জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-১১/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার 

শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল



পর্ব :১১ 

থানার গরাদের ভেতর লোকটা গোঙাচ্ছে। একটা চেনা চেহারা হঠাৎ করে কেমন অচেনা ঠেকছে আমার। পুলিশের লাঠির ঘা খেয়েও লোকটার ভেতরে কোনও পরিবর্তন নেই। একটা তথ্যও বের করা যাচ্ছে না। 

সকালে লোকটাকে নিয়ে পুলিশ আবার এল শান্তি আশ্রমে। ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য। এক ভ্যান পুলিশ দেখেই আশেপাশের লোকজন ছুটে এল। অপরাধীকে দেখে লোকজনের মধ্যে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল। সত্যিই তো ! যে মানুষটা এই আশ্রমের জন্মলগ্ন থেকে আছে তাকেই কি না সন্দেহ করে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ! সে কি সত্যিই অপরাধী! বিশ্বাস হয় না কারোরই। 

পিন্টু দেখাচ্ছে আশ্রমের অন্দরমহল। আশপাশ। আর সবচেয়ে অবাক করার মতো, আশ্রমের ভেতরের সুড়ঙ্গপথ।গোপনঘর। যেটা ঠিক পাতালঘরের মতো। 

পুলিশের সঙ্গে ঢুকেছি আমিও। ভালো করে দেখছি গোপন ঘরটা। থরে থরে সাজানো আছে সোনার অলংকার। সোনার বাট। দামি দামি আসবাব। এমনকি চোখ ধাঁধানো হিরে। অনেক পরিমাণে। একটা বড় সিন্ধুক। না জানি তার ভেতরে কত জহরত রাখা আছে! 

পিন্টু যত দেখাচ্ছে, ওকে জেরা করে তার বেশি তথ্য বের করে নিচ্ছে পুলিশ। কাল রাত্রে থানায় হয়তো যথেষ্ট প্রহার পেয়েছে পিন্টু। আর কথা চেপে রাখার মতো সাহস ও পাচ্ছে না।
'কে কে রেখেছে এইসব? কোথা থেকে আসে? কোথায় যায়?' অত্যন্ত রূঢ় শোনায় ইনস্পেক্টরের গলা।
'জানি না স্যার!'
'মেরে এখানেই শেষ করে দেব। এই সুড়ঙ্গেই। পুঁতে দেব এখানে। সমাধি হবে তোর! বল !'
'সব ওই চরণ ডাকাতের কাজ। এর বেশি কিছু জানি না আমি।' পিন্টুর গলা কাঁপছে। একটা সপাটে লাঠির ঘা পড়ল। পিন্টু চমকে গিয়ে বলল, 'বলছি। বলছি স্যার। আমাকে চরণ ডাকাত বলত এখানেই সব লুকিয়ে রাখতে। ও ওর দলবল নিয়ে দূর দূরান্ত থেকে , গৃহস্থ বাড়ি, দোকান বাড়ি, সোনা জহুরীর দোকান,  এমন কি বিহার বর্ডারের দিক থেকে চুরি করে সোনাদানা, হিরে এবং বিভিন্ন মূল্যবান মালপত্র নিয়ে এসে এখানে জমাত। চোরাই মালও কিনত। কম দামে। আমার সাহায্যে নিরাপদে এই আশ্রমেই রাখত সেইসব বহুমূল্য জিনিস, যাতে কেউ কোনোদিন জানতেও না পারে। তারপর আমি আমার যোগাযোগের মাধ্যমে অন্য রাজ্যে, ভিনদেশে পাঠিয়ে দিতাম। টাকা পয়সার লেনদেন করতাম। তার বদলে আমাকে কিছু অংশ দিত চরণ ডাকাত। কমিশন হিসেবে।
'তুই একা চরণ ডাকাতকে সাহায্য করতিস, নাকি সাধুবাবা, সন্ন্যাসিনী সবাই এতে জড়িত?'
'আমি জানি না স্যার।'
লাঠির গায়ে 'ও মা গো' করে চিৎকার করল পিন্টু।
'থার্ড ডিগ্রী বুঝিস তো ! নাকি দেখবি একবার! বল তোদের ধান্দা কীভাবে চলত। চরণ ডাকাতের সঙ্গে আর কে কে আছে? কোথায় আছে ওরা সব? তোর সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হল?'
আমি জানি না স্যার ওরা কোথায় থাকে। যখন প্রথম প্রথম এই আশ্রম তৈরি হয়, তখনই চরণ এসেছিল। মাঝে মাঝেই আসত। এভাবেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ওর কথা মতোই এই সব সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়। এর খরচ ও নিজেই দিত, আবার বাইরে থেকেও আসত। আশ্রমের সঙ্গে ওর গোপন চুক্তি ছিল। আমি এপাশ থেকে অন্যপাশে তথ্য, টাকা, মাল চালান করতাম। তার বেশি কিছু আমি জানি না স্যার।' হা হা করে হাসেন পুলিশ অফিসার। 'কী করতে বাকি রেখেছিস তুই? তুই তো চরণের ডান হাত। চল এবার সারাজীবন জেলে পচে মর! চরণ কোথায় থাকে? বল!' পিন্টু বলে, 'আমি কোনোদিন চরণ ডাকাতের ডেরায় যাইনি। তবে ওরা এই পাহাড়ের ওপারেই কোথাও থাকে। আশ্রমের উল্টো পাশে।' 

ভালো করে সুড়ঙ্গের ভেতর বাহির দেখল পুলিশ। সুড়ঙ্গের একটা মুখ ঠিক কালী মূর্তির পেছনে। একটা মুখ সন্ন্যাসিনীর শোবার ঘরে। আর একটা মুখ পাহাড়ের গায়ে। দূরে। করে কবেই এই আশ্চর্য সুড়ঙ্গ বানানো হয়েছে, কেউ টেরই পায়নি! 

পুলিশের এখন পাখির চোখ হল চরণ ডাকাত। একমাত্র ওকে ধরতে পারলেই বিদেশ অব্দি চেইনটাকে ধরা সম্ভব। পিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে যখন পাহাড়ের অন্যপাশে গিয়ে পৌঁছাল পুলিশের দল ততক্ষণে চরণ ডাকাতের দল হাওয়া। ওপাশে অনেক খুঁজে খুঁজে একটা গুহা মতো পাওয়া গেল। বোঝা গেল ওটাই চরণের ডেরা। গত রাত্রেও ও ছিল এখানে। গুহার ভেতরের অগোছালো বিন্যাস দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে পাওয়া যাবে চরণকে। ওকে যে ধরতেই হবে। তদন্তের স্বার্থে। পুলিশের মনে প্রশ্ন আসে স্বামী স্বরূপনন্দকে বা অঞ্জলীকে তীর বিদ্ধ করেছিল চরণের সাঙ্গপাঙ্গরা। কিন্তু কেন! 
পিন্টুকে আবার জেরা করে পুলিশ। 'সাধুবাবাকে, সন্ন্যাসিনীকে একইভাবে তীর দিয়ে কে মেরেছে? তুই নিশ্চয়ই জানিস! বল।'
'জানি না স্যার। জানতে পারলে, আমি কিছুতেই হতে দিতাম না। তবে পরে শুনেছি, সব চরণ ডাকাতই করিয়েছে। ওর ট্রেইন্ড তীরন্দাজকে দিয়ে।' 

আরও কয়েকদিন গেল। বাড়তি চারদিনের পুলিশী হেফাজতের আবেদনে করেছিল পুলিশ। জেলা কোর্ট সায় দিয়েছে। পিন্টু এখন থানার লকআপেই। রাজ্য এবং জেলা সীমান্তের সমস্ত রাস্তায় এখন পুলিশ সতর্ক। জেলা পুলিশ থেকে বিশেষ দল গঠন করে চরণ ডাকাতকে ধরার গোপন কৌশল সাজানো হচ্ছে। 

খুব বেশি বেগ পেতে হল না । বিহারের বর্ডার থেকে বিহার পুলিশের বিশেষ সহায়তায় ধরা পড়ল চরণ ডাকাত।কয়েকদিনের মধ্যেই। ওর সঙ্গে আরও সাতজন। ট্রানজিট রিমান্ডে সবাইকে নিয়ে আসা হল সদর থানায়। খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপানো হল কুখ্যাত চরণ ডাকাতের নাম। ছবি। সঙ্গে গর্ব ভরা পুলিশের ছবি এবং দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী।


#
খরস্রোতা নদীর প্রবাহের মতো পেরিয়ে যায় সময়।
আমাদের প্রিয় আশ্রম, আমাদের অতিচেনা আশ্রম, তার চারপাশে ঘিরে থাকা তপোবন দেখে এখন মায়া লাগে আমাদের। আশ্রমকে কেন্দ্র করে আমাদের ভালোলাগা, ভালো থাকা আবর্তিত হয়েছে এতদিন, আশ্রমের আলো আলোকিত করেছে আমাদের কুসুমপুর, চন্দ্রপুর অঞ্চলের আকাশ, বাতাস, মানুষজনকে। অথচ সেই প্রদীপের নীচেই কী অদ্ভুতভাবে বিরাজ করেছে ছায়া ছায়া অন্ধকার!
আমাদের কৈশোরের কলরব ছড়িয়ে রেখেছি আশ্রমের গাছে, প্রশাখায়, ঘাসে, ফুলে, ফলে। আমাদের বেড়ে ওঠায়, আমাদের এলাকার উন্নয়নে অনিবার্য ভাবে থেকেছে আশ্রমের আশীর্বাদ। এই অহংকারের অন্তরালে আজ অনুভব করছি এক অদ্ভূত কষ্ট। সবকিছুই তছনছ গেল! 

আমি ইচ্ছে করেই ভোর বেলা আজ এসেছি এই আশ্রমে। ভাবছি, সব ঠিকঠাক থাকলে যজ্ঞানুষ্ঠান হত আবার। কত লোকজন আসত, আনন্দের মেলা বসত, সংস্কৃত মন্ত্রের উচ্চারণে আবিষ্ট হত চারপাশ। সেই আবেশটুকু পাওয়ার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে অন্য আবহ। চারপাশে অথৈ এক নিস্তব্ধতা। শুধু অনাদরে ফুটে থাকা রাতের ফুল থেকে সুগন্ধ আসছে।  আশ্রমের মূল ফটক বন্ধ। মা কালীর মন্দির বন্ধ। লাইব্রেরিও। আমাদের মনে রেখে দেওয়া, আশ্রমের ভালো ভালো স্মৃতিগুলো ঢাকা পড়তে শুরু করেছে সমকালের নিঃস্বতায়। নাহ্। এই আশ্রমে আর থাকা যায় না। থাকতে পারছি না! 


হেঁটে হেঁটে নদীর দিকে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার প্রিয় কাঁসাই। আমার প্রিয় বট গাছ। একমাত্র ওই জানে আমার জীবনের গোপন গল্প। সেখানে গেলেই হয়তো শান্তি আসবে। 

সূর্যের আলো মেখে, নদীর পাড় বরাবর আমি হাঁটতে থাকি। এগোতে থাকি সম্মুখে। 
পেছনে থেকে যায় আমাদের প্রিয়, সবার প্রিয় শান্তি আশ্রম। আর তাকে ঘিরে থাকে, ঘিরে রাখে, মন কেমন করা ছায়া ছায়া অন্ধকার।


(সমাপ্ত)

Post a Comment

0 Comments