জ্বলদর্চি

লাট সাহেবের লম্বকর্ণ/(উৎসব ১৪২৮)/শুভাশিস ঘোষ

লাট সাহেবের লম্বকর্ণ

শু ভা শি স ঘো ষ


এ গল্পের শুরুতেই চড়ে বসলাম আমরা টাইম মেশিনে। ধরা যাক চলে এসেছি চার দশক পিছনে। এই ধরুন ১৯৭৮ বা '৭৯ সাল। অঙ্গদেশের সবথেকে বড় এবং বিলাসবহুল বাড়িটিতে থাকেন জনা দুয়েক মানুষ। মনে করুন বাড়ির নাম লাটভবন। দুজন মানুষের জন্য লাটভবনটি বরাদ্দ হলেও চাকর, বাঁদি, বাবুর্চি, খানসামা, পাইক, পেয়াদা, সান্ত্রী, বরকন্দাজ , লোক-লস্কর মিলিয়ে আরও শ'আড়াই মানুষের থাকার ব্যবস্থা আছে এই লাটভবনে। অষ্টপ্রহর কড়া পাহারা। মাছিটি গলার জো নেই। লাটভবনের বর্তমান লাট সাহেবটি খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। আনুমানিক বছর দুয়েক আগে এসেছেন এ বাড়িতে। মানুষটি বড় খাঁটি। মাটির মানুষ তো, তাই এমন খাঁটি। ওই উত্তরে কোথায় যেন আদি নিবাস। নাম ত্রিলোক নারায়ণ সিং। সংক্ষেপে টি এন সিং। এই সিংসাহেবকে যখন অঙ্গদেশের লাট সাহেব করে পাঠানো হল, প্রথা অনুযায়ী ব্যক্তিগত কোনো জিনিসই আনতে পারলেন না সঙ্গে । সাথে নিলেন একমাত্র অর্ধাঙ্গিনী আর দু'জন দুগ্ধদায়িনী। তবে শেষোক্ত দুই সঙ্গিনীর লাটভবনে প্রবেশাধিকারের জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয় লাট সাহেবকে । শেষমেষ হিল্লিশ্বরের অনুমতি পেয়ে লাটভবনের অতিথিশালায় স্থান হয় লাট সাহেবের দুই দুগ্ধদায়িনীর। এই দুজন আসলে লম্বকর্ণ। আমাদের এই লাট সাহেব ছাগ-বলয়ের মানুষ। মাতৃদুগ্ধ ছাড়া ইস্তক সকাল বিকেল মিলিয়ে প্রতিদিন লিটার দেড়েক ছাগদুগ্ধ থাকে তাঁর আহার-তালিকায়। তাই যখন লাট সাহেবির চাকরিটা হল পাকা , হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন সিং-জায়া। বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় পাবেন এমন মর্ত্যলোকের অমৃত? পতিদেবতার শরীর স্বাস্থ্যই বা রক্ষা পাবে কীভাবে ? অনেক আলাপ আলোচনার পর স্থির হল তিন কুড়ি পোষ্যের থেকে বাছাই করা দুটি নধর লম্বকর্ণ সঙ্গী হবে এ যাত্রায়। তাই লাটভবনে লেডি আর লাট ব্যতিত এই দু'জনের স্থান হল, যারা পদমর্যাদায় চাকর গোত্রের নয়।

অতিথিশালায় নতুন অতিথিরা আসতেই নিযুক্ত হল ক'য়েকজন কর্মী। অতিথিদের খাওয়া দাওয়া স্নান নিদ্রা ঠিকঠাক করানো জন্য তিন শিফটে এলেন তিন জন লোক। শরীর স্বাস্থ্য দেখার জন্য নিযুক্ত হলেন দু'জন ভেটেরিনারি সার্জন। একজনের দিনে ডিউটি, অন্য জনের রাতে। অতিথিরা এক দেশ থেকে পাড়ি দিয়েছে অন্য দেশে, তাই শরীরের পাশাপাশি বিপর্যস্ত হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্যও। সবদিক বিবেচনা করে নিযুক্ত হলেন দু'জন বিশেষজ্ঞ। যারা দেখবেন ওদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটা। ক'দিন পরেই মতান্তর হল দুই চিকিৎসকের। কাঁঠাল পাতা নাকি ঘাস, পুষ্টি বেশি কিসে ? আবার ঘাসের মধ্যে খাদ্যগুণ কোনটায় বেশি ? লাটভবনের বাগানের ঘাস নাকি কেল্লার মাঠের তাজা ঘাস ? দুই ডাক্তারের ঝগড়া থামাতে নিযুক্ত হলেন একজন ডায়াটেশিয়ন। এইসব লোকেরা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা, ফাঁকিবাজির কোনো ফন্দিফিকির কারো পেটে পেটে আছে কিনা, সে সব দেখার জন্য এলেন একজন সুপারভাইজার। অতিথিশালায় আগে থেকেই বরাদ্দ ছিল তেরো জন দারোয়ান। কিন্তু তেরো সংখ্যায় আপত্তি আছে লাটপত্নী গুলাবি দেবীর। তাই তাদের সংখ্যা বেড়ে হল পনেরো। শিফট প্রতি পাঁচ জন। কাজের সময় দারোয়ানদের ফাঁকিবাজি একেবারেই না-পসন্দ গুলাবি দেবীর। তাই ডিউটি-আওয়ার্সে দারোয়ানের পকেটে খৈনির কৌটো আছে কিনা, আসেপাশে
ট্রানজিস্টারে রামলীলা কিম্বা জনপ্রিয় ভোজপুরি গান চলছে কিনা সেসব কড়া নজরে রাখার জন্য নিযুক্ত হল সিকিউরিটি সুপারভাইজার। তিন শিফটে তিন জন। তাদের মাথার ওপরে থাকলেন একজন সিকিউরিটি ইনচার্জ। সর্বক্ষণের কড়া নজরদারি আর কঠোর নিয়মানুবর্তিতার সাথে চলতে থাকল অতিথিশালার অতিথি দুই লম্বকর্ণের নতুন জীবন। 

এই অঙ্গদেশে পরপর দু'বছরে ঘটে গেছে দুটো ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। বন্যা আর খরা। দু'বছরে দুই আপদকে সামলাতে দেশের অবস্থা একেবারে হাঁড়ির হাল । টানাটানির সংসার দেশময়। রাজকোষের অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু লাটভবনের এই লম্বকর্ণদের চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, অনটন বলে একটা শব্দ আছে অভিধানে। রেশমিকালো কুচকুচে লোমের গোড়ায় যেন লাগানো আছে তেলের পাইপ। টপটপ করে ঝরে পড়ছে কাঠের ঘানিতে পেষাই করা খাঁটি সরষের তেল। ভুল করে যদি কোনো মাছি বসে, তবে হড়কে পড়ে হাত পা ভাঙার প্রবল সম্ভাবনা  আছে, এমনই মসৃণ এই লোমস দেহ! খাওয়া, ঘুম আর দু'বেলায় কয়েক লিটার দুধ দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই এই লম্বকর্ণদ্বয়ের। লাট সাহেবেরও কাজ বলতে মাসে গোটা চারেক ফিতে কাটার অনুষ্ঠান আর চার ন-এ ছত্রিশ মিনিটের ভাষণ ছাড়া বলার মতো তেমন কোনো কাজ ই নেই। তবে দিনে দু'বার তিন পোয়া মাপের মোট ছ'পোয়া, মানে দেড় সের খাঁটি দুধে চুমুক দেওয়াটা অবশ্য তাঁর দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ে। এমনি করেই কাটছিল বেশ লাটভবনের দিন। 

হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বাতাসবাণীর স্থানীয় সংবাদে দেশবাসীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো এক খবর শোনালেন শ্যামদুলাল বন্দোপাধ্যায়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত লাটভবনের সর্বচ্চ নিরাপত্তার বলয় ছিন্ন করে চুরি হয়ে গেছে লাট সাহেবের দুটো পোষা ছাগল। অষ্টপ্রহর কঠোর নিরাপত্তার বেষ্টনীর মধ্যে কে বা কারা এমন দুঃসাহসিক কাজ করল, তা ভেবেই বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন লাট সাহেব। দশ মিনিটের স্থানীয় সংবাদের পৌনে ছ'মিনিট জুড়ে থাকল এই খবর। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান, পান গুমটি, সেলুন দোকান সহ যেখানেই চলছে রেডিও, সেখানেই জমে গেল ভিড়। সর্বত্র একটাই আলোচনা - লাট সাহেবের ছাগল চুরি। পরের দিন সকালে প্রতিটি দৈনিকের ব্যনার নিউজ হল এই খবর। খুশির হাট পত্রিকা, অন্য যুগ, দৈনিক মধুমতি তে এ বিষয়ে ছাপা হল একাধিক প্রতিবেদন । প্রতিটি চায়ের দোকান, সেলুন দোকানের বেঞ্চিতে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই। খবরের কাগজ নিয়ে কাড়াকাড়ি,বচসা থেকে কোথাও কোথাও পৌঁছে গেল হাতাহাতিতে। হাটে, বাজারে, ট্রামে, বাসে, অফিস-কাছারি, কলেজ ক্যান্টিন সর্বত্রই চলছে রুদ্ধশ্বাস আলোচনা।

ওদিকে শোকে পাথর অবস্থা গুলাবি দেবীর। মাঝেমধ্যেই মূর্ছা যাচ্ছেন লাটগিন্নি। লাটভবনে তলব করা হয়েছিল দ্বারপালকে । এ শহরের প্রধান কোতোয়ালের পদ হল দ্বারপাল। তাকে বাহাত্তর ঘন্টা সময় বরাদ্দ করেছেন লাট সাহেব। এই সময়ের মধ্যে ছাগল উদ্ধার না হলে চাকরি থাকবে না দ্বারপালের। খোদ প্রধান কোতোয়ালের যখন এমন অবস্থা, তখন মেজো, সেজো, ন, ছোট কোতোয়ালদের যে কী করুণ দশা, তা সহজেই অনুমেয়। শহরের প্রত্যেক কোতোয়ালিতে জারি হল লাল সতর্কতা। ঘুম ছুটল বড়বাবু, মেজোবাবু সহ সব বাবুদের। নধরকান্তি সিপাই, বিশাল বপু হাবিলদার, মায় লিকপিকে সান্ত্রীগুলোরও বাতিল হল ছুটি। সেনাবাহিনীর বাতিল করা গাড়িগুলো রদ্দির দরে কিনে কোতোয়ালির কাজে লাগানোর প্রথা চলছে সেই কবে থেকেই! সেই সব লজ্ঝড়ে গাড়ি নিয়েই অভিযান শুরু করল বাঘা বাঘা কতোয়ালের দল। ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট দিচ্ছে সদর দপ্তর। পাহাড় থেকে সমুদ্র, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল উদ্ধারকারী দল। শহরতলির গলি-ঘুঁজি, গঞ্জের কোণমোচর, গ্রামের প্রতিটি গোয়ালঘর, ছাগলখানা সবখানেই চলল তল্লাশি। কিন্তু কোথাও আর মিলল না লাটভবনের বর্ণনা মতো লম্বকর্ণ। ইতিমধ্যেই কেটে গেছে আটচল্লিশ ঘন্টা। কাজকর্ম লাটে তুলে রেডিও তে কান পেতে আছে দেশবাসী। দ্বারপালের দজ্জাল গিন্নি হত্যে দিয়েছে ওলাবিবির থানে। মা ওলাবিবি মুখ তুলে তাকিয়ে ছাগল জোড়া খুঁজে দিলে জোড়া পাঁঠা বলির মানদ করেছেন তিনি। সদর দপ্তরে প্রতিটি মূহুর্ত কাটছে তীব্র উৎকন্ঠায়। বাতাসবাণীর খবর আর স্থানীয় সংবাদের সময় হলেই চায়ের দোকান আর পান গুমটিতে উপচে পড়ছে ভিড়। সবার কান খাড়া রেডিওর পানে। 

বাহাত্তর ঘন্টার সময়সীমা শেষ হতে যখন আর ঘন্টা খানেক বাকি, সবাই ধরে নিয়েছে এ যাত্রায় আর ছাগল উদ্ধার হল না। সদর দপ্তরে শুরু হয়ে গেছে ফিসফিসানি, নতুন দ্বারপালের নাম নিয়ে। হঠাৎই বাতাসবাণীর নির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল করে প্রচার হচ্ছে,  " বিশেষ সংবাদ বুলেটিন পড়ছি শ্যামদুলাল বন্দোপাধ্যায়। এইমাত্র খবর পাওয়া গেল , লাটভবন থেকে চুরি যাওয়া ছাগল দুটি উদ্ধার করেছেন খোদ দ্বারপালের নেতৃত্বে একদল কোতোয়াল। বাজেকদমতলা ঘাটের কাছে ধ্যানমগ্ন এক সাধুর পাশে বসে ছাগল দুটিকে গঞ্জিকা পাতা চিবতে দেখা যায়। তৎক্ষণাৎ তাদের উদ্ধার করে আনা হয় লাটভবনে। এ দুটি তাঁর ই চুরি যাওয়া ছাগল বলে চিহ্নিত করেছেন খোদ লাট সাহেব। এর সাথেই যবনিকা পড়ল এই ছাগল চুরি রহস্যের ।"


 আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments