জ্বলদর্চি

কিছু স্মৃতিময়তা ( দ্বিতীয় পর্ব ) /দেবলীনা চক্রবর্তী

কিছু স্মৃতিময়তা ( দ্বিতীয় পর্ব ) 
দেবলীনা চক্রবর্তী

প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ক্যালেন্ডারে এই তারিখেই নির্দিষ্ট থাকে  বিশ্বকর্মা পূজার দিনটি। আর ছোটবেলার স্মৃতি উস্কে দিলে এই দিনটির তাৎপর্য অমোঘ। বিশ্বকর্মা পুজো মানেই আকাশ - বাতাস ভরা পূজোর গন্ধ , পুজোর ছুটি পাওয়ার আনন্দ , কেনাকাটা ,চোখের সামনে গড়ে ওঠা প্যান্ডেল ও ঠাকুর তৈরি দেখা শুরু হয়ে যাওয়ার তাড়না।

পুজোর দিন বাবার সাথে রেল ইয়ার্ডের এতোবড় বিশ্বকর্মার মূর্তি দেখতে যাওয়া আর দেব কারিগর সম্বন্ধে বিস্ময় মাখানো কত গল্প শোনা সাথে প্রসাদ খাওয়া দারুণ মজার। কারণ ওই একদিনই নিজের কাজের এক্তিয়ারে প্রবেশ করতে দিত বাবা, কলিগদের সাথে, তাদের পরিবারের সাথে কথা বার্তা ও শুভেচ্ছা বিনিময় হতো সকলের। যেহেতু এই দিনেই বাবার সারাদিন ছুটি তাই এই দিনেই পুজোর কেনাকাটার জন্য প্রতটি বছর ধার্য্য করা থাকতো। কিছু কেনা হোক বা না হোক বাটার দোকানে ঢুকে নতুন জুতো অবশ্যই কিনে দিত বাবা আমাদের দুই বোনকে , কিন্তু সত্যিই অবাক হই তার নিজের জন্য যে কখন আর কিভাবে গেঞ্জি - জামা - জুতো কেনার সুযোগ আসতো সেটা দেখতে পেতাম না ! বাবার জন্য এইগুলো কেনা ছিল বিলাসিতা কিন্তু আমাদের জন্য এগুলোই ছিলো আনন্দ ও উৎসবের প্রাপ্তি - প্রয়োজন। যেন সবই আমাদের অলক্ষে কোন এক আশ্চর্য প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসা জিন রেখে যেত মাথার শিয়রে !!

তারপর সারা বিকেল সন্ধ্যে বাজার তোলপাড় করে দুহাত ভরে জামা - জুতো কেনার পর ঠিক এ্যাব্বর মিষ্টির দোকানের সামনে এসেই আমার খুব পায়ে ব্যাথা করত আর দিদির ভীষণ জল তেষ্টা পেয়ে যেতো , বাবা আর মা আমাদের এসব ভন্ডামি বুঝে গিয়েও তৃপ্তি দেওয়ার জন্য ঢুকে পড়তেন  লাল সানমাইকা দেওয়া কাঠের টেবিল  - বেঞ্চ সাজানো দোকানঘরে যেখানে কাঁচের শোকেসে থরে থরে সাজানো মিষ্টি ও ভাজা। সেদিন অবশ্যই কচুরি বা সিঙ্গারা সাথে লালমোহন বা গরম রসগোল্লা দিয়ে পেট পুজো সেরে আমরা হতাম কত আহ্লাদী। 

 পুজোর আনন্দের দিন শুরু হওয়ার আভাস যেন পেয়ে যেতাম এই বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটিতেই।

এরপর আর একটু যখন বড় হলাম এই দিনের সাথে ভীষণ আনন্দের আরো একটা স্মৃতি জুড়ে আছে।
 এই দিন মানেই আকাশে ঘুড়ির মেলা। ভাদ্রের আকাশে সময় সময় মেঘের মেলা আর কখনও বৃষ্টি, কখনও রোদ। এরই মধ্যে বিশ্বকর্মা পূজার দিনে চলে ঘুড়ি ওড়ানোর পালা। সারা আকাশে যেন টুকরো রঙিন কাগজের কোলাজ।
 
 " পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা... 
.......
ঐ তো লেগেছে প্যাঁচ চাঁদিয়াল বগ্গায়।
শান্ দেওয়া মানজায়, বগ্গা ভো কাট্টা।
ছেলেটা চেঁচিয়ে ওঠে “এই নিয়ে আটটা”।

সুমন চট্টোপাধ্যায় এর সেই অব্যর্থ গান !
আকাশে ঘুড়ির প্যাচ খেলা।মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় একটা ঘুড়ি উড়িয়ে সেটা দিয়ে যে সবচেয়ে বেশি ঘুড়িকে প্যাচ খেলায় কেটে দিতে অর্থাৎ ভোঁ-কাট্টা করতে পারবে, সেই ঘুড়িই হবে বিশ্বকর্মা পূজার দিনের আকাশের রাজা।

একরঙা কত ঘুড়ি কেনার জন্য পড়ার দোকানে ভিড় জমতো। মুদি দোকানে ঘুড়ির ভান্ডার আলো করে থাকতো মোমবাতি, বগ্গা, পেটকাটি, চাঁদিয়াল । থাকতো লাটাই ভরা মাঞ্জা সুতো। এছাড়াও ক্যালিকট , জেভিকট সুতো কিনে এনে মাঞ্জা দেওয়ার জন্য সারা বাড়িতে কর্মযজ্ঞ লেগে যেতো। কাঁচগুড়ো, সাবু, অ্যারারুট, ক্যামেলের রং জোগাড় করা এবং তারপর সেসব মিশিয়ে জাল দিয়ে তৈরি করা সেই মাঞ্জা ! বাড়িতে আমার থেকে বড় দুই দাদা কত তদবির করে মা , জেঠিমার কাছ থেকে বাটি চামচ উনুন ম্যানেজ করে তৈরি করতো সেই মাঞ্জা। আর আমি সাথে আমার এক বোন ছিল ওদের সাগরেদ এদিক ওদিক নানা কাজের হেল্পিং হ্যান্ড!  তারপর বাড়ির উঠোনে বা ছাদে খুব সন্তর্পনে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া হতো। আর আসে পাশের বাড়ির বন্ধুদের সাথে চোখের ইশারায় বোঝানো হতো আগে সুতো রেডি হোক তারপর দেখে নেবো তোদের ঘুড়ির লড়াইয়ে । এর মাঝে যদি বৃষ্টি নামে তো হুড়োহুড়ি পরে যেত সেই সুতোকে বাঁচাতে। আর আকাশের দিকে নজর রেখে, মেঘের পরিমাণ,আয়তন লক্ষ্য করে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতাম নাওয়া - খাওয়া ভুলে কতক্ষণে বৃষ্টি থামবে!

আর অপেক্ষা করা হতো ঘুড়ির লড়াই আকাশে কতটা জমে উঠবে। আর কে কটা ঘুড়ি কাটতে পারলো, শুধু তাই নয় কোন বাড়ির ছাদে,পাঁচিলে না কোন গলিতে কাটা ঘুড়ি পড়েছে তা সংগ্রহের হুড় পরে যেত।  আর কে কত জোর আকাশ - বাতাস কাঁপিয়ে সেদিন বলতে পারবে "ভো কাট্টা" ... "দু-ও"!

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments