জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৯/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৯

শ্যামল জানা


সাররিয়েলিজম্, থিম প্রদর্শনী ও অভিনব ক্যাটালগ

 আগের পর্বে ‘BOITE ALERTE’-এর প্রদর্শনীর অভিনবত্ব ও বিশেষত্ব নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল, তার পরেও আরও কিছু কথা থেকে যায়৷ এই যে প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হল, তা অনেকগুলি উদ্দেশ্যর মধ্যে একটি মূল উদ্দেশ্য হল— সাররিয়েলিস্টরা বলল আমাদের এই প্রদর্শনীটি পাপের বিবৃতি হিসেবে দেখাতে চাইছি৷ এই যে বর্তমান রাজনীতি, সমাজ ও নীতির যে ক্রমাঙ্ক, তার বিরুদ্ধে আমরা একত্রিত হয়েছি৷ আমাদের কোনো প্রদর্শনীই গতানুগতিক বা সাদামাটা হবে না! আমাদের প্রতিটি প্রদর্শনীরই, যতগুলি দৃষ্টিকোণ বা দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা চেষ্টা করবো জোরালো ধাক্কা(Shock) দিতে, উত্তেজনা সৃষ্টি করতে(Provoke)৷ “বইতে এলের্তে”(Boîte Alerte) ক্যটালগটি যেহেতু অভিনব, একেবারে লেটারবক্সের মতো, তাই, তাঁরা তার ভেতরে রাখা বিষয়গুলির(Content) নিয়মিত পরিবর্তন করে একাধিক সংস্করণ করতে পারতেন৷ পাল্টে পাল্টে যাওয়া বিষয়গুলিকে তাঁরা ‘Paperback exhibition catalogue’ হিসেবে প্রস্তুত করতেন৷ যার মধ্যে নিয়মিত লেখা থাকত— আন্দ্রে ব্রেতোঁ, হান্স বেলমের, ম্যান রে, জাঁ আর্প, লেওনোরা ক্যারিংটন, বেঞ্জামিন পেরেত এবং জাঁ-জ্যাকুয়েস লেবেল প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ সাররিয়েলিস্ট শিল্পীদের৷

  আরও অভিনবত্ব হল— ওই Boîte Alerte-তে তাঁরা রাখলেন  ‘Lexique succinct de l’érotisme’.৷ এই ফরাসি কথাটিকে বাংলা করলে দাঁড়ায়— “কাম সংক্রান্ত(Eroticism) সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ”৷ এই শব্দকোষ-এর বৈশিষ্ট হল— যেহেতু এগুলি কাম বা যৌন সংক্রান্ত, তাই, সংজ্ঞার মধ্যে সরাসরি কোনো কথা তাঁরা ব্যবহার করলেন না, যাতে অশ্লীল মনে না হয়৷ তাঁরা সাংকেতিক ধারণার সাহায্যে বিষয়গুলিকে উপস্থাপন করলেন৷ অনেকের অবদান ছিল এই অভিনব শব্দকোষ-এ৷ যেমন মিমি প্যারেন্ট যাঁর কথা আগেই উল্লেখিত৷ অভিনবত্বটা কোথায়, তা বোঝাবার জন্য এই শব্দকোষ-এর ভেতরে থাকা তাঁর দুটি সংজ্ঞা আমরা এখানে উল্লেখ করছি৷ এক. দুশ্চরিত্র(Depraved) মানুষ৷ তাঁর করা সংজ্ঞাটি হল— ‘Depraved person : one who descends the ascending staircase of pleasures’.৷ সহজ বাংলায় যাকে আমরা বলতে পারি— সুখানুভূতির যে সিঁড়ি উর্দ্ধমুখী, তার সাহায্যে যারা নিচের দিকে নামছে৷

দুই. যে মানুষ অপরের যৌনক্রিয়া বা যৌনাঙ্গ দেখে যৌনতৃপ্তি পায়(Voyeur)৷ তাঁর করা সংজ্ঞাটি হল— ‘Voyeur : one who, from his own point of view, shares the life of others’.৷ যে মানুষ অন্যের জীবন(এখানে গোপন জীবন) নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে নিজের সঙ্গে ভাগ করে নেয়৷ ঠিক এরকমভাবে ক্যাটালগ-এ রাখা হয়েছিল যে সব গবেষণামূলক লেখা, বিষয়, ছবি ইত্যাদি সব কিছুর ভেতরেই সরাসরি না বলে ওই সাংকেতিক ধারণার প্রয়োগ করা হয়েছিল৷ কোনো কোনো সময় আবার সংকেত ব্যবহার না করে, রসালো ও খুব হাল্কা পর্ণোগ্রফি প্রয়োগ করা হত৷ এইভাবেই নিয়মিত ক্যাটালগ-এর লেখা ও ছবিগুলির মধ্যে মাপা উত্তেজক মশলা রাখা হত, যা কিনা শুধুমাত্র সাররিয়েলিস্টদের একেবারে নিজস্ব প্রতীকস্বরূপ! কারণ— সারেরিয়েলিজম-এর জন্ম হয় ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন থেকে৷ এই স্বপ্ন তৈরি হয় চেতন অবস্থার অবদমিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ অবচেতন অবস্থায় ঘটে বলে৷ আর এই অবদমিত আকাঙ্ক্ষার বেশিরভাগটাই হয় যৌনাকাঙ্ক্ষা৷

এ প্রসঙ্গে আরও দু-একটি অভিনব ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য৷ আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ক্যাটালগ “বইতে এলের্তে” বা অ্যালার্টবক্সটির তলায় Missives Lascives’(কামোদ্দীপক চিঠি) লেখাটির কথ(ছবি-১)৷ 

এই কামোদ্দীপক বিষয়টি যাতে অশ্লীল না হয়, অথচ এর অপরিসীম গুরুত্ব বোঝানোর প্রয়োজনেই এই সব অভিনবত্বের ভাবনা বা প্রয়োগ! বিশিষ্টদেরও বিশিষ্ট যাঁরা, তাঁদের দেওয়ার জন্য মাত্র নটা ক্যাটালগ-এ দুশ্যাঁ একজোড়া করে ধোপানীর অ্যাপ্রণ রেখেছিলেন, যা স্পষ্টতই যৌন-ইঙ্গিতবাহী৷ অ্যাপ্রণদুটি এমন ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছিল যে, দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে— একটি অ্যাপ্রণ নারীর ও একটি অ্যাপ্রণ পুরুষের লিঙ্গচিহ্ন বহন করছে(ছবি-২), যা আঠারো শতকের যৌন উত্তেজক টাকা রাখার ব্যাগ(Erotic purses)-কে ভিত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছিল৷

এই দুটো অ্যাপ্রণকে প্যাকেটের বদলে রঙিন দুটো ডোরাকাটা পশমের তৈরি ওভেন-গ্লাভস(Tartan oven-gloves)-এর ভেতরে রাখা হয়েছিল৷ এবং এই দুটি গ্লাভসও ছিল অভিনব, যা মার্শেল দুশ্যাঁ কিনেছিলেন নিউ ইয়র্ক-এর “নভেলটি শপ” থেকে৷ এই গ্লাভস-এর বিশেষত্ব হল— ধরা যাক্ দুটো পা সমেত মুণ্ডুহীন একজন মানুষের ধড়, এরকম দুটো যদি পাশাপাশি থাকে, তাহলে মোট চারটে পা হয়৷ যে চারটে পা(বুড়ো আঙুলকে বাদ দিয়ে) হয়ে গেছে ওভেন-গ্লাভস-এর চারটে আঙুল৷ এবং দুটো ধড় মিলে হয়ে গেছে হাতের চেটো ঢাকার অংশটা৷ আর এই, দুটো পা ও একটা ধড় হল একজন নারীর, ও বাকি দুটো পা ও একটা ধড় হল একজন পুরুষের, যাদের পাশাপাশি যুক্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে ওভেন গ্লাভস-এর মাধ্যমে(ছবি-৩)৷

“বইতে এলের্তে”-তে আরও একটা যৌনোদ্দীপক(Missives) জিনিস ছিল৷ সেটি হল— একটি দীর্ঘ কালো রঙের মোজা৷ যা সাধারণত তৎকালীন মহিলারা পরতেন৷ আর এই ধরনের মোজা এতটাই দীর্ঘ হত যে, তা পরলে উরুর ওপরে প্রায় উরুসন্ধি পর্যন্ত চলে যেত, এবং তার Pin-ups স্বাভাবিক কারণেই যৌনোদ্দীপক হত৷ এই মোজাতে কোনো সই করা ছিল না, ফলে বোঝা যায়নি এটি কার সংযোজন৷ কিন্তু একদম ওপরে ‘HAUT’ (high) কথাটি প্রিন্ট করা ছিল(ছবি-৪)৷ 

আর ছিল একটি শব্দ— ‘bas’৷ ভাষাতত্বের বিপরীতে গিয়ে নিছক শব্দের খেলা হিসেবে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল৷ কারণ ‘bas’-এর মানে ফরাসি ভাষায় ‘নিম্নদেশ’ও বোঝায়, আবার ‘মোজা’ও বোঝায়! রবার্ট বেনাউন এই কটাক্ষের স্পিরিটটা যেন যোগসূত্র হিসেবে বজায় রাখলেন একটি অভিনব প্যামপ্লেট-এর সাহায্যে৷ যেটি ছিল অত্যন্ত উঁচু দরের সাংকেতিক ফোটোগ্রাফিক মিরর-ইমেজ-এর সাহায্যে তৈরি৷

এছাড়া আর বাকি যা কিছু ‘বইতে এলের্তে’-তে missives lascives হিসেবে ছিল, সেগুলো ছিল মূলত লিখিত বিষয়(Written text)৷                    (ক্রমশ)

 আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments