জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-২/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার
শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল


পর্ব ২. 

পাহাড়ের কোলে সুন্দর একটা আশ্রম। আশ্রমের নাম 'শান্তি আশ্রম'। মহাভারতে পড়া ঠিক তপোবনের মতো। শান্তি আশ্রমকে ঘিরে আছে ঘনপ্রায় জঙ্গল। ছোটনাগপুরের মালভূমি এলাকার প্রান্তিক ঢাল বরাবর এই জনপদ এবং জঙ্গল। ১৯৫৬ সালে বিহার এবং বঙ্গের মধ্যে জেলা ভাগের পর এই অংশ এখন পশ্চিম বাংলার। তরঙ্গায়িত, অসমান উচ্চতার দুটো পাহাড় এমন ভাবে বিস্তৃত, ঠিক যেন সারিবদ্ধ পর্বতমালা। আসলে তা নয়। দুটো পাহাড়ই একটা ঢালু জায়গায় এসে মিশেছে। আর ঠিক এই মিলনস্থলের সমতলপ্রায় জায়গায় গড়ে উঠেছে আশ্রমখানি। আশ্রমের অনতিদূরে এক্কেবারে লাগোয়া গ্রাম কুসুমপুর। আমাদের গ্রাম। এছাড়াও চন্দ্রপুর, শ্যামপুর, মুকুন্দনগর এইসব গ্রাম ঘিরে আছে আশ্রমকে। পাহাড়ের গা বরাবর মাইল তিনেক হেঁটে গেলে আনন্দপুর গ্রাম। শান্তি আশ্রমের একটা শাখা আশ্রম আছে ওখানে। সেটার আলাদা নামও আছে। 'আনন্দমেলা'। 

এই সবকিছুই কিন্তু একদিনে হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। আমি আমার জ্ঞান হওয়ার পর অবশ্য শান্তি আশ্রম আর আনন্দমেলাকে পূর্ণরূপে দেখে আসছি। এই আশ্রমের উৎপত্তি আমার কাছে গল্পের মতোই। বাবার কাছে শুনেছি। অনেক গল্পকথা এখনও আকাশে হাওয়ায় ভাসে। জাদুমন্ত্রের মতো নাকি এক সময় এক সন্ন্যাসী এসে এই সব গড়ে তুলেছেন। কোনও এক সকালে এই জঙ্গল, জনপদের মানুষ দেখতে পায় এক যুব সন্ন্যাসী, এক সন্ন্যাসিনী আর তাদের ছায়াসঙ্গীর মতো এক ভক্ত হঠাৎ এসে পর্ণকুটির নির্মাণ করে থাকতে শুরু করেন। পূজার্চনা করেন নিয়মিত। মানুষের সঙ্গে তাঁরা  মিশে যান। মানুষের প্রয়োজনে, তাদের দুঃখে সুখে, সাথী হন। আস্তে আস্তে সবার নয়নের মণি হয়ে ওঠেন এই সন্ন্যাসী। তাঁর আসল নাম কী ছিল কেউ জানতে পারেনি। সন্ন্যাসী নাম গ্রহণ করেন স্বামী স্বরূপানন্দ। অনেকেই তাঁকে সাধুবাবা বলেও ডাকে। সন্ন্যাসিনীর নাম রুপসী দেবী। তাদের একনিষ্ঠ ভক্ত, সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী লোকটিকে সবাই পিন্টু নামে ডাকতে শুরু করল। আশ্রমের পর্ণকুটির আস্তে আস্তে প্রাসাদে রূপান্তরিত হল। এক অপূর্ব স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের মিশেলে স্থাপিত প্রাসাদোপম এই আশ্রম আস্তে আস্তে দর্শন এবং তীর্থের স্থান হয়ে উঠল। দূর দূরান্ত থেকে অনেক অনেক লোকজনের যাতায়াত চলতেই থাকে বছরভর। এখনও তেমনই চলছে। 

পাহাড়ের ঢাল বরাবর চেনা অচেনা গাছ গাছালির জঙ্গল।সেখান থেকেই জ্বালানির কাঠ, ঘরবাড়ির আসবাব সব নিয়ে যায় গ্রামের মানুষেরা। পাহাড় দুটির মিলন স্থানটি কিছুটা সমতল। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার জল দিয়ে পাশাপাশি গ্রামগুলোতে পানীয় জলের সংস্থান হয়। মরসুমি অনেক ফসলও হয়। এমনিতেই এই অঞ্চলের মাটি অনুর্বর।বর্ষার জলে একবারই ধান ফলে। বাকি যেটুকু সবজি, রবিশস্য, বোরোধান ইত্যাদি হয় তা সবই এই ঝর্ণার জলে।সারাবছরই জল থাকে এই ঝর্ণায়। তাই সবাই এর নাম রেখেছে 'লক্ষ্মী ঝর্ণা'। লক্ষ্মীর মতোই যার সম্ভার অফুরন্ত। 

সমাগত বসন্তে এক অপার মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে।আশ্রমে যে আসে তারই মন ভালো হয়ে যায়। আমারও হয়।আজ খুব ভোরেই এসেছি। এসেই দেখি যজ্ঞের আয়োজন চলছে। ত্যাগের মতো গৈরিক রং নিয়ে সূর্যের আলো চারপাশে আছড়ে পড়ছে। কোকিল ডাকছে। মিহি সুরে। কু হু।কু হু। আশ্রমের চারপাশে ফুলের গাছে ফুটে থাকা রাতের ফুল থেকে মন মাতানো মিষ্টি গন্ধ আসছে। থেকে থেকে। সকালের সূর্য পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রেখার উপর আলোর আভা ফেলছে। ভোর থেকে সকাল হচ্ছে। এই সন্ধিক্ষণে এক অপূর্ব ভালোলাগা জড়িয়ে থাকে। একটা আলাদা শান্তি, আলাদা তৃপ্তি বা আলাদা পূর্ণতা মনকে ছেয়ে রাখে। 

সকাল হল। অনেক লোকজনই এসেছে। আজ যে যজ্ঞের প্রথম দিন! শুভারম্ভ।
আশ্রমে যজ্ঞানুষ্ঠান শুরুর একটা রীতি আছে। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার পুণ্য তিথিকে স্মরণে রেখে এর শুরু হয়। তিন দিন চলে। ঠিক এমন ভাবে উদ্বোধন করা হয়, যাতে শেষ দিনটি এসে পড়ে দোল পূর্ণিমার দিন। 

একটু আগেই হল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ঠিক প্রাক-সকালে। স্বামী স্বরূপানন্দজি এবং মাতা রূপসী দেবী নিজেদের হাতে শান্তির দূত হিসেবে সাদা পায়রা উড়িয়ে দিলেন। এভাবেই হয় প্রতি বছর। 

যজ্ঞের এই বাৎসরিক অনুষ্ঠানকে গ্রামীণ ভাষায় সবাই 'শান্তি মেলা' বলেই ডাকে। এখানকার মানুষের যৎসামান্য আয়, সারাবছর চরম দারিদ্র্য আর যন্ত্রনায় কাটানো দৈনন্দিনে, অন্তত কয়েকটা দিনের জন্য ভুলে থাকার আয়োজনটুকু সুন্দর ভাবে করে দেন সাধুবাবা। তাঁর অনেক ভক্ত। তারাই এসব দেখাশোনা করে। 

এলাকার সবার কাছেই একটা বিষয় রহস্যের। কীভাবে তিনদিনব্যাপি যজ্ঞের এত খরচ সামাল দেন স্বরূপানন্দজি! দামি দামি গাড়ি চড়ে প্রচুর বাইরের লোকের আনাগোনা লেগেই থাকে আশ্রমে। এটা সবাই জানে। সেটাই সম্ভবত টাকার উৎস। দৈনন্দিন খরচ চালানোর জন্য অবশ্য অন্য ব্যবস্থাও ছিল। স্বরূপানন্দজি নিজে মা কালীর ভক্ত। একটা সুন্দর কালী মন্দির আছে। স্ফটিক পাথরের মূর্তি। কোথা থেকে বানানো আমরা কেউ কোনোদিন জানতে পারিনি। এই মন্দিরের সামনে ইজিচেয়ারে স্বরূপানন্দজি বসে থাকেন অবসর সময়ে। সাধারণত বিকেলের দিকে। অন্যপাশে রূপসী দেবী। মাঝখানে রাখা থাকে প্রণামী বাক্স। যখনই কোনও ভক্ত প্রণাম করে প্রায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে সিকি আধুলি,টাকা বা নোট সেই প্রণামী বাক্সে রেখে যায়। এই নিত্য আদায়ের টাকার পরিমাণও বেশ ভালোই। বাঁচিয়ে রাখা টিফিনের টাকা কত কত বার আমি নিজেও ওই প্রণামী বাক্সে রেখেছি তার ঠিক নেই। 

যজ্ঞের নাম প্রতিবছর বদল হয়। "রাধাকৃষ্ণ যজ্ঞ", "সীতারাম যজ্ঞ", "লক্ষ্মীনারায়ণ যজ্ঞ"  ইত্যাদি। এবছর শুরু হলো  "বিশ্ব শান্তি" যজ্ঞ। এই নামটুকুর বদলই দেখা যায়। কিন্তু আয়োজন, আড়ম্বর, পুরোহিতগণের মন্ত্রোচ্চারণ সব একই শোনা যায়। বড় বড় সামিয়ানা খাটিয়ে, চারপাশে মাইকের স্পিকার লাগিয়ে অনুষ্ঠান চলে। অনেকদূর পর্যন্ত সংস্কৃত মন্ত্রের আওয়াজ ও আবেশ ছড়িয়ে যায়। তিনদিন ধরে শান্তি আশ্রমের পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। হাজার হাজার লোক ভিড় করে, দূরের গ্রাম শহর এমনকি বিদেশ থেকেও। সবচেয়ে কষ্ট হয় মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর। এক চরম শূন্যতায় ছেয়ে যায় আশপাশ। এমনিতেই গ্রামের দিকে বড় মাপের উৎসব অনুষ্ঠান হাতে গোনা। আর এই যজ্ঞানুষ্ঠান তো সবচেয়ে বড় উৎসব। তাই এই সমাপ্তি এত করুণ। প্রতিবছর এই আনন্দ আর কষ্টের অনুভব সহ্য করতে করতে একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। 

শান্তি আশ্রমের কিছু দূর দিয়ে বয়ে গেছে কাঁসাই নদী। তারই পাড়ে চন্দ্রপুর। সেখানেই আছে চন্দ্রপুর হাই স্কুল। আমি এই স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল দেব এবার। শান্তি মেলার একটা অলিখিত নিয়ম হল, মেলার তিনদিন চন্দ্রপুর স্কুলের সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরাই স্বেচ্ছাসেবকের প্রধান ভূমিকায় থাকে। আমিও তাই, অনিবার্যভাবেই এবছর সেই দলে আছি। 

আমার ক্লাসমেট আকাশ, বিমান, কমল, মলয়, অসীম সবাই এসেছে। আমাদের এই বন্ধুবৃত্তের মধ্যেও আবার অনেক জটিল রসায়ন। আমি তো প্রায় ভূমিহীন চাষির ছেলে! মনে না থাকা বয়সে মা হারা। বাবা একাই মানুষ করছেন আমাকে। চরম দারিদ্রের সঙ্গে আমার নিয়ত বসবাস। তা সত্বেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, আমিই বন্ধুদের মধ্যমণি। আমার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। বিমান উচ্চবর্ণবংশজাত। স্বচ্ছল পরিবারের। ওর বাবা রেলের অফিসার। কিন্তু আমার অসম্ভম জেদ, অধ্যবসায়ের কাছে প্রতিবার হেরে যায় বিমান। শুধুমাত্র একবারই ও ক্লাস এইটের অ্যানুয়েল পরীক্ষায় আমার সঙ্গে যুগ্ম প্রথম হয়েছিল। আশ্চর্যরকম ভাবে। অসীম তার নামের মতোই সীমাহীন। উদার। সবাইকে আপন করে রাখে। কমলও গরিব চাষির ছেলে। মলয় আবার সংস্কৃতিমনস্ক। পড়াশুনার প্রতি অমনোযোগি, জমিদারের একমাত্র সন্তান। এরকম এক মিশ্র মনোভাবের বন্ধুরাই এবারের শান্তি আশ্রমে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায়। 


হঠাৎ করেই যেন এবার মেলাটা শেষ হয়ে গেল। মেলা শেষ হওয়ার পর এক শূন্যতা টের পাচ্ছি। কষ্টও হচ্ছে। কয়েকটা দিন হৈ চৈ করে কাটিয়ে হঠাৎ করে সব চুপচাপ। 

প্রতি বছরের মতো এই বাধ্য নীরবতা মেনে নিতে হয়। মেনে নিচ্ছি আমিও।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments