নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব ---(২৩)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল
ধর্ম ও মানুষ
বস্তুজগতের অভিজ্ঞতায় চেতনার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের মূলে কিছুটা স্থান করে নেয় মিথলজির পরিবর্তে দর্শনচিন্তা। একেশ্বরবাদ, সর্বত্র বিরাজিত সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ সর্বস্রষ্টা ঈশ্বরের তত্ত্ব।
আদি-অন্তহীন, অকল্পনীয়, অনির্বচনীয়, নিরাকার ব্রহ্ম বা পরমেশ্বরের সংজ্ঞা। এ ভাবেই এদেশে অদ্বৈতবাদ এবং অন্য দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় দর্শনের উৎপত্তি হলো। কিন্তু তথাপি ব্যক্তিমানুষের ধর্মের গভীরে দর্শনের চেয়ে প্রাচীন কল্পকায়াগুলোই বেশি শক্তিমান হয়ে বেঁচে রইল। তাই মানুষ সর্বত্র বিরাজমান যে ঈশ্বর, তার উপাসনা করতে মন্দির মসজিদ গির্জায় যায়। দূর-দূরান্তে বহু ব্যয়ে এবং বহু কষ্টে তীর্থ করতে যায়। মানুষ বিশ্বাস করে ঈশ্বর উপাসনাস্থলে বা তীর্থস্থানেই বিশেষ ভাবে উপস্থিত থাকেন। আবার ঈশ্বর যদিও নিরাকার, তবুও মানুষ তার পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। তিনি যদিও অন্তর্যামী এবং মানুষের মনের কথা সবই জানেন, তথাপি উচ্চস্বরে এমন কি মাইক লাগিয়ে প্রার্থনা, মন্ত্রোচ্চারণ ভজন-কীর্তন, ধর্মগ্রন্থ পাঠ প্রভৃতির মাধ্যমে তাকে তুষ্ট করে তার কাছে অনুগ্রহ ভিক্ষা করা হয়। যাতে দূর থেকে শুনতে ঈশ্বরের কোন অসুবিধে না হয়।
এভাবে মানুষ জাগতিক দুঃখ-কষ্টে কিছুটা শান্তি সান্ত্বনা পায় বলেই সে ধর্মকে কিছুটা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজের জীবনে ধারণ করে। সে বিশ্বাস করে আদর্শ মানবিক গুণসম্পন্ন বিধাতা শেষ পর্যন্ত ন্যায় বিচার থেকে বিচ্যুত হবেন না। সব অমঙ্গলের, সব দুঃখকষ্টের পরেও শেষ পর্যন্ত মঙ্গলের, সুখেরই জয় হবে। মানুষের ভক্তি এবং বিশ্বাসের জোর পরীক্ষা করবার উদ্দেশ্যই ঈশ্বর পৃথিবীতে দারিদ্র, অবিচার এবং দুঃখ-কষ্ট পাঠান। এ সবই ঈশ্বরের লীলা এবং মানুষের অবিদ্যা-অজ্ঞানতা প্রসূত মতিভ্রম।
ঈশ্বরের শেষ বিচারে মিথ্যার উপর সত্যের জয়, অন্যায়ের উপরে ন্যায়ের জয়, অমঙ্গলের উপরে মঙ্গলের জয় হবেই। ব্যক্তিমানুষ বিশ্বাস করে যে মানুষের সমাজ যখন তাকে অপমান অবহেলা নির্যাতন শোষণ করেছে, তখন ঈশ্বর পৃথিবীতেই শেষ বিচারে তার মঙ্গল এবং অপরাধীদের অমঙ্গল সাধন করবেন। আবার ধর্মবিশ্বাসী মানুষ যখন তার প্রিয়জনদের হারায়, তখন সে বিশ্বাস করে দয়াময় ঈশ্বর অমৃতলোকে তাদের নিজস্ব পাদপদ্মে আশ্রয় দিয়েছেন। তারা মরেনি, অমৃতলোকে পরম আনন্দে বেঁচে আছে। এ ভাবে মানুষের দুঃখকষ্টে ধর্মবিশ্বাস একটা মানসিক চিকিৎসার কাজ করে। অশুভের মধ্যে শুভ, অমঙ্গলের মধ্যে মঙ্গল, দুঃখের মধ্যে সুখের না হলেও অন্তত শান্তির আশ্বাস দেয়।
এ ধরনের শান্তি ও সান্ত্বনার সন্ধানে ব্যক্তিমানুষ অনেক সময় গুরু-পীর-বাবাদের কাছে ছুটে যায়। মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এসব ধর্মবণিকেরা মানসিক চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করে, এবং বিনিময়ে বিপুল অর্থ, প্রভুত্ব এমন কি রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে। এরা নানা রকম ম্যাজিক দেখিয়ে ভক্তদের বশীভূত করে। এদের ফটো থেকে মধু ঝরে, এরা শূন্য থেকে সোনার আংটি এনে ভক্তকে দেয়, কাউকে বা সন্দেশ রসগোল্লা দেয়। এরা ভক্তদের দুঃখকষ্ট দূর করবার, রোগ নিরাময় করবার, ব্যবসায়ে লাভ করবার, চাকুরীতে উন্নতি করবার, নির্বাচনে টিকিট পাওয়ার, মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হবার ব্যবস্থা করতে অর্থের বিনিময়ে যাগ-যজ্ঞ করে এবং তাবিচকবচ দেয়। অথচ এদের যদি সত্যিই শূন্য থেকে দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষমতা থাকে, তবে এরা শুধু ভক্তকে ম্যাজিক না দেখিয়ে শূন্য থেকে অফুরন্ত অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও অন্যান্য ভোগ্যদ্রব্য উৎপন্ন করে নিজ দেশের ও সমস্ত পৃথিবীর মানুষের অভাব দূর করে না কেন, সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
তথাপি মানুষ ধর্মের নামে তাদের কাছেই ছোটে, কারণ বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের অসংখ্য দুঃখকষ্ট আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে প্রতিকারহীন। অথবা অগণিত আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে, যার বাস্তবায়ন অসম্ভব কিংবা দুরূহ। তাই মানুষ সংকট নিরসনে বা ইচ্ছাপূরণের সহজ উপায় হিসেবে মনোরোগের গুনিন ধূর্ত ধর্মবণিকদের জাদুর শরণাপন্ন হয়। কল্পিত ঈশ্বর কিংবা দেবদেবীদের দেখতে পাওয়া যায় না। তারা সত্যই আছেন কিনা সে বিষয়েও ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের মনে এক ধরনের সন্দেহ থেকেই যায়। বাবা-গুরুরা এই পরিস্থিতিতে ঈশ্বর কিংবা দেবতার 'অলৌকিক' ক্ষমতাসম্পন্ন মূর্তিমান বিকল্প হিসেবে ধর্মজাদুর মাধ্যমে মানুষের কাল্পনিক ইচ্ছাপূরণের সহায়তা করে। ( ক্রমশ)
আরও পড়ুন
0 Comments