জ্বলদর্চি

বিশ বিশ পঁয়তাল্লিশ /(উৎসব ১৪২৮)/প্রতিমা রায়

বিশ  বিশ  পঁয়তাল্লিশ 
প্রতিমা রায় 


এক,
ওরা দুজন। একজনের পঁয়তাল্লিশ ছুঁয়েছে, আর একজন ছুঁইছুঁই । একজন গান গায়তো, সুরের প্রতি ছিল নিবেদিত প্রাণ সেজন্য সে গানওয়ালী, অন্যজন ছবি আঁকতো। তার ছবির ভাষা কথা বলতো তাই সে ছবিওয়ালী। একজন কাঞ্চনবর্ণা,স্টাইলিশ। অন্যজন গুণে সরস্বতী, পড়াশোনার প্রতিটি ধাপে প্রথমভাগে উত্তীর্ণা। 

ওদের দুজনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। পঁচিশ বছর আগে। কলেজে পড়তে এসে। দুজনেই গোপনন্দিনী, গোপকলেজে ভর্তি হয়ে কলেজের ভেতরে সংলগ্ন হোষ্টলে থাকত। হোষ্টলে এসে দুজনেরই খুব মন খারাপ। ঘরের স্নেহশীতল ছায়া এখানে নেই, ইচ্ছে মতো খাওয়া ঘুমোনো নেই। সেই সঙ্গে মায়ের বকুনি নেই, বাবার আদর নেই। নেই নেই অনেককিছু নেই। আবার নতুন অনেক কিছু ছিলও। নিজস্ব রুম, নিজস্ব বেড, নিজের হাতে বই গোছানো বড় হওয়ার স্বাধীনতা ওদের মতো সমবয়সী একদল মেয়ের সাহচর্য , অবসরে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টা, খাবার শেয়ার, পছন্দের হলে জামাকাপড় বদল, সিনেমা দেখা, অনেক গোপন আলোচনা । পরিবার ছেড়ে এসে হোষ্টলে মন খারাপ করলে, হোষ্টলের বন্ধুরাই পাশে এসে দাঁড়ায় । একসময় ওরাই কাছের জন হয়ে ওঠে। তবে ওরা দুজন দুজনের বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেলো। গানওয়ালীর গান গাইলে, ছবিওয়ালী মাথা নাড়ায়, মন দিয়ে শোনে, কখনো বলে- আরেকটা শোনা না রে। ছবিওয়ালী আঁকতে থাকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে গানওয়ালী  তারিপ করে বলে- কি করে পারিস রে। কলেজেও দুজনের সুনাম হয়। কোন অনুষ্ঠান হলে ছবিওয়ালী মঞ্চ সাজায়, তার ছবি দিয়ে ডেকোরেশন করে। আর গানওয়ালী সেই মঞ্চে সুরেলাকন্ঠে সুরের মূর্ছনা ছড়ায়। গানওয়ালী ছবিওয়ালীর গলায় গলায় ভাব দেখে অন্য বন্ধুদের হিংসে হয়। মনে মনে জ্বলে পুড়ে যায়, গানওয়ালী হাসে, ছবিওয়ালী বলে- আয় শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা এখানে আমাদের ভবনের সামনে ঝাউয়ের চারা পুঁতি। দুজনে সার দেব, জল দেব তিন বছরে অনেকটা বড় হয়ে যাবে। গানওয়ালী বলে- তারপর কি হবে?

ওতে দুজনের নাম লিখে দিয়ে যাবো। বছর বছর যারা আসবে তারা আমাদের নামগুলো দেখে আমাদের কথা জানবে, আমাদের স্মৃতি থেকে যাবে, বন্ধুত্ব অমরত্ব পাবে।

তারপর আমারাই যদি নিজেদের ভুলে যাই, তাহলে কি হবে? 

মাথা নাড়ায় ছবিওয়ালী । ধূর্ মানুষ তার কলেজ লাইফকে কখনো ভোলে না। জীবনের গোল্ডেন সময় নাকি এটা। বড়দের বলতে শুনেছি- তুমি ওই কলেজে পড়ো? ওটা আমারও কলেজ ছিল। এটা এখনো ওখানে হয়? ওটা এখনো আছে। অনেকবছর পরেও পাশ দিয়ে গেলে নিজের কলেজটাকে একবার অন্তত দুচোখ ভরে দেখে মন্তব্য করে- কলেজটা অনেক বদলে গেছে । আমাদের সময়,,,। নিজের বদলে যাওয়ার ভেতর – গোল্ডেন সময়টা আসলে উঁকি দিয়ে দেখতে চায় । খুব মিস করে।

তবে চল ঝাউয়ের গাছটা লাগিয়েই ফেলি।
ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে গাছ লাগানো হলে, বিকেলে কলেজ ছুটির পর নিজেদের রুমে যাওয়ার আগে ভবনের ঢোকার মুখে ওরা গাছটা রোজ দেখে যায়। কখনো সকালে বিকেলেও দেখতে আসে। 
সময় পার হয় । হোস্টেলের বাউন্ডারির ভেতর ঝুরিনামা বট, সেগুন মেহগনি ছাতিম দেবদারু রাধাচূড়ারা আলো করে আছে, জামরুল বেল আম সফেদা গাছে সময়মতো ফল ধরে। পাখি গায় মহা আনন্দে, পাঁচিলের পাশে বয়ে যাওয়া কাঁসাইনদীতে ঢেউ ওঠে। পুরানো রাজবাড়ি সাজিয়ে কলেজ সঙ্গে হোষ্টেল। গানওয়ালী বলে চল ঘুরে দেখি- নাচমহল, বাইজি মহল, হাওয়াখানা, রানীর গোসাঘর অতিথিশালা হাতিশালা, ঘোড়াশালা বাগানে গিয়ে মরনকুয়ায় কাছে গিয়ে গলা ফাটায়- কেউ আছো, অতীতের কেউ- উঠে এসো। ঝরোখায় রাজারানির দোলনায় বসে পা দোলায়। চেটেপুটে নেয় জীবনের সব রঙ রস। হাসে,লুটোপুটি খায়। একসময় এসব বোর লাগে। নতুন ফন্দী আঁটে। গানওয়ালী বলে দু চারটে ফল চুরি না করলে পোষায় না। ছবিওয়ালী বাধা দেয়, যদি ধরা পড়িস হোষ্টেল সুপার জানতে পারে, তোর কপালে দুর্ভোগ জুটবে। বাড়িতে গার্জেন কল হবে। 

দূর কিছু হবে না। চুরি করব, কেউ টের পাবে না, তবেই তো মজা। ছোটখাটো নয় হোষ্টলের পাঁচিলের কাছে কাঁঠাল গাছের নধর নধর কাঁঠাল পুরো সাফ হয়ে গেল, সুপারের নাকে গন্ধ গেল, গাছে কাঁঠাল নেই দেখে হা হা করে উঠলো। বাতাসে গানওয়ালীর নাম ভাসল। হোষ্টেল সুপার ছবিওয়ালীকে ডেকে পাঠালেন । জানতে চাইলেন- সত্যি কথা। ছবিওয়ালী আকাশ থেকে পড়ল, সে তো পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকে, কাঁঠাল কেন গাছটারই অস্তিত্ব জানা নেই। কেস ফিসলে গেল, সব বন্ধুরা মিলে হাততালি দিল।

ছবিওয়ালীর পেটে ব্যথা হলো, গানওয়ালী দেখভাল শুরু করলে, ডাইনিং থেকে লাঞ্চের খবার  তুলে নিয়ে এসে ছবিওয়ালীর রুমে দিলে, সুপারের কাছ থেকে ওষুধ এনে দিলে। বইপত্তর সরিয়ে বেড গুছিয়ে দিলে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মানে টিফিন টাইম। চা আর স্ন্যাকস। আর একটা জিনিসের জন্য সবাই চেয়ে । চিঠি। প্রিয়জনের, মনের মানুষের। তখন যে মোবাইল ফোন আসেনি। এই চিঠি সুপারের হাতঘুরে বেয়ারা দিয়ে যায়- অমুক মন্ডল, তুমুক বোস , রায়, মুখার্জি চিঠি এসেছে। গানওয়ালীর মন খারাপ তার কোনো চিঠি আসেনি। কতদিন হয়ে গেল, তাকে কেউ চিঠি পাঠায় না। সে মনের দুখে গায়- আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম,,,। ছবিওয়ালীর দরদী মন। বললে- মন খারাপ করিস না রে,  কালই আসবে তোর চিঠি দেখিস। বান্ধবীর মুখে ফোটে সোনালী আভা।

গানওয়ালী চুল বাঁধে তো ছবিওয়ালী চুল খুলে দেয় । গানওয়ালী চেঁচায়- শাহরুখ তো ছবিওয়ালী আমির, গানওয়ালীর শচিনের ছবি ঝোলালে ছবিওয়ালী সৌরভের ছবি নিয়ে  আসে। দুদিন কেউ কারো মুখ দেখে না, তিন দিনের দিন আবার ভাব।

দেখতে দেখতে গরমের ছুটি আসে। বাড়ি ফেরার আনন্দে সবাই নাচতে থাকে। জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেও মন খারাপ করে। এই কদিন দেখা হবে না , চিঠি লিখিস কিন্তু। 

হাঁ লিখব, তুইও লিখিস।
কতো কথা জমে, কত কিছু মিস হয় বাবা মার কাছে ফিরেও এই প্রথম অন্য কোথাও মন পড়ে থাকে। বাবা মার কাছে থেকেও এই প্রথম কোন জায়গার জন্য মন খারাপ করে, ঘুরে ফিরে সে জায়গার গল্প করে।
তিনবছর কোথা দিয়ে কেটে যায়। ফাইনাল ইয়ার। ফাইনাল পরীক্ষা। সবাই পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গানওয়ালী ছবিওয়ালীর চোখ পরীক্ষার দিকে।
 পরীক্ষার শেষদিন চোখ ভিজে যায়, গলা বুজে আসে।  তিনবছরের জার্নি শেষ। এবার ফেরার পালা। সবাই সবাইকে প্রতিশ্রুতি দেয়, যোগাযোগ রাখবো ভুলবো না। ঠিকানা দেওয়া নেওয়া, স্মৃতি হিসেবে ছোট উপহার দেওয়া  চলে। গানওয়ালী ছবিওয়ালীকে বলে- চল শেষবারের মতো ঝাউগাছটাকে দেখে আসি। গানওয়ালী বলে- এতো ঝাউয়ের মাঝখানে আমাদের গাছটা তো হারিয়ে যাবে, চিনবে কি করে?
ছবিওয়ালী মাথা নাড়ে, হারাবে না ওর গায়ে বেচ নম্বর লিখে দিলাম। এখন থেকে এই নম্বর  দিয়েই ও চিহ্নিত হবে।

দুই.
কতদিন তানপুরাটা নিয়ে বসিস না। এবার রেওয়াজটা একটু কর। গ্র্যাজুয়েশনটা তো হয়ে গেল।
মায়ের কথায় আবার গান নিয়ে জড়িয়ে পড়ে গানওয়ালী। গানে সেকেন্ড ইয়ারটা কমপ্লিট করবে। ছবিওয়ালীর আশানুরূপ রেজাল্ট নিয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়। সঙ্গে টিচারশিপের জন্য কোচিং। সময় নেই, দম ফেলার ফুরসত নেই। ক্যারিয়ারের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে তাকে। গানওয়ালী তার শহরে বসে গানের জগতে সুর তাল লয় মেলায়, ছবিওয়ালী আর ছবি আঁকার সময় পায় না, ভিন্ন শহরে পড়াশোনায় ডুবে যায়। সুতোর বাঁধন আস্তে আস্তে খুলতে থাকে, শীত আসতেই ঝাউগাছের পুরানো পাতাগুলো খসে পড়তে থাকে। গানওয়ালী আর চিঠি লেখে না, ছবিওয়ালীও আর উত্তর দেওয়ার সময় পায়না। ধীরে ধীরে শীত বিদেয় নেয়। বসন্ত আসে। গানওয়ালীর জীবনে এ বসন্ত বড় রঙিন লাগে, সে গায়- আজি দখিন দুয়ার খোলা, এসো হে এসো হে, এসো হে, আমার বসন্ত এসো,,,,। গানওয়ালীর মা গানওয়ালীকে ডেকে বলে- এবার তোর যত্ন নে মা। সামনের বোশেখেই ওরা দেখতে আসতে চায়। এমন সুপাত্তর আজকের দিনে পাওয়া যে মুশকিল। সরকারের উঁচু পদে চাকরি,বাড়ি গাড়ি খুবই ধনী পরিবার ওদের। গানওয়ালী বলে- আর একটু সময় দাও না মা। সময় আর পায় না। সামনের আষাঢ়ে নতুন জীবনে প্রবেশের দিন নির্ধারিত হয়। নিমন্ত্রণ জানিয়ে ছবিওয়ালীকে চিঠি লেখে, আমার এমন দিনে তুই আসবি রে। তোর আশায় পথ চেয়ে থাকবো।
 ছবিওয়ালীও আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। কিন্তু ততদিনে  সে মাস্টার্স করে চাকরির পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে। আমি যে খুব যেতে চাই, তোকে কতদিন দেখিনি,গানু রে ভেতরে কি কষ্ট হচ্ছে বোঝাতে পারবো না। সবে স্কুলে নতুন জয়েন করেছি, ছুটি তো পাবো না। আর তোর বাড়ি থেকে আমার বাড়ি যে অনেক দূর, গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফিরেও আসতে পারবো না। তোর জন্য অনেক শুভেচ্ছা শুভকামনা ও ভালোবাসা রইলো, নতুন পথ তোর সুখের হোক, আমি সময় করে ঠিক তোর ওখানে যাবো।

 সময় আর হয়ে ওঠে না। ছবিওয়ালীর স্কুলে চাপ দিন দিন বাড়তে থাকে। গানওয়ালী সুন্দর করে নতুন সংসার গোছায়, ঘর সাজায়। সারা ব্যালকনিতে কতরকমের গাছ বসিয়েছে- ফ্লেমিংগো, বোগেনিয়া,পিস লিলি কালানঞ্চো, জেসমিন, কেপ প্রাইম রোস। না, একটাও ঝাউয়ের চারা নেই। সারাদিন ঘর সংসারের কত কাজ, কত দায়িত্ব সামলিয়ে, ব্যালকনিতে আসে আর গুনগুন করে গান গায়। ছবিওয়ালীর সারাদিন স্কুলে একটার পর একটা ক্লাস থাকে, অফ পিরিয়ড থাকলে টিচার্সরুমে চা খেতে খেতে স্কুলের বাইরে তাকিয়ে দেখে- গেটের কৃষ্ণচূড়ায় রং ধরেছে, পাতাবাহার মণিকাঞ্চন জবারা গুছিয়ে সংসার করছে, কোথাও বৌ কথা কও পাখি ডেকে চলেছে, দূরে ঝাউয়ের গাছটা আর নজরে পড়ে না। ছাতিমের গন্ধ  নিতে নিতে বাড়ি ফিরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

তিন 
‘গোপনন্দিনী’ নামে হোয়াট অ্যাপ গ্রুপটা ওর হোয়াট অ্যাপে চলে আসে। ওদের ডিপার্টমেন্টের সোমা ওকে ফেসবুকে পেয়ে ফোন নম্বরটা নিয়েছিল, সেই ওকে অ্যাড করে দিয়েছে। ও ইনফো খুলে দেখে ওদের ইয়ারে হোষ্টলে যারা থাকত তাদের নিয়ে গ্রুপটা। আর সেখানে দেখতে  দেখতে  ইনফোতে একটা ফোন নম্বর ও পিকচারে ওর চোখটা আটকে যায়- ছবিওয়ালী! ও ও তো আছে! কতদিন পর যেন একটা বন্ধ দরজায় আবার কেউ কড়া নেড়ে দেয়। ভালো করে ওর পিকচারটা দেখতে দেখতে সোমাকে থ্যাংকস দেয়,এই গ্রুপটা খোলার জন্য।

ওর নম্বরে কি ফোন করবে? না সেটা ঠিক হবে না, এতদিন পর ও যদি বদলে গিয়ে থাকে, গ্রুপে আছে বলে শুধু কথাটুকুই হয়তো বলবে, আগের মতো ফিরে পাওয়া সে নাও হতে পারে, ব্যালকনিতে দোলনায় পা দোলাতে দোলাতে অতীত স্মৃতির ভেতর নিজেও দোল খেতে থাকে গানওয়ালী, স্মৃতি বড় মায়াময়!

কিন্তু সন্ধ্যের মধ্যেই ফোনটা বেজে ওঠে, ধরতেই ওপ্রান্তে সেই পঁচিশ বছর আগের গলা ভেসে আসে- আমি ছবিওয়ালী বলছি রে, চিনতে পারছিস? কেমন আছিস বল। গানওয়ালীর ভেতরে উচ্ছ্বাস ভরা নদীর মতো খলবল করে ওঠে,- ভালো। তুই কেমন আছিস বল? কথা গড়াতে থাকে সেকেন্ড মিনিট ঘন্টায়। এরপর থেকে প্রতিদিন, নিয়ম করে।

হাঁ রে গানু তোদের বাড়িটা তো শিয়ালদার দিকে, আমি একটা কাজে যাচ্ছি আসতে পারবি দুজনে তাহলে মিট করব। 
হাঁ কেন পারবো না, কিন্তু বাড়িতে আয় না ছবু।
সে পরে যাবো, আগে আয় না ওখানে কোন রেস্টুরেন্টে বসে একটু গল্প করি।

ভেতরে ভেতরে তোলপাড় হতে থাকে দুজনেই, কি নেবে গানুর জন্য উপহার হিসেবে! ও তো ধনী পরিবারের বৌ, গিফট যদি পছন্দ  না হয়, গানু  ভাবে- ছবু এখন স্কুলের দিদিমণি, গিফট যদি ওর রুচির সাথে না যায়! কেউ কিছু  গিফট নেয় না খালি হাতেই দেখা করতে আসে। একটু আগেই গনু পৌঁছে গেছে রেস্টুরেন্ট কাম ফুড প্লাজাতে। প্রায় তখনই আসে ছবু, পরনে মানানসই সিফন, খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে, ম্যাচিং সানগ্লাস আর ভ্যানিটি ব্যাগে কি ক্রেজি লাগছে ছবুকে। আরহ গনু যে এভারগ্রিন সুন্দরী। কানে হীরের কুচি, হাতের ব্রেসলেটে অনামিকার রিং এ হীরে জ্বলজ্বল করছে, দক্ষিণী সিল্ক শাড়ীতে মাথা ঘুরিয়ে  দেওয়ার মতো  সুন্দর। গনু! চোখে মুখে খুশি ঝলসে ওঠে ছবুর। চল ভেতরে গিয়ে  বসি।
গনুর পাশে পাশে ছবু, নাকি ছবুর পাশে পাশে গনু কে জানে? এই লাউঞ্জটুকু পেরিয়েই প্রথম টেবিলটা ওদের। ওদের থেকে ডিসটেন্সে অন্য সব টেবিল। তবু যে পথ ফুরোয় না। টেবিলে বসে গনু বলে- দাঁড়া আগে অর্ডারটা দিয়ে দিই।

না, তুই কেন আমি দেবো আমি ডেকেছি না। 
না রে আমি দেবো। শেষে দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠে- চল দুজনেই অর্ডার করি।

দুজনেই দুজনকে দেখতে থাকে। দুজনের জীবনেই কতগুলো দিন চলে গেছে, এই দীর্ঘ অদেখা তাদের স্বভাবে কি একটু আড়ষ্টতা এনেছে? গনু মেপে কথা বলে, ছবু সমঝে চলে। দুজনেই ভাবতে থাকে এ জীবনে ও বোধহয় বেশি সুখী। টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে যায় ওয়েটার। হঠাৎই ছবু বলে- এই খাবারগুলোতে একটা ফ্রাই ককক্রোচ ফেলে দিই, কি বলিস ছবু।
এই কথায় হঠাৎ বাজ পড়ার শব্দে চমকে ওঠার মতো চমকে ওঠে গনু। ওরে ছবু রে তুই যে একেবারে আগের মতোই আছিস রে। কলেজে সরোজদার ক্যান্টিনে খাবার খেয়ে পয়সা না দিতে তুই তো এই কান্ডই করতিস। সরোজদা বদনামের ভয়ে প্রায়ই পয়সা ছেড়ে  দিত। আর আমারা কি খুশি হতাম। 
মিচকি হাসে ছবু। তুইও তো আগের মতোই আছিস রে গনু। আমি নেমেছি তুই দেখিসনি। তখনই দেখলাম তুই লাউঞ্জে লাগানো প্লান্টগুলোর থেকে একটা তুলে  নিজের হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে দিলি, সেই কাঁঠাল চুরির মতো।

মানে ছবু তুই দেখেছিস?
মাথা নাড়ে ছবু। হা হা করে হাসতে থাকে গনু। এতক্ষণে টেবিল ছেড়ে উঠে এসে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে আবারও হিহি করে হাসে। একেবারে প্রান খোলা হাসি। গনু বলে একদিন কলেজে যাবো রে আমারা। ঝাউয়ের গাছটা নিশ্চয় ব্যাচ নম্বর বললে চিনতে পারবে। এখন তো ব্যাচ নম্বর হিসেবেই আমাদের পরিচয়।

 পাশের টেবিল থেকে অন্যরা ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখতে থাকে-  পঁয়তাল্লিশ অবয়বের দুই নারী যেন বিশ বছরের যুবতীর আবেগে হেসেই চলেছে । পঁয়তাল্লিশ হেরে যাচ্ছে ফেলে আসা বিশ বছরের কাছে।।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments