এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য
(ষষ্ঠ অধ্যায়)
আজ পাহাড়যাত্রা। সকাল থেকেই সবার মনে উত্তেজনা, বোঝাই যাচ্ছে, গতকালের গল্পের রেশ নাগরিক মানুষ গুলিকে প্রকৃতির আরও কাছে নিয়ে এসেছে, বহুদূরে নয়, অতীব ব্যয়বহুলও নয়, আমাদের বাড়ির পাশেই যে এমন কতো অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক স্মারকখন্ড পড়ে আছে, নাগরিক মানুষেরা তার খোঁজ পায়না। আমরা দূরে যাই অবসর বিনোদনে, কিন্ত 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া..'
সে যাকগে, মনখারাপের দিন আজ নয়, অদম্য উৎসাহী একদল মানুষ চলেছেন পাহাড়যাত্রায়। যদিও সময়টা আষাঢ় মাস নয়, পাহাড়পুজোর ইচ্ছেও তাঁদের কারো নেই, তাঁরা শুধুমাত্র দর্শন অভিলাষে এসে পৌঁছলেন পাহাড়তলীতে; এবার চড়ার পালা। এদিক ওদিক তাকাতেই দুটি আদিবাসী ছেলে পাওয়া গেল, ওরা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে ঠাকুর-থানে। খাড়া উঁচু পাহাড়, ঘনলতাগুল্ম ঝোপঝাড় পেরিয়ে ক্রমে বড়বড় গাছগাছালি দেখতে দেখতে চলেছেন; জুতো,জীন্সের পায়ের অংশে চোরকাঁটা, এবড়োখেবড়ো পাথরের ঠোক্কর লাগছে, সঙ্গের বাচ্চাদুটোর প্রাথমিক খরগোসের মতো লাফালাফি আস্তে আস্তে কমতে লাগলো, চিউয়িংগামের চালাচালি বাড়তে লাগলো এ হাত থেকে ও হাতে। আরও খানিক দূর গিয়ে, বিমল বসে পড়লেন,
-আমি আর পারছিনা।তোরা এগো,আমি একটু বসি।
দেখাদেখি,রূপাও বসে পড়লেন। চিরকালের আল্হাদী মানুষ, এসব তাঁর যে তেমন পোশায় না, ঝোঁকের বশে এসে পড়েছেন, বেশ বোঝা যাচ্ছিল।
অরূপ-দোলারও মুখ-চোখ লাল; কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারছিলেন সবাই, কিন্তু ছেলেদুটি বারবার বলছিল আর একটু গেলেই 'হরির থান'। এদিক, অরূন্ধতীর খুব যাওয়ার ইচ্ছে। ওনার বাবা ছিলেন নৃতত্ত্ববিদ, ছোট থেকেই বাবার অনুসন্ধানের সওয়ারী হতেন। নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষিকা হয়েও আগ্রহ আছে এসবে, বেশ বোঝা যাচ্ছিল। অগত্যা আরও কিছুদূর যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, বিমল আর রূপা কোনভাবেই যেতে রাজি হোলনা, বাচ্চাদেরকেও নিয়ে যাওয়া হলো না, পথ দেখানোর জন্য আসা আদিবাসী ছেলেদুটির সঙ্গে অরণি,দোলা, অরূপ ও অরূন্ধতী চললেন।
রাস্তা বেশ বন্ধুর, অল্প উচ্চতায় হলেও চড়াই-উৎরাই বেশ। আরও অনেক পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু এসব পাহাড়ে একেবারেই মানুষজনের ছায়া পড়ে না, স্বাভাবিক ভাবেই, কেমন যেন এক আদিমতার গন্ধ লেগে আছে, ভিজে ভিজে, সোঁদামাটির মত। চলতে চলতে কখনও পায়ের তলার নুড়ি সরে যাচ্ছে, কখনও বুনো ঝোপে পা আটকে যাচ্ছে, সাবধানে চলতে হয় পথ। দোলার অসুবিধে হচ্ছিল, তিনি সামনে থাকা অরণির হাত ধরে এগোচ্ছিলেন,হাঁপাতে হাঁপাতে হাসিমুখেই বলছিলেন,
-অরণিদা,'এই পথ যদি না শেষ হয়' -টাইপের কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে কিন্তু!
অরণি,অরূপও হাসলেন, ওনাদের মধ্যে সম্পর্ক এমনই সুন্দর,এর চাইতেও বেশি হাল্কা ঠাট্টা-রসিকতা চলে বইকি। কিন্তু সেই মুহূর্তে কেন কে জানে,দোলা নয়, অরণির খুব ইচ্ছে করছিলো, অরূন্ধতীর হাত ধরার, তাঁকে সাহায্য করার জন্যই, কিন্তু তিনি সাহায্য চাননি, বরং হরিণী-ক্ষিপ্রতায় সবুজ-হলুদ সম্বলপুরী শাড়ির আঁচল উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন স্বচ্ছন্দ্য গতিতে। অরণির মন কি যেন এক অজানা সঙ্কোচ অথবা মুগ্ধতায় আবিষ্ট; এতদিনকার জীবনে, এমন অনুভূতি আগে কখনও হয়নি।
সে যাক গে…
ওনারা ইতিমধ্যে পৌঁছে গেলেন,পাথরখন্ডটির কাছে, স্হানীয়মানুষেরা বলেন,'হরির থান'...আশ্চর্যজনকভাবে কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবেই, আটকে আছে প্রকান্ড সেই পাথরখানা, যদিও ভূমিরূপ একেবারেই আলাদা, মনে পড়ে যাচ্ছিল, মহাবলীপূরমের সেই পাথরটির কথা। সবাই অবাক হয়ে দেখছিলেন, জায়গাটি পথের অন্য অংশের তুলনায় চ্যাটালো, গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, খানিক দূরের খড়িডুংরি পাহাড়, তার পাশের সাদা কোয়ার্জাইট পাথরের ধূম্রপাহাড়, আরও দূরের গারড়াসিনি; কেমন যেন এক অতিন্দ্রীয় অনুভব ছেয়ে যাচ্ছিল সবার মন। সেদিকে তাকিয়ে অরূন্ধতী বলে উঠলেন,
-জানেন,এখানেই শুটিং হয়েছিল মরূতীর্থ হিংলাজ সিনেমার!
অবাক হলেন,লজ্জিতও; তাঁর মাটি,অথচ তিনিই জানেন না! হঠাৎ অরণি দেখলেন, অরূন্ধতী পাশের বুনোঝোপ থেকে একমুঠো ফুল তুলে পাথরটির মধ্যের গর্তে দুহাত ভরে অঞ্জলি দিলেন, অরণি পাশেই ছিলেন, কি মনে হতে এগিয়ে গিয়ে হাত পাততেই ফুল ফেরৎ এলো তাঁর হাতে, হয়তো সমাপতন, হয়তো একেবারেই সাধারণ ঘটনা; কিন্তু এই যে একটু হাত ঠেকে যাওয়া, কি এক অনির্বচনীয় সুখমাধুরী ছড়িয়ে দিলো মনে, এতক্ষন দোলার স্পর্শে তা কিন্তু হয়নি।
নীচে নেমে এলেন, সঙ্গে থাকা ফ্লাস্ক থেকে কফি খেলেন সবাই মিলে, পরবর্তী গন্তব্য গাড়রাসিনি পাহাড়, পাহাড় চূড়ায় উঠে কিছুদূর আবার সুড়ঙ্গে নেমে অসংখ্য মাটির হাতি-ঘোড়া-সিঁদুর মাখা পাথরে পূজিতা জাগ্রতা লৌকিক দেবী গাড়রাসিনি, এই এলাকার সমস্ত দেবীই হয়তো রঙ্কিনী বা ভৈরবীর প্রতিরূপ; শক্তিময়ী।
সেখান থেকে খানিক নেমে ঘাগরা জলপ্রপাত। পাহাড়ের অসংখ্য ঝোরা বৃষ্টিজল বয়ে এনে তীব্র স্রোতধারায় পাথর কেটে প্রায় ষাটফুট গভীরে প্রপাতাকারে আছড়ে পড়ছে, অপুর্ব শোভায়। বেশ খানিকক্ষণের পাহাড়যাত্রার পরে এই যে দূর্বার-স্নিগ্ধ নদী-আসঙ্গসুধা; সবাইকে ভীষন তৃপ্ত করলো….,অরূন্ধতী গান ধরলেন, মধ্য দুপুরের উজ্জ্বল সৌরালোকে, ঝর্ণার কলকাকলী সঙ্গতে মিলে যাচ্ছিল সেই সুর, 'আমি কি গান গাহিব যে..'
বহুশ্রুত গানটি যেন এক আলাদা মাত্রা এনে দিলো; হয়তো কন্ঠমাধুর্যে, হয়তো পরিবেশের জন্য; সুরখানি ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিল সবাকার মনে মনে, 'আমার অঙ্গে সুরতরঙ্গে ডেকেছে বান..'
আবেশিত,মুগ্ধ চরাচর।
মুখ ফুটে বলতে পারেন নি,গতকাল ভীষণ, ভীষণভাবে চেয়েছিলেন, তাঁর গান শুনতে,আজ দেবী স্বয়মাগতা!..
বেশ খনিকক্ষণ ওখানে কাটিয়ে দলটি নেমে এলেন শিলদায়। ওখানেই কিছু খাওয়া দাওয়ার পরে যাওয়া হোল রাজবাড়ী। কালের করালগ্রাসে হয়তো তলিয়ে গেছে রাজবৈভব, কিন্তু রয়ে গেছে ভগ্নস্তূপ স্হাপত্য, রাসমঞ্চ, নহবৎখানা, রাজবাঁধ, পঞ্চরত্ন মন্দির...আরও কতো কি! আর রয়ে গেছে রাজা মানগোবিন্দ,রানী কিশোরমনির প্রজাকল্যাণী বীরগাথা; কেই বা ভুলে যেতে পারে, ভারতের প্রথম স্বাধীনতাকামী আন্দোলন চূয়াড় বিদ্রোহের প্রথম দিব্যাগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছিলো এখানেই; আর সেই সংগ্রামের পুরোধা-পুরুষ, এই এলাকার অবিসংবাদিত লোকনায়ক জগন্নাথ ধল ছিলেন রানী কিশোরীমনির জামাতা, প্রযত্নে মানসপুত্রই।
আজ হয়তো নিকটবর্তী ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী সরকারী আনুকূল্যে অনেক বেশী চাকচিক্যময়, রাজপরিবারের শিক্ষা, স্বাস্হ্য, যোগাযোগসহ বহুল জনমুখী কাজকর্ম উচ্চ প্রশংসিত, তবু জনমানসে শিলদা অথবা চিল্কিগড়ের জামবনী রাজপরিবারের প্রজাহৈতিষণা আজও যে সুবিদিত, শিলদা ফেরৎ ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ীর বিভিন্ন অংশ দেখতে দেখতে সবাই নিজেরা তা আলোচনা করছিলেন, পাশেই ছিলো রাজমন্দির সাবিত্রী দেবীর। অসংখ্য লোককথা যে মন্দির ঘিরে,সময়াভাবে দেখা হলোনা, আফশোষ রয়ে গেল।।
সেখান থেকে যাত্রা ঝাড়গ্রামের হোটেল, আজকের মত বিশ্রাম ; বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো ছোট্ট জেলাশহর। সারাশহরই প্রায় শালগাছে ঘেরা, মাঝেমধ্যে নাকি হাতিও আসে। যদিও নাগরিক পরিসেবা যথেষ্ঠ উন্নত, ত্রিফলা আলোয় আলোকিত সুন্দর রাস্তাঘাট 'অরণ্যসুন্দরী' নামটির যথার্থতা বহন করছে, হোটেলের পরিসেবা ও আপ্যায়নও সুন্দর। তরুণ হোটেলমালিকের অনুরোধে সমান্য জলযোগের পরে তাঁরা গেলেন ছাদে, তথাকথিত 'রুফটপ গার্ডেন'-এ।
গিয়ে তো মুগ্ধ, একে তো চারপাশের শালগাছগুলির মাথা প্রায় হাতে ছোঁয়া দূরত্বে, আদিগন্ত নক্ষত্রখচিত আকাশ একেবারেই চোখের সামনে, সাইকাস, এরিকাপাম সহ বাহারী গাছ সজ্জিত ইতিউতি, এককোনে কেয়ারি করা মাধবীকুঞ্জের সুগন্ধ, বাহারী অ্যকোরিয়ামে রঙ-বেরঙ মাছ-কচ্ছপের খেলা ছোট-বড় সবার মন ভুলিয়ে দিলো। বাচ্চারা ছাদময় হুটোপুটি করছে, সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও তাদের উৎসাহের অন্ত নেই; বড়োরা সবাই বসলেন একধারে পাতা চেয়ারে। সবাই এমন অসাধারণ একটি ভ্রমন-অভিজ্ঞতা উপহার দেওয়ার জন্য অরণিকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন, টুকটাক গানে, গল্পে বেশ কেটে যাচ্ছিল সময়।
কি মনে হতে অরণি অরূন্ধতীকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-সবাই ভালো বললো,আপনি তো কিছু….
আয়তনয়নে চাইলেন নারী,অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলেন,
-'আমি তো তোমার পরে করিনি নির্মান
অভ্রভেদী স্বর্গের শোপান
ভুলিনি তো তুমি মুগ্ধ মুহুর্তের দান…'
এতদিন জানতেন, প্রতিষ্ঠা, সম্মান, সংসার; সবই তাঁর অধিকৃত, তিনি সুখী। কিন্তু অপরিমেয় তীব্র সুখানুভূতির মধ্যেও লুকিয়ে থাকা তীব্রতর কোন এক অসুখবোধে, আকাশভরা এই চন্দ্রালোকিত শারদরাত্রে, মাধবী সুগন্ধিত মনে, অরণি কোন এক অনাস্বাদিত আনন্দ-চেতনায় গলে গলে যেতে লাগলেন, মনে-মনে বললেন, মানুষ জন্মায় একবার, কিন্তু জীবনভ'র মরে অসংখ্যবার। এমন কোনও কোনও বিশেষ মুহূর্তে কখনও কখনও হয়তো অরতি-রাগ-রঞ্জিত কাঙ্খিত মরন হয় 'সরগ সমান…'
চিত্র- লেখিকা
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
2 Comments
আহা..ব্র্যান্ড আবীর পূর্ণ মাত্রায় উপস্থিত।
ReplyDeleteঅনবদ্য
ReplyDelete