জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-৩/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাতি মানুষের পাঁচালি::৩

লাউদোহা আর নবীনবাবার কাহিনি
------------------------------------------------
 ইংরেজির ছিয়াত্তর সনে বাবা, মা, ভাই, বােন আর আমি পৌঁছলাম বাবার চাকরিস্থল লাউদোহায়। লাউদোহা বর্ধমান জেলায়। উখরা থেকে দূরত্ব চার মাইল। কয়লার ট্রেন সে সময়, অর্থাৎ স্টিম ইঞ্জিন। স্টেশনে নেমে বাস, ট্যাক্সি, রিকশা, হেঁটে, সব রকমেই লাউদোহা পৌঁছনাে যেত। মনে আছে ট্যাক্সি ভাড়া ছিল দশ টাকা। সে সময়ের তুলনায় খুবই বেশি। রিকশা ভাড়া আরো  বেশি।  আমরা বাসে যাতায়াত করতাম। বাবা লাউদোহা বেসিক ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক। কলেজের গাল ভরা নাম কিন্তু থলে ভরা মাইনে নয়। সে মাইনেতে বড় সংসার চালিয়ে ট্যাক্সি চড়া বিলাসিতা ছিল। এ ব্যাপারে আমাদের অবশ্য কোনরকম অভিযােগ ছিল না।
এরকমটি যে হওয়া উচিত তা নিজে থেকেই বুঝতে শিখেছিলাম । মানুষ তার স্বচ্ছলতা অনুসারে সবকিছু বুঝতে শেখে। লাউদোহা মালভূমি ধাঁচের একটা শুকনাে খটখটে জায়গা। ছােট বড় টিলা চারদিকে। ইতিউতি ইউক্যালিপটাস, মহুয়া, পলাশ, শিমূল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। বাবার কলেজ পুরনাে কিছু আমগাছ দিয়ে ঘেরা (এখন সে কলেজ আর নেই, ঝাঁঝরা প্রােজেক্টের শিল্পের থাবা সব সবুজ খেয়ে নিয়েছে সেখানকার)। পানীয় জলের জন্য চাপকল ছিলনা। সাপ্লাইয়ের জলের তাে প্রশ্নই নেই। বড় বড় ইঁদারা থেকে দড়ি, বালতি, কপিকল দিয়ে জল তুলে বিশাল বিশাল হাঁড়িতে রাখা হতো। সেগুলোকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো, হাঁড়া। সে জলেই সবকিছু। গরম কালে ইঁদারার জলের স্তর এত নেমে যেত যে, জল তােলার দড়ির সঙ্গে আরও দেড় গুণ দড়ি লাগিয়ে তবে নাগাল পাওয়া যেত তার। সে গরমে কিছু পাখি জলের খোঁজে মাঝে মাঝে নেমে যেত ইদাঁরায়, আর উঠতে না পেরে ওখানেই মরে পড়ে থাকত। পচা গন্ধ উঠত জল থেকে। লাউদোহায় পড়াশোনা শুরু করলাম সরকারি প্রাইমারি স্কুলে।  সেখানে বাউরি, বাগদি, রুইদাস, ডোম  এদের  ছেলেমেয়েরা , আর সঙ্গে গুটিকয় ‘আমরা'। হেডমাস্টার পঞ্চানন পাঁজা লিকলিকে সরু। ফরসা গায়ের রঙ।   চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা। আদ্দির ধুতি আর পাঞ্জাবি তাঁর নিত্য সঙ্গী। হাতে বেত, মুখে কথার খই ফুটছে। পড়ানাের থেকে পেটানাের দিকে মনযোগ বেশি। বাবার মাস মাইনে মাসের প্রথম দিকে নিঃশেষ হয়ে যেত। তারপর চাল, ডাল, আলু, পেঁপে আর কলেজের ক্ষেতের এটা সেটা। দুধ সস্তা ছিল। সেটা পাওয়া যেত সহজে। দুধ মাসি’র সৌজন্যে তাতে অবশ্য জল বেশি, দুধ কম থাকত। ছাত্র ভালাে ছিলাম না একেবারেই। প্রতি মুহূর্তে নানা অছিলায় আমাকে আর বাবাকে সে কথা মনে করিয়ে যন্ত্রণা দিতেন পঞ্চানন বাবু। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা মানুষের। ব্যর্থ যাঁরা নিজেদের জীবনে, তাঁরা নানা অছিলায় পদে পদে মানুষকে অপদস্থ করে প্রভূত আনন্দ পান। পঞ্চানন পাঁজা ব্যর্থ মাস্টারমশাই ছিলেন। ছাত্ররা তাঁকে ভালােবাসত না, ভয় পেত। লাউদোহার প্রতি আমাদের গােটা পরিবারের বিশেষ কারণে অন্য এক নস্টালজিয়া ছিল। ছিয়াত্তর সনের প্রথম নাগাদ বাবা বীরভূমের শ্যামপাহাড়ি বেসিক ট্রেনিং কলেজে জয়েন করেন অধ্যাপক হিসেবে। সদ্য দেউলি বিশ্বনাথপুর থেকে  সেখানে এসেছেন ।  শ্যমপাহাড়ি বীরভূম জেলার দুমকা বর্ডার, রামপুরহাটের কাছাকাছি। সময়টা নকশাল আমল। চারদিকে অশান্তি, খুনােখুনি, নাশকতা। কলেজেও কিছু নকশালপন্থী ছাত্র ছিল। সে কারণে কলেজও আন্দোলন আর অশান্তিতে উত্তাল। বাবা ছাত্র রাজনীতি পছন্দ করতেন না যে কোনো কারণেই হোক। সে জন্য কিনা জানি না, রোজ সন্ধ্যের পর দমাদম ইট পড়ত আমাদের  কোয়ার্টারের বন্ধ জানালায়। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি এমন ভয়ংকর  হয়ে দাঁড়ালো যে,  এক রাতে বাধ্য হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে  গােটা পরিবার নিয়ে বাবা আশ্রয় নিলেন বহরমপুরে আমার দাদুর বাড়িতে। দাদু তখনও বেঁচে। শক্তসমর্থ পুরুষ। সুতরাং অসুবিধে হয়নি। সেখানে টানা দেড় দু বছর ছিলাম আমরা। ছােট ভাই আর বােনের পড়াশােনার সময় হয়নি তখনো। আমার দুবছর নষ্ট হয়েছিল । আমরা চলে আসার বছর খানেক বাদে দাদু ও  আমার অসম সাহসী মা এক ম্যাটাডর ভর্তি আমাদের জিনিসপত্র শ্যামপাহাড়ি থেকে বহরমপুরে নিয়ে আসেন, তার মধ্যে আমাদের গাছে ফলা এক কাঁদি পাকা কলাও ছিল। তারপর বহুদিন ধরে সরকারি স্তরে চিঠিচাপাটি চালাচালি করে এই লাউদোহায় আসা। ছোটবেলার সে অশান্ত মন, অশান্ত হৃদয় নিয়ে লাউদোহা পৌঁছনো তাই নতুন করে জীবনকে পাওয়া আমাদের কাছে। লাউদোহার কথা নয় অন্য একদিন হবে। আজ বসেছি নবীনবাবা'র কথা বলতে। নবীনবাবা গেরুয়া পরা ছােটামােটা সাধু। কুচডিহির মােড়ের কাছে লাউদোহা থানা, তার ঠিক পিছনটাতে নবীনবাবার ছােট আশ্রম। আমরা সেই বয়সের ছ-সাত বন্ধু (কেউ লাউদোহা থানার পুলিশের ছেলে, কেউ বাবার সহকর্মীর, কেউ আবার নিছক পাড়ার।) হাতে ছােট ছােট লাঠি (গাছের ডাল ভেঙে তৈরি।) নিয়ে বাপে তাড়ানাে মায়ে খ্যাদানাে ছেলেদের মতাে স্কুল পিরিয়ড ছাড়া অন্য সময়গুলিতে শেয়াকুলের ঝােপেঝাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। তখন সদ্য নতুন চাকরি পেয়ে আঠাশ বছর বয়সে স্বাতী পিসি লাউদোহা কলেজে জয়েন করেছেন আর্টিস্ট হিসাবে। তিনিও সঙ্গী ছিলেন আমাদের। মাইলের পর মাইল ধূ ধূ  মাঠ কেবল চাইনিজ বাঁশ, বাবুই ঘাস আর শেয়াকুল। (কুলগাছ গুলি অদ্ভুত ছােট ছােট। মাটির সঙ্গে মিশে থাকত প্রায়। শেয়ালে সেই কুল খেয়ে পায়খানা করত  কুলের বীজ। তার থেকে আবার গাছ গজাত।) অসংখ্য সাপ আর উইটিবি চার পাশে।
সাপের থেকে বাঁচতে হাতে লাঠি ।(বাঁচতে না বলে তাড়াতে’ বলাটা ঠিক হবে।) চিতি, কেউটে, গােখরাে,চন্দ্রবােরা কত রকম সাপ! কামড়ালে সাক্ষাৎ মৃত্যু। যদিও সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না আমাদের। কতবার তাদের পাশ দিয়ে চলে গেছি । কতবার লাঠি ঠুকে ভয় দেখিয়েছি তাদের! বড়রা তাদের দেখলেই মেরে আগুনে পুড়িয়ে দিত। ভীষণ রাগ হত তখন। হাজার হােক তারাও তাে খেলার সঙ্গী ছিল আমাদের! আশ্রমটা যেন তারই মাঝে এক ঝলক মরুদ্যান। খড়ের চালের আর মাটির বাড়ি। তিন চার খানা ঘর। পরিষ্কার ঝকঝকে দেওয়াল। খড়িমাটি দিয়ে আঁকা বিভিন্ন ছবি। নিকোনাে মাটির মেঝে। বাড়ির চারদিক দিয়ে উঠান, পুরােটা বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা । সে গুলো  আবার আলকাতরা দিয়ে রং করা হয়েছে। সামনে উত্তর পূর্ব কোণে তুলসী মঞ্চে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বড় সাইজের তুলসীগাছ। পিছন দিকে ছােট একটা ডােবা। সেখানে পােষা হাঁস খেলে বেড়ায় সকাল থেকে। গােরু, ছাগল রয়েছে। আর বিভিন্ন ফল ফুলের গাছ। কুমড়াে, লাউ, সিম, উচ্ছে।  প্রয়ােজনের অনেকটাই মিটে যায় এখানকার সব্জি থেকে।
নবীনবাবার বয়স তখন বছর পঁয়তাল্লিশ। গলায় বােষ্টমের মালা, দাড়ির নীচের সরু হয়ে আসা অংশ হালকা গিঁট দিয়ে রাখা।  নবীনের সঙ্গে এক বছর চল্লিশেক বয়সের কালো মহিলাও থাকেন। বােধহয় বােষ্টমী হবেন। আসল নাম ননীবালা, নবীন তাকে বালা বলে ডাকতেন। ছােট বড় সবার অবারিত দ্বার আশ্রমে। লাউদোহা হাসপাতালের পিছন দিক দিয়ে হাঁটা পথে ঝােপঝাড় ভরা মাঠ দিয়ে বাঁয়ে বালিজুড়ি ও সােজা লঘনপুর যাওয়া যায়। পাকা পথের থেকে রাস্তা কিছুটা কম। লঘনপুর অথবা তার থেকেও  অনেক দূরে নাগরাকোন্দা হাঁটা পথে যাওয়া পথিক আশ্রমে ঢুকে গুড়জল অথবা বাতাসাজল খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে যান মাঝে মাঝে, বিশেষ করে গরমের দিনে। আর্থিক সংস্থান বলতে ভিক্ষা। জমিটা সরকারি। সেকালে এ রকম অনেক সরকারি জমির উপর ছােটখাটো বাড়িঘর, দোকানপাট ইত্যাদি গড়ে উঠত। সাধারণ মানুষের জুলুমবাজি বা সরকারি জটিলতা  তখন ছিল না। আসল বিষয় ছিল শান্তির সহাবস্থান। সে সব দিন এখন গেছে। বদলে ছােট ছােট বিষয়ে বড় বড় জটিলতা। পাঁচ পয়সার স্বার্থে টান পড়লে মানুষের ঘুমের বারাে বাজে। আমার নিজের খুব ভালাে লাগত নবীনের জীবনচর্চার এ দিকটা। মুখে তাঁর গুনগুন গান লেগেই থাকত সব সময়। এ মেলা থেকে ও মেলা, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে চেয়ে চিনতে বেশ চলত সবকিছু।
ভেড়ার পালের থেকে নিজেকে আগলে রাখা আড়ালে থাকা একটা আলাদা সত্তাও ছিল আমার । ফলত দলে ভিড়ে ছাড়াও মাঝে মধ্যে অবসরে একা একাও নবীনবাবার আশ্রমে চলে যেতাম আমি। তার পাশে দাওয়ায় বসে তাঁর জীবনের নানা অজানা গল্প শুনে প্রভূত আনন্দ পেতাম তখন। নবীনের জীবনকথা খুবই আকর্ষণীয়। আদতে তাঁরা দেওঘরের বাসিন্দা। বাবা-মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে বড় তিনি। সেখানকার বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশে ছােট খড়ের চাল দেওয়া ইটের গাঁথনির বাড়ি ছিল তাঁদের। বাবা সরকারি ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতেন। একটা অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। উপরি আয়ের ইচ্ছে না থাকলেও তা না নিয়ে তাঁর উপায় ছিল না। অন্যথা মরার সম্ভাবনা। এমনিতে ঈশ্বরভক্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন নবীণের বাবার, তবে মদের নেশা ও মেয়েমানুষের দোষ ছিল। রাতে এক রকম দিনে আরেক রকম। দিনের স্নেহশীল বাবাকে রাতে কেমন যেন মদ্যপ পাষণ্ড চণ্ডাল রাগী লােক মনে হতো। বাবা পঞ্চাশ বছর বয়সে যৌন রােগে মারা যাওয়ার পর কালের নিয়মে বাঁচার তাগিদে মা-ছেলে মানুষের ভিড়ে মিশে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছিল  আগে! ফলে  কারো কাছে সে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি। বুঝে নিয়েছে নিজেরটা। মায়ের খবর তখন থেকেই নেই আর। ছেলে নবীনের ডাকনাম ছিল বুড়াে। ভালাে নাম মনে নেই। নবীন নাম পরে পাওয়া। গােলগাল চকচকে শরীর স্বাস্থ্য, মেয়ে মেয়ে গড়ন। এখানে ওখানে ঠেক খেতে খেতে শেষে উখড়ার মেলায় এক বিহারি সাধু দলের পাল্লায় পড়লেন তিনি। তাদের সঙ্গে এখান থেকে ওখান, এ রাজ্য থেকে ও রাজ্য করতে করতে সােজা হরিদ্বারে সেই দলের আসল ডেরায়। ডেরা বলতে মনসা পাহাড়ের নীচে সুপ্রাচীন এক বটগাছ। একদিকে টিনের ছাউনি দেওয়া লম্বা একটা শােওয়ার জায়গা। দিনমানে পর্যটক, ভক্ত দর্শনার্থীদের থেকে ভিক্ষা করে ভালােই চলত। গাছের নীচে একটা গর্ত খুঁড়ে পেল্লাই একটা শুকনাে গাছের কাণ্ডর এক ভাগে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হতো। সেই আগুন শীতে তাপ দিত, অন্য সময় প্রয়ােজনে রান্না হতো। যদিও বেশিরভাগ সময় রান্না করার দরকার হতো না। কাঙাল ভােজ অথবা সাধু ভােজে পাত পারলেই হতো। বছর তিনেক সেখানে কেটেছিল। সাধুদের একজন ‘দূর্বাশাবাবা’ ছিল সমকামী। তার টার্গেট ছিল 'বুড়াে', সুতরাং কম অত্যাচার সইতে হয়নি তাঁকে। অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে একরাতে পালিয়ে হাওড়াগামী এক ট্রেনে চড়ে দুর্গাপুর পর্যন্ত এসে নেমে পড়ে সে যাত্রায় বাঁচেন তিনি। বাঁচলেন তাে, কিন্তু খাবেন কি ? উঠতি বয়েস। হাত খালি, পেটে টান। গানের গলা ছিল। সে গানই তাঁকে বাঁচিয়ে দিল সে যাত্রা। গােটাদিন গান গেয়ে ভিক্ষে আর রাতে খেয়ে-দেয়ে স্টেশনের শেডে বা ওভারব্রিজের নীচে ঘুম, এভাবে চলল আরও সাত বছর। রােগব্যাধি বিশেষ হতো না। হলেও ঠিক হয়ে যেত নিজে নিজে। বেপরােয়া মানুষদের ভয় পায় রােগবালাই। হয়তাে বা পাত্তা না পাওয়ার কারণে । তাই তারা মানে মানে কেটে পড়ে। আর সময় সুযােগ পেলে মরণ কামড় বসিয়ে তাকে শেষ করে দিতেও পিছপা হয় না।

এরকম করতে করতে বাষট্টি সালে এক শীতের ভােরে লঘনপুরের জিতেন মােড়লের সঙ্গে আলাপ হয় বুড়াের। ভদ্রলােক একটুর জন্যে অন্ডাল যাওয়ার ট্রেন মিশ করে গােটা রাতের জন্য আটকে ছিলেন স্টেশনে। প্রথম আলাপেই বুড়ােকে বেশ মনে ধরে জিতেনের। তাকে সঙ্গে নিয়ে এসে মােড়ল, এখন যেখানে তার আশ্রম, সেখানে এক ফালি পঞ্চায়েতী জমি দেন অলিখিত চুক্তিতে। বাড়িঘর করার রসদ দিয়ে সাহায্য করেন তাঁকে। এভাবে গড়ে ওঠে আশ্রম। তার বছর তিনেকের মধ্যে ননীবালার প্রবেশ নবীনের জীবনে। ভারভারন্ত দোহারা গড়ন তাঁর।  সেই উখরা বাসস্ট্যান্ডে বাটি হাতে বসে ভিক্ষা করতেন তিনি। মায়ার বশে দুজনে যে কি ভাবে চলার স্রোতে এক নৌকায় ভিরে গেল তা তাঁরাই জানেন। তারপর থেকে একসঙ্গেই আছেন দুজনে।
পুরনাে দিনের কিছু রাগ, যন্ত্রণা, আনন্দ, রােমাঞ্চ মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে থাকে সব সময়। সে স্মৃতি, তা সুখের বা দুঃখের যা-ই হােক না কেন, গােটা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় তাকে। যন্ত্রণার স্মৃতি বিষণ্ণ অপরাধী করে মানুষকে, আর সুখস্মৃতি সম্বল করে অনায়াসে সে কাটিয়ে দিতে পারে গােটা জীবন। নবীন ওরফে বুড়াের দুই স্মৃতিই মজুত ছিল সমান তালে, ফলে তাঁর চরিত্র যে ভালােমন্দ, আলােআঁধারির অদ্ভুত এক মিশেল ছিল, তা টের পেয়েছিলাম কিছুদিন পর থেকেই।

নবীনের সমকামিতার শিকার হয়ে মানসিক এবং শারীরিক ধকল সওয়া সত্তার সারতে সময় লেগেছিল বহুদিন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রলেপ পড়ে যায় মনের ক্ষতে। শরীরেও ক্ষত লাউদোহা হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা মিলে বহুদিন পরিশ্রম করে লেগে থেকে থেকে সারিয়ে ছিলেন। মানুষের মন অতি বিচিত্র বস্তু। অতীতের ভয়ানক স্মৃতি ভবিষ্যতে অনেক সময় রসালাে ও রােমাঞ্চকর বাঁচার রসদ হয়। নবীনের ক্ষেত্রে তা হয়তাে ঘটে থাকতে পারে, আমার জানা নেই। তবে ওর বহুগামীতা এবং পুরুষ ও নারী শরীরের প্রতি সমান আকর্ষণ টের পেয়েছিলাম সে বয়সেও। একটা সময়, আমি তখন বয়ঃসন্ধিক্রমে। গনগনে দুপুরে যখন সকালে স্কুল হয়ে দশটার মধ্যে ছুটি হয়ে যেত তখন ঝাঁঝালাে রােদ উপেক্ষা করে (সে বয়সে ও সেকালে শীত গ্রীষ্ম বােধ থাকত না তত।) একটা হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডাে গেঞ্জি পরে দিব্যি গােটা দুপুর ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিতাম । জ্বর ব্যাধি কবে হয়েছে ঠিক মনে পড়ে না। সেখানকার গরম ছিল শুকনাে । বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা প্রায় ছিল না বললেই চলে, সুতরাং ঘাম হতো না। যদিও টো টো করে বখাটেদের মতাে ঘােরার কারণে মায়ের বকুনি ছিল আমার নিত্য সঙ্গী। কত বাড়ির দরােজা জানালার ফাঁক দিয়ে কত ঘরের ভিতরে উঁকি মেরেছি। কত কী অবাঞ্ছিত দৃশ্য দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। মানুষের শরীর, জন্ম বৃত্তান্ত ইত্যাদি নিয়ে সবে মাত্র কৌতূহলী হতে শুরু করেছি তখন। বুঝতাম  এগুলি জীবনের চরম সত্যি ও ব্যাপারগুলির মধ্যে তীব্র  উত্তেজনা এবং রােমাঞ্চের রসদ আছে। শারীরিক ও  মানসিক মুরােদ তখনই ছিল না যদিও। বড় হওয়ার স্বাদ আমি পেয়েছিলাম অবশ্য যথেষ্ট বড় হওয়ার পর। এবং যা কিছু ঘটেছে সিদ্ধ পথেই ঘটেছে। অবৈধতা যে   এক একটা  মাইন্ডসেট এবং সবার দ্বারা সম্ভব নয় তা টের পেয়েছিলাম বড় হওয়ার পর।

নবীনের বহু ধরনের যৌন বিকৃতির সাক্ষী আমি নিজে। ওর বেড়ার দরজার ফাঁক দিয়ে একাধিকবার উঁকি মেরে সময় সে সব কিছু দেখেছি।   কুচডিহির মোড়ের সাইকেল গ্যারেজের বছর বাইশেকের একটা  ছেলের  সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল।  সেটাও টের পেয়েছি একদিন হঠাৎ করে। এর পিছনে যে কী মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে তা নিয়ে পরে বহুদিন ভেবেছিলাম আমি, কিন্তু কোনাে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। প্রথমে নবীনের ছােটবেলায় তার বাবার কর্মকাণ্ড, তারপর তার নিজের জীবনে যৌন লালসার শিকার হওয়া, এই দুই-ই কি জেনেটিক ও পরিবেশগত কারণ ছিল  এ বিকৃতির ? যা এতদিন অবচেতনে থেকে তারপর সময় ও সুযােগ বুঝে মাথা চাড়া দিয়ে জীবন উপভোগের এক উপাদান হিসাবে দেখা দিয়েছে তাঁর জীবনে ? হতেও পারে হয়তাে ! আজকাল অবশ্য এগুলিকে স্বাভাবিক যৌনতার ভিন্ন রূপ মেনে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । সবই নাকি এক একটা ওরিয়েন্টেশন। প্রাথমিক দুবিধা আমারো ছিল এ বিষয়ে মত বিনিময়ের। পরে ভেবে দেখেছিলাম যৌনতা (তা সে তথাকথিত স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যাই হােক না কেন) মানব জীবনে এক সত্যি, স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। এক্ষেত্রে  যা সত্যি তা  চিরকালীন সত্যি, যা মিথ্যে তা মিথ্যে ।হতেই পারে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার বিশ্বাসযােগ্যতা গ্রহণযােগ্যতা বাড়ল বা কমলো।  দেহতত্ত্বে কোনটা ভালাে কোনটা মন্দ তার লড়াই অতীতেও ছিল আগামীতেও থাকবে। আমরা সেই লড়াইয়ের ময়দানে  এক একজন পদাতিক সেনা বই কিছু নই । 

নবীনের যৌনতার বাইরের জীবনচর্চা যেমন আমাকে আনন্দ দিয়েছিল, তার বিকৃত যৌনতা আমাকে পীড়াও দিয়েছিল সমানভাবে। অস্বীকার করব কোনটাকে?  লাউদোহায় সে সময় থেকে প্রায় ন'বছর ছিলাম আমরা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা অনেক রূপ দেখেছি তার। কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। অতীতের কত স্মৃতি ফিকে হয়েছে। ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতিরা মন ও মস্তিষ্কের সায় নিয়েই ফিকে হয় কারণ তখন তার থেকে মন ও মস্তিষ্কের প্রাপ্তিযােগ কিছু নেই। তারা প্রতিটি জিনিস মেপে করে, মেপে ভাবে। তাদের সঙ্গে চালাকির উপায় নেই।  লাউদোহা ছেড়ে আসার পর একবার মাত্র সেখানে গেছিলাম বারাে বছর পর। স্বাভাবিক কৌতূহলের বশে থানার পিছনের জায়গাটাও দেখতে গেছিলাম। নবীনের সঙ্গে নয়, দেখা হয়েছিল ননীবালার সঙ্গে। তার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম নবীনের মৃত্যুর কথা। এডস হয়েছিল তাঁর। তিনি নিজেও এইচ.আই.ভি ক্যারিয়ার, তবে রােগ বাসা বাঁধেনি তখনও তাঁর শরীরে। এক মানুষের মধ্যে আর এক মানুষের সন্ধানের বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয়েছিল সেদিন। সে কারণে বিশ্বাস ভঙ্গের হতাশা আমাকে গ্রাস করেছিল কি না সে নিয়ে এখনও ভেবে চলেছি আমি।  আর কি'ই বা পারি?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments