জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /মলয় সরকার

গুচ্ছ কবিতা 

মলয় সরকার

শেষ ইচ্ছা

আমাকে শুইয়ে রেখো উন্মুক্ত জমিতে। 
শববাহকেরা যেন
শ্মশানে করে না দাহ কিছুতে তখনি;
রৌদ্র তাপে শুষ্ক হবে, 
বৃষ্টি এসে স্নেহভরে ভেজাবে শরীর--
চন্দ্রের জ্যোছনা এসে 
রাত্রিশেষে হিমরেখা এঁকে যাবে নম্রভাবে 
ত্বকের উপরে, 
দূরে কোথা যামঘোষ হেঁকে যাবে অবিশ্রাম
প্রহরে প্রহরে, 
বাতাস শোনাবে তার রাতের বেহাগ রাগ
সুধা বর্ষি’ কানে, 
শান্তিতে একাত্ম হব জননীর বুকে।

প্রভাতে আমাকে দেখো-
সজীব নতুন প্রাণে শ্যামল শিশিরে, 
নরম শষ্পের সাথে নবীন আলোকে। 

ধন্য হব মাতৃক্রোড়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।



একটি নারীর বিষয়ে

কোনো এক নারীকে যখন দেখি আমি,
আমার চোখে সে হয়ে যায় এক
হরিণী, এক সুবর্ণময় মসৃণ মায়ামৃগী-
যার সুমধুর আকর্ষণে ছুটে যায়
জ্যামুক্ত শরের মত প্রলুব্ধ পুরুষ,
যন্ত্রণাদায়ক বিভ্রমে ছুটে চলে
মরীচিকার মত অলীকের পিছে।
জীবনের ছুটে চলা টাই তার কাছে
হয়ে ওঠে ধ্রুব সত্য, 
আসল লক্ষ্যটা পরিবর্তিত হয়ে যায়
কখন যেন চুপিসাড়ে-
কঠিন নিষ্ঠুর সত্যের মত
একটা মায়াময় উপলক্ষ্যে।
তাই অন্ধকার আকাশে হাউই এর মত
লক্ষ্যে পৌঁছানো আর হয়ে ওঠেনা কোনদিন।



ভাঙ্গা মন্দিরের প্রহরী

অন্ধকার ভাঙ্গাচোরা দেওয়ালখসা  পুরানো মন্দির-
দেববিগ্রহ অদৃশ্য হয়েছে বহুদিন,
মন্দিরের দেওয়ালে গজিয়ে উঠেছে
এখানে ওখানে কিছু গাছ ,
পুরানো কারুকাজ কিছু ভাঙ্গা, কিছু বিবর্ণ -
গর্ভগৃহে প্রদীপ জ্বলে না বহুদিন।
তবে জ্বলত যে একদিন-
তার প্রমাণ আজও ভিতরের দেওয়ালের গায়,
সিঁড়িটার ছাল উঠে বেরিয়ে পড়েছে
হাড় পাঁজর, 
ভক্তের পায়ের চিহ্ন পড়েনি বহুদিন-
তাই আসে না পূজারীও।
শুধু দেওয়ালের, অমোঘ সত্যের মত,
অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছগুলোই সত্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
প্রকৃত বর্তমানকে তুলে ধরতে।
আশে পাশের সাজানো বিতানকুঞ্জ কবে ভেঙ্গেচুরে একাকার,
আজ সেখানে শুধু কিছু আগাছার জঙ্গল আর
বিষাক্ত প্রাণীর আশ্রয়-- 

আর আছে কিছু ফাটলে ফোকরে
পায়রার বক বকম।
তারাই একমাত্র জীবনের প্রতীক হয়ে
জায়গাটাকে রেখেছে সজীব।

কিন্তু আশ্চর্য,
এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে
ইতিহাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মন্দিরের সামনে দ্বাররক্ষীর মত
সজীব এবং প্রাণবন্ত রয়েছে
একটি কারুকার্যখচিত 
প্রায় অবিকৃত ষাঁড়-
চোখে তার গর্ব ও আভিজাত্যের ছাপ
দেহেও, মন্দিরের সামনে
দেবতার রক্ষক হওয়ার গর্ব।


কিন্তু নির্বোধের মত,
তার জানা নেই
পিছন তার কবেই হয়ে গেছে ফাঁকা অন্তঃসারশূন্য।
শূন্যতার আঁধার ঢেকে ফেলেছে চতুর্দিক,

মূর্খের মত শূন্য বর্তমানের থেকে মুখ ঘুরিয়ে-
মিথ্যে অতীতকে আঁকড়ে বসে রয়েছে আজও।



স্বপ্নকুমারী


কত রাত্রির নিদ্রায় তুমি এসেছ আমার কাছে,
জানি না তোমার ঠিকানা কোথায় কোন মায়াপুরে আছে।
তোমার মায়ায় পরশে আমার স্বপ্ন নীলিমাময়,
নিশাশেষে উঠি প্রভাতে যখন মনে হারানোর ভয়।
হৃদয়ে শুনেছি স্বপ্ন কুমারী তোমার প্রেমের বাণী,
নিশার আঁধার তব অনুভব দেয় হৃদয়েতে  আনি।
উন্মনা ক্ষণে তোমার মননে কেটে গেছে কত ক্ষণ,
অলস দিবস বৃথাই কেটেছে বিক্ষত করে মন।
তবুও তোমার মোহপাশে আমি বদ্ধ মোহিনী বালা-
তোমার পরশে হৃদয় হরষে শান্ত ত্রিতাপ জ্বালা।


এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায়


ঘন নীলাম্বরে একা নিঃসঙ্গ পূর্ণিমা সন্ধ্যায়-
রজত নিন্দিত শুভ্র শশধর পূর্ণজ্যোতিস্মান,
শব্দহীন, মেঘশূন্য, বায়ু স্থির, একা বারান্দায়
চেয়ারে আসীন আমি, কুলুধ্বনি রবে বহমান--

ধীর স্রোতা স্রোতস্বিনী, কৃষ্ণবর্ণ, মসীমাখা গায়ে-
নিরুত্তর স্তব্ধ হয়ে কুলুগীতি একাগ্র শ্রবণে,
নদীপার্শ্বে বিটপীরা সার সার উচ্চশিরকায়ে
রজতচূর্ণকণিকা ঝরে পড়ে নিবিড় বিজনে।

দূরে কোথা যামঘোষ দলবদ্ধ ঘোষিছে প্রহর,
মূর্খ বিহগেরা দেখি জেগে ওঠে দিবসের ভ্রমে,
পূর্ণ শশী প্রকাশিছে শুভ্রতর, মুগ্ধ চরাচর-
নবযৌবনা যুবতী বিকশিছে যেন ক্রমে ক্রমে।

আমি একা স্তব্ধ নেত্রে নিরীক্ষণ করি চারিধার-
অরূপ রূপের স্পর্শে মায়াময় প্রকৃতির শোভা।
বাক্যহারা ভাষাহীন মোহময় সৌন্দর্য অপার
চন্দ্রাতপতলে রাজে অনুপম বিশ্বরাজসভা।



প্রার্থনা

জাগো হে পবিত্র মন আত্মার সঙ্গমে,
মুক্তি দাও চিরন্তন সমল চিন্তায়-
জাগো হে আলোক পদ্ম নবীন কিরণে,
দীপ্ত হোক অগ্নিশিখা অম্লান জ্যোতিতে।
বায়ু হোক শুদ্ধস্নাত পুষ্প অমলিন-
চন্দ্রালোকে ধৌত হোক প্রাণের মৃণাল। 
অবাতকম্পিত হোক চিন্তার বিদিশা,
অপাবৃত হোক যত সত্যের দীপিকা,
দূরে যাক অঘময়  অনৃত আচার-
মৃত্যুভরা বিভীষিকা হোক নির্বাসিত, 
জাগুক প্রেমের পদ্ম মৃত্তিকাধূলিতে।


অন্ধকারের রূপ

অন্ধকারের রূপ খুঁজে ফিরি আমি
নিঃসীম স্তব্ধতায়,
মনের অন্তহীন গাঢ় গভীরতায়
হাজার প্রশ্নের বুড়বুড়ি উঠে আসে
সেই তলদেশ থেকে-
নিরুত্তর থেকে যায় প্রায় সবাই,
হারিয়ে যায় আবার মিলিয়ে যায় নিঃশব্দেই অনন্ত নীলাভ মহাশূন্যে।

আমি নিজের মুখে নিজেই নুড়ো জ্বেলে
গিলে খাই শূন্য গহ্বর,
মহাশূন্য থেকে ভেসে আসে,  শুনতে পাই
অশ্রুতপূর্ব ওঁকারের অনর্গল মহানিনাদ--
হারিয়ে যায় আমার প্রশ্নোত্তরের পালা।

আমার আমিত্ব  বিলীন হয়ে যায় অনন্তের গভীরতায়।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments