জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা (ইথিওপিয়া)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা (ইথিওপিয়া) – ৫৬

চিন্ময় দাশ

রাজা কতো বোকা

সবে সকাল হয়েছে। মাটিতে, নদীর জলে, গাছের পাতায় এসে পড়েছে কাঁচা সোনার মত ঝকঝকে রোদ। বাতাসও বইছে মৃদু মৃদু। একটা সোনাব্যাঙের মনে হল, গলা ছেড়ে একটা গান পাওয়া যাক।

গান ধরবে বলে গলাটা ফুলিয়েছে, হঠাৎ দেখে,  সামনে সাক্ষাৎ যম। পেটের সব বাতাস বেরিয়ে গেল ভুস করে। হাত- পা কাঁপতে লাগল ঠক-ঠক করে। কিন্তু ভড়কে গেলে চলবে না। বউ-বাচ্চারা আছে বাসায়। মারা পড়লে, তাদের কে দেখবে? মাথা ঠিক রাখতে হবে এখন। 

আঁচড়ে কামড়ে পাশের একটা গাছে উঠে পড়ল বেচারা। উপর থেকেই বলল—পেন্নাম হই, রাজামশাই!  
আসলে হয়েছে কী,  একটা সিংহ আসছিল সেই পথ দিয়ে। দিন দুই পেটে কিছু পড়েনি। তাই সকাল সকাল বেরিয়েছে শিকারের খোঁজে। সিংহকে দেখে, সেলাম ঠুকে দিয়েছে ব্যাঙটা।

কথাটা কানে গেল বটে, কাউকে চোখে পড়ল না সিংহের। বলল-- কেরে? সামনে আয়।
হঠাৎ অত বড় জীবটাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল ব্যাঙ। এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। এমন সোনার বরণ আলো। ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস। বদবুদ্ধি চেপে বসল পুঁচকেটার মাথায়। ভাবল, রাজার সাথে একটু  মস্করা করা যাক। এমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে। ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। লাফ দিয়ে নেমে পড়ল সে।
ছোট্ট সোনাব্যাঙটাকে তাকিয়ে দেখল সিংহ। বিরক্ত হয়ে বলল—কী হল? দাঁড় করালি কেন, হতভাগা?  
-- আহা, চটবেন না। মানে, এই সাতসকালে কোথায় চলেছেন, জানতে চাইছিলাম।
-- পেট চুঁইচুঁই করছে। শিকারে বেরিয়েছি। তা, তুই কে, সেটা বল দেখি। 
ব্যাঙ দেখল, নিজেকে জাহির করবার, এই মওকা। বেশ গুমোর দেখিয়ে বলল—এই বনে, নদীতে যত ব্যাঙ আছে, আমি হলাম তাদের রাজা। তবে, আপনি হলেন আমারও রাজা। বন-পাহাড়ের সবার রাজা আপনি। 
শুনে সিংহের তো হাসিতে পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড়। জোর একচোট হেসে নিয়ে, ধমক দিয়ে বলল—রাজা কাকে বলে, তুই জানিস, হতভাগা? 
সিংহের ধমকে আকাশ কাঁপল, বাতাস কাঁপল, নদীর জলও। নদীর ওপারেও সবাই শুনল সেই হাসি। কিন্তু কাঁপল না শুধু ব্যাঙটা। 
সে আবারও গুমোর দেখিয়ে বলল--  হতে পারেন আপনি রাজা। হতে পারেন বড়ও। তাই বলে ছোটদের নিয়ে হাসি আপনার ঠিক নয়।
সিংহ রেগে গিয়ে বলল-- মানে? কী বলতে চাস তুই? 
ব্যাঙ বলল—দেখুন না, এইটুকুন একটা ঘুঘু পাখি। সেও উড়ে নদীটা পার হয়ে যেতে পারে। আপনি তো রাজা। আপনি পারেন? 
-- উড়তে যাব কেন রে? লাফিয়ে পার হয়ে যাব। বললি, তুইও তো না কি রাজা। তুই পারবি নদীর ওপারে যেতে? জলে নামলে তো কোথায় ভেসে যাবি স্রোতের টানে, তার নাই ঠিক।

ব্যাঙ দমবার পাত্র নয়। সে বলল—জলে নামতে যাব কেন। সরু আর লম্বা পাগুলো আছে কী করতে? এক লাফে গিয়ে পড়ব ওপারে।
-- হায় ভগবান!  আজ দেখছি পেট ফেটেই মরতে হবে আমাকে। বেদম হাসতে লাগল সিংহ। তারপর হাসি থামিয়ে বলল--  লাফিয়ে নদী পেরোতে হবে না আর তোকে। কপ করে গিলে ফেলছি। পেটের ভিতরে গিয়ে যত খুশি লাফালাফি কর ব্যাটা।
একটু তফাতে সরে গিয়ে, ব্যাঙ বলল—বনের রাজা কি না একটা ব্যাঙ খাবে? তাতে মান থাকবে তো রাজার? ভেবে দেখুন। 
বেয়াদপীর সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাঙটা। এদিকে পেটও চুঁই-চুঁই করছে। সিংহ কথা না বাড়িয়ে বলল--  ঠিক আছে। আয়,  লাফ দে। দেখি তোর দৌড়। 
এক হাত জিভ কেটে, ব্যাঙ বলল-- ছি-ছি, রাজার আগে প্রজা? তাই আবার হয় না কি? আগে আপনি। আপনার পিছনে আমি।

সিংহ যেই লাফাবে বলে পা ভাঁজ করেছে,  টুক করে ছোট্ট একটা লাফ দিল ব্যাঙটা। সিংহের লেজের এক গোছা চুল কামড়ে ধরে রইল শক্ত করে।
সিংহের চোখেই পড়ল না পুঁচকেটার কান্ড। লম্বা এক লাফে গিয়ে পড়ল নদীর ওপারে। ব্যাঙ তো সিংহের পেছনেই ঝুলছিল। লেজের ঝটকায় ব্যাঙটা পড়ল আরও খানিকটা তফাতে।
সিংহ মুখ ঘুরিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। হলোই বা পাহাড়ি সরু নদী, তাই বলে ব্যাঙ কি আর লাফিয়ে পার হতে পারে না কি? নিশ্চয় জলে পড়ে গেছে ব্যাটা। চালাকি করে,  ডুব সাঁতার দিয়ে পারে এসে উঠে পড়বে।
কিন্তু লেজের ঝটকা বলে কথা। ব্যাঙ তো এসে পড়েছে সিংহের পিছনে,  আরও খানিকটা দূরে। সে বলে উঠল—জলে কী দেখছেন, রাজামশাই?  আমি আপনার পিছনে এসে পড়েছি। আপনি রাজা। মেপে বলুন, কে বেশি লাফিয়েছে? কার পায়ে কত জোর?   
দেখে শুনে সিংহ তো থ। কথা যোগাচ্ছে না মুখে। ব্যাঙ বলল—ঠিক আছে, লাফের কথা বাদ দিন। খাওয়ার বিচার হোক। আসুন, দু’জনে বমি করি। দেখি, কার পেটে কী আছে। কে কী খেয়েছে গতকাল?
দু’দিন পেটে কিছু পড়েনি সিংহের। সামান্য একটু তরল ছাড়া, কিছুই বেরুল না তার মুখ দিয়ে। মাটিতে পড়বার সময় ঝটকা লেগে, সিংহের লেজের কয়েক গাছি চুল রয়ে গেছিল ব্যাঙের মুখে। সেগুলোই বের করে দিল ব্যাঙ। 

সিংহ দেখে বলল—ওরে ব্যাটা, এগুলো কী?  
কাঁচুমাচু গলা করে, ব্যাঙ বলল-- রাজামশাই, কী বলব আপনাকে। পাঁচ-ছ' জনের সংসার আমার। আমাকেই খাবার জোগাড় করতে হয় সকলের। কাল একটা সিংহ শিকার করেছিলাম। বউ আর বাচ্চাদের দিয়ে, মুড়ো আর লেজটাই জুটেছিল আমার কপালে। এখন দেখছি, লেজের চুলগুলো পেটে রয়ে গেছল। হজম হয়নি। 
কী সাংঘাতিক জীব রে, বাবা?  আর একটিও কথা নয়। এক লাফে সিংহ বাবাজী কতটা দূরে গিয়ে পড়ল। তারপর দৌড়। আহা, সে কী চোঁ-চোঁ দৌড়। দৌড়তে দৌড়তে সামনে দেখল একটা পাহাড়। পাহাড়ে চড়তে শুরু করেছে, তখন এক শেয়ালের সাথে দেখা।
শেয়াল অবাক হয়ে বলল—ব্যাপারটা কী, রাজামশাই? অমন দৌড়োচ্ছেন কেন? 

কাউকে একটা দেখতে পেয়ে, একটু ধাতস্থ হল সিংহ। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল-- বিপদ, পন্ডিত। ভারী বিপদ। 
--আপনি রাজা। আপনার আবার বিপদ কী? 
একটু দম নিয়ে, সব কথা খুলে বলল সিংহ। শুনে শেয়াল তো হেসে বাঁচে না। সিংহ রেগে গেল হাসি দেখে—অমন দূরে দাঁড়িয়ে হাসতে আমিও পারি। সামনা-সামনি হলে, তখন বোঝা যায়, কে কত বড় বীর!
--একটা ব্যাঙের গালগল্প শুনে রাজা ভয় পাচ্ছে। শুনলে কী বলবে সবাই? শেয়াল বলল-- চলুন, আমিও যাচ্ছি।
মাথায় রাগ চড়ছিল সিংহের। এবার খানিকটা ভড়কে গেল সে। আবার সেই ব্যাঙের সামনে যেতে হবে? বলল-- দোহাই, পন্ডিত। বাহাদুরি দেখাতে হয়, তুমি যাও। আমি আর ওদিকে যাচ্ছি না।
শেয়ালের মাথায় জেদ চেপে গেছে। সে বলল—নিজের চোখেই দেখবেন, চলুন। থাবার নিচে চেপেই, সাবাড় করে দেব বদমাসটাকে।
তবুও সিংহ রাজি নয় দেখে, শেয়াল বলল—ব্যাঙের গলা চেনেন না? সূর্য ডুবলেই সবাই মিলে গান জুড়ে দেবে— কেমন মজা, কেমন মজা। ব্যাঙের ভয়ে পালায় রাজা।। বনের সব্বাইকে শোনাবে গেয়ে গেয়ে। তখন মুখ দেখাবেন কী করে?
সিংহ ভেবে দেখল, কথাটা ঠিক। শেয়ালকে বলল—ঠিকই বলেছ। তবে, আবার তেমন বিপদ হলে, তুমি তো সটকে পড়বে। আমার কী হবে? অত বড় চেহারা নিয়ে কোথায় লুকোব?  এমনিতেই বেশ হাঁপিয়ে গেছি। তাছাড়া, ব্যাঙের গলাটাই চেনো তুমি। লাফ তো দ্যাখোনি।

শেয়াল যখন হাল ছেড়ে দেবে ভাবছে, সিংহ বলল—ঠিক আছে। চলো, যাবো। বলেই, শেয়ালের লেজটাকে নিজের লেজের সাথে বেদম কষে দু-তিনটে গিঁট মেরে দিল সিংহ।
শেয়াল তো অবাক। বলল—এটা কী হল?  
সিংহের মুখে মুচকি হাসি—এবার আর কোন চালাকি, কোন ফন্দি খাটবে না তোমার। বিপদ বুঝলে, পালিয়ে আসবে—সেটি আর হচ্ছে না। যা হবার, দুজনের হবে।
সিংহ ভাবছে, ব্যাঙটা যদি এতক্ষণে নদীর ওপারে ফিরে গিয়ে থাকে, এ যাত্রাইয় বাঁচা যায়। শেয়াল ভাবছে, বনের রাজাকে কেরামতি দেখাবার এই এক মওকা পাওয়া গেছে। 

এদিকে, ব্যাঙ তখনও সেখানেই বসে আছে। সে ভাবছে, বাসায় ফিরে, রসিয়ে রসিয়ে রাজার বোকামির গল্প শোনাবে বউ-বাচ্চাদের।
হঠাৎই তার চোখ গেল সামনে। সিংহ আর একটা শেয়াল এগিয়ে আসছে গা জড়াজড়ি করে। তার মানে, আমার সব কেরামতি শেষ.। আর কোন চালাকি, কোন জারিজুরি খাটবে না পন্ডিতের সামনে।
একবার ভাবল, বাঁচার একটাই রাস্তা। টুপ করে একটা লাফ দিলেই হয় নদীতে। এক ডুবসাঁতারে ভোঁ-কাট্টা। সোজা নদীর ওপারে। তখন আমার নাগাল পায় কে? কিন্তু আবার বদবুদ্ধি চাপল মাথায়। আর একবার বেকুব বানাতে হবে রাজাকে।

বাঘ আর শেয়াল প্রায় এসে পড়েছে, ব্যাঙ চেঁচিয়ে উঠল-- আরে, ব্যাটা শেয়াল। সারা বছরের খাজনা বাকি তোর। কাল সারাদিন বসে রইলাম। এক টুকরো মাংসও নিয়ে এলি না। আজও বসে আছি সেই কখন থেকে। ঘরে বউ-বাচ্চারা বসে আছে পথ চেয়ে। তোর টিকিরও দেখা নাই। যাকগে,  আজ তাহলে এই সিংহটাকে এনেছিস। মন্দ নয়, আজকের দিনটা চলে যাবে আমাদের।

সিংহের মাথায় চিড়িক করে উঠল। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসাটা তাহলে, শেয়ালের ফন্দি। ব্যাঙকে ভেট দেবে বলে নিয়ে এসেছে তাকে। কী বদমাস শেয়ালটা! 
আর কোন ভাবনা নয়।মুখ ঘুরিয়েই দে ছুট।
দিক-বেদিক জ্ঞান নাই সিংহের। ছুটেই চলেছে, প্রাণটুকু বাঁচাবার দায়ে। এদিকে শেয়াল তো লেজে গিঁট দিয়ে বাঁধা। রাস্তার পাথরে, গাছের শেকড়ে, খানা-খন্দে ঠোক্কর খেতে খেতে ঘসটাতে ঘসটাতে টানা হয়ে চলেছে বেচারা।
কত সময় ধরে, বা কতদূর ছুটেছিল সিংহ, সেটা ঠিক মত জানা নাই আমাদের। আসলে, একটু বাদেই ঘন বন আর পাথরের আড়াল হয়ে গিয়েছিল কি না দুটিতে, তাই।
তবে, নদীতে লাফিয়ে পড়ে, ডুবসাঁতার দিয়ে ব্যাঙের কেটে পড়াটা, নিজের চোখে দেখেছি আমরা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments