জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৫৩(উৎসব -২)


সম্পাদকীয়, 
চোখ আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়। মহালয়ার দিন হয় দেবীর চক্ষুদান। অর্থাৎ শিল্পীর তুলির টানে জেগে ওঠে প্রতিমার ত্রিনয়ন। এ বছর মহালয়া তিথি আর মাত্র দু'দিন পর। চক্ষুদানের সেই অসাধারণ মুহূর্তের ছবি প্রচ্ছদের জন্য উপহার দিয়ে নীলাব্জ আঙ্কেল এক লহমায় আমাদের এতসব কথা মনে করিয়ে দিল। কিন্তু তাবলে ভুললে চলবে না, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা এখনও দেখা যাচ্ছে না। প্রভাত জেঠু তাই নীল নবমেঘশিশুদের নিয়ে ছড়া লিখেছেন। দীপ কাকুও ছড়ায় বলেছেন আকাশে মেঘের পাহাড়। তবু মন খারাপের কোন কারণ নেই। এসো আমরা নীলাঞ্জনার মতো শরতের মেঘের স্বপ্ন দেখি। কিভাবে? কেন খাতা পেন খুলে রেনেসাঁর মতো চারপাশে ঘুর ঘুর করা শব্দগুলো নিয়ে ছড়া লিখে ফেলে। দেখবে স্বপ্নও সত্যি হয়ে যাবে। শুধু কি তাই? দিলীপ জেঠুর গল্পের মতো শত্রুও বন্ধু হয়ে যাবে। চুমকি আন্টির গল্পের মতো নিজের প্রিয় পাখিটাকে সুন্দর বাসা উপহার দিতে পারবে। আরে পাখির কথায় মনে পড়ে গেল তোতার কথা। সুব্রত আঙ্কেলের তোতাকাহিনি পড়ছো তো। করোনা মিটলেই স্কুলের অনুষ্ঠানে বন্ধুদের নিয়ে এই নাটকটা মঞ্চস্থ করবে কিন্তু। করোনার কথায় আরো মনে পড়ে গেল গৌর জেঠুর ভূতের উপন্যাসটা। এবারে আরো মজা পাবে পড়লে। আর আমি তো জানি ভূতের গল্প তোমাদের ফেভারিট। তাই জয়তী আন্টি তোমাদের জন্য খুব খুব মজার ভূতের গল্প লিখেছেন। এই সমস্ত লেখাগুলো বিখ্যাত চিত্রশিল্প মৌসুমী বিশ্বাস, শ্যামাপ্রসাদ ব্যানার্জি, সুব্রত দেব, এবং বানীয়া সাহার আঁকা দিয়ে উৎসবের রঙে সাজিয়েছি। তাছাড়া বৃষ্টি যতই হোক শ্রেয়সী, শতভিষা, শ্রীজা,  রায়ান ও সৃষ্টির আঁকাতে এবারের উৎসব সংখ্যা আমাদের পুজোর আনন্দ ফিরিয়ে দিয়েছে। এসো আমরা কোভিড বিধি মেনে উৎসবে মেতে উঠি। আর অসীম জেঠুর ছোটোবেলাকার দুর্গোপুজোর স্মৃতিকথা পড়ে জেনে নিই বড়দেরও ছোটোবেলা থাকে।    - মৌসুমী ঘোষ




 মাঙ্কিক্যাপ
চুমকি চট্টোপাধ্যায় 

পিসিন আর পিসাই বেড়াতে এসেছে  অনীতদের বাড়ি। অনীতদের বাড়ি আলিপুরদুয়ারে। বেশ অনেক বছর পর এলো পিসিনরা। আসবে কী করে, ওরা তো আমেরিকার ডেনভার বলে একটা জায়গায় থাকত। 
পিসাই ওখানকার কলেজে পড়াত। আর পিসিন ছিল সরকারি লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। চাকরি করা শেষ হয়ে গেছে, ওই যে রিটার না কি করে না, তাই ওরা কলকাতায় চলে এসেছে।
অনীতের মায়ের খুব ইচ্ছে বিদেশ দেখার। পিসিন পিসাই কতবার বলেছে যেতে। কিন্তু অনীত তখন বেশ ছোট বলে ওর বাবা এত দূর জার্নি করতে রাজি হয়নি। তাছাড়া, ঠামাই কে কোথায় রেখে যেত! 
ঠামাইকেও পিসিন নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ঠামাই তো ওখানকার সব গল্পটল্প শুনে ' রামচন্দ্র, ছ্যা, ওখানে মানুষ থাকে ' বলে নাকচ করে দিয়েছে। বিশেষ করে টয়লেট-হ্যাবিট জানতে পেরে। 
তারপর ঠামাই ভগবানের দেশে চলে গেল, অনীতও একটু বড় হল কিন্তু পিসিন পিসাই ও দেশ থেকে চলে এল। আর যাওয়া হল না ডেনভার। অনীতের বাবা বলে, " ওখানে এমন কী আছে যা আমাদের দেশে নেই? আমাদের দেশ আরো সুন্দর। আগে দেশ দেখব তারপর বিদেশ। " 
অনীতের তো আলিপুরদুয়ার খুব ভালো লাগে। কত্ত গাছপালা এখানে। সবুজ সবুজ চারপাশ। সেই গাছে অনেক অনেক পাখি এসে বসে, খেলা করে, বাসা বানায়। রঙবেরঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় ফুলে ফুলে। আর অনীতের দারুণ লাগে জোনাকিপোকা দেখতে।
রাত্রিবেলায় ঘরের আলো নিভিয়ে বাবা যখন বারান্দার ইজিচেয়ারটায় বসে, অনীতও তখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সামনের গাছগুলোতে সেই সময়ে জোনাকি-পার্টি চলে। জোনাকি-পোকার জ্বলা নেভায় ঝিকমিক করে গাছগুলো। টিয়াদিদির বিয়ের সময় ওদের বাড়িটা যেমন টুনি বালব দিয়ে সাজিয়েছিল, গাছগুলোকে ঠিক তেমনি লাগে দেখতে। 
" অনি, স্কুল আছে, সকালে উঠতে হবে। এসে শুয়ে পড়। " অনীতের মা বিছানা ঠিক করতে করতে ডাকাডাকি করে বটে, অনীতের বাবা বলে, " এখনো আমাদের এখানে এসব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কলকাতায় গেলে কিচ্ছু দেখতে পাবি না। ওখানে এত আর্টিফিসিয়াল লাইট যে, জোনাকিরা হারিয়ে গেছে। ভালো করে দেখে নে। পড়াশোনার জন্য হয়তো কলকাতা যেতেও হতে পারে তোকে।" 
অনীতের মন খারাপ হয়ে যায় বাবার কথা শুনে। গুটিগুটি ঘরে গিয়ে বিছানায় উঠে পড়ে। ঘুমোবার আগে অনীতের মা রোজ অনীতকে আদর করে দেয়। মাথার চুলে হাত চালাতে চালাতে বলে, " আমার অনিসোনা। ঘুমা ভালো করে। কাল সকালে এক ডাকেই উঠে পড়তে হবে কিন্তু।" তারপর গাল টিপে একটা হামি দেয় মা। 
অনীত মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, " আমি কিন্তু কলকাতা যাব না মা। এখানেই পড়াশোনা করব। " ওর মা একটু অবাক হলেও কিছু বলে না। বেশি কথা বললে ঘুমের রেশটা কেটে যাবে। অনীতকে আরো একবার আদর করে নিজের কাজে চলে যায়। 
এখন ডিসেম্বর মাস। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব উত্তরবঙ্গ জুড়ে। খুব আরামের ওয়েদার। অনীতের পিসিন পিসাইও তাই এই সময়েই এসেছে। গরম ওদের সহ্য হয় না বিশেষ। কলকাতার গরমে দিনরাত এসি চালিয়ে রাখে। অনীত বলেছে, " বেশি এসি চালালে এয়ার পল্যুশন হয়। সোশাল স্টাডি বইতে আছে।"
পিসিনরা আসাতে রোজই ভালো ভালো রান্না হচ্ছে বাড়িতে। করুণাপিসি অনীতদের বাড়িরে রান্না করে। এখন অনীতের মাও হাত লাগিয়েছে। একদিন চিংড়ি পোলাও, মাটন রেজালা তো পরের দিন কিমা রাইস, নারকোলের দুধ দিয়ে চিকেন। এছাড়া কত রকমের যে ভেজিটেরিয়ান আইটেম হচ্ছে, সে বলার নয়। অনীতের সময়টা ভালোই কাটছে। 
পাখিদের খুব পছন্দ অনীতের। কত রকমের পাখি এসে বসে আশপাশের গাছে। বাবা সেলিম আলির ' বার্ডস অফ ইন্ডিয়া ' বইটা কিনে দিয়েছে। ফ্রি টাইমে অনীত বইটা নিয়ে ছাদে বা বারান্দায় চলে যায়। গাছে বসা কোনো না কোনো পাখি ঠিক পেয়ে যায়। বই খুলে মিলিয়ে কী পাখি সেটা চিনতে চেষ্টা করে অনীত। তবে বেশির ভাগ সময়ই খুঁজে পেতে পেতে পাখিটা উড়ে যায়। 
অনীতের খুব সখ ওদের বাড়ির বারান্দায় কোনো একটা পাখি বাসা বানায়। বাবাকে একবার বলেছিল কথাটা। শুনে ওর বাবা বলেছিল, " পাখি পোষ না তাহলে। খাবার দিবি, গল্প করবি। বলা যায় না, পাখিও কথা বলা শুরু করে দিতে পারে। এনে দেব খাঁচা আর পাখি? "
" না না, খাঁচার ভেতর পাখি আমার ভালো লাগে না বাবা। ছাড়া পাখি ভালো লাগে। " 
অনীতের বন্ধু সৌমাল্য যেদিন থেকে গল্প করেছে যে, ওদের বাথরুমের ভেন্টিলেটরে পায়রা বাসা বানিয়েছে, ডিম পেড়েছে, ছানা হয়েছে, সেদিন থেকে অনীতের পাখির বাসার ইচ্ছেটা আরো জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু ওর ইচ্ছেতেই তো আর পাখি বাসা বানাবে না। তাছাড়া, ওদের বাড়ির ঘরগুলোতে ভেন্টিলেটর নেই যে পাখি এসে বাসা বাঁধবে। মনের ইচ্ছেটাকে মনের ভেতরেই বন্ধ করে রাখে অনীত।
পিসিনরা চলে যাবে। অনীতের অল্প অল্প মন খারাপ। বেশ একটা হইচই হচ্ছিল বাড়িতে। আবার শান্ত হয়ে যাবে বাড়িটা। অনীতের অবশ্য অভ্যেস আছে। ও গাছপালা, পশুপাখিদের নিয়ে থাকতেই ভালোবাসে। তাছাড়া স্কুলের বন্ধুরা তো আছেই খেলা, গল্প করার জন্য।
যাবার আগের দিন পিসিন অনীতকে ডেকে বলল, " অনিসোনা, কী নিবি বল। তোর যেটা পছন্দ সেটাই দেব। " পিসাইও বলল, " বলে ফেলো অনিবাবু। কী চাই তোমার। " 
খানিক চুপ করে থেকে অনীত বলল, " পিসাইয়ের মাঙ্কিক্যাপ। " সবাই অবাক! বলে কি ছেলে?  এত জিনিস থাকতে পিসাইয়ের মাঙ্কিক্যাপ!  হোহো করে হেসে গড়িয়ে পড়ল অনীতের পিসিন। পিসাইও হাসছে খুব। 
অনীত বুঝতে পারে না এতে হাসির কী আছে। পিসিন আর পিসাই জিগ্যেস করল ওর কী চাই আর সেটা বলতেই ওরা হাসছে। কেন রে বাবা! মাঙ্কিক্যাপ অনীতেরও আছে, ওর বাবারও আছে। শীত যেখানে বেশি পড়ে সেখানে প্রায় সবারই এই টুপি থাকে। কিন্তু পিসাইয়ের মাঙ্কিক্যাপটা অন্য রকম। বিদেশ থেকে আনা। কী সুন্দর ফার দেওয়া বাইরেটা। হাত বোলালে কি আরাম লাগে। 
পিসিনের হাত ছাড়িয়ে ঘরে চলে গেল অনীত। কষ্ট হয়েছে ওর। ছোট বলে কি মান অপমান বোধ নেই? ড্রইং বুকটা নিয়ে খাটে উঠে বসল।  সকালে একটা হলুদ বুক লাল লেজের পাখি দেখেছিল, সেই পাখিটা আঁকতে শুরু করল। 
দু মিনিটের মধ্যেই পিসিন এসে বসল অনির পাশে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, " রাগ করিস না সোনা। এই নে পিসাইয়ের মাঙ্কিক্যাপ। অ্যাতো সামান্য জিনিস চেয়েছিস বলে আমাদের অবাক লেগেছে। খুব ভালো ছেলে তুই, কোনো চাহিদা নেই। " 
মাঙ্কিক্যাপটা পেয়ে খুব খুশি অনীত। ওর একটা প্ল্যান আছে। তার জন্যেই এই ক্যাপটা চেয়ে নিয়েছে। 
প্ল্যান অনুযায়ী অনীত মাঙ্কিক্যাপটা উল্টে দিলো। মানে, বাইরের নরম লোমশ অংশটা ভেতরদিকে করল আর ভেতরের উলের দিকটা বাইরে। এইবার একটা ভাঙা হ্যাঙার নিয়ে সেটাকে ইংরেজি ' এস ' অক্ষরের মতো বেঁকিয়ে তাতে ওই টুপিটার ওপর দিকটা ভালো করে গেঁথে বারান্দার গ্রিলের এক কোণে ঝুলিয়ে দিলো। 
দুদিন কেটে গেল। অনীত সারাক্ষণই লক্ষ রাখে ঝোলানো টুপিটার দিকে। হাওয়ায় দোল খাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনাই ঘটে না। দ্বিতীয় দিন রাত্রে ওর বাবা বারান্দায় এসে ইজিচেয়ারে বসে। অনীতও এসে দাঁড়ায় রোজকার মতো। সেই সময়ে চোখে পড়ে গ্রিলের কোণায় কিছু একটা নড়ছে।
" ওখানে কী, দেখি? " 
" আমি ঝুলিয়েছি বাবা। " 
অনীতের বাবা বুঝতে পারে ছেলের উদ্দেশ্য। বলে, " অত নীচে ঝোলালে কিছুই হবে না। আমাকে দে, আমি ওপরের কার্নিশে ঝুলিয়ে দিচ্ছি কায়দা করে। " 
এরপর কেটে গেছে দু সপ্তাহ। পরপর তিনটে ক্লাস টেস্ট পড়েছে। অনীত পড়া নিয়ে একটু ব্যস্ত। এখন আর মনটা মাঙ্কিক্যাপে নেই। এর ভেতর অনীতের মায়ের চোখে পড়েছে ওটা। চেঁচিয়ে বলে উঠেছে, " এ বাবা, এটা কী ঝুলছে এখানে? রাধা, ঝুল ঝাড়ুটা নিয়ে আয়, ফেলতে হবে। " 
আঁতকে উঠে অনীত বলেছে, " মা, ওটা আমি ঝুলিয়েছি। মানে, আমি বলাতে বাবা টাঙিয়ে দিয়েছে। থাক না মা। পরীক্ষা হয়ে গেলে খুলে নেব। " 
এখন সরিয়ে দিলে পাছে অনীতের মন খারাপ হয় আর ঠিকভাবে লেখাপড়া না করে, সেই ভেবে ওর মা আর কিছু বলল না। 
শনিবার দুপুরে ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে অনীত। কিচিরমিচির শব্দ এলো ওর কানে। ডাইনিংরুমের পাশেই বারান্দা। চট করে সেদিকেই চোখ গেল অনীতের। আরে, টুপিটার মধ্যে থেকে কি একটা বেরলো না! 
খাওয়া ছেড়ে উঠে দৌড়ে  বারান্দায় গেলো অনীত। টুপিটার খোলা মুখ দিয়ে একটা চড়াই উঁকি মারছে। একটু যেন বেশি ঝোলা লাগছে টুপিটা। অনীতকে দেখে কিচিমিচ করে রাম চেঁচাতে শুরু করেছে উঁকি দেওয়া চড়াইটা। 
মা কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি অনীত। " মনে হচ্ছে চড়াই ডিম পেড়েছে। সরে যা অনি। চড়াইটা ভাবছে, তুই ওর ডিম চুরি করতে এসেছিস। যে সময়ে থাকবে না, সেই সময়ে দেখিস। ভাত পড়ে আছে, খেয়ে নে।
আর খাওয়া,  অনীত তখন খুশিতে লাফাতে শুরু করেছে। এটাই তো চেয়েছিল ও। কি মজা! কি মজা! 
 বাবা অফিস থেকে ফিরলে ছুট্টে গিয়ে সুখবরটা দিলো অনীত। " বাবা, যখন চড়াই-মা থাকবে না, আমাকে কোলে তুলে টুপির ভেতরটা দেখাবে একবার?" 
অনীতের বাবা হেসে বলল, " আচ্ছা, দেখাব। " 
এরপর আরো মজা হল। চারটে ডিম ফুটে চড়াই- ছানা বেরলো। ওদের মা আর বাবা কেবল বাইরে যায়, মুখে করে খাবার নিয়ে আসে, ভেতরে ঢুকে ছানাদের খাওয়ায়,  আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। 
অনীত ওর বাবার কোলে উঠে দেখেছে, ভেতরে নরম লোমের মধ্যে আরাম করে বসে আছে চারটে চড়াই-ছানা। অনীতকে দেখে ভেবেছে ওদের খাবার এসেছে, তাই বড় বড় হাঁ করেছে । মুখের ভেতরটা লাল। 
ছানারা বড় হল। উড়তে শিখল। চড়াই ফ্যামিলি চলেও গেল একদিন। অনীতের মন খারাপ হল। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই কিচিরমিচির শুনে অনীত দেখে, আবার একটা চড়াই এসে হাজির। আর একটা চড়াই-ফ্যামিলি হবে।
অনীত হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, " থ্রি চিয়ার্স ফর পিসাইয়ের মাঙ্কিক্যাপ! " ওর মা ভেতর থেকে বলল,  " হিপ হিপ হুররে।" সারা বছর ধরেই মাঙ্কিক্যাপ হাউস ফুল থাকে এখন।





ছোটগল্প

ফটিকচাঁদের  বুদ্ধির ফাঁদ
                                                                  দিলীপকুমার মিস্ত্রী

 মাধবগঞ্জের কাইতিপাড়ার বুড়ো কেশবচাঁদ কাইতি। তার একমাত্র আদরের নাতি ফটিকচাঁদ। গঞ্জে ফটিকচাঁদের খুব নাম-ডাক আছে।  কারণ আর কিছুই নয়, তার প্রখর বুদ্ধি। গঞ্জের সকলে তার বুদ্ধির তারিফ করে। আর তাই নিয়ে হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে মরছে হাজরাপাড়ার বুড়ো গোবিন্দচাঁদ হাজরা। কারণ তার একমাত্র নাতি বলাইচাঁদ ফটিকচাঁদের সমবয়সী, এক ক্লাসে পড়ে। কিন্তু তার নাতির  সুনাম গঞ্জের কেউ করে না। গোবিন্দচাঁদ আর কেশবচাঁদ আবার সম্পর্কে মামাতো পিসতুতো দুই ভাই।  কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে এখন ঠান্ডা লড়াই চলছে তাদের দুই নাতিকে নিয়ে। 
              কিছুদিন ধরে গোবিন্দচাঁদ তার নাতি বলাইচাঁদকে বলে চলেছে, দাদুভাই, তোমাকে এমন একটা কিছু করতেই হবে, যাতে ঐ ফটিকচাঁদ ছোঁড়াটা একেবারেই জব্দ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বুড়ো কেশবচাঁদের মুখেও ঝামাটি ঘষা হয়। ঐ বুড়ো,আর ছোঁড়াটার জন্য গঞ্জে আমার মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠেছে। বলাইচাঁদ দাদুকে আশ্বস্ত করে বলল, দাদু,তুমি একদম চিন্তা করবে না।  এবার আমি এমন একটা চাল চালব,তাতে দাদু-নাতি দু’জনেই একসঙ্গে কুপোকাৎ হবে। আর দু-চারটা দিন সবুর কর,তোমার বলাইচাঁদ এবার গঞ্জে এক জব্বর খেল দেখাবে। 
         ইদানিং নন্দীদের বাগান থেকে রোজই পেয়ারা চুরি হচ্ছে। আর সেই চুরির দোষ চাপছে ফটিকচাঁদের ঘাড়ে। দোষ চাপার কারণটিও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। চুরি যাওয়া পেয়ারার দু-পাঁচটি রেখে আসা হচ্ছে প্রতিবেশীদের দরজায়। সঙ্গে একটি চিরকুটে লেখা থাকছে, ‘ফটিকচাঁদের এই ছোট্ট উপহারটি আপনার জন্য। অত্যন্ত সুস্বাদু এই পেয়ারাটি আপনি অবশ্যই খাবেন। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি আছে। শরীর ভালো থাকবে। ইতি- আপনাদের আদরের ফটিকচাঁদ।‘
          এমন ঘটনায় গঞ্জে ফটিকচাঁদ আর তার দাদু কেশবচাঁদের বদনাম চারদিকে হু-হু করে ছড়িয়ে পড়েছে। হাটে মাঠে ঘাটে, লোকের মুখে মুখে এখন এই একটি বিষয় নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। আর সবাই ছি ছি করছে। বলছে, ‘ফটিকচাঁদ ভেতরে ভেতরে চুরি-বিদ‍্যেটা ভালোই রপ্ত করেছে বটে। ছোঁড়া সবদিক থেকেই এক নম্বর। এমন  নাতিকে নিয়ে কেশবচাঁদের এত গর্বের কী আছে ? বুড়োর মাথাটাও বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছে।‘  আর এসব কথা দেখেশুনে, গোবিন্দচাঁদ ও  তার নাতি বলাইচাঁদের আনন্দ দেখে কে! 
        ফটিকচাঁদ আর বলাইচাঁদ দুজনেই স্থানীয় মিশন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ফটিকচাঁদ আবার ক্লাসের ফার্স্ট-বয়। তাই স্কুলের সবাই তাকে ভালোবাসে। সে একদিন স্কুলে এসে সরাসরি হ‍্যাডস‍্যারের ঘরে ঢুকে পড়ল।  তাঁকে বলল, স‍্যার,আমি পেয়ারা চুরি করিনি। আমি পেয়ারা চোর নই। আমার মনে হচ্ছে,বলাইচাঁদ  আমাকে,আমার দাদুকে অপদস্থ করতে এমন চক্রান্ত করেছে।  আমি এটা প্রমাণ করতে চাই। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন।
          টিফিনবেলায়, টিচার্স রুমে, ফটিকচাঁদ আর বলাইচাঁদের ডাক পড়ল। দু’জনেই হাজির হল হেডস্যার এবং অন‍্যান‍্য স‍্যারের মুখোমুখি। হেডস্যার বলাইচাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন,গঞ্জে এমন কথা ছড়িয়েছে, ফটিকচাঁদ নন্দীদের বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার লোকজনের বাড়িতেও দু-চারটে পেয়ারা রেখে যাচ্ছে। কিন্তু ও তো বলছে,ও এমন কাজ করতেই পারেনা। এটা বলাইচাঁদের কাজ। তাহলে, এ’ব‍্যাপারে তুমি কী বলতে চাও বলাইচাঁদ?
         হেডস‍্যারের মুখে এমন কথা শুনে বলাইচাঁদের মুখ শুকিয়ে কাঠ। সে দু’বার ঢোক গিলে, আমতা আমতা করে বলল,স‍্যার,এটা কী করে সম্ভব ! আমি পেয়ারা চুরি করে অন‍্যের ঘরের দুয়ারে,আমার নিজের ঘরের দুয়ারে রাখতে যাব কেন। তাছাড়া, সবার ঘরের দরজায়, পেয়ারার সঙ্গে চিরকুটে তো ফটিকচাঁদের  লেখা চিরকুটই রাখা ছিল।
        এ’কথা শুনে হেডস্যার ফটিকচাঁদের মুখে তাকালেও সে কোনো উত্তর দিল না। সে নিজের  ব‍্যাগ থেকে দুটো খাতা আর দুটো ডটপেন বের করল। তারপর সেগুলো টেবিলের উপর রেখে বলল,স‍্যার,এর একটি খাতায় বলাইচাঁদ দশবার আমার নাম লিখুক। আর একটায় আমি দশবার ওর নাম লিখি। তাতেই আসল চোর ধরা পড়ে যাবে।
         হেডস্যার ফটিকচাঁদের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন,তা কী করে সম্ভব ? এভাবে,এতো সহজে কখনও চোর ধরা যায় ? তুমি কী বলছ ফটিকচাঁদ ? এরপর  হেডস্যার হঠাত কী মনে করে আবার বললেন, ঠিক আছে,তবে তাই হোক। নাও তাহলে দু’জন ঝটপট লিখে ফ‍্যাল। দেখা যাক শেষে কী দাঁড়ায় !
        বলাইচাঁদ মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও, স‍্যারদের সামনে কিছু বলতে পারল না। সে একটি খাতা পেন নিয়ে ফটিকচাঁদের মুখে তাকিয়ে একবার টেঁরিয়ে দেখল। তারপর লিখতে শুরু করে দিল। আর ফটিকচাঁদ লিখতে শুরু করল ঝড়ের গতিতে। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত দুষ্টু-হাসি। 
           দু’জনের লেখা শেষ। হেডস্যার খাতা দুটি নিজের কাছে নিয়ে বারকয়েক চোখ বোলালেন। তারপর খাতা দুটি ফটিকচাঁদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ফটিকচাঁদ,আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি বল, তোমাদের দু’জনের মধ্যে সত্যি সত্যি কে পেয়ারা চুরি করেছ ? আমি তোমাদের কাউকে কোনরকম শাস্তি দেব না, কথা দিলাম।
       ফটিকচাঁদ তার পকেট থেকে কয়েকটি টুকরো লেখা কাগজ বের করে হেডস্যারের হাতে তুলে দিয়ে বলল,স‍্যার,এই লেখাগুলোর সঙ্গে, এই খাতার লেখা মিলিয়ে দেখলেই আপনি আসল পেয়ারা চোরের খোঁজ পেয়ে যাবেন এক নিমেষে।
       হেডস্যার একবার তাতে চোখ বুলিয়ে,সেগুলো অন্য স‍্যারদের দিকে এগিয়ে দিলেন। তাঁরাও প্রত‍্যেকে ভালো করে দেখে,একসঙ্গে বলাইচাঁদের মুখে তাকিয়ে রইলেন। তাতেই বলাইচাঁদ ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করে দিল। হেডস্যার এগিয়ে গিয়ে তার পিঠে হাত রেখে বললেন,ভুল মানুষ মাত্রই করে। কিন্তু সেটা সংশোধন করা অত্যন্ত জরুরী। তোমরা দু’জনেই আগামীকাল তোমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে আসবে। ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমি ওঁদের সঙ্গে শুধুমাত্র দুটো কথা বলতে চাই।
           পরদিন যথারীতি ফটিকচাঁদ আর বলাইচাঁদ তাদের দাদুকে সঙ্গে নিয়ে হেডস্যারের ঘরে ঢুকল। হেডস্যার তাঁদের সামনেই বললেন,ফটিক এবং বলাই, দু’জনেই আমাদের প্রিয় ছাত্র। ফটিক একটু বেশি মেধাবী বটে। কিন্তু বলাইয়ের মেধাও কম নয়। সেটা ওর এই পেয়ারা চুরির সাজানো ঘটনাই প্রমাণ করেছে। বলাইচাঁদ,সত্যিই তোমার বুদ্ধির তারিফ করছি আমরা। কিন্তু তোমার এই বুদ্ধিটাকে সঠিক জায়গায়,সময়মতো কাজে লাগাতে হবে। তাহলে তুমিও পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারবে। কিন্তু, এবারেও তুমি ফটিকচাঁদের বুদ্ধির ফাঁদে ধরা পড়ে গেছ।
            এরপর, হেডস্যার অভিভাবকদের কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে সেই সুযোগ না দিয়ে বলাইচাঁদের  দাদু বলতে শুরু করল। ‘মাষ্টারমশাই, আপনি ঠিকই বলেছেন, ফটিকচাঁদের বুদ্ধির ফাঁদে শুধুমাত্র বলাইচাঁদ একা নয়, তার দাদুও ধরা পড়ে গেছে। আপনি জানেন না, ফটিকচাঁদের দাদু আমার সম্পর্কে ভাই। আমাদের মধ্যে এক মিথ্যে বিবাদ চলছিল প্রায় দশ বছর ধরে। ফটিকচাঁদের বুদ্ধির জোরে তার অবসান ঘটল।  আজ আমার সত্যিই খুব আনন্দের দিন।
           আমাদের দুই পরিবারের বিবাদ নিয়ে গঞ্জের মানুষ এতকাল অনেক হাসিঠাট্টা করেছে। কিন্তু আর নয়। এটা আমারই ভুল ছিল। বলাইচাঁদ যেমন আমার নাতি, ফটিকচাঁদও ঠিক তেমন। ওদের যে কোনো একজনের সাফল্য আমার গর্বের বিষয় হওয়া উচিত। দেরিতে হলেও,আমার মধ্যে এই অনুভূতিটা জেগেছে ফটিকচাঁদের জন্য,ওর বুদ্ধির কারণে। ওর জন্য আমার গর্বের শেষ নেই। আপনি বলাইচাঁদকে শাস্তি দিলে,আমাকেও শাস্তি দেওয়া দরকার।
         হেডস্যার একগাল হেসে বললেন,কী যে বলেন আপনি। অপরাধ করলে তাকে অপরাধী বলা হয়, তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু ছাত্ররা কখনও অপরাধ করে না। ওরা কখনও সখনও এক-আধটু ভুল করে। সুতরাং শাস্তির প্রশ্নই আসে না। ওদের ভুল সংশোধন করার দায় তো আমাদেরই। আপনি-আমি সেই কাজটাই যত্ন সহকারে করতে পারি। আর সেটা করতে পারলে,ওদের ভবিষ্যত জীবনটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আসুন,আমরা ফটিকচাঁদের বুদ্ধির ফাঁদটা প্রত‍্যেক ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে দিই।
          হেডস্যারের কথা শেষ হতেই ফটিকচাঁদ ও বলাইচাঁদের দাদু আনন্দে হাততালি বাজাতে লাগল।  ফটিকচাঁদ বলাইচাঁদও নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসতে লাগল। এত্তো হাসি ফুটে উঠল হেডস্যার ও অন‍্যান‍্যদের মুখেও। 





এক ঝোলা আর তিন ভূত
জয়তী রায়


শিবুদাদার ঝোলায় তিনটে ভূত থাকে। ছোট্ট থেকে একথা শুনে শুনে বড় হয়ে বুড়ো হতে চললাম। না কথার নড়চড় হল, না শিবুদাদার ভূতের দেখা পেলাম। সে যদি বলো, দেখা শোনা একপ্রকার হয়েই যেত কখনো কখনো। এখনো বেশ মনে পড়ে। সত্তরসালে কথায় কথায় লোডশেডিং হত। আমাদের তাতে ভারি বয়ে যেত! পড়াশুনোর চাপ আমাদের ছিল না বাপু। আকাশে জোছনা ফুটফুট। বাতাস ফুরফুর। উঠোন ভরা চাঁদের আলো। খেলো আর গরম গরম মাছভাজা খাও । ওই সময় চেঁচিয়ে উঠত শিবুদাদা --নিল নিল। মাছ নিল। বজ্জাত। নোলা ভারি ভূতের পো। 
বাবা আস্তে করে ধমক দিতেন--শিবু। হচ্ছে কি! বাচ্চারা ভয় পাবে। 
    বাচ্চাদের ভয় পেতে বয়ে গেছে। তখন মোবাইল ছিল না। ছিলনা ফেসবুক।  আমাদের সময় কেটে যেত গল্পে গল্পে। সে গল্পে ভূত প্রেত রাক্ষস রাজকুমারী পেত্নী সব জীবন্ত। সব সত্যি। তাদের নিয়েই ঘরকন্না। শিবুদাদার ঝোলায় থাকে তিনটি ভূত। নাচুনে কাঁদুনে আর হাসুনে। আমাদের মতই ছটফটে। দুষ্টু আর খেলুড়ে। 
দিদি ভারি ভুলো। এই রাখছে। এই হারিয়ে ফেলছে। পরীক্ষার আগে দরকারি নোটস হারাবেই হারাবে। সারা বাড়ি মাথায় করে চেঁচাবে দিদি--শিবুদাদা শিবুদাদা খোঁজো খোঁজো। 
শিবু ধমকে ওঠে দিদিকে --রোজ রোজ হারাবে। রোজ রোজ চিল্লাবে। দেখি ঝোলা নাড়িয়ে। 
  সে নোটস শিবু খোঁজে না ভূত--ওতো খবরে কার কি দরকার! শিবুদাদা ওইরকম বলে বলে সামলে রাখত আমাদের চার ভাইবোনের দামাল দল। শান্তিতে কাজ করত মা -বাবা।
   নাচুনে -কাঁদুনে -হাসুনে- ভূত না পেত্নী , কচি না মামদো-- জিজ্ঞেস করলে, বাসন মাজতে মাজতে শিবুদাদা গম্ভীর মুখে উত্তর দিত--ভগবান আর ভূতের বয়স কক্ষুনো জিগাতে নাই। তেনরা যখন যেমন তখন তেমন। 
দাদা বলত-- যাকগে, জানার দরকারই বা কী! ওদের জন্য পাড়ায় কত্ত খাতির। 
*****
মা বাবা দাদা দিদি ভাই আর আমি এই ক 'জনের সংসারে অ-বাক হয়ে যাওয়ার মত অনেক কিছু এমনিতেই  ঘটতে থাকত না কি  আমরা অকারণে অবাক হতে ভালবাসতাম, সে সব হিসেব আজ আর দিতে পারব না, দিন যেত দিনের মত, বিকেল থেকে রাত গড়াত নিজের মত। তবে জায়গা যেহেতু তিরিশ বছর আগের নৈহাটির এক ছোট্টগ্রাম, গ্রামের ধারে নদী তার তীরে ছমছম শশ্মান, কাঠের চিতায় পুড়ছে মৃতদেহ, বর্ষাকাল হলে, গভীর রাত হলে শরীর অর্ধেক পুড়ে পড়ে থাকে, শিয়াল কুকুর ছিঁড়ে খায়, তাদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। অপদেবতা হয়।  মাঝে মাঝে‌ শশ্মানে আসে পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক। ইয়া বিশাল চেহারা। চোখে ভয়ংকর কুটিলতা।  সঙ্গে থাকে রোগা পটকা দুটো চ্যালা। রাতের বেলা কত কিছু অং বং হৃং ট্রিং করে।  ডোমপাড়ার কচি বাচ্চা উধাও হয়। ফিস ফিস কথা ভাসে। শিশুবলি হল নাকি? 
*******
      বাবা পাড়ার মাথা। আপদে বিপদে গরীব লোক বাবার কাছেই ছুটে আসে। ধনী নন তিনি, কিন্তু গ্রামের লোকের কাছের মানুষ। বাচ্চা গায়েব হবার পিছনে তান্ত্রিক আছে নিশ্চিত সেইসঙ্গে আছে আরো কারো লোভ। কিছু কিছু মানুষের অন্ধবিশ্বাস আছে এই সব বলি তুকতাক ইত্যাদিতে। তারা মনে করে এইসব করলে কার্যসিদ্ধি হয়। 
আমাদের বাড়ির উঠোনে ছোটখাটো জমায়েত হল সেদিন। তান্ত্রিকের অত্যাচারে টেঁকা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে জুটেছে  চালের ব্যবসায়ী রাঘব সমাদ্দার। রাঘব ভয়ংকর লোক। চালের ব্যবসা উপরে উপরে। ভিতরে আছে আরো নানানরকম খারাপ কাজ। চড়া সুদে টাকা ধার, ছোট ছোট মেয়েদের ধরে ধরে বিয়ে দেওয়া, লোকের জমি দখল --সব মিলিয়ে এলাকার ত্রাস লোকটা। তান্ত্রিকের সঙ্গে হেব্বি খাতির। বজ্জাতের গাছ হলে কি হবে চেহারা পাতিহাঁসের মত ছোটখাটো। মাথাজোড়া টাক। প্রজাপতি গোঁফ। বয়স? সে হবে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। চোখ  কুতকুত  আর ধূর্ত। সবচেয়ে মারাত্মক হল ওর দুটো কুকুর। কালো কুচকুচে। দেশি  কিন্তু তেজ দেখলে অবাক হতে হয়। সদর হাসপাতালের পাশে, বিশাল বাগানসহ বাড়ি রাঘব সমাদ্দারের। সেখানে ঘুরে বেড়ায় কুকুরগুলো। অমাবস্যার গভীর রাত্তিরে কি সব উৎকট হোম যজ্ঞ হয়। তখন শোনা যায় কাঁদছে কুকুরগুলো। এলাকার লোক ভয় পায়। রটনা থাকে, হিংস্র পিশাচের আরাধনা চলছে মাটির নিচের গোপন কুঠুরিতে। 
**********
    এই রাঘব সমাদ্দারের সঙ্গে বাবার লেগে গেল সাংঘাতিক বিরোধ। সরকার থেকে ঠিক করল নদীর উপর ব্রিজ তৈরি করবে। সে ব্রিজ তৈরির কনট্র্যাক্ট নেবার জন্য ক্ষেপে উঠল রাঘব। বাবা প্রতিবাদ করলেন--নাহ্! লোক ভালো না হলে, ব্রিজের মালমশলা খারাপ হবে। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনমিনি খেলা যাবে না। ব্রিজ বানাবে সুধাংশু। ভালো ছেলে। ইঞ্জিনিয়ার। 
রাঘব চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করে--আমাকে আটকাবে কে? আপনি? ছিরিচিত্তরঞ্জন বসু? হাহাহা। তিন পয়সার মাস্টার! এত বড় সাহস? 
বাবা বললেন--
  সরকারের লোককে টাকা দিয়ে বশ করতে পারো, কিন্তু এলাকার মানুষ বিরোধিতা করলে তুমি কিছুই করতে পারবে না। এটা মনে রেখো।
--মাষ্টার! ---চেঁচিয়ে উঠল রাঘব--সাবধান । সাবধান। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করো। সাবধান বলে দিলাম। 
  অন্ধকার নেমে এসেছে উঠোনে। শিবুদাদা এসে দাঁড়াল। সঙ্গে মা আর আমরা তিন ভাইবোন। ভুল বললাম। আরো কেউ। দেখা যায়না, শিবুদাদার ঝোলায় থাকে। দিদি চুপি চুপি বলল---বুঝলি মুনিয়া। শিবুদার ভূত গুলো বোকা আর ভীতু। তান্ত্রিকের সঙ্গে পারবে না। 
*********
ব্রিজ তৈরির কাজ শুরুর আগে একের পর এক সরকারি অফিসার আসতে শুরু করল। অবাক ব্যাপার, তারা কেউ বাবার সঙ্গে দেখা পযর্ন্ত করল না। সব রাঘব সমাদ্দারের বাড়ি যায়। সেখান থেকেই চলে যায় কলকাতা। বাবা দমে যাবার পাত্র নন। লোকজনের সঙ্গে মিটিং করতে লাগলেন। সরকারি অফিসারদের সামনে বিক্ষোভ হল একদিন। সব মিলে পাকিয়ে উঠল জোরদার গন্ডগোল। 
    একদিন কারা যেন চড়াও হল আমাদের বাড়ি। 
দুমদাম ঢুং ধাং বুম ব্যুম দম দম...ঢিল পড়ছে। বাড়ির চতুর্দিক ঘিরে আতঙ্ক। বাবা লাফিয়ে উঠলেন বিছানা থেকে। এলাকায় টিমটিমে ইলেকট্রিক ল্যাম্পপোস্ট। কেউ নেই কোথাও। চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে ঢিল। মড়ার মাথার খুলি। হাড়। মা কাঁপতে কাঁপতে কেমন জড়ানো গলায় বলল--তুমি ছেড়ে দাও। এই ব্রিজ যে বানাবে বানাক। তুমি ছেড়ে দাও। 
   পুজোর আগে আগে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। হিম মেখে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জ্বলছে বাবার চোখ। সে চোখে ভয় নেই। আতঙ্ক নেই। আছে নির্ভয় প্রতিজ্ঞা।
************
  পরের দিন এলাকার সবার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এক আবেদন লিপি জমা পড়ল জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে দৌড়ে এলো রাঘব সমাদ্দার---
মাষ্টার। এই  শেষ। আর নিস্তার নেই তোর। আগামীকাল অমাবস্যা।  গোটাবাড়ি জীবন্ত পুড়ে মরবে। থানা পুলিশ কেউ বাঁচাতে পারবে না। 
      রাঘব চলে গেল। মা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার উপর---তুমি থামবে? থামবে? 
       যুগে যুগে থাকে কিছু বে- হিসেবী লোক। যারা মানুষের ভালো করতে চায়। নিজের প্রাণের বিনিময়ে, সুখের সংসারে বিনিময়ে।  এমন ধারার মানুষের কাছে একটাই কথা--
   --মানুষের ভালো না করলে সে তো অমানুষ। কোনো হিসেবী কথা তারা শুনবে না। বাবাও শুনলেন না। এলাকার দুঃখী গরীব মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ যেন সারাজীবন নিরাপদে নদী পার হতে পারে, বাবা তার জন্য জীবন বাজি রাখলেন। 
*************
  পরদিন অমাবস্যা। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। রাঘব আসবে রাত্তিরে। সঙ্গে সেই তান্ত্রিক। হিংস্র কুকুর। আরো কে কেজানে? বাবাকে নিয়ে বলি দেবে না কি ওরা? উফফ। বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। খাটের এক কোণে বসে আছি গুটি পাকিয়ে।  পাড়ার বহুলোক জড়ো হয়েছে উঠোনে। হাতে হাতে হ্যারিকেন। ছেলে বুড়ো সকলের মুখ থমথম। কিছুতেই হার মানবে না কেউ। 
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন---বাড়ি যাও সকলে। প্রাণ হানির আশঙ্কা আছে। 
ভিড় থেকে এক কাকু বলল--পুলিসে খবর দিলে হয় না? 
--থানা বিশ্বাস করবে এসব আজগুবি অলৌকিক ঘটনায়? যা দেখা যায় না? ওরা আসবে কেন আমাদের কথায়? যাও। যাও বলছি--ধমক দিলেন বাবা--
যদি সত্যি সত্যি আমার কিছু হয়, তোমরা আছো। লড়াই চালিয়ে যাবে। 
   বলতে বলতে এসে গেল ধূলোর ঝড়। সে কি আওয়াজ! উঠোন ঢেকে গেল ধুলোয়। হ্যারিকেন নিভে গেল। দু একটা লাইট টিমটিম করছিল, কট কট করে বন্ধ হল। সবাই চোখে নাকে হাত চাপা দিচ্ছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। চিৎকার করছে সবাই। দিদি আর মা প্রাণপণ চেঁচাচ্ছে -বাবা । বাবা। বাবা কোথায় গেল? 
উঠোন জুড়ে জান্তব ঘড় ঘড় শব্দ। কার যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। গলা টিপে ধরলে যেমন হয়! অথচ সেই গলার স্বর হাড় হিম করা ভয়ংকর। হঠাৎ দিদি তীক্ষ্ম গলায় চেঁচিয়ে উঠল --
  শিবুদা। শিবুদা। তুমি কই? তুমি কই? 
কে যেন হিহি করে হেসে উঠল ব্যঙ্গ করে---
  সে আর তার ফিঙে ভূত পালিয়েছে রে। কেউ কিছু করতে পারবে না। 
  ধূলোর বাতাস ক্রমশঃ জমাট বাঁধতে লাগল। শ্বাস কষ্ট শুরু হচ্ছে। দম বন্ধ করা কাশি। আমি  ডাকতে গেলাম--মা, গলা দিয়ে শব্দ নেই।  কিছু দেখাই যাচ্ছে না । চোখে ধুলো ঢুকে কর কর করছে। আর পারছি না। সব শেষ। হে ভগবান! মাত্র ক্লাস ফাইভ আমার। বাবাকে মনে হয়...!
**********
          
      হঠাৎ একটা বিন্দু জেগে উঠল ঘরের মধ্যে। ফিকে গোলাপী রঙ। মিহি। সুতোর মত। চোখ কচলে তাকালাম। মিহি আলো হাত বুলিয়ে দিল আমার মাথায়। ঠান্ডা বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। 
   নাচুনি --কাঁদুনি--হাসুনি!
বোঝা গেল--- চলছে এক অসম লড়াই। বিরোধীপক্ষ বেশি শক্তিশালী। হিংস্র গলায় কেউ বলল
    --বশীকরণ করো শিবুকে। 
    --পারবি না। চেষ্টা করিস না। 
   এতক্ষণে শোনা গেল শিবুদার গলা। ধূলোর ঝড় থেমেছে। ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডাকাতের মত কিছু প্রাণী। মানুষের মত দেখতে, কিন্তু সারা শরীরে কাপড় নেই। ছাই মাখা। লম্বা লম্বা কালো কালো শরীর। ভয়ানক চোখ। এদের সামনে শিবুর পুঁচকে ভূত করবে কি? তারা তো আমাদেরই মত। নিরীহ। আমার কানে কানে কে যেন বলল--
   পুঁচকে যদি লক্ষ হয়, তবে সে জিতে যায়। 
  --কে রে? কে রে? 
খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল ভোরের শিউলি ফুলের মত। ঝরঝর। ঘর জুড়ে উঠোন জুড়ে হাসি। যেন শরতের মেঘ। যেন গাছ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে ফুল ফেলছে কেউ। হাসি বড় সংক্রামক। আমাদের বুকের ভিতর দিয়ে কুলকুল করে হাসি আসতে লাগল। ভয়ানক চেহারার লোকগুলো কেমন ঘাবড়ে গেল মনে হল। হাতের ধারালো অস্ত্র ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসতে গেল। কিন্তু চারিদিকে গোলাপী আলোর ফুলকি পাঁচিল তুলেছে। লক্ষ লক্ষ ফুলকি। এতক্ষণে চোখ পরিষ্কার হয়েছে। বাবা কই? বাবা? মেঝতে ওটা কে শুয়ে? বাবা? বেঁকে চুরে মাটিতে পড়ে? বাবা গো। বাবা... । মনে পড়ল, বাবা বলতেন--
   --অশুভ শক্তির প্রতাপ সবসময় বেশি। কিন্তু হারিয়ে দেওয়া যায় যদি নিজের মনের জোর থাকে। 
শুনলাম দিদি বলছে--
বাবাকে মেরেছে? ছাড়ব না ওদের। ঝাঁপিয়ে পড়। শিবুদা আছো? 
--আছি। চিন্তা নেই। 

তারপর? নিজেরাই অনুমান করো, তারপর কি ঘটল! সব কথা বলতে নেই। তবে এইটুকু শুনে রাখো, ভোরের আলো ফুটি ফুটি হতে হতে পরিষ্কার হল আকাশ। উঠোন জুড়ে নামল মানুষের ঢল। রাঘব সমাদ্দার ছিল তার মধ্যেই বসে। চোখে মুখে তার বৈষ্ণব প্রশান্তি।  সবার সঙ্গে সঙ্গে সেও ব্রিজ তৈরির কাজে উৎসাহ দিচ্ছিল। বাবাকে পেন্নাম করল দুবার। 
**********
দিন গড়িয়ে গেছে। আলো ঝলমল বিদেশে বসে থাকি। শিবুদাদা বেঁচে নেই। বাবা ও নেই। কিন্তু, নদীর উপর ব্রিজ দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায়। আর, তিনভূত? তারা আছে বইকি! ডাকলেই আসবে। তখন আবার শুরু হবে নতুন গল্প।




নীল নবমেঘ
প্রভাত মিশ্র

নীল নবমেঘশিশুরা খেলছে বিকেলে...
গায়ে গায়ে ছোটে বজ্র এবং বিদ্যুৎ।
আকাশের চোখে বিন্দু বিন্দু জল...
কী জানি ঘটবে আজকেই কী অঘটন।
মেঘশিশুদের জড়িয়ে ধরতে চায় সে -
তারা যেতে চায় বজ্রের সাথে যুদ্ধে!

আকাশের কোল ছাড়িয়েই অবশেষে
তারা হয়ে ওঠে কালো দৈত্যের বাহিনী!
সভয়ে বজ্র ছেড়ে দিয়ে বিদ্যুৎকে
কোথায় পালায় কেউ কী খবর রাখে!
আনন্দে মেঘশিশুরা খেলার ছলে
নেমে আসে নিচে মাঠে-ঘাটে-হাটে-বাটে!



গুচ্ছ ছড়া 
দীপ মুখোপাধ্যায়


সকালের খাতা

গাছের চারদিকে গাছ
ছড়ানো কত লতাপাতা
কিছুটা রোদ্দুর এসে
খুলেছে সকালের খাতা।

অলস আড়মোড়া ভেঙে
খাতাটা রং মাখামাখি 
বসেছে মগডালে দেখি
দু-খানা বুলবুলি পাখি।

মাছেরা বুড়বুড়ি কাটে
জলেতে ছায়া নড়েচড়ে
লুকোনো পানকৌড়িটা
চকিতে মাথা বের করে।

বাতাস পাগলাটে খুব
আকাশে মেঘের পাহাড় 
ছেলেটা ভাবুকের মতো
দু-চোখে দ্যাখে বারবার।

বাগানে শিউলি বকুল
নিকোনো ধুধু তল্লাট
কে যেন সুনিপুণ হাতে
করেছে খাতাটা ভরাট।

এখানে সেই খেলাঘরে
ছবিটা মনের খাতায়
নিরালা সোনাঝুরি দিন
সমানে পাতা ওলটায়।


কাটাকুটি

আকাশে তখন ফুরফুরে হাওয়া
মেঘের আড়ালে পেটকাটি ঘুড়ি
উবুচুবু নীলে ভেসে ভেসে যাওয়া
চাঁদিয়ালটাকে দিল সুড়সুড়ি।

কেউ শখ করে বাড়ে মোমবাতি 
ন্যাড়া ছাত থেকে ওড়ে মুখপোড়া
ঢাউসঘুড়িটা পাচ্ছেনা সাথী
থম মেরে আছে যেন আগাগোড়া।

মাঞ্জা হয়েছে কত রকমারি
অ্যারারুট আর কাচগুড়ো দিয়ে
ঘুড়ির পিছনে যতটা যে পারি
ঘনঘটা করি পুচ্ছ বানিয়ে।

বইখাতা ফেলে ধরেছি লাটাই
একতেল ওড়ে নিজস্ব টানে
ইচ্ছেখুশিতে সুতো ছেড়ে যাই
ঘুড়ি উড়ে চলে কোথায় কে জানে?

কাটা ঘুড়ি ঝোলে নারকেল গাছে
লাট খেয়ে নামে ঢিল-লঙ্গরে
কত রহস্য কারিকুরি আছে
গিজগিজ করে মাথার ভেতরে।

স্মৃতির ঘুড়িরা তাই বারেবারে
ফিরিয়ে এনেছে সেই ছেলেবেলা
এখনও সবার অজ্ঞাতসারে
মনের আকাশে কাটাকুটি খেলা।


পথ হারানোর বাঁকে

ঘর ছাড়িয়ে একটু দূরে মনমাতানো ভরদুপুরে
আতায়-পাতায় শিরশিরানি ইচ্ছেখুশির দোলায়
এক-পা দু-পা এগিয়ে গেলে
দেখতে পাবে দু-চোখ মেলে
সুজ্জি ক্যামন পুকুরটাকে  আনন্দে হাত বোলায়।

শীতলজলে ডোবায় মাথা ঘাড় নোয়ানো খেজুরপাতা
শালুকতলায় মুখ লুকিয়ে হাঁসের ছানাদুটো
ঘাই মারে মাছ তলবিতলে
কাঁপন লাগে অথৈ জলে
দুষ্টু হাওয়ায় হুলুস্থুলু উড়ন্ত খড়কুটো।

স্বপ্নাভ সেই নিঝুম পাড়া ঠায় দাঁড়িয়ে মাছরাঙারা
পথ হারানো বাঁকের দিকে উড়ছে বকের সারি
এমনি করে দিন চলে যায়
ছায়ার ভেতর দুপুর গড়ায়
কিচিরমিচির পাখপাখালি ফিরছিল ঘর-বাড়ি।

ইচ্ছেনেশায় আবার যাব শানপুকুরে পা ডোবাবো
নাও ভাসাবো আয়নাজলে এমন অভিপ্রায়-
দূরান্ত এক প্রান্ত থেকে
মায়ের গলা উঠবে ডেকে
ও খোকা,তুই কোথায় গেলি?ঘরকে চলে আয়।


ঘন আবছায়

মেঘ করলেই
ওরা বৃষ্টির খোঁজে ছুটত
বাজ পড়লেই
পাখি ছটফট করে উঠত।

ধুধু মাঠটায়
ভেজে আনচান করা ইচ্ছে
হাসি ঠাট্টায়
যেন গড়াগড়ি খেয়ে নিচ্ছে।

ছবি পালটায়
তবু কতকিছু থাকে না ছোঁয়া
মজা খালটায়
তেড়ে জল এল বলে বাঁচোয়া।

হাওয়া দুদ্দাড়
ভাঙা রোদ্দুর দিয়ে শুকোনো
করি উদ্ধার
কোণে মনটাও আছে লুকোনো।

যদি ভাব চায়
আমি রেখেছি পা-দুটো বাড়িয়ে
ঘন আবছায়
ভেজা শৈশব গেছে হারিয়ে।


স্বপ্নের পাঁচালি

সবুজে সবুজ যেন সবটা
ঝোপঝাড়ে ফোটে রাঙাফুলটি
পরিবেশ ছিমছাম গ্রাম্য
গেরস্থ পায় ফল-মূলটি।

কখনও বা কাঠফাটা রোদ্দুর
গড়াগড়ি খায় গোটা মাঠটায়
একটাও নেই মুখ গোমড়া
আছে খুনসুটি আর ঠাট্টায়।

ধানচারা ঢেউ তোলে হাওয়াতে
বটগাছে বয়সের চিহ্ন
একপায়ে খাড়া থাকে তালগাছ
ঘাসপাতা রয়েছে অভিন্ন।

ছবি ছবি সবকিছু এতটাই 
কুঁড়েঘর,তারে ঝোলে গামছা-
পাখিসব আসে পাড়া বেড়াতে
প্রতিদিন একই রোজনামচা।

ব্যস্ততা ভ্যানগাড়ি রিকশার
ছায়া মেখে রাস্তাটা দাঁড়ানো
মায়াভরা শৈশব খুঁজে যাই
আলগোছে হাতদুটো বাড়ানো।

লোকজন ভালো আছে,বেশ তো-
ঝকমক করে গাছগাছালি
তুলোমেঘ ওড়াউড়ি আকাশে
লেখা হোক স্বপ্নের পাঁচালি।




শব্দে আঁকি ছড়ার পাখি 
রেনেসাঁ গঙ্গোপাধ্যায় 
সপ্তম শ্রেণী, স্যাক্রেড হার্ট স্কুল, আদ্রা, পুরুলিয়া

 রঙ তুলিতে আঁকছি ছবি 
সাদা খাতার গায়ে 
মনের ভেতর ছড়াগুলো 
ঘুরছে পায়ে পায়ে।
 
কোথায় তাদের বসতে বলি
নেই তো আসন পাতা।
ছবির মাঝেই শব্দ দিয়ে 
ভরাই নিজের  খাতা।



আলোর রশ্মি
নীলাঞ্জনা শীল
সপ্তম শ্রেণী, টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ পাবলিক স্কুল, হুগলি
                                                
শরৎকালের দুপুরের হালকা রোদের দিকে পিঠ করে বসেছিলাম। দাদুর বাড়ির খোলা ছাদের নিচে বসে পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলোকে আস্তে আস্তে ভাসতে দেখতে দেখতে, দুর্গা পুজোর ছুটির কথা ভাবতে ভাবতে, কতটা সময় যে কেটে গেল, বুঝতেও পারিনি। হঠাৎ, আমি খেয়াল করলাম, মেঘগুলোর মাঝখান থেকে একটা ক্ষীন আলোর রশ্মি বেড়িয়ে আসছে। তার যে কি রঙ, ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার কোনো আকার নেই। উজ্জ্বল রশ্মিটা আবার হারিয়েও যাচ্ছে মেঘের মধ্যে ।  ভালো করে তাকিয়ে বুঝলাম, এটা কোনো রামধনু নয়।  ইচ্ছে করছিল, মাকে একবার ডাকি। কিন্তু মুখ যেন খুলতেই চাইছিল না। গলা থেকেও আওয়াজ বেরল না। হঠাৎ, আমার মনে একটা ভালো লাগা জাগল। আমি অবাক হয়ে সেই রশ্মির দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। ধোঁয়া ধোঁয়া আলোর রশ্মির মধ্যে, খুব সুন্দর একটা আবছায়া দুর্গামূর্তি দেখতে পেলাম চোখের সামনে। সিনেমার মতো কিছু ছবিও ফুটে উঠল। শুনতে পেলাম, খুব কাছে কোথাও যেন কেউ খুব ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁদছে। শুনতে মনে হচ্ছে যেন হাহাকার। আমি চারিদিকে খুঁজতে খুঁজতে লক্ষ করলাম, আমার চারিদিকে সেই রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে। সেই ধোঁয়া ধোঁয়া পরিবেশে একটা অদ্ভূত দৃশ্য দেখলাম। সেখানে ভেসে উঠল কিরণদাদু, ঢাকিকাকু আর চিনুর করুণ মুখ। কিরণদাদু ঠাকুর তৈরি করে। আমার দাদুর বাড়ির ঠাকুরও সে তৈরি করে। কিন্তু এই বছর, কোরোনা ভাইরাসের জন্য, আমার দাদুর বাড়িতে প্রতিমা পুজো হবেনা। এবারে চিনু আর ঢাকিকাকুও তাই আসতে পারবেনা। কিরণদাদুর একটাও ঠাকুর বিক্রি হয়েনি। তারা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।



ধারাবাহিক উপন্যাস -২

অনিকেত

গৌর বৈরাগী


        ( তিন )

অহি-নকুল খেতে বসেছে বারান্দায়। তার খাওয়া বেশ কম-সম। সকালে ব্রেকফাস্টে দু’টো রুটি খায়। সঙ্গে ডুমো ডুমো করে কাটা আলুভাজা। ডাক্তার বলেছে একটু করে ছানা খেতে, সঙ্গে ডিম-সেদ্ধ একটা করে থাকলে ভালো হয়। আজ ডিম-সেদ্ধটা মুখে তুলতে যাবে দেখল, পাশে একটা কিম্ভুত টাইপের লোক বসে আছে।

খাবার সময় পাশে এসব হাবিজাবি লোক থাকা পছন্দ করে না সে। এদিকে যে বসে আছে তাকে মোটেই চেনে না। কিরকম ত্যাড়া-ব্যাকা শরীর। দেখলেই যেন কিরকম ঘেন্না হয়। অহি-নকুল বলল, তুমি কে হে?   —আজ্ঞে আমি অদ্ভুত, অদ্ভুত দাস। —কিন্তু তুমি ভেতরে এলে কি করে? সদর দরজা বন্ধ, জানালা কপাট সব বন্ধ। —আজ্ঞে আমি সব জানি। —কী জানো? —ওই যে একটা পোকার উৎপাত শুরু হয়েছে। পোকার জ্বালায় রাস্তাঘাট বন্ধ, বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ, বাজার বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ। —তাহলে তুমি ঢুকলে কি করে? 

অদ্ভুত হাসল। তার হাসিটাও বড় বিচ্ছিরি। তার মুখের ভেতর একটাও দাঁত নেই। জিভটাও আছে কিনা বোঝা গেল না। হাতদুটো প্যাংলা। সে বলল, ওইসব বন্ধ-টন্ধ আমার কাছে কোন ব্যাপার নয় স্যার। আমার যখন ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারি।

এখন কথাটা মোটেই খেয়াল করল না অহি-নকুল। সে ঝগড়ার কথাটাই ভাবছিল তখন। কতদিন যে ঝগড়া করা হয়নি। সকালে যাওবা একটা লোক জুটল, কিন্তু লোকটা এত গরিব যে ঝগড়ার ধার মারাল না। তার কথায় লোকটা কোনও প্রতিবাদ না করে বেমালুম হাতে চটি তুলে চলে গেল। দ্বিতীয়বার এই লোকটা জুটল। কিন্তু দেখে শুনে মনে হচ্ছে ঝগড়া করার কোন এলেমই নেই এই লোকটারও। সেদ্ধ ডিমটা গলায় চালান করে অহি-নকুল বলল, তুমি কী চাও এখন? —আমি একটা কাজ চাই স্যার।

‘স্যার’ ডাক শুনে মনটা খুশিতে ভরে গেল তার। তাকে কেউ কোনদিন স্যার বলে ডাকে নি। আহা এই লোকটাকে যদি একটা কাজ দেয়া যায়। কিন্তু কী কাজ? এই সময়ে চাষবাস বন্ধ। গঞ্জের বাজারের মুদিখানার দোকান বন্ধ। একবার শ্রীরামপুরে মাসির বাড়ি যাবার দরকার ছিল। কিন্তু বাস বন্ধ। এদিকে একটা লোক খুব নিরীহ ভাবে এসে কাজ চাইছে।

অদ্ভুত লোকটা আস্তে করে বলল, দেবার মত কাজ কি তাহলে আছে স্যার? না, এমন লোককে তো এককথায় "না" বলা যায় না। কিন্তু কী কাজ, কী কাজ, ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ একটা কাজের কথা মনে পড়ে গেল। অহি-নকুল বলল, আচ্ছা, তুমি ঘামাচি মারতে পারো? লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়েছে। এটা যে একটা কাজ সে যেন এই প্রথম শুনল। তারপর আস্তে করে বলল, আপনি যদি বলেন তাহলে পারি। —বেশ তাহলে কাজ শুরু করে দাও। বলে একটা সিকি এগিয়ে দিল অদ্ভুত দাসের হাতে। —এই নাও শুরু করে দাও।

অদ্ভুত পড়ল মহাফাঁপরে। অবাক হলেও এখন আর কিছু করার নেই তার। সে নিজেই বলেছে, এই কাজটা পারি। অতএব তাকে শুরুটা করতেই হবে। ততক্ষণে অহি-নকুল লোকটা জল খাবারটা কোনরকমে শেষ করে তার সামনে পিঠ পেতে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। অদ্ভুত কাজটা শুরু করতে যাবে তখনই লোকটা আবার ঠেলে উঠল। বলল, তুমি যেন আবার জোচ্চুরি করোনা। —এরমধ্যে আবার জোচ্চুরি  কোথায় পেলেন? —হ্যাঁ আছে বৈকি। আমার নাতির কান্ড শুনলে হাঁ হয়ে যেতে। নাতিটা এক নম্বর জোচ্চোর। আমার হিসেব হলো একটা ঘামাছি মারলে এক সিকি পাবে। সেও তাই গুনে গুনে ঘামাচি মারে। এক--দুই--করে গুনতে গুনতে সে কুড়ির পর একুশে আসে না চলে যায় তিরিশে। তেমনি পঞ্চাশের পর সে লাফিয়ে চলে যায় বাষট্টিতে। বুঝতে পারছ কেমন জোচ্চুরি।

অদ্ভুত বলল, আমার কাছে অমন জোচ্চুরি পাবেন না স্যার। বলেই সে পয়সাটা দিয়ে ঘামাচি মারতে শুরু করলো। মারছে আর গুনছে --এক ---দুই ---তিন ---চার। অহি-নকুল লোকটা ঝগড়ুটে হলে কি হবে। সে ভারি আরামখোর। অদ্ভুত একুশে পৌঁছাবার আগেই দেখল লোকটার নাক্ ডাকছে। সে আরও এগোতে চাইছিল। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নড়ে উঠল খটখট করে। ওই কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। বলল, এইরে কে আবার ডাকছে দেখো? বলল আবার সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে ঘুমিয়েও পড়ল। ওদিকে দরজার কড়া নাড়ছে কেউ। শব্দ হচ্ছে খট-খট-খট-খট। ঘুমন্ত লোকটাকে আর ডাকতে ইচ্ছে হলো না অদ্ভুতের। সে আস্তে উঠে গিয়ে সদর দরজাটা খুলে দিল।

প্রতিকার  সান্যাল কড়া গলায় বললেন, তুমি কে? —আজ্ঞে আমি বাবুর কাজ করছি। আমার নাম — অদ্ভুত দাস। তুমি গিয়ে বাবুকে বল প্রতিকার সান্যাল এসেছে। কিন্তু উনি তো এখন আসতে পারবেন না, উনি ঘুমোচ্ছেন। পাশে অনি দাঁড়িয়েছিল। সে আস্তে করে বলল, ঘুমন্ত মানুষকে ডাকাটা কি ঠিক হবে কাকা? প্রতিকার খানিকটা ভেবে বললেন, কথাটা মন্দ বলনি হে, লোকটা ঘুমোক। তার আগে চলো আমরা আদালতের  কাগজপত্র গুলো ঠিক করে নিই। অনি অবাক গলায় বলল, আদালতের কাগজ? —হ্যাঁ এমন লোককে শায়েস্তা করতে আইন-আদালতই দরকার। যে নাকি পায়ের চটি হাতে তুলতে আদেশ দেয়। এত আস্পর্ধা তার। তাকে আইন দেখান ছাড়া উপায় নেই। 

আদালতে যাবার রাস্তা ধরতেই অনির পেটের ভেতর খিদে গুলিয়ে উঠল। সকাল থেকে তার কিছু খাওয়া হয়নি। ওদিকে রাস্তার ধারে একটা গুমটি খোলা। হ্যাঁ, একটাই গুমটি। সেই  গুমটিতে দেখল ঘুগনি হচ্ছে। চারদিকে ঘুগনির বাস ম-ম করছে। অনি আস্তে করে ডাকল, প্রতিকার কাকা। প্রতিকার মুখ ঘুরিয়ে বললেন, কিছু বলবি? বলছি, আমার বড় খিদে পেয়েছে কাকা। প্রতিকার কাকা বিরক্তির গলায় বললেন, কাজের সময় কেন এত খিদে পায় বুঝিনা। কী খাবি? অনি আস্তে করে বলল, ওইতো মুড়ি ঘুগনি। 

পেট ভরে মুড়ি ঘুগনি খাওয়া শেষ হলে আবার আদালতের পথ ধরল দুজন। কিন্তু বাদামতলায় গিয়ে প্রতিকার সান্যাল অবাক। চারপাশ খাঁ খাঁ করছে। লোকজন কিছু নেই। আদালতের দরজা বন্ধ। খুঁজে পেতে একজন পথচারীকে ধরল প্রতিকার কাকা। বলল, কি ব্যাপার? পথচারী অবাক হয়ে বলল, আপনি জানেন না? —কী জানব? —পোকার জ্বালায় চারদিক সব বন্ধ। দোকানপাট, বাজার হাট, এমনকি আদালতও বন্ধ। আপনি কিছু শোনেন নি?  —না হে আমার কিছুই শোনা হয়নি। আসলে আমি তো চিঠি চাপাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। 

কথা থামিয়ে প্রতিকার কাকা অনির দিকে তাকালেন তারপর বললেন, চল থানাতেই যাই তাহলে। ওই লোকটার বিরুদ্ধে থানায় একটা ডায়েরি করে আসি। অনি বলল, থানা আবার বন্ধ নয়তো? —না, থানা বন্ধ না, খোলাই। গটগট করে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন প্রতিকার। একটা কনস্টেবল তাকে থামিয়ে বললো, কোথায়? প্রতিকার কাকা বললেন, একটা ডায়েরি করব। —আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? পোকার জ্বালায় পুলিশ এখন চোখে দেখতে পাচ্ছে না। কানেও শুনছে না কিছু। এখন সব কাজ বাদ শুধু পোকার ডিউটি। কনস্টেবল বলল, যান বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ডায়েরি ফায়েরি এখন সব বাদ।

( চার )

মানকুন্ডু স্টেশন রোড যেখানে জিটি রোড ক্রস করছে সেখানেই জ্যোতি সিনেমা। এই এলাকাটা সবসময়ই জমজমাট। লোকজন গাড়ি-ঘোড়া বাজার হাট। আজ এখানেই পুলিশের ডিউটি পড়েছে। দুটো পুলিশের ভ্যান, গোটা চারেক 'পুলিশ' স্টিকার লাগানো মোটরবাইক। বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু চারদিক দেখাশোনা করছে, তার সঙ্গে আছে গোটা পাঁচেক কনস্টেবল আর দু’জন সিভিক পুলিশ। একজন সিভিক পুলিশের নাম হারাধন পল্লে। ছেলেটার বিশাল চেহারা মোটা মোটা হাত-পা, বিশাল একখানা চ্যাটালো বুক। আর তাল গাছের মতো লম্বা। সিভিক পুলিশ হবার যোগ্যতা থরে থরে সাজানো। শুধু দরকার ছিল মাধ্যমিক পাশ একটা সার্টিফিকেট। তো সেটা যোগাড় হতেই সিভিক পুলিশে জয়েন করেছিল হারাধন।

পুলিশ হবার পর তার জীবনটাই বদলে গেল। তার আগে কি হেনস্থাই না  হতে হয়েছে। এখন তাকে বেশ সম্মান দিয়ে কথা বলে সবাই। ‘হারু’ বলে কেউ ডাকে না। ডাকতে হলে বলে ‘হারাধন বাবু’। বড়বাবু মেজবাবুরা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সব তদারকি করছেন। আসল কাজটা করতে হচ্ছে দু'জন কনস্টেবল আর দু’জন সিভিক পুলিশকে। তারাই হাত দেখিয়ে সাইকেল দাঁড় করাচ্ছে, বাইক দাঁড় করাচ্ছে, লোকও দাঁড় করাচ্ছে। সবাইকে নয়, যাদের মুখে মাস্ক নেই তাদেরকেই দাঁড় করাচ্ছে। —কি ব্যাপার মুখে মাস্ক নেই কেন? 

কিন্তু লোকেদের এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই। বারবার সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। রেডিও-টিভিতে কান পাতা দায়। সেখানে সব সময় বলছে ‘মাস্ক পরুন’। ‘নাক মুখ ঢেকে রাখুন’। ‘ভিড় এড়িয়ে চলুন’। ‘খুব দরকার না পড়লে বাড়ি থেকে বেরোবেন না’। কিন্তু কে শোনে কার কথা! লোককে বাড়িতে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ছেলেছোকরারা দলে দলে রাস্তায় চলে আসছে।  কেউ ফাঁকা বাজারের দৃশ্য দেখতে আসছে। কেউ শুনশান ফাঁকা রাস্তা ঘাট দেখবে বলে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। কারো বাইক, কেউ আবার সাইকেলেই সওয়ারি হয়েছে। কেউ শুধু হাঁটছে ফাঁকা রাস্তায়। আর পুলিশের জালে ধরা পড়ছে পটাপট। হারাধন এ ব্যাপারে বেশ করিতকর্মা। দূর থেকে দেখলেই সে এগিয়ে যাচ্ছে, কড়া গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, কি ব্যাপার মুখে মাস্ক নেই কেন?

একটা মস্তান টাইপের ছেলে প্রথমে তেণ্ডাই-মেণ্ডাই করছিল। হারাধন তাকে সোজা এনে দাঁড় করালো বড়বাবুর সামনে। বড়বাবু কড়া গলায় বললেন, কী ব্যাপার মুখে মাস্ক নেই কেন? মস্তানটা মিইয়ে গিয়ে বলল, আজ্ঞে স্যার, ভুলে গেছি। বড়বাবু আস্তে করে বললেন, বেশ ভালো কথা। কান ধরে একশো ওঠবোস করো। খেকুড়ে টাইপের মস্তান টা একেবারে হেদিয়ে গিয়ে বলল, স্যার একশোটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে না! —বেশ তাহলে পঞ্চাশটা।

এরকম মজার শাস্তি জীবনে দেখেনি হারাধন। রুলের বারি নয়,  চড়-চাপড়ও নয়। শুধু কান ধরে ওঠবোস। আবার কারও শাস্তি নীলডাউন, কাউকে আবার চেয়ার সিটিং করতে হচ্ছে। বড়বাবু মানুষটা খুব রাগী। সব সময় যেন ছুটছেন। মুখে কথা ফুটছে। সবকটাকে ঢুকিয়ে দেবো। সবকটা মানে যারা যারা ধরা পড়ছে মাস্ক-বিহীন, তাদের বলছেন। পুলিশের লকআপে ভরে দেওয়ার ভয়ে ধরা পড়া লোকেরা  কুঁকড়ে যাচ্ছে। কান ধরে ওঠ-বস তখন তাদের কাছে জলভাত।
                এদিকে মেজবাবু লোকটা আবার পুলিশ হবার অযোগ্য। নামটিও বড় বিচ্ছিরি। হিমশীতল কুন্ডু। এমন ঠান্ডা ধাতের মানুষকে কোনদিন দেখেনি হারাধন। 'মুখ না ঢাকা' কেস এলেই তিনি নরম করে বলছেন, মুখে মাস্ক নেই কেন? —আজ্ঞে আছে তো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হারাধন বলল, আছে বটে তবে নাকে মুখে নয়, থুতনিতে আছে। লোকটা বলল, ওই হল। হারাধন জোর গলায় বলল, না হলো না। টিভিতে রোজ ঘোষণা করছে গভমেন্ট থেকে। 

তখনই পাশ দিয়ে আর একজন যাচ্ছিল। এই কেসটা মেজবাবুর হাতে ছেড়ে দিয়ে তাকে গিয়ে ধরল হারাধন। বলল, মাস্ক কোথায়? এই লোকটাও বলল, আছে তো। —কোথায় আছে? —পকেটে আছে স্যার। এইরকমই। উত্তরে কেউ বলছে, জানতাম না, স্যার। আবার কেউ বলছে, ভুলে গেছি স্যার। হিমশীতল স্যার তখন নরম করে বলছেন, তাহলে পঞ্চাশটা ওঠ-বস। —পঞ্চাশটা স্যার বড্ড বেশি হয়ে যাবে। আরেকটু স্যার কমিয়ে দিন। —বেশ তাহলে কুড়িটা।

আবার কেউ কেউ শাস্তির ধার দিয়ে যাচ্ছে না। মাস্কের কথা শুনে কেউ পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ চাপা দিচ্ছে। কেউ গামছা চাপা দিয়ে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। হারাধন একজনকে ধরল তার রুমাল নেই, গামছাও নেই। তাকে ধমক দিতেই সে গায়ের গেঞ্জিটা খুলে মুখে চাপা দিল। এদের শাস্তি শুধু বকাঝকার উপর দিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

হারাধন যে কেউকেটা সেটা এখন সবাই বুঝতে পারছে। চিরকাল তাকে সবাই ক্ষমা ঘেন্না করেছে। আজ হচ্ছে উল্টোটা। চেনা দুজনকে বেমালুম ছেড়ে দিয়েছে হারাধন। আরেকজনকে সে চেনে না। কিন্তু তাকে ধরতেই সে হারাধনের সামনে হাত জোড় করে বলল, স্যার, এবারের মত মাফ করে দিন। ‘স্যার’ কথাটা এত সুন্দর, কেউ তাকে ‘স্যার’ বলছে। যে বলছে তাকে কি কোনো শাস্তি দিতে পারে হারাধন! ‘স্যার’ বলা চারজনকে বেমালুম ছেড়ে দিল সে। তবু তক্কে তক্কে ছিল। জীবন জুড়ে অনেকেই তাকে অপমান করেছে। আজ এই সুযোগ, তার অপমান কড়ায়-গণ্ডায় ফিরিয়ে দেবার। ভাবতে ভাবতেই দেখল দূরে সাইকেলে করে একজন আসছে। তখনই দু’পাশ থেকে রব উঠল 'ধরছে' 'ধরছে'।

এ ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছে হারাধন। রাস্তায় পুলিশের ধরপাকড় শুরু হলেই দু’পাশের লোকজন বাইক চালকদের সাবধান করে দেয়। কারো মাথায় হেলমেট নেই, কারোর ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, কারো আবার ধোয়ার কাগজ নেই। এসব ক্ষেত্রে ফাইন অনিবার্য। এরকম সময় রাস্তার দু'পাশের লোকজন বাইক আরোহীদের সতর্ক করে দেয় 'পুলিশ ধ রছে' বলে। এটা হল পুলিশের ওপর রাগের কারণ।এখন সাইকেলে করে আসা ওই লোকটার দিকে সবাই সতর্ক বার্তা পাঠাতে লাগলো ‘ধরছে’  ‘ধরছে’। 

কিন্তু লোকটার কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কাছে আসতেই লোকটাকে চেনা চেনা মনে হল হারাধনের। বয়স আন্দাজ পঞ্চান্ন, খুব একটা অডিনারি ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, মাথার চুলগুলো সাদা, আর পায়ে একটা অডিনারি চটি। আর মুখটা চেনা চেনা। চেনা চেনা কিন্তু চিনতে পারছেনা সে। রাস্তার দু'পাশ থেকে তাকে যে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই এই লোকটার। মাথা নিচু করে একমনে সাইকেলে প্যাডেল করে যাচ্ছে। মন দিয়ে কিছু ভাবছে নিশ্চয়। 

আরেকটু কাছে আসতেই লোকটাকে চিনতে পারল হারাধন। আরিব্বাস ঐতো তাদের ইস্কুলের অংক মান্না স্যার। নাম একটা ছিল বটে, কিন্তু সেই নামে কেউ ডাকেও না তাকে, চেনেও না। এমন অংক পাগল লোক পৃথিবীতে আর দুটি নেই। যে ছাত্র অংক পারত তাকে কোলে তুলে নিত । আর যার মাথায় অংক ঢুকত না তার দুর্ভোগের একশেষ । তো এমন মাস্টার এর আসল নাম ভুলে গিয়ে লোকে অংক মান্না বলবে, এ আর বেশি কথা কি। হারাধনকে ওই লোকটার হাতে হেনস্তা হতে হয়েছে সারা স্কুল জীবন। ওই মানুষটার ক্লাসে হারাধনের শাস্তি ছিল বাধা। কোনদিন নীলডাউন, কোনদিন বেঞ্চির উপর দাঁড়ান, আবার কোনদিন কান ধরে ওঠ-বস। যদি ঠিকমতো হিসেব করা যায় তাহলে দেখা যাবে হারাধন এক হাজার সাতশো ওঠ-বস  করেছে সারাজীবনে। তিনশো নীলডাউন, আর অগুনতি বার বেঞ্চির উপর দাঁড়ান।

মুখে মাস্ক ছাড়া অংক মান্না স্যারকে দেখে আজ মনটা আনন্দে ভরে গেল তার। আজ একটা মোক্ষম জবাব দেয়া যাবে লোকটাকে। কাছাকাছি হতেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল হারাধন। সে হাত দেখিয়ে অঙ্ক স্যারকে বলল, দাঁড়ান। লোকটার ভয়-ডর নেই। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে তাকে যে চিনতে পারবে না এটা জানা কথা। স্যারেরা শুধু ভালো ভালো ছেলেদেরই  মনে রাখে। খারাপ আর বখাটে ছেলেদের মুখটা তাদের মনে রাখার কথা নয়। তাই হারাধন নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, একটু দাঁড়ান। 'স্যার' কথাটা ইচ্ছা করে উচ্চারণ করল না সে। কিন্তু অবাক কান্ড, অঙ্ক স্যার এগিয়ে এসে বললেন, তুই হারাধন না? বাহ বেশ বেশ, তুই পুলিশের চাকরি পেয়েছিস নাকি? যাহোক এবার মন দিয়ে চাকরি করো বাবা।

সহজ কথা, নরম কথা, খানিকটা তার মনযোগান কথাও বলা যেতে পারে। কিন্তু এতে মোটেই ভুলবেনা হারাধন। আসলে তার গায়ে পুলিশের ড্রেস বলেই লোকটা খানিক নরম গলায় কথা বলছে। কিন্তু এতে হারাধন মোটেই  নরম হবে না। এতদিনকার জমানো রাগ। তাই হারাধন কড়া গলায় বলল, সামনে আসুন। সামনে মানে যেখানে বড়বাবু আছেন। বড়বাবু মানুষটা মোটেও মেজবাবুর মত নরম নন। এই মানুষটা রাগী আর গম্ভীর প্রকৃতির। যার সামনে দাঁড়ালে শাস্তি নির্ঘাত বাধা। হয়তো বুড়ো মানুষ আর বড় মানুষ দেখে শাস্তি কিছুটা কমতে পারে।  ওঠ-বস পঞ্চাশটার জায়গায় যদি কুড়িটাও হয় তাহলেও তার শান্তি। তার এতদিনকার পুরনো ক্ষতে একটু প্রলেপ পড়বে। তখন যদি কান ধরাটা বাদ দিয়ে শুধু উঠ-বস করানো হয় তাতেও খুব একটা ক্ষতি হবে না। বড়বাবুর সামনে টানটান দাঁড়িয়ে গলা চাপা করে হারাধন। বলল, এই দেখুন মুখে মাস্ক নেই স্যার। তারপর গলাটা চাপা করে বলল, ইনি বঙ্গ বিদ্যালয়ের অঙ্কস্যার। যদি বলেন তাহলে অন্তত দশটা ওঠবস করিয়ে ছেড়ে দিই, আপনি কি বলেন?

হারাধন ভেবেছিল তাকে পাত্তা না দিয়ে বড়বাবু পঞ্চাশটা ওঠ-বসই বহাল রাখবেন। কিন্তু ঘটনা তা ঘটল না। হারাধন পরিষ্কার দেখল বড় বাবুর শরীর থেকে রাগ সরে যাচ্ছে। মুখ চোখ সহজ স্বাভাবিক হয়ে গেল। মানুষটা হঠাৎই ঝুকে পড়ে অংক স্যারের পায়ে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘটনায় একেবারে ভ্যাবলা হয়ে গেল হারাধন। রাগী মানুষটা হঠাৎ খুব শান্তশিষ্ট আর নরম গলায় বললেন, মাস্টারমশাই, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি অনুপম।
                   হারাধন কে যারপরনাই হতাশ করে অংক মান্না স্যার হাসলেন। চিনতে পারব না? তুই ভারী দুষ্টু ছিলি। তবে অংকে তোর মাথাটা ছিল ভাল। তুই বুঝি এখন আমাদের থানায় পোস্টিং পেয়েছিস? —আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। রাগী বড়বাবু এখন বেশ নরম গলায় বললেন, তবে আপনি এখন রাস্তায় কেন? ভাইরাস নিয়ে চারদিকে যে তুমুল শোরগোল পড়েছে আপনি জানেন না? —হ্যাঁ জানব না আবার। ওই কারণেই তো ইস্কুল বন্ধ আট মাসের ওপর। ছেলেরা সব পড়া ছাড়া, অংক ছাড়া। এমন হলে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে ছাত্রদের। মন্ডল বাগানের একটা বাড়ির হলঘরে দু'ঘণ্টা করে বসার ব্যবস্থা করেছি। যারা যারা পারবে তেমন ছাত্রদের  আসতেও বলেছি। 

বড়বাবু আস্তে করে বললেন, বেশ যান মাস্টারমশাই। তবে সাবধান। বলে একটা নতুন মাস্ক অংক স্যারের দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, এটা পরতে ভুলবেন না যেন। পাশে দাঁড়িয়েই দেখছিল হারাধন পল্লে। থানার বড়বাবু ওই লোকটার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। সেই থানারই সিভিক পুলিশ বলে তারও স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাটা উচিত। ভাবতে গিয়ে বেশ দেরী করে ফেলল হারাধন। অংক মান্না স্যার  মুখে মাস্ক পরে তখন এগিয়ে গেছেন। ( ক্রমশ)





নাটক (পর্ব – দুই)

তোতাকাহিনী

মূল কাহিনী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নাট্যরূপ - সুব্রত নাগ

[ চরিত্র :- রাজা, মন্ত্রী, রাজপণ্ডিত, কোতোয়াল, ভাগনে, স্যাকরা ও নিন্দুক]


[তৃতীয় দৃশ্য]

[নিন্দুকের প্রবেশ। নেপথ্য থেকে বিভিন্ন বিষয় পড়াবার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।]


নিন্দুক      -    শিক্ষা তো শুরু হল, ভয়ানক তেজ 

        পুস্তকে ঢাকা পাখি - মাথা থেকে লেজ।

        হৈ চৈ হাঁকডাক, বাজে ঢাক ঢোল

        ছেলে বুড়ো মেতেছে মহা শোর গোল।

        ভারি ভারি পুঁথি আর মোটা মোটা খাতা

        অঙ্ক আর ইংলিশে ভরে গেল পাতা।

        তোতাটাকে কত লোক দর্শন করছে

        পাখিটার ভাগ্যে জ্বলে পুড়ে মরছে।

        বনে গাছে উড়ত - নেই চাল-চুলো

        তাকে পড়া শেখাতেই টাকা এতগুলো!

        আমাদের ঘরে কত ছেলেপুলে রয়েছে

        শিক্ষা সবার চাই - এ কথা কে ভেবেছে?

        এসব তো ছেঁদো কথা - এগুলোকে বাদ দিন -

        কী কী পাশ দিল পাখি, নেট খুলে জেনে নিন।

        এত খ্যাতি, বৈভব পায় কয়জনা

        তবু কেন তোতাটার মন  উন্মনা -

        ভোর হয়, রবি ওঠে রাঙা আলো মেখে

        আনচান করে মন তোতা ওঠে ডেকে।

        নেই নেই নীলাকাশ, বন্ধুরা কই?

        সোনার খাঁচাতে আছে রাশি রাশি বই।

        দানা নেই, পানি নেই, নেই আলো হাওয়া

        পাবে কবে সেই সুর, গলা ছেড়ে গাওয়া।

    [মঞ্চে আলো কমে আসে। পাখির শিস শোনা যায়। নেপথ্যে গান ভেসে আসে - ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে / আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে।’]   [আলো নিভে যায়।]


[চতুর্থ দৃশ্য]

[ভাগনে পায়চারি করছে। কোতোয়াল হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল।]


কোতোয়াল    -    এই যে আছেন ভাগনে সাহেব, এমন তলব কেন? 

            খেতে বসেও জুটল না ভাত, বাজ পড়েছে যেন।


ভাগনে        -    বাজ বললে বাজ, নইলে বলো  শমন 

            একটু পরেই মহারাজের হচ্ছে আগমন।


কোতোয়ালি    -    এই মরেছে, কাজ সেরেছে, হঠাৎ তদারকি;

            পান থেকে চুন খসলেই মিলবে বকাবকি।


ভাগনে        -    তবেই বোঝো ব্যাপারখানা কেমন সিরিয়াস?

            ঢপবাজি যা চলছে হেথায় কেউ কোরো না ফাঁস।

কোতোয়াল    -    পাগল নাকি। নিজের পায়ে নিজে কুড়–ল মারে? 

            গুহ্য কথা ফাঁস করলে থাকবে মাথা ঘাড়ে?


ভাগনে        -    ইমপর্ট্যান্ট বলছি যা খাতায় করো নোট

            দেখলে বেচাল, ঘাড়ধাক্কা - বলব তাকেই ‘ফোট’।

            ঘন্টা, শাঁখ, তূরীভেরি, কাঁসর, বাঁশি. ঢোল

            জগঝমন, মৃদঙ্গ, কাঁসি, করতাল, খোল।

            সঙ্গে ক’টা টিকিধারী পণ্ডিতকে নাও,

            বলবে তোমরা মহারাজার জয়ধ্বনি গাও।

            লিপিকার রা’ও আসুক সাথে দিস্তা দিস্তা খাতা

            পুঁথি দেখে নকল করুক পাতার পর পাতা।


কোতোয়াল    -    এই প্ল্যানেতেই হবে নিয্যাস রাজামশাই মাত

            পুকুরচুরি করতে গেলে রাখুন হাতে হাত।

            দুশ্চিন্তা না করে আর ব্রেনটা রাখুন ফাঁকা

            রাজামশাই আসার আগে করছি সব পাকা।

            [কেতোয়াল ভাগনের হাতে হাত মেলায়। তারপর বেরিয়ে যায়]


ভাগনে        -   

[খুশীতে গান ধরে]    ‘‘এই যে গো ভাগনা

                কাঁদা কিংবা রাগ না,

            হাঁফ ছাড়া মন শুধু উড়বে;

                মামা যদি খুশী হ’ন

            কানে কানে ডেকে কন -

                মুক্তোর হার গলে ঝুলবে।’’

    [বাইরে থেকে শোনা যায় - ‘‘সাবধান, সাবধান - মহারাজ শ্রীল শ্রীযুক্ত বীরবিক্রম রায় পক্ষীশালার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন।]


ভাগনে        -    কোতোয়াল, কোতোয়াল

            [কোতোয়াল ছুটে এসে স্যালুট করে]

            অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেল? আসছেন রাজা


কোতোয়াল    -    আমরাও রেডি তো - [বাইরের উদ্দেশ্যে]

            তোরা [হাত নাড়িয়ে] ঢাক ঢোল বাজা।

        [বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রের আওয়াজ শোনা যায়। সঙ্গে শঙ্খ নাদ, মন্ত্র পাঠও চলতে থাকে। মহারাজ প্রবেশ করেন।]

মহারাজ        -    [খুশী হয়ে] বাঃ, বাঃ! বেশ, বেশ - সব দেখি খাসা - 


ভাগনে        -    এতটুকু খুঁত নেই - আয়োজনে ঠাসা।


রাজা        -    হই চই হাঁকডাক - কানে লাগে তালা


মন্ত্রী        -    এত রব, করে সব প্রাণ ঝালাপালা।

ভাগনে        -    শব্দ তো শুধু নয় - অর্থও কত 

            ব্যয় হয়- দেখছেন লোক শত শত।


রাজা        -    আজ যদি তদারকে নিজে না আসতাম 

            এতা ঘটা, আয়োজন - কখনো কি জানতাম?

            শুনে রাখো ভাগিনা, বাড়াবই মাহিনা, যে যা খুশী বলে যাক লোক,

            তুমি স্রেফ করো কাজ, হারজিত নাহি লাজ, করো না কো এক ফোঁটা শোক।

            এত যে ঝরেছে ঘাম, তারও ঠিক দেব দাম- লোভনীয় এই পুরস্কার,

            গলা থেকে খুলে নিই, সবার সামনে দিই - স্বর্ণখচিত এক হার।


ভাগনে        -    ধন্য মামা থুড়ি রাজা আপনার যে দান

            ভুলব না কো বাঁচব যদিন, গাইব রাজার গান।


মন্ত্রী        -    সাধু সাধু বলো সবাই - সাধু সাধু বলো

            ইন্সপেকশন্  শেষ হল - এবার ফিরে চলো।

[সম্মিলিত সুরে ‘সাধু’ ধ্বনি শোনা যায়। মহারাজ ফিরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ নিন্দুক গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।]


নিন্দুক        -    মহারাজ, মহারাজ- মিটল কি কাজ?


রাজা         -    একদম, একদম - খুশী আমি আজ।


নিন্দুক        -    কী জন্যে এসেছেন সে খেয়াল আছে?


রাজা        -    আলবত - এসেছি তো পাখিটার কাছে।


নিন্দুক        -    বারে বা, পাখিটাকে দেখে এসেছেন? 

            শিক্ষা এগোল কত- বুঝে নিয়েছেন?


রাজা        -    [জিভ কেটে] এই যাঃ! মন্ত্রী, ভুলে মেরেছি!

            হয় নি তো পাখি দেখা, ভুল করেছি।

            কই হে ভাগনে, কোথা আছে পাখি?

            কোথা কে খোঁচা দেবে, সব দেখে রাখি।


ভাগনে        -    বেশ তো, আসুন না - নিজে দেখে নিন

            কী নিবিড় শিক্ষায় কাটে প্রতি দিন।

            [ভাগনে হাত দিয়ে একটা কাল্পনিক পর্দা সরিয়ে দেয়।]

            ওই যে সোনার খাঁচা ঝলমল করে

            দাঁড়ে বসে আছে পাখি পুঁথি মুখে ধরে।

            দিনে পড়া, রাতে পড়া দানাপানি বন্ধ

            কী দারুণ শিক্ষা! নেই কোনো ধন্ধ।


মন্ত্রী        -    করলে অবাক ভাগনে বাবু, শাবাস ভায়া শাবাস

            ওরে, কে রে আছিস তোরা, নিন্দুককে ভাগাস।

রাজা        -    সত্যি কথা, মন্ত্রীমশাই - নিন্দুককে ধরে 

            কানমলা দাও সকাল-বিকাল একশো একশো করে।



ভাগনে        -    হিংসে, স্রেফ মন্ত্রীমশাই - হিংসে করে লোকে;


রাজা        -    এগিয়ে যাও, ভাগনে তুমি - কে তোমাকে রোখে?

    [আবার তুরী ভেরী বেজে ওঠে। মহারাজার নামে জয়ধ্বনি ওঠে। মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়।] (ক্রমশ)







শারদীয়ার স্মৃতিকথা
অসীম হালদার


আর মাত্র কটা দিন বাদে মাইকে বাজতে চলেছে  "যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যই নমস্তস্যই নমস্তস্যই নমো নমোহ:।...." সেই গলা, সেই আওয়াজ, যা আকাশে বাতাসে মুখরিত হতো আশ্বিনের শারদ প্রাতে দেবী মহামায়ার আগমনে। উদাত্ত কণ্ঠের শিল্পীকে কে না চেনেন! হ্যাঁ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। 
মহালয়ার সেই দিনে ভোর চারটেতে বিবিধ ভারতীর বেতার তরঙ্গে পুরানো দিনের তিন ব্যাটারীর রেডিও তখন গম গম করে বাজতো 'মহিষাসুরমর্দিনী'। তাঁর ছন্দোময় সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণে মুখরিত হতো গোটা পরিবেশ। বাজতো বিখ্যাত শিল্পীদের গান। "বাজলো, তোমার আলোর বেণু..." অথবা "তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা..." এই গানগুলো শুনে সেই ছোটবেলা থেকেই মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। শিহরিত হতাম, আবেগে ভাসতাম। ঘুম-ভাঙ্গা চোখ কচলে চোখেমুখে জল ছিটিয়ে বিছানায় বসে শুনতাম মহালয়া। শুনতে শুনতে চোখ ঘুমে এতো জুড়িয়ে আসতো যে কখনো টলতামও বিছানায়। আবার সজাগ হয়ে শুনতাম। এই আবেগে ভাঁটা পড়ে নি আজও। 

ত্রিনয়নী মা দুর্গা, মানেই বাঙালীর নাড়ির সাথে মিশে আছে বঙ্গসংস্কৃতির ধারা। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যাপী যে আনন্দ উদ্দীপনা চলে, তার রেশ কিন্তু রয়ে যায় মায়ের বিসর্জনের পরেও বহুদিন। 
স্কুলে পুজোর ছুটি পড়লে মনে হোত, ব্যস্, কদিনের জন্য শান্তি। এই সুবাদে নতুন জামা-প্যান্টের প্রাপ্তি মনে বেশ আনন্দ নিয়ে আসতো। নতুন বাক্সের সাথে জড়িয়ে থাকতো ছোটবেলার অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি। এখনকার মতো তো আর তখন শপিং মলের এতো রমরমা ছিল না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার মানেই তো একটা পরিকল্পনা পুজোর ঠিক আগে। 'বোনাস' নামটা তখনই প্রথম শোনা বাবা মার কাছ থেকে। বাবা-মাকে দেখতাম আলোচনা করতে, পুজোয় কাকে কি দিতে হবে, এই নিয়ে। না, না, এখনকার মতো একাধিক নতুন সেট একেবারেই নয় গো। ঐ একটি নতুন পোষাকেই খুশী থাকতাম পুজোয়। তবে নতুন জুতো যে পেতাম, তা নয়। পুরানো জুতোতেই ভুলতাম দুঃখ। বাবা মায়ের সাথে ঘুরে ঘুরে প্যাণ্ডেলে ঠাকুর দেখবো, খাবার খাবো...ব্যস্ এতেই খুশী।

বাবার অফিসে বদলির জন্য আমি ছোটবেলা থেকে অনেকগুলো স্কুলে পড়েছি এবং পুজোর সংস্কৃতিও পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন। জীবন শুরু যাদবপুরের ভাড়াবাড়িতে...বাপ্পাদাদের বাড়িতে। তাঁর ছিলো ইলেকট্রিক জিনিসপত্রের ব্যবসা। তাই প্রায়শঃই ঘরে থেকে শুনতাম বিভিন্ন শিল্পীর গান। রেকর্ড প্লেয়ারে বাজতো মান্না, কিশোর, রফি, আশা, লতা, সন্ধ্যার গান। পুজোর ঠিক আগে ঘর থেকে সমস্ত সরঞ্জাম বাইরে বের করে দিয়ে টেস্টিং চলতো...সবকিছু ঠিকমতো চলছে কি না।
বাপ্পাদার বাবা, স্বর্গীয় অজিত মুখার্জীকে মেসো বলে ডাকতাম। তাঁর কাছে থেকে কতো কিছু শুনেছি, শিখেছি। বাংলা, ইংরাজী, অঙ্ক শিখেছি। মাঝে মাঝে সংস্কৃত শ্লোকও বলতেন। সাদা ধুতি পরতেন, খয়ের দিয়ে পান খাওয়ার জন্য মুখটা লাল হয়ে থাকতো। তখন নবদুর্গার কথাটা খুব শুনতাম।মেসো পুজোআর্চার সাথে যুক্ত থাকতেন বলে একদিন জিগ্যেস করেছিলেন, 'তুমি কিছু জানো নবদুর্গা সম্বন্ধে?' উত্তরে হেসে অতি সহজেই বলেছিলাম, 'মা দুর্গার ন'টি রূপই নবদুর্গা।' কিন্তু পরের প্রশ্নটির জন্য তৈরী ছিলাম না আমি। পরের প্রশ্নটি ছিল, 'সেই রূপগুলো কি তুমি জানো?' প্যাণ্ডেলে যা দেখেছি, তা মনে করে সম্ভবতঃ বলেছিলাম একটি রূপ হলো কাত্যায়নী, আর একটি হলো দেবী চামুণ্ডা। তবে মহালয়া শুনে দেবী কাত্যায়নীর কথা আমার মনেই ছিলো। পরে জেনেছিলাম স্বয়ং ব্রহ্মা সেই নয়টি রূপের নাম দিয়েছিলেন। নিজের উৎসাহে পরে জেনেছিলাম, মা দুর্গার সেই রূপগুলি হলো শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্ধমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী। চাইলে তোমরাও এ বিষয়ে আরো ভালো জানতে পারবে বই পড়ে। 

যাইহোক, পুজো মানেই তো চাঁদা তোলার একটা যজ্ঞ দু তিনমাস ধরে। তা একবছর আমি মাসীবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছি। পথে এক স্কুলবন্ধুর সাথে দেখা, ও দাদাদের সাথে চাঁদা তুলতে বেরিয়েছে। আমি ওদেরকে আমাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলাম চাঁদা দেবো বলে। মা পরে বলেছিলো, 'তুই এতো বোকা কেন? এইরকম কেউ বাড়িতে লোক ডেকে এনে চাঁদা দেয় না কি!' অথচ আমি খুশী হয়েছিলাম চাঁদা দিয়ে। কেমন উৎপটাং ভাবনা ছিলো, বলো!
পুজোর ছুটি পড়লে বাবা, জ্যেঠুর সাথে গ্রামের বাড়ি, বাসন্তীতে পাঠিয়ে দিতো। ভয়ে বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারতাম না! সেখানে মাত্র খান দুয়েক ঠাকুর দেখেই ক্ষান্ত থাকতে হতো। তেমন লাইটিং নেই, গান বাজলেও মনে ধরছে না, ঘুরে বেরানোর মনের মতো বন্ধু বান্ধব নেই...সে একটা বিরক্তিকর ব্যাপার! ছুটি কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, ক্যানিং স্টেশনে মাইকে বাজতো, "আজ বিজয়া দশমী, যাঁরা মাকে বরণ...., তাঁরা.....চলে আসুন।" মানে পুজো শেষ! আর আমারও বাড়ি ফেরা! এর অর্থ এটাই যে আবার বাড়ি গিয়ে বইপত্তর নিয়ে বসা! মুখটা তখন বাসি চাটনি আর কি!

যখন ক্লাস ফাইভে, তখন সোনারপুরের কাছে একটি ভাড়াবাড়িতে। একটা গ্রুপ ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার। পুজোর আগে গানবাজনা আর নাটকের রিহার্সাল চলতো। বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েরা ছিলো। দেখে ভাবতাম এরকম যদি গাইতে পারতাম, অভিনয় করতে পারতাম! সবাই পুজোর আগে এসবে মেতে উঠতো অনুষ্ঠানের জন্য। 

পুজোর কথায় বাজির প্রসঙ্গও আসে বইকি। তখন সুপারহিরো ছিলো চকলেট ব্যোম। আমারও খুব ইচ্ছে ফাটানোর। কিন্তু কিনে দেবে কে! অনেক আবদারের পর একটা শস্তার বন্দুক আর দু বাক্স ক্যাপ জুটেছে। পরে রাজকুমারীর ফুলঝুড়ি আর এক প্যাকেট কালি পটকাও জুটেছিলো। কিন্তু মনে তো স্বাদ চকলেট ব্যোমের, তার স্থান পূরণ তো ওসবে চলে না! অনেক দিনের আশা একবছর পূর্ণ হলো অবশেষে। যদিও তা শুধু মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার পর, বাবা জানতো না। এক স্কুলবন্ধুর সাথে চলে গেলাম সোজা চাম্পাহাটি। পিঠে ব্যাগ আর কিছু টাকা পয়সা নিয়ে ট্রেনে করে। দেখলাম প্রতিটি বাড়িতেই থরে থরে সাজানো বিভিন্ন বাজি। রকেট, দোদমা, তুবড়ি, রং মশাল আরও কতো কি! বাড়ির সব সদস্যরাই বাজি বানাতে ব্যস্ত। সামনে পুজো, তাই। গুচ্ছের ক্রেতাদেরও ভিড় সব বাড়িতে। বেছে বেছে একটি বাড়ি থেকে ছয় বাক্স চকলেট ব্যোম কিনে ব্যাগে ঢুকিয়েই মুখে চওড়া হাসির ঝিলিক! সাধ পূরণ করে তা উপভোগ করেছি। কিন্তু এখন আর বাজির শব্দ ভালো লাগে না। দূষণের কথাও তো মাথায় রাখতে হবে, তাই না!

জীবনে কিছু ঘটনা এমনই দাগ কেটে যায় যে তা কোনদিন মন থেকে সরে না। আবার বদলি বাবার, সেবার ডায়মণ্ডহারবার থেকে চল্লিশ মিনিট ভেতরে, গ্রাম্য এলাকা। গ্রামের নাম মাথুর। ক্লাস সেভেনে হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষায় জীবনে প্রথম ফেল করার অনুভূতি হলো! একটি নয়, তিন তিনটি বিষয়ে! তোমরা নিশ্চয়ই হাসাহাসি করছো জেনে। কিন্তু হ্যাঁ, এটাই সত্যি। বাবাকে ভয়ে মিথ্যে কথা বলেছিলাম বলে তার শাস্তিও পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই আঘাত আমার জীবনে শাপে বর হয়েছিলো। তারপর থেকে বাবা প্রতি শনি ও রবিবার করে পরীক্ষা নিতো তিনঘণ্টা করে। সে বছর দুর্গাষ্টমী পড়েছিল রবিবারে। কিন্তু পরীক্ষা বন্ধ হয় নি। রাগ হলেও সহ্য করেছি। এক অফিস কলিগ এসেছিলেন সেদিন। তাঁর কথাতেও চিড়ে ভেজে নি। চারিদিকে পুজোর গান বাজছে, ছেলেমেয়েরা রাস্তা দিয়ে হই হুল্লোড় করে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে, আর আমি পুজোর সময় ঘরবন্দী! মুখ কালো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন পরীক্ষা দিচ্ছি। তবে আমিও জেদ চেপেছিলাম, পরীক্ষা না দিয়ে ঠাকুর দেখতেই বেরোব না। মনে আছে, সেবারের পরীক্ষাতেই আমি বাবার কাছ থেকে সবচাইতে বেশী নম্বর পেয়েছিলাম। হয়তো মা মহামায়ার অসীম কৃপার জোরেই। ফাইনাল পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর নিয়েই পাশ করেছিলাম সেবার। অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম যে যদি জেদকে সঠিক পথে চালনা করা যায়, তার সুফলই পাওয়া যায় জীবনে।

কোভিড-দৌরাত্ম্যে গত বছর থেকে পুজোর আনন্দে কিছু তো ভাঁটা পড়েইছে, সে তো তোমরা সকলেই টের পাচ্ছো। নতুন করে কি আর বলবো! তবে দুর্গাপুজোর আনন্দের কথা বলে শেষ করা যায় না। শুধু যে ঠাকুর দেখা, প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ঘোরা, তা তো নয়। অনেকে আবার পুজোয় বেড়াতেও যায়। তবে কি জানো, পুজোর সময় এলাকা ছাড়তে একদমই মন চায়না। মাকে নিয়ে কটা দিন আনন্দে কাটাবো না, তাই কখনো হয় নাকি!

এবারে গড়িয়া এলাকায় এলাম। কোথাও কাঁচা মাটির রাস্তা, কোথাও ব্যাটস ফেলে রাস্তা তৈরী হয়েছে। তখন বাড়িঘর কম, নতুন বাড়ি হাতে গুণেই বলা যায়। রাস্তার পাশের ফাঁকা জমিতে দশ বারো ফুট উঁচু হোগলা বন। সে বছরেই প্রথম দুর্গাপুজো, কিন্তু হবে কোথায়! সবাই মিলে একটা ভালো ফাঁকা জায়গা দেখে ঠিক হলো। সেটা পরিষ্কার করার পর দেখি সেখানে কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও বা কোমর সমান জল! প্যাণ্ডেল কি করে হবে! কাকুরা বললেন উঁচু করে বাঁশ আর তক্তা পেতে তার ওপরে বেদী বানানো হবে। সে এক দারুণ ব্যাপার। এদিকে আমাদেরও নতুন বাড়ি তৈরী হচ্ছে।  কাছেই মণ্ডপ। ফাঁকা জলাজমির কোথাও কাশফুল হাওয়ার দোলায় নেচে উঠছে, শরতের আকাশে মেঘের ফাঁকে সূর্যের আনাগোনা, ছেলে ছোকরারা বেরিয়ে সবাই প্যাণ্ডেলের কাজকর্ম দেখছে। কারোর বাড়ি ফেরার নাম নেই। সারাদিনই মণ্ডপে খেলাধূলা। শোনা গেলো পুজোয় ফাংশানও হবে। অঙ্কন প্রতিযোগিতা, ধুনুচি নাচ, মিউজিক্যাল চেয়ার এইসবও! বাপ্ রে! শুনেই তো আনন্দে ডগমগ।

ঠাকুরমশাই ফর্দ দিয়ে গেলেন। দশকর্মার ফর্দও আসবে কদিন পর। প্যাণ্ডেল তৈরী হলো। রাস্তার দুধারে লাইটিংএর কাজকর্ম চলছে। বসতি খুব বেশী নয়, তাই আয়োজনও কম। তা বলে মনের আশা তো কম নয়, উৎসাহও লাগামছাড়া। ঠিক হলো ফুলের মালা আনা হবে বড়বাজার থেকে।  ঢাকি ভাইদের আনা হবে শিয়ালদা থেকে। ফলমূল, পুজোর উপকরণ ইত্যাদি সমস্ত কাজই ভাগ করে দেওয়া হলো সব সদস্যদের মধ্যে। প্রতিদিনের পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হলো মহিলা সদস্যদের। চাঁদা কাটার পর্ব প্রায় শেষ। উৎসাহী সদস্যরা মিলে থার্মোকল দিয়ে প্রবেশপথ সাজিয়ে দিলো। রাতের আলোয় চুমকিগুলো চক চক করতে লাগলো, গান বাজতে লাগলো মাইকে। পুজোর গন্ধে আকাশে বাতাসে খুশীর পরশ। 

কাকভোরে শিয়ালদায় নামতেই দুম দুম শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই চোখে পড়লো সারি দিয়ে প্রায় এক কিমি রাস্তা জুড়ে ঢাকি ভাইদের সমাবেশ! ঢাকের বাদ্যিতে কম্পিত ধরণী। দেয়ালে লেগে শব্দের প্রতিধ্বনি। এক এক দলে দুজন, চারজন, পাঁচজন মিলে ঢাক, কুড়কুড়ি, কাঁসর বাজিয়ে নিজেদের মহিমা তুলে ধরছে বায়নাকারীদের কাছে। এরা কেউ বর্ধমান, কেউ মুর্শিদাবাদ, কেউ বা মেদিনীপুর বা দ: চব্বিশ পরগণার। তাঁদের কথার টানও আলাদা। পোশাক দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে এদের সাথে দারিদ্র্যতা নিত্যসঙ্গী; জামাপ্যান্টের অনেক জায়গা সেলাই করা, পায়ে পুরানো চপ্পল, মাথায় তেল চপচপে । বাচ্চা ছেলেকেও সাথে নিয়ে এসেছে সঙ্গত দিতে৷ পাঁচদিনের কামাইতে যা আসে, তা নিয়েই ফিরে যাবে দেশে। তাই দিয়ে চড়বে ভাতের হাঁড়ি, শিশুদের মুখে ফুটবে নির্মল হাসি। পছন্দসই ঢাকিকে সাথে করে বাড়ির পথে পা। প্যাণ্ডেলের কাছে পৌঁছানোর পথে ঢাক আর কাঁসরের শব্দে পাড়ার মানুষ সামনে এলো। সূর্যাস্তের পর পরেই মায়ের মুখ আলোরাশিতে ভরে উঠলো। দেখলাম মা ভয়ানক রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরের বক্ষে আঘাত হেনেছেন আর তাতেই কুপোকাৎ অসুররাজ। মায়ের অপরূপ মহিমায় সবাই মুগ্ধ! মায়ের দুপাশে কার্তিক, সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশ আলো করে আছেন। ষষ্ঠীতে দুপুরে "বসে আঁকো" প্রতিযোগিতা হলো। মহাষ্টমীতে সকাল থেকেই মহা ধূমধাম। সন্ধিপুজোও শেষ সময়মতো। কিন্তু বেলা বাড়তেই মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। বিকেলে তুমুল বৃষ্টি। মণ্ডপে তখন সরেজমিনে দেখা চলছে যাতে ঠাকুর নষ্ট না হয়। ভাগ্যিস মোটা ত্রিপল দিয়ে চালা ঢাকা দেওয়া ছিল, তাই রক্ষে। সেদিন রাতে বৃষ্টি থেমে গেলেও ঝোড়ো হাওয়া বইছিলো বেশ। পরের দিন সকালে প্যান্ডেলে তাকিয়ে দেখি 'দুর্গোৎসব' লেখাটির মধ্যে শুধু 'দ' আর 'ব'কে দেখা যাচ্ছে। হাওয়ায় খুলে বাকি অক্ষরগুলো জলে ভাসছে। এবার বিড়ম্বনা হলো মাকে বরণ করা নিয়ে, এদিকে একাদশীতে বিসর্জন। কেউ চাইছেন দশমীতেই বরণ করবেন। এই সিদ্ধান্ত নিতে বড়োদের ওপর একটা চাপ ছিলো। প্রথম বছরটা মোটের ওপর ভালোই কাটলো। 

আর একবারের কথা বলতে গেলে এখনও অবাক হই। নবমীতে খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত কয়েক বছর ধরেই। তো সেবারও বৃষ্টি আমাদেরকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো। নবমীর সকাল থেকেই সদস্যদের দৌড়ঝাঁপ চলছে মায়ের ভোগ রান্না নিয়ে। চাল, ডাল, সব্জি বাজার শেষ। দুপুর থেকে আকাশে মেঘ জমছে। গুর গুর শব্দও শোনা যাচ্ছে বিকেলে। পাশের বাড়ির উঠোনে ভোগ রান্না হচ্ছে। সেইমতো যোগাড়াদিও হচ্ছে। এক কড়া খিচুড়ি নামানোর পর দু তিন ফোঁটা করে বৃষ্টি গায়ে লাগতে শুরু করলো। বিপদ বুঝে পলিথিন পেপার যোগাড় হলো। হঠাতই ঝর ঝর করে ঝরণা ঝরতে লাগলো। মাথার ওপর দিয়ে দু দিকে দড়ি দিয়ে পলিথিন বাঁধা হলো। আর বাকি দুদিকে ধরে রইলাম দুজন, যাতে ভোগে বৃষ্টির জল না পড়ে। হঠাৎ তার মাঝখান দিয়ে বৃষ্টির জল বেশ কিছুটা পড়ে গেলো কড়াইএর মধ্যে। এদিকে মশলার গামলা, সব্জির বালতিতে জল ছিঁটছে, ভিজে ভিজে তখন সবাই মায়ের ভোগ বাঁচাতে ব্যস্ত। ঘণ্টাখানেক পর বৃষ্টি থামলো। কিন্তু ভোগ নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। কে কি বলবেন...কে জানে! ঠাকুর দেখে ফেরার পথে চেয়ারে তখন লোকেরা বসে আছেন একটু ভোগের জন্য। বৃষ্টির পরে ঠাণ্ডা হাওয়া। গরম ভোগের সাথে লাবড়া...আহা! এসব দেখে ভক্তরা উল্লসিত। গোটা চারেক ব্যাচ উঠে যাওয়ার পর জনতার ফিডব্যাক একটাই..."দারুণ হয়েছে মায়ের ভোগ!" অনেকে আবার বাড়িতে নিয়েও গেলেন। এবার নিশ্চিন্ত। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয় কি না, জানা নেই। তবে সেবারের নবমীতে মায়ের কৃপায় ভালোয় ভালোয় মিটে গিয়েছিলো ভোগদান পর্ব।

মহাষষ্ঠীতে সন্তানের জন্য মায়েদের ব্রতপালন দিয়ে শুরু হয়ে বিসর্জন অব্দি নানা শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানে ভরা সার্ব্বজনীন দুর্গোৎসব। একবছর গোবিন্দপুরে স্কুলের বন্ধুর বাড়িতেও কাটিয়েছি। সেখানে জমিদারী ব্যবস্থাপনায় বলি হতো। তবে পাড়ায় চালকুমড়ো, শসা আর আখ বলি হয় মহানবমীতে। বিজয়াদশমীতে নারকেল নাড়ু বানানোর কথা মনে পড়লে মায়ের ছবি ভাসে। নাড়ু গোল্লা পাকাতে হাত লাগাতাম আমিও। এরপর প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য ঠাকুরকে গাড়িতে তোলার সময় মন খারাপ হয়ে যেতো। মা মহামায়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক এক নাড়িতে বাঁধা। তাই ছেড়ে যেতে মন চায় না। একটা বছর সময় তো কম কথা নয়। ঢাকের বিষাদসুরে সে রাতে ঘুম আসে না চোখে!


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments