন একই ভাবে পড়ানো আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমি তখন পরীক্ষা দিয়ে সিভিল সার্ভিসে গেলাম। এতে নিজেকে প্রসারিত করার সুযোগ পেলাম। আমি চেয়েছিলাম অন্যরকম মানুষ দেখব তাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেব। যে পরিমান চলাচল আমি কাজের বাইরে করেছি সেটা অন্যান্যরা করেননি। এটা আমি চেয়েছিলাম। সাধারণ মানুষের সংসর্গ করলে একটা উত্তাপ পেতাম। একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পেতাম। তারা কাছে চলে আসতো। কলকাতার সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তা আমাকে টানে না। আমি চিরকাল শহরের বহিরাগত ছিলাম। এখনও তাই আছি। 

বৈষম্য চিরকাল আমাকে আঘাত দিয়েছে। অর্থনীতির ছাত্রী হিসেবে আমার মনে হয়েছিল, এই যে উন্নয়নের নানাবিধ পরিকল্পনা, তার ফাঁক গলে কত মানুষ রয়ে যাচ্ছে। তাদের আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। তাদের জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের নির্মুল করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা আমার কাছে বেদনার জায়গা। এদের জন্য আমি কাজ করার চেষ্টা করেছি। তার ফলে আমার কর্ম জীবনে অগ্রজদের কাছ থেকে যথেষ্ট সমালোচিতই হয়েছি। সরকারের যে বড় বড় এচিভমেন্ট সেগুলোর কথা না বলে আমি খালি দুঃখ দুর্দশা দেখতে পাই। আমি এতটা দেখি কেন? যখন লোকেদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছি, তখন অনেকে বলেছেন এতটা করছো কেন। মানুষের প্রতি নিস্পৃহতা আমার স্বভাব নয়। আসলে আমি চেষ্টা করেছি লেখা আর জীবনের মধ্যে মিল রাখতে। আমি একরকম জিনিস লিখব আরেকরকম জীবন যাপন করব, এদুটো আচরণ আমি করিনি।

আমি বলব এটা আমার লেখকজীবনের বড় চ্যালেঞ্জ যে আমি যে বাংলায় লিখি অথচ লেখকজীবনের চল্লিশ বছরের মধ্যে মাত্র পনেরো বছর আমি বাংলা ভাষা বলয়ের মধ্যে ছিলাম। আমি মহারাষ্ট্রীয়কে বিবাহ করি, আমরা বাড়িতেও বাংলা বলি না। তাই বাংলা ভাষাকে আমার লেখার মধ্যে রাখতে আমাকে যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছে । প্রতি মুহূর্তের চেষ্টা । বাংলা খুব জঙ্গম ভাষা। প্রবাসী বাঙালিদের ভাষায় অনেক সময় দেখি একটা ‘ডেটেড’ ব্যাপার। চর্চা রাখতে আমি প্রচন্ড চেষ্টা করেছি। আমি ওড়িয়া শিখেছি, মারাঠী শিখেছি। তবু আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানকার ভাষা ব্যবহার করিনা। কখনো কখনো দু একটা লাইন ব্যবহারকরি ফ্লেভারের জন্য।  আমি যেটার উপর জোর দিই সেটা হচ্ছে তাদের জীবনযাত্রা খাওয়া দাওয়া পোশাক পরিচ্ছদ। ফলে ওখানকার ওড়িয়া ভাষায় চরিত্র কথা বলবে সেটা আমার কাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা আমার নির্মাণ। এমনিতে পটভূমি আলাদা আবার ভাষাও যদি আলাদা হয় সেটা আরো জটিল হয়ে যায়। অথেনটিসিটি আমার লেখার মধ্যে জরুরি বলে আমি মনে করি। পৃথিবীটা বদলেছে। একটা হচ্ছে পরিবেশ সচেতনতা আর একটা হচ্ছে মানুষের অবস্থা সচেতনতা। আমার লেখায় শ্রেণী বা জাতি নাম কাউকে চিহ্নিত করতে ব্যবহার করি না।  সেটা আমাদের অগ্রগতির একটা চিহ্ন।       

মৌসুমী : প্রথম উপন্যাস ‘মহুল ডিহার দিন’ পড়ে অনেক আলোচক বলেছেন, কবিতার মতো অপূর্ব চিত্রকল্প আছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। ‘কাস্তে’ কিন্তু পুরোপুরি প্রতিবেদনের প্রকরণ মেনে আধুনিক সাহিত্য রীতিতে নির্মিত। সেটা কি দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান হেতু, নাকি অসম্ভব বাস্তব বঞ্চনার কর্কশ চিত্র বোঝাতে আপনি সচেতন ভাবেই এই প্রকরণে নির্মাণ করেছেন, চাষীদের লং মার্চ, কন্যা ভ্রূণ হত্যার লিপ্ত বাস্তব চিত্রগুলোকে?

অনিতাদি : ‘মহুল ডিহার দিন’ আমার প্রথম লেখা তো তাই এটা খুব আবেগ পূর্ণ লেখা। মহুল ডিহা একটি কাল্পনিক জায়গা। সে অঞ্চল নিয়ে আমার খুব মায়া ছিল। ব্রাম্ভণী নদী অরণ্য পাহাড়। তাই এটায় আমার খুব রিচ একটা ভাষা এসেছে। তখন আমি ঐরকমই লিখতাম। নিরুদ্দেশ যাত্রা এই সময়ের লেখা। সময়ের সঙ্গে আমার ভাষা সরল হয়েছে। ‘কাস্তে’ উপন্যাসের ভাষা একদম আলাদা। কাস্তের পরিবেশ টা সাংঘাতিক সঙ্কটের তাই এই রকম ভাষা ব্যবহার করেছিলাম। ‘কাস্তে’ লিখতে লিখতে মনে হয়েছে আমার ভাষা কম পড়ে যাচ্ছে, আমি লিখতে পারছি না। এরকম একটা অদ্ভুত অবস্থা হয়েছিল । আসলে এরকম বাস্তব কে কোনো রকম আবেগ দিয়ে লেখা যায় না। সেজন্য অনুবাদও ভাল হয়েছে। সবকিছু রিয়েল টাইমে ঘটছিল। লংমার্চে ঐ মহিলা ইচ্ছে করলে নাও যেতে পারতেন। তিনি তো মারা গেলেন। লংমার্চে যে চাষীরা গেছে, তারা অত হাঁটা তো আগে কখনো হাঁটেনি। ডাক্তাররা রাস্তায় ক্যাম্প করেছিল, সাধারণ মানুষ ওদের জন্য চটি এনেছিল, শহরে মানুষও অনেক করেছে। এগুলো আমি নিজে দেখেছি। কাস্তের মধ্যে বহু ডায়মেনশান আছে। লেখাটা একদিক দিয়ে জটিলও।    

মৌসুমী :  ‘মহানদী’ আখ্যানে আখ্যায়িত হয়েছে নদী সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষজনের যাপন, মিথ, কিংবদন্তী, লোককথা, লোক পুরাণ, মানুষের মুখে মুখে গড়ে ওঠা জনজীবনের ইতিহাস। ‘মহাকান্তার’ আপনার লেখা সম্প্রতি প্রকাশিত আখ্যান। মহানদীর ধারাই কী প্রবাহিত হয়েছে মহাকান্তারে?

অনিতাদি :  না, ‘মহাকান্তার’ লিখব বলে আমি কিছুদিন আগেও ভাবিনি। ‘মহানদী’ লেখার পর মনে হয়েছিল অনেক বড়ো কাজ হয়েছে। এবার বিশ্রাম নেব। এইসময় আমার তরুণ বন্ধু ও প্রকাশক, শুভঙ্কর দে বললেন, আপনি কি ‘মহানদী’র পর আর কিছু লিখবেন না? মহানদী তো ছত্তিশগড় থেকে এসে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেল। তখন মনে পড়ল এই অঞ্চলকে ঘিরে কিছু গল্প লিখেছিলাম, যে গুলো এর পরিপূরক বা উল্টোপিঠ। তখন ছত্তিশগড়-কালাহান্ডির সীমানা, সেখানকার মানুষজনের কথা দন্ডকারণ্য অঞ্চলকে কেন্দ্র করে লেখা কাঁদনা, নবান্ন এবং আরো কিছু ছোটোগল্পের কথা মনে পড়ল। কাঁদনার কথা  মহাকান্তারেও আছে। এই অঞ্চল আমার খুব প্রিয়। তখন আমি একটা পথরেখার কথা ভাবলাম। কালাহান্ডির দক্ষিণ থেকে নিয়ে নিয়মগিরি অঞ্চল থেকে নিয়ে ইন্দ্রাবতী নদীর কথা লিখলাম। যদিও ইন্দ্রাবতী এখানে মহানদী উপন্যাসের মহানদীর মতো অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু ইন্দ্রাবতীর পথরেখাটা একটা দিকচিহ্ন দেয়। অরণ্যের পাশাপাশি নদী বয়ে চলেছে। নদী আবার গেছে ছত্তিশগড়ের মধ্যে দিয়ে। এটাতে যেটার বলা হয়েছে সেটা হল, যে মহা অরণ্যটা আগে ছিল কিন্তু এখন কিছুটা আছে কিছুটা নেই। কিন্তু এখানকার মানুষের যে লড়াইটা তাদের জীবনকে নিয়ে সেটা এখন খুব দুরূহ হয়ে গেছে। এখানে এখন শিল্প এসেছে, শিল্পগোষ্ঠী মানুষের জীবনে নিয়ন্ত্রণ আনতে চায়, বিশেষ করে আদিবাসী গোষ্ঠীর উপরে শিল্পগোষ্ঠী আগ্রাসন কায়েম করতে চেষ্টা করছে।      
‘মহাকান্তার’ পড়লে দেখতে পাবে, এটা খুব দ্রুত চলা বা ফাস্ট লেখা ঘটনা সঙ্কুল উপন্যাস। তার একটা পথ দিয়ে যাচ্ছ সেখানে রক্তারক্তি হানাহানি হচ্ছে, মানুষের জমি লুন্ঠনের চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে মাওবাদী লেনিনবাদীদের ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা চলছে। পুলিশ তাদের এলিমিনেট করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে আঘাত করছে। সমস্ত কিছু মিলিয়ে যাত্রাপথটি ঘটনা বহুল, কারণ বাস্তবই এমন জঙ্গম। 

মৌসুমী :  কমলিকা, রুকমিনী, পারিজাত, দয়া জোশী সবেতেই দুই ‘আমি’ বিদ্যমান। ‘স্বপ্নের আলিঙ্গনে কিছুক্ষণ’ গল্পটিতেও কুশলের বাবা কুশলকে বলছে ‘আমার মধ্যে যে সত্যি সে লেখে’। আপনার পেশাজীবন আর লেখক জীবন — এই দুটিকে আলাদা করা যায় না। তবু আপনার কোন জীবন অন্য জীবনকে বেশি প্রভাবিত করেছে বলে আপনি মনে করেন?

অনিতাদি : আমি মনে করি, আমার মধ্যে অনেকগুলি মানুষ বাস করে একই সঙ্গে, অনেকগুলি সত্তা। অনেকে বলেন, তুমি কেবল লিখলে না কেন? আমার মধ্যে প্রচুর ক্রিয়েটিভ এনার্জি। শুধু লিখলে আমার সেই এনার্জি ক্ষয় হতো না। সাঁইত্রিশ বছর আমি দশ-বারো ঘন্টা কাজ করে গেছি, তারসঙ্গে নিয়মিত লিখেও গেছি। আসলে আমার মধ্যে দুটো মানুষ মেলানো। তারা যদিও কাজে আর লেখায় আলাদা। আমি কখনও আমলাতন্ত্র নিয়ে লিখিনি (যদিও সেই লেখাগুলোকে ছোটো বলছি না), আবার আমি কখনও অফিসে বসেও লিখিনি। আমি বাড়িতে লিখেছি। আমার মধ্যে যে লেখে আর আর যে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে, দুটোর মধ্যে বেণী বন্ধন সর্বদা চলেছে আসলে মানুষটা আমি এক। আমার ব্যক্তিগত সত্তার মধ্যে একটা বহু মাত্রিকতা আছে। এটা অবশ্য অনেকেরই থাকে। যারা ক্রিয়েটিভ এবং একই সঙ্গে কাজকর্মও করেন, তাদের অনেকের মতোই আমার মধ্যেও বহু মাত্রিকতা আছে।  

মৌসুমী :  ‘মহুলডিহার দিন’এ চিরির লৌহ আকরিক জনিত কারণে পানীয় জলের সমস্যা, মারাঠাওয়ারায় আখের চাষের জন্য জলের স্তর নেমে যাওয়া, মহানদীতে পাড় ক্ষয় জনিত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আপনার উপন্যাসের চরিত্ররা লক্ষে পৌঁছাতে চায়। রুকমিণী আর ফাধন আর হাসুকে নিয়ে যারা ভালোবেসেছিল উপন্যাস টিতে জীবনের ইচ্ছাপূরণের চিত্র লক্ষ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে লেখা অকালবোধন উপন্যাসে সত্তরের দশকের কুমোরটুলির পটুয়াদের কথা উঠে এসেছে। সেখানেও বনুর সন্তান অর্থাৎ একটা জীবনকে দু’হাতে তুলে নিলেন অরুণিমা। অন্যদিকে ‘অলীক জীবন’ গল্পের প্রেক্ষাপট জঙ্গল মহল। সেখানে কিন্তু কান্না বা কষ্ট রয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। ‘শত হাজার বছর যুদ্ধের পর দেবী ক্লান্ত’। ‘কাস্তে’তে দয়া জোশীও শেষে ক্লান্ত। তাহলে যে লক্ষে পৌঁছানোর কথা আপনি উপন্যাসগুলোতে বলেছেন তা প্রশাসনের জাঁতাকলে পরলে কি অলীক স্বপ্ন হয়েই রয়ে যায়?

অনিতাদি :  না, ঠিক ঐরকম ধরনের ফিজিক্যাল লক্ষ ব্যাপারটা তা নয়। খেয়াল করে দেখবে, আমার লেখায় খুব ক্লিয়ার থাকে জেন্ডার পারস্পেক্টিভ। একজন নারীর যে অনুভব সেটা খুব প্রবলভাবে থাকে। মহুলডিহারদিনেও যে কমলিকার ব্যর্থতা সেটাও কিন্তু শুধু এই নয় যে সে একজন সরকারি অফিসার, সে কিছু পারল কিছু পারলনা। ব্যাপারটা হচ্ছে সে একজন নারী, সে একজন মা, এবং সে মানুষের জন্যে কাজ করছে। এই দুয়ের মধ্যে পরে তার যে সংকট, তাকে মানুষ বিশ্বাস করছে কি করছে না সেটা সে বুঝতে পারছে না। সে কার জন্য কাজ করছে সেটাও বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছে সে মানুষের সঙ্গে আছে নাকি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনেও আমি দেখেছি, একজন নারীর যে ক্লান্তি, পথচলার, সেটা কিন্তু শেয়ার করার কেউ নেই। আমার ক্ষেত্রেও বিপুল একটা ক্লান্তি মাঝে মাঝে চাপে, সেটা ঘরের দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব, সন্তানের দায়িত্ব, এটা সবকিছু নিয়েই। ফলে মেয়েদের এই ক্লান্তি ভাগ করে নেবার কেউ নেই। এই ক্লান্তিটা কিন্তু এই জন্য নয় যে সে গন্তব্যে পৌঁছতে পারলনা। এটা পথচলার ক্লান্তি, যে পথ আমাদের চলতেই হবে। এর তো কোনো ব্যতিক্রম নেই।  
‘অলীক জীবন’ উপন্যাসটিও দুঃখ দিয়ে শেষ। রাণী মেয়েটির জীবন এর মধ্যে এসেছে, শুভকে সে হয়তো পেতনা, কিন্তু দৃষ্টিহীনতার কারণে শুভকে চিরতরে হারানোর বিষাদ এর মধ্যে রয়ে গেছে। কুমোরটুলির অর্জুনের জাতটা আলাদা বলে পটুয়াদের পাড়ায় পালেদের সঙ্গে থাকতে পারেনি। তাকে কলোনীতে থাকতে হয়েছে। তার লড়াই সেখান থেকেই। তিন নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে তাকে প্রতিমা নিয়ে যেতে হয় বলে সেই মাপের প্রতিমা তাকে করতে হয়। এটা একটা অদ্ভুত লড়াই। জাতিগত ভাবে পাল নয় বলে কুমোরটুলিতে জায়গা না পাওয়া। অকালবোধনও আমার খুব প্রিয় উপন্যাস। খুব দ্রুত এই উপন্যাসের অনুবাদ হয়েছে। এর নাম ‘Awakening’.           

মৌসুমী :  দেশের বিভিন্ন প্রদেশের আদিবাসী গোষ্ঠী জীবনের গুরুত্ব ও প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা - এগুলো আপনার লেখায় ভীষণ ভাবে প্রকট। প্রশাসকের চাকরির জন্য আপনি দেশের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাস করায় এই বিষয়গুলি আপনার লেখায় বাস্তব চিত্রের আকারে প্রকাশ পেয়েছে। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোও কি আপনাকে একই ভাবে ভাবায়? ভবিষ্যতে সেগুলো নিয়ে কি লেখার পরিকল্পনা আছে?

অনিতাদি : পরিকল্পনা যে নেই তা বলব না। আপাতত দেশের বাইরে যা ঘটছে সেগুলো আমি অনুধাবন করি, ফলো করি। আমি যখন বিদেশে যাই বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে দেশ এখন এমন ভাবে ঢুকে গেছে যে তাকে আমি মাথা থেকে বার করতে পারছি না। মাঝে মাঝে ফেসবুকে অনেকের লেখা পড়ি একটা মায়ালোক, একটা জ্যোৎস্না, একটা ঝরাপাতা, একটা নদী, একটা পূর্বজন্মের স্মৃতি, আমি এইধরনের মায়াময় গদ্য লিখতে পারিনা। সকলেই বলে বাঃ,  কি দারুণ মায়াময় লেখা। কিন্তু আমার চোখের সামনে আমার দেশের শরীর দিয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। যদিও আমার মনে হয় এটা আমার পক্ষে ভাল নয়, কারণ সব লেখককেই একটা ফিলজফিক্যাল প্লেন-এ থাকতে হয়। একেবারেই যদি তুমি সব কিছুর মধ্যে জড়িয়ে যাও তাহলে তোমার লেখার অসুবিধা হয়। হয়তো আমি এই অবস্থাটা কাটিয়ে উঠব, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একটা কিছুর মধ্যে জড়িয়ে গেছি। আমার মনের মধ্যে এখন আছে দেশ। আমার সব লেখাই আমি অশ্রু বিসর্জন করতে করতে লিখি। আমার এমন অনেক বন্ধু লেখক আছেন যিনি আমেরিকায় কিছুদিন কাটিয়ে এসে আমেরিকাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু আমি তেমন লেখা লিখতে চাইনি। যেখানে আমি নিজেকে সম্পূর্ণ দিইনি সে লেখাগুলো আমার কাছে ঠিক পূর্ণ লেখা নয়। আমার লেখার মধ্যে আমার পূর্ণ ইনভলমেন্ট থাকে, ফলে স্যাটিসফ্যাকসানও আছে। আপাতত দেশ নিয়ে আমি এখন নিমজ্জিত হয়ে আছি।    

মৌসুমী :  লেখকজীবনের প্রথমদিকে অনেক অগ্রজ পুরুষ লেখকের মুখে আপনি যেমন শুনেছেন ‘মেয়েদের মধ্যে তুমি খুব ভাল লিখছো।’ সমাজে মেয়েদের এই যে এক বিশেষ সম্প্রদায়ে ভাগ করে সরিয়ে রাখা এখন কি সেই অবস্থা থেকে সমাজ একটুও এগিয়েছে?

অনিতাদি :  হ্যাঁ, একটু যে এগোয়নি তা বলব না। অন্তত তরুণদের মধ্যে একটা একসেপ্টেন্সের ব্যাপার এসেছে। আমি কিছুদিন আগে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলাম একটা লৌহ যবনিকা আছে, যার একদিকে মেয়েরা। মেয়েরা যারা ভালো লেখে তারা ভূতের মতো। মানে ভূত মনে করে সে আছে। কিন্তু কেউ তো ভূতকে দেখতে পাচ্ছে না। ভূতের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সকলে বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্যদের কাছে তার অস্বিত্ব নেই। একটা সাইলেন্স কিন্তু কাজ করছে একনলেজমেন্টের ব্যাপারে। কবিদের মধ্যে নেট ওয়ার্কিংটা স্ট্রং। তারা সংখ্যাতেও বেশি। আমি তো চিরকাল একা লিখেছি। আমার যারা অগ্রজ ছিলেন তাদের মধ্যে এই ডিসক্রিমিনেশনের প্রবণতা দেখিনি। আমরা ভাল লিখলেই তাঁরা খুশি। বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, কমল চক্রবর্তী, প্রফুল্ল রায় এঁরা সবাই ছিলেন। প্রতিদিনে আমার অনেক ভাল ভাল লেখা ছেপেছেন। তরুণদের মধ্যেও এখন অনেক ভাল ভাল সম্পাদক আছেন। যেখানে প্রতিষ্ঠানের নিগড় আছে, ইনস্টিটুশান যেখানে আছে সেখানে দেখা যায় মেয়েদের একনলেজ করার ক্ষেত্রে একটা দ্বিধা আছে। তুমি যদি রোমান্টিক গল্প লেখ যতটা একসেপটেন্স পাবে, তুমি যদি মেনস্ট্রিম প্রতিবাদী লেখা লেখ সেটা পাবে না। এগুলো এখন আমি মেনে নিয়েছি। এতদিন লিখেছি এগুলো আর ভাবায় না। কিন্তু নীরবতা এ কটা এখনও আছে সেটা বুঝতে পারি। আমরা তো শুধু মেয়েদের লেখা লিখিনা। তবু মেয়েদের লেখা একসেপটেন্সের জন্যে কিছু কিছু ইনিস্টিটিউশানে একটা বেরিয়ার কাজ করে। তবে সেটা নিয়ে আমাদের ভাবলে চলবে না। লিখে যেতে হবে।   

মৌসুমী :  কোন কোন লেখকের বই আপনাকে লিখতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?

অনিতাদি : রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ, সতীনাথ ভাদুড়ি, মহাশ্বেতা দেবী, প্রফুল্ল রায়, বিমল করের ছোটোগল্প, রমাপদ চৌধুরীর কাছে শিখতে হয় সংযম।

মৌসুমী : সমসাময়িক কোন কোন লেখকের লেখা আপনার প্রিয়?

অনিতাদি :  তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, নলিনী বেরা, জয়া মিত্র। আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সিরিয়াস এবং ট্যালেন্টেড লেখক তৃপ্তি সান্ত্রা, যশোধরা রায়চৌধুরী, সেবন্তী ঘোষ, তৃষ্ণা বসাক, অহনা বিশ্বাস, এঁরা কবিতা গদ্য প্রবন্ধ সব লিখছেন দু’হাতে। এঁদের সঙ্গে লেখা আদান প্রদান আমাকে লকডাউনে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি সবসময় বলি, লেখাটা কোনো একক কাজ নয়, সম্মিলিত কাজ। সম্মেলক গানের মতো। এক কোণা থেকে একজনের ধ্বনি ভেসে এল, অন্য কোণা থেকে পিয়ানোর সুর ভেসে এল, আর এক কোণা থেকে বেহালার স্বর ভেসে এল। সব মিলিয়ে যে ধ্বনি তরঙ্গ হল সেটাই সিম্ফনি। লেখার মধ্যেও এই সম্মেলক বিষয়টা থাকা উচিৎ।

মৌসুমী :  নতুন লেখিকাদের জন্য আপনার পরামর্শ।

অনিতাদি : পরামর্শ দেব না, মতামত দিচ্ছি। লেখিকারা অনেকেই খুব ভাল লেখেন। আমার মত হল, লেখাটা শেষ পর্যন্ত একটা শিল্প। তার কন্টেন্ট যাই হোক না কেন। কাজেই বাংলা ভাষাটা বা বাক্য বন্ধের নির্মাণ এগুলো ভালো করে জানতে হবে। ভাষার মধ্যে বাঁধুনি নেই, বাক্য অসম্পূর্ণ বানান ভুল, এসব আমার পছন্দ নয়। ক্রাফটিং টা শেখা খুব জরুরী। আমরা ভালো ইংরাজি সাহিত্য যখন পড়ি বাংলার সঙ্গে তার যে তফাৎটা সেটা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাষা ভালো জানার ব্যাপারটা রয়েই যাচ্ছে। সেটা তরুণদের শিখতে হবে। যারা এটাকে জরুরি মনে করেন না আমি তাদের কথা বলছি। 

দ্বিতীয় হচ্ছে ভালো লেখা পড়তে হবে। অতীত থেকে আরম্ভ করে এখন পর্যন্ত কবিতা গদ্য সবকিছু। আর তৃতীয় কথাটা হচ্ছে লেখালেখির মধ্যে বড়ো কিছু পাবার আশা না রেখে একটা নির্জন পথে চলেছি সেটা ধরে নেওয়াই ভাল। কখনও হয়তো কোনো ভালো পাঠকের সঙ্গে দেখা হল, একটা মানপত্র পাওয়া গেল বা একটা পুরস্কার। সেটাতে খুব ভাল লাগে তবে লেখার মধ্যে প্রাপ্তির অশান্তিটা রাখলে ভাল লেখা হয় না। লেখার জগতে প্রত্যেকেই একা। কিন্তু এটা মেনে নিতে হবে। লেখার ক্ষমতাটা ধরে রাখাই খুব শক্ত। সেটা আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি। 

লেখার থেকে বিচ্ছিন্ন না হবার যতরকম চেষ্টা আমি করেছি সেটা শেষ পর্যন্ত আমার নিজের যে শ্রম ছিল বা আত্ম নিবেদন ছিল তার জন্য সফল হয়েছে। আমার সঙ্গে লেখালেখি আরম্ভ করেছিলেন অনেকেই তারা এই বাংলায় থেকেও নিয়মিত লিখতে পারছেন না বা ভাল লিখতে পারছেন না। আমাদের যারা অগ্রজ লেখক তারা অসামান্য লেখা লিখে গেছেন, প্রাপ্তির কোনো আশা করেন নি। এবং কোনো লেখা-প্রকাশের রাজনীতিতে জড়াননি। সেই জন্যই তাদের লেখা আমরা এখনও পড়তে পারি। এই কথাটাও মনে রাখা দরকার।

পরিশেষে, জ্বলদর্চির সম্পাদক মন্ডলী ও পাঠকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য। আর তুমি, মৌসুমী নিজে একজন সুলেখিকা। এত সময় ও যত্ন নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছ, আন্তরিক ভাবে। তোমাকেও ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। পুজোর জন্য সবাইকে শুভকামনা জানাই। সবাই ভালো থাকুন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

5 Comments

  1. পড়লাম মূল্যবান এই সাক্ষাৎকারটা। লেখিকা সম্পর্কে বা তাঁর লেখার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। খুব ভাল লাগল। কবি ও কথাসাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী ও তোমাকে যুগপৎ শুভেচ্ছা জানাই। মৌসুমী তুমি অনেক এগিয়ে চল। আবার শুভেচ্ছা ও ভালবাসা জানাই তোমায়।

    ReplyDelete
  2. এমন সাক্ষাৎকার পড়লে মনের অনেকগুলো জানলা একসঙ্গে খুলে যায়। বিশেষত, কয়েকটি কথা একেবারে মন্ত্রের মতো। নির্জন পথে চলাই লেখক জীবনে মূখ্য। সাধারণ লেখার মধ্যেও আমাদের সমাজ ও দেশ সম্পর্কিত ভাবনা, রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষের অশেষ যন্ত্রণার মধ্যে যাপন, এগুলো ধরে রাখা, এখনকার লেখকদেরও লক্ষ হওয়া দরকার। সমৃদ্ধ হলাম। লেখিকার নিজের অসাধারণ মেধা ও মননের ক্ষমতা, জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া পর্যটন তাঁকে অন্য এক সূত্রে উন্নীত করেছে। শুধু লিখতে হবে বলেই লেখা, এ ওঁর লক্ষ নয়। 🙏

    ReplyDelete
  3. এমন সাক্ষাৎকার পড়লে মনের অনেকগুলো জানলা একসঙ্গে খুলে যায়। বিশেষত, কয়েকটি কথা একেবারে মন্ত্রের মতো। নির্জন পথে চলাই লেখক জীবনে মূখ্য। সাধারণ লেখার মধ্যেও আমাদের সমাজ ও দেশ সম্পর্কিত ভাবনা, রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষের অশেষ যন্ত্রণার মধ্যে যাপন, এগুলো ধরে রাখা, এখনকার লেখকদেরও লক্ষ হওয়া দরকার। সমৃদ্ধ হলাম। লেখিকার নিজের অসাধারণ মেধা ও মননের ক্ষমতা, জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া পর্যটন তাঁকে অন্য এক সূত্রে উন্নীত করেছে। শুধু লিখতে হবে বলেই লেখা, এ ওঁর লক্ষ নয়। 🙏

    ReplyDelete
  4. খুব খুব ভাল লাগল। আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে ওঁর থেকে। যে সকল প্রশ্ন উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে সেগুলোও খুব সুন্দর।

    ReplyDelete
  5. ভাল লাগল। অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete