জ্বলদর্চি

একুশ শতকের প্রেক্ষিতে গান্ধীজির শিক্ষানীতি/প্রসূন কাঞ্জিলাল

একুশ শতকের প্রেক্ষিতে গান্ধীজির শিক্ষানীতি

প্রসূন কাঞ্জিলাল

অনেকেরই জানা আছে যে ১৯৩৮ সালে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বড়ো আকারে কংগ্রেসের উত্থান ঘটে। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ও জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদনক্রমে কংগ্রেস শাসিত বিভিন্ন প্রাদেশিক শিক্ষা দপ্তর "নঈ তালিম" বা "বুনিয়াদি শিক্ষা"কে তাদের শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে এখানে ওখানে কোথাও কোথাও নামমাত্র এই শিক্ষাব্যবস্থা টিকে আছে। সেগুলোও গান্ধীজি প্রস্তাবিত ও প্রবর্তিত ‘নঈ তালিম’-এর সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে পারছে, তা প্রশ্নাতীত নয়। গান্ধীজি দীর্ঘসময় ধরে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পর তাঁর শিক্ষাচিন্তা ভারতবাসীর সামনে উপস্থিত করেছিলেন। জাকির হোসেনকে নিয়ে কমিটিও তৈরি করেছিলেন। আর্যনায়কম দম্পতির মতো মানুষদের শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে গেছেন। একটা নতুন শিক্ষানীতি এইভাবেই গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে বহু ব্যক্তিত্ব জড়িয়ে আছেন। বিজয় ভট্টাচার্য, সাধনা ভট্টাচার্য সেই শিক্ষানীতিকে ফলিত রূপ দিতে চেয়েছিলেন। মানভূমে ‘মাঝিহিরা’ গ্রামে চিত্তভূষণ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে গান্ধীজির নয়া শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে সংগঠন গড়ে উঠেছিল ১৯৪০ সালে। নানা মতের মঞ্চ কংগ্রেস সেই ১৯৩৮ সালেই সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে স্থির করেছিল, ভারতবাসীকে শিক্ষায় সচেতন ও স্বয়ম্ভর করতে গান্ধীজির শিক্ষানীতিকেই প্রয়োগ করতে হবে।

"নঈ তালিম" প্রয়োগে অবহেলা:---

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর যে শিক্ষাব্যবস্থা আসমুদ্র হিমাচলে প্রযুক্ত হল, তাতে গান্ধীজির নয়া শিক্ষাপদ্ধতি ধীরে ধীরে অপসৃত হয়েছিল। বরণ করে নেওয়া হয়েছিল ভারী শিল্পনীতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের শিক্ষানীতিকেই। স্বাধীনতা উত্তর যুগে কিছুটা গান্ধীজির ভাবাদর্শে বুনিয়াদি শিক্ষা ও বুনিয়াদি শিক্ষক-শিক্ষণ প্রচলিত ছিল। কিন্তু ‘কোঠারি কমিশন’ বুনিয়াদি শিক্ষাক্রমকে সাধারণ প্রচলিত শিক্ষারই সঙ্গে কর্ম অভিজ্ঞতা (work experience) নামে সংযুক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে বুনিয়াদি শিক্ষাদর্শন ও তার বাস্তব প্রয়োগ একেবারেই পরিত্যক্ত হয়।

    গান্ধীজির কাম্য ছিল এমন ভারত, যে ভারতে প্রতিটি মানুষ স্বনির্ভর, প্রতিটি গ্রাম স্বয়ম্ভর। গান্ধীজির এই কামনা রাষ্ট্রযন্ত্রের তথাকথিত উন্নয়নের তাগিদে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে ভারতে আজ সমধর্মী সমাজের বদলে ভোগধর্মী সমাজ কায়েম হতে চলেছে। বুনিয়াদি শিক্ষার কথা বাদ দিলেও পশ্চিমি বিশ্বায়নের সমর্থক যে শিক্ষাব্যবস্থা ভারতে চালু হয়েছে, তার একপ্রান্তে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষা --- অন্যপ্রান্তে পাঁচলক্ষ টাকার বিনিময়ে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে বহু বিদ্যালয় সংস্থা। এই দুই ধরনের বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যে ছাত্রছাত্রী সমাজের দায়িত্ব নেবে, তাদের কি কোন মিলনবিন্দু আছে ? প্রশ্ন থাকবেই। এই ধরনের বিদ্যালয় শিক্ষাই ভারতকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করে দিতে পারে। অথচ কথা ছিল, ভারতে থাকবে বহু ধরনের নয়, এক ধরনের ‘কমন স্কুল সিস্টেম’। এই সিস্টেম থাকলে ভেদ তৈরি হতে হয়ত পারত না।

গান্ধীজি র শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও আদর্শ:----

ভারতের প্রয়োজন গান্ধীজি অনেকটাই অনুধাবন করেছিলেন। নানা জাতি, নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা সংস্কৃতির মানুষকে ভারতে একত্রিত রাখতে হলে চাই জাতীয় সংহতির চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতার মানসিকতা; চাই অস্পৃশ্যতার বর্জন; চাই পরমত সহিষ্ণুতা, চাই অহিংসাকে জীবনে প্রয়োগ। গান্ধীজি তাই তাঁর শিক্ষানীতির কয়েকটি মূলসূত্র রচনা করেছিলেন :---

1.  প্রীতি (সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব)

2.  মুক্তি (অপরের ওপর, জীবনধারণের জন্য, নির্ভরতাহীন স্বাবলম্বন)

3.  অভিব্যক্তি (নানা সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা)

4.  অহিংসা (রিপুকে প্রেম প্রীতি ভালোবাসার পথে প্রবাহিত করা)

5.  সত্যাগ্রহ (সত্যের প্রতি আগ্রহ, অসত্যের অন্যায়ের প্রতিরোধ)

6.  সাফাই (পরিবেশ চেতনা, সৌন্দর্যের চর্চা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা)

 একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতবাসী যদি অহিংস না হয়, তবে এত বিভিন্নতার মধ্যে এক জাতি হিসেবে বাস করতে পারবে না। এই অহিংসা পাশ্চাত্য শিক্ষার ধারায় কোথাও নেই। উপরন্তু গরিব দেশের জন্য গরিব মানুষেরা জোগাতে পারে এমন কম খরচের শিক্ষার কথা গান্ধীজি ভেবেছিলেন, এমন শিক্ষা যা বেকার তৈরি করবে না।

"নঈ তালিম" প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা :----

এখন দেখা যেতে পারে, আধুনিক শিক্ষাধারার সঙ্গে গান্ধীজির শিক্ষানীতিকে মিলিয়ে দেওয়া যায় কিনা এবং তা দুই ধারার মধ্যে মৌলিক কোন পরিবর্তন না করেই। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সামাজিক যথার্থতা লক্ষ্য করে এখনও গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত কিছু শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী এখনকার পটভূমিতে বুনিয়াদি শিক্ষাকে প্রয়োগ করার কথা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বুনিয়াদি শিক্ষার মূলধারাকে কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে জীবনমুখী এক সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে প্রবর্তন করা যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। 

আজকের সংকট ও তার মোকাবিলা:----

একুশ শতকের প্রেক্ষিতে আজকের আর্থ-সামাজিক সংকটময় পরিস্থিতিতে গান্ধীর নয়া শিক্ষাক্রম গ্রহণ করার প্রসঙ্গে ফিরে দেখা প্রয়োজন। আজকের পৃথিবীর ছবিটা মাথায় রেখে আলোচনা প্রয়োজন। বিরানব্বই বছরের মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডো ফ্রাঙ্ক ফেনার সম্প্রতি তাঁর গবেষণায় মন্তব্য করেছেন, আগামী একশ বছরে মানব গোষ্ঠী (Homo sapiens) পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। চমকে দেওয়ার মতো মন্তব্য। কিন্তু কেন একথা উঠে এল?

প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায়, জীবনধারণের সমস্ত উপকরণ অরণ্য, ভূমি, বাতাস, জল সংকটাপন্ন। অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। প্রতি বছর ১৩০ লক্ষ হেক্টর অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে। অরণ্যকে ধ্বংস করে, জমিকে ভুলভাবে ব্যবহার করে মরুভূমির বৃদ্ধি ঘটে চলেছে। হাজার হাজার হেক্টর জমি প্রতি বছর মরুভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। পৃথিবীর উষ্ণায়ন আজকের সবচেয়ে বড়ো সংকট। ধ্বংসাত্মক আবহাওয়ায় বিপন্ন পৃথিবী ও পৃথিবীর প্রাণ। তেমনই দ্রুত বেড়েছে জলসংকট। অনেকেই মনে করে, এই জলসংকট যুদ্ধের হেতু হয়ে উঠতে পারে। ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ জলাভাবে প্রাণ হারাবে। অজস্র ‘প্রাণ’ হারিয়ে যাবে, ঘন্টায় প্রায় এক-একটা প্রজাতি। গত তিন শতকে ১১৫ রকমের পাখি, ৫৮ রকমের স্তন্যপায়ী ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে।

সমাজের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ভারতে প্রতি তিন মিনিটে একটি শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়, দারিদ্র্যসীমার নিচে ৭০% ভারতীয়, অপুষ্ট ৫০% শিশু, আশি কোটি লোকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি।

অনেকের মতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ উন্নতির পদক্ষেপ না হয়ে সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে ধর্ম থেকে, পরিবার থেকে, ইতিহাস ও শিক্ষার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমেরিকার চিন্তাবিদ ডঃ নীল পোস্টম্যান লিখছেন, আমেরিকার সভ্যতা ধ্বংসের মুখে। ৮৫% শিশু এক বাবা বা মায়ের (single parent home) আশ্রয়ে থাকছে। প্রতি বছর লক্ষাধিক লোক উদ্বাস্তু হয়ে রাস্তা বা সাবওয়েতে আশ্রয় নিচ্ছে। ১৯৫০ থেকে আজ অবধি হিংসাত্মক অপরাধ বেড়েছে ১২০০০ শতাংশ। যে কোন দশজন আমেরিকাবাসীর মধ্যে তিনজন থাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে। শহর যানবাহনের চাপে শ্বাসরুদ্ধ। জল দূষিত, বৃষ্টি অ্যাসিডপূর্ণ। আমেরিকার মানুষ বিশ্বের অন্য যে কোন অঞ্চলের মানুষের চেয়ে বেশি অ্যাসপিরিন খায়। পাশ্চাত্য দুনিয়ার মধ্যেও এখানে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা মাদকাসক্ত।

গান্ধীজি অনেক আগেই অনুমান করেছিলেন, পশ্চিমি শিল্প ও বাণিজ্য ভিত্তিক সমাজ হিংসার উৎস। তিনি বুঝেছিলেন, আধুনিক সভ্যতা এক যান্ত্রিক সভ্যতা। এই সভ্যতা থেকে উঠে আসে কেন্দ্রীভুত শাসন, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধভিত্তিক অর্থনীতি। এই সভ্যতা অর্থের প্রাচুর্য আর ভোগ এনে দিতে পারে শুধু মুষ্টিমেয়র জন্য। কিন্তু গোটা বিশ্বের শান্তি বা সুখ দিতে পারে না। একটা শিল্পসমাজ কেবল পণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে যাবে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে। সেটাই বারবার অর্থনীতিতে ধস আনবে। ২০০৭ থেকেই ধনতান্ত্রিক দেশগুলি সেরকম এক সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে।

গান্ধীজির মুক্তি-আন্দোলনে অবদান, স্বাধীনোত্তর ভারতে তাঁর জাতি গঠনের ভাবনা, শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে তাঁর অহিংসা-বাণীর তাৎপর্য, এ সব আমরা অনেক বিশ্লেষণ করেছি। কিন্তু গান্ধীজির দর্শনের একটি দিক তুলনায় উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে: শিক্ষা সংক্রান্ত ভাবনা। অথচ এই ভাবনা আজও প্রবল রকম প্রাসঙ্গিক। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা, এখন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে পঠন-পাঠন প্রক্রিয়ায় ও পরিচালনায় আমূল পরিবর্তনের চিন্তা আসছে, শিক্ষার ব্যাপ্তির সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচার ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার দাবি উঠেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ভিতরে ও বাইরে নিত্যদিনের অস্থিরতা তো রয়েছেই। অপরাধমূলক কার্যকলাপ, অন্ধ প্রতিযোগিতা, অসহিষ্ণুতা, এ সব সামাজিক ব্যাধিও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই প্রেক্ষিতে গান্ধীজির শিক্ষাচিন্তা হয়তো কিছু নতুন দিশা দেখাতে পারে।

ঔপনিবেশিক শিক্ষার পরিবর্ত হিসেবে গান্ধীজি মৌলিক শিক্ষার একটি রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন। এর উদ্দেশ্য, সরকারি চাকুরে বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কেরানি প্রস্তুত না করে সার্বিক মানুষ তৈরি করা। গান্ধীজির এই মৌলিক শিক্ষা ‘নঈ তালিম’ বলে পরিচিত। এর রূপরেখা তৈরি হয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দু’টি ধারা— স্বরাজ ও স্বদেশির অনুপ্রেরণায়। গান্ধীজির প্রথম সুপারিশ ছিল ৭ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা। স্বাধীনতা লাভের পরে ভারতীয় রাষ্ট্রের দীর্ঘ ৬২ বছর লেগে গেল ‘রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট’ (২০০৯)-এর মাধ্যমে ৬ থেকে ১৪ বছরের দেশের শিশুদের শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশাধিকারের মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি দিতে। শুরু হল সর্বশিক্ষা অভিযান। কিন্তু এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও ভাবনা ও রূপায়ণের মধ্যে এখনও বিস্তর মেলবন্ধন করতে হবে।

গান্ধীজি চেয়েছিলেন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে। আক্ষেপের সঙ্গে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-য় লিখেছিলেন (১ সেপ্টেম্বর, ১৯২১), বিদেশি শিক্ষা আমাদের শিশুদের নিজেদের দেশেই বিদেশি হিসেবে তৈরি করেছে। উপলব্ধি করেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষার ফলে তাঁর দেশের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মতো করে চিন্তা করতে শিখছে না, এবং তারা যে জ্ঞান লাভ করছে, সেটা সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। এর বদলে মাতৃভাষায় শিক্ষা দান করলে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিধর্মিতা তৈরি হবে, জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়বে, তারা নৈতিকতার প্রতি আকৃষ্ট হবে। জাতীয় স্তরে একটি বৃহৎ অনুবাদ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন তিনি, যাতে মাতৃভাষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা অন্য ভাষার সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠ অবদানগুলির সঙ্গে সহজে পরিচিত হতে পারে। স্কুলে ইংরেজিকে দ্বিতীয় ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে পড়ানোর উপদেশ দেন। চাইতেন, ছাত্রছাত্রীরা পড়ুক অঙ্ক, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, শরীরচর্চা, অঙ্কন, সংগীত ও সমাজবিজ্ঞান, যার মধ্যেই মিশ্রিত থাকবে ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। যে পরিবেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসছে, তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উপরেও তিনি জোর দেন। মজার কথা, আধুনিক শিক্ষাবিশেষজ্ঞরাও আজও এই সম্পর্কের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।

গান্ধীজি চাইতেন, শিক্ষার মূল স্রোতের সঙ্গে কারিগরি বা বুনিয়াদি বিদ্যাকে যুক্ত করতে। এই সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে তিনি ভারতের চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থার সামাজিক ভিতকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানান। কী ভাবে? সনাতন প্রথা অনুযায়ী, ভারতীয় সমাজে শিক্ষা প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চবর্গীয়দের মধ্যে। যে সমস্ত নিম্নবর্গীয় মানুষ মূল অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতেন, যেমন সুতো কাটা, বয়ন করা, চর্মশিল্প, কুমোরশিল্প, ধাতুশিল্প, বই বাঁধাইয়ের মতো কাজে, তাঁরা ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। কারিগরি শিক্ষাকে পঠন-পাঠনের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়ে গাঁধীজি স্পষ্টাস্পষ্টি এই বর্ণভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আঘাত হানলেন। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে আরও একটা কাজ করতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার্থীর ভাবনাচিন্তা ও দেহচর্চার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন।

মৌলিক মূল্যবোধ প্রসারের উপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিিন। ‘নঈ তালিম’-এর প্রস্তাবনায় কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষার কোনও স্থান ছিল না। গান্ধীজি ধর্ম ও নৈতিকতার মধ্যে তফাত করতেন। এও বিশ্বাস করতেন যে, মৌলিক নৈতিকতার ক্ষেত্রে সমস্ত ধর্মের মধ্যে একটা সমন্বয় আছে। আজকে এই বক্তব্যের খুবই বড় প্রাসঙ্গিকতা আমরা টের পাচ্ছি— যখন সামাজিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কথা বার বার উঠে আসছে,  রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এক বিশেষ দৃষ্টিকোণে দেশের ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা চলছে, কিংবা কিছু রাষ্ট্রীয় ভাষা যেমন উর্দু ও সংস্কৃতকে কোনও বিশেষ ধর্মের ভাষা হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। ভারতের সংস্কৃতির মূল ভিত "সহনশীলতা ও বহুমাত্রিকতা"। এই ঐতিহ্যের উপর আক্রমণ যাতে না আসে, তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি।

স্বাধীন ভারতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘জাতীয় প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন গান্ধীজি। এদের মাধ্যমে চরকা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মৌলিক নীতিবোধ, ভারতের সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা, অহিংসা ও অস্পৃশ্যতা-বিরোধী বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে চেয়েছিলেন, শিক্ষায়তনগুলি রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না থেকে স্বয়ম্ভর হোক। তিনি মনে করতেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিক্ষাদানের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত। আজকে যখন গোটা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির স্বায়ত্তশাসনের অভাব নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন উঠছে, তখন গান্ধীজির এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

 শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, বেশি পাঠ্যপুস্তক-নির্ভর না হতে। কেননা, ছাপা অক্ষরের থেকে শিক্ষকদের ‘living word’ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হওয়ার কথা। ‘Virtual’ শ্রেণিকক্ষের দিকে তাকিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা কমানোর যে উদ্যোগ আজ, তার প্রেক্ষিতে গান্ধীজির এই সাবধানবাণী প্রাসঙ্গিক।

মহাত্মা ভেবেছিলেন স্বাধীন ভারতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয় শিক্ষাদান প্রথা প্রবর্তনে ব্রতী হবে। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করা হবে ভারতীয় পদ্ধতিতে, পশ্চিমি পদ্ধতিতে নয়। গান্ধীজির এই ভাবনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখন দেশের শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার সংস্কার ক্রমাগত বিদেশি ভাবধারায় প্রভাবিত হচ্ছে। যেমন, সেমেস্টার বা ক্রেডিট ট্রান্সফার নীতির প্রবর্তন। দু’টি ব্যবস্থা হয়তো অনেকাংশেই প্রচলিত পঠন-পাঠন ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত। কিন্তু যদি উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়া এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, তা হলে ফল হতে পারে বিপজ্জনক। লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথও ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে বিদেশি শিক্ষা ব্যবস্থার অন্ধ অনুকরণের বিরোধিতা করেন।

গান্ধীজি আশা করতেন, ‘জাতীয় শিক্ষা: স্বাধীন মানসিকতা তৈরি করবে। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন, এই স্বাধীন সত্তা নিয়মানুবর্তিতা-বিরোধী হতে পারে না। ১৯২৬-এ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-র পৃষ্ঠায় স্বাধীনতার  সঙ্গে শৃঙ্খলাবোধ ও নম্রতার অপরিহার্য সম্পর্কের উপর জোর দেন তিনি। শৃঙ্খলার প্রসঙ্গে আর একটি কথা। ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে গাঁধীজির বার্তা কী ছিল? তিনি মনে করতেন, রাজনীতিতে ছাত্রদের কৌতূহল থাকা উচিত। ওঁর নেতৃত্বেই তো ছাত্রসমাজ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শামিল হয়। কিন্তু ১৮ জানুয়ারি ১৯৪৮-এর ‘হরিজন’ পত্রিকায় শিক্ষায়তনের মধ্যে ছাত্র-রাজনীতি ও পার্টি বা দলীয় রাজনীতির মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্যও করেছিলেন গান্ধীজি। বলেছিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-রাজনীতিতে কে কংগ্রেস, কে কমিউনিস্ট বা সোশ্যালিস্ট না দেখে, ছাত্রদের স্বার্থভিত্তিক রাজনীতি সংগঠিত হওয়া উচিত। যত দিন এক জন ছাত্র বা ছাত্রী শিক্ষায়তনে থাকবে, তত দিন তার মূল কাজ হবে জ্ঞান লাভ করা, যে জ্ঞানের ভিত্তিতে সমাজ ও দেশের সেবা সম্ভব: বলেছিলেন তিনি। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ ‘হরিজন’ পত্রিকায় লেখেন, দলীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ করা উচিত কেবল ছাত্রজীবন সমাপ্ত হলেই। নয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেই তারা দলীয় রাজনীতিতে যোগ দিক, যে রকম ঘটেছিল আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলনের সময়।

আজকের ছাত্রসমাজের এক বৃহৎ অংশের কাছে গান্ধীজির এই অভিমত হয়তো গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু বুঝতে হবে, গান্ধীজি তাঁর ছাত্র-রাজনীতি বিষয়ে এই সব ভেবেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে সাধারণতন্ত্রের স্বার্থে হয়তো শিক্ষায়তনে ছাত্র-রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর ধারণা হয়তো তিনি নিজেই পরিবর্তন বা পরিমার্জনা করতেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যদি সাধারণ নির্বাচনে ভোট দানের অধিকার থাকে, তা হলে ক্যাম্পাসে তাদের রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকারও নিশ্চয়ই থাকা উচিত। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক অধিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রয়োগ করতে হবে, যাতে অন্যের মানবিক অধিকারের উপর আঘাত না আসে, তা দেখতে হবে। আজকের জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার যুগে ছাত্রছাত্রীদের এটাও বুঝতে হবে যে, তাদের আন্দোলন যাতে এমন ভাবে পরিচালিত না হয়, যার ফলে তাদের প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগে শিল্পের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সংযোগ নিশ্চয়ই চাই। ডিগ্রি লাভের পর শিক্ষার্থীদের চাকরি লাভের পথ যাতে সহজ হয়, তা-ও নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে, উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক সম্পদ সৃষ্টির জোগান দেওয়া? না। উচ্চশিক্ষার আদর্শ সমাজসচেতন নাগরিক তৈরি, যারা জাতি গঠনের বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রয়োগের যথাযথ প্রশ্ন তুলতে পারে। গাঁধীজি শিক্ষার এই অভিমুখের কথাই ভেবেছিলেন।

তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আধুনিকতাকে স্বাগত জানাতে ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ ভাবে ত্যাগ করা অপ্রয়োজনীয়। উনি চাইতেন, আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের একটা মিলনক্ষেত্র, যাকে আধুনিক বিশ্লেষকরা বলেছেন traditional modernity। আজকে বিশ্বায়নের যুগে একটা দেশ বা একটা সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য দেশ বা অন্য সংস্কৃতির আদান-প্রদান অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবী একটা ছোট্ট গ্রামে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু ১ জুন ১৯২১-এ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-য় গাঁধীজি সতর্ক করেন, যাতে উন্নত দেশের সঙ্গে আদান-প্রদানের ফলে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পায়ের তলার মাটি সরে না যায়।

নিশ্চয়ই কূপমণ্ডূক হয়ে থাকব না আমরা। প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে বিদেশি শিক্ষায়তনদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করব এমন ভাবে, যাতে দুই পক্ষই লাভবান হয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণাভিত্তিক প্রতিযোগিতাতেও সংশয় থাকার কারণ নেই, যতক্ষণ এই প্রতিযোগিতা হবে সমতার ভিত্তিতে। আমাদের দেশের মাটিতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক নিয়ম ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আর এক নিয়ম, এমন হলে আমরা নয়া সাম্রাজ্যবাদের শিকার হবো। স্বাধীন রাষ্ট্রের আর্থিক সাহায্যে, কিন্তু স্বাধীন ভাবে পরিচালনার মাধ্যমে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যদি বিদেশি অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দেশীয় প্রেক্ষিতে কাজে লাগিয়ে এমন ছাত্রসমাজ তৈরি করতে পারে, যারা কেবল নিজেদের বিষয়ে দক্ষ না হয়ে সমাজসচেতন নাগরিক হবে, তা হলেই গান্ধীজির শিক্ষাদর্শের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।

আজকে অনেকেই শিক্ষা প্রশাসন থেকে দায়মুক্ত হবার ইচ্ছা প্রকট করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে আইনি ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও যদি প্রগতিশীল, জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণুতার মূল্যবোধে আশ্রিত শিক্ষিত সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা যায়, তা হলে হয়তো-বা নিজেদের সামাজিক দায়বদ্ধতাও কিছুটা পালন করতে পারা সম্ভব, বিশেষ করে যখন আমাদের দেশবাসীর মাত্র ২১ শতাংশ উচ্চশিক্ষার আঙিনায় প্রবেশলাভে সক্ষম। শিক্ষায়তনের প্রশাসনে থেকে  অনেকেই নানান ক্ষেত্রে তা করতে গিয়ে আটকে যান, অস্বস্তিতে ভোগেন। তখন নতুন করে মানসিক শক্তি পাওয়া যায় গান্ধীজির পরামর্শ স্মরণ করে যে, নিজেদের উপরে আস্থা হারানো উচিত নয়।

পশ্চিমি সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের বদলে গান্ধীজি তাই গ্রাম নির্ভর অর্থনীতি ও কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, আধুনিক সভ্যতা ভোগবাদী এবং সহজ সরল জীবনের পরিপন্থী। একজনের সুবিধা যদি অন্যজনকে অসুবিধায় ফেলে, সেটা উন্নতি নয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথও একইভাবে চিন্তা করেছিলেন। তাঁর কল্পনায় সমাজ হবে ‘বহু সম্বন্ধ বিশিষ্ট সমাজ’। এটাই আমাদের ঐতিহ্য।

গান্ধীজি এই সমাজ নির্মাণ মাথায় রেখেই এক নতুন শিক্ষানীতির কথা বলেছিলেন --- নঈ তালিম বা বুনিয়াদি শিক্ষা। শিক্ষা হবে কর্মকেন্দ্রিক, উৎপাদনমূলক, স্বনির্ভর। এই কায়িক প্রশিক্ষণের অর্থ এই নয় যে বিদ্যালয় ভবনের সংগ্রহশালায় কিছু খেলনাপাতি তৈরি করে রেখে দেওয়া হবে, যার কোন মূল্য নেই। বিক্রয়যোগ্য জিনিস তৈরি হবে বিদ্যালয়ে।

জাকির হোসেন হয়তো ভয় পেয়েছিলেন, শিক্ষকেরা এই নীতি বা নিয়মে গরিব ছাত্রদের শ্রমকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাবেন, অথবা তারা হবেন ‘দাসেদের চালক’। কে টি শাহের মতে, কেবল পাঠ্যপুস্তক সর্বস্ব এবং মুখস্থ বিদ্যা সর্বস্ব আজকের পঠনের ক্ষতিকারক দিকের বদলে সেই ব্যবস্থা হয়ে উঠবে শ্রম সর্বস্ব, অসঙ্গত ভাবে ছাত্রদের থেকে শ্রম আদায়ের পন্থা মাত্র। তখন শিক্ষার মূল আদর্শ পড়ে থাকবে পিছনে। এই বিতর্কে ভারতের শিক্ষানীতি থেকে হারিয়ে গেল ‘নঈ তালিম’। ব্যতিক্রম হিসেবে রয়ে গেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গুজরাত, মহারাষ্ট্র বা পশ্চিমবাংলার কয়েকটি গান্ধী আশ্রম। তারা গান্ধীর স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করল --- সরল কিন্তু সৎ, উৎকৃষ্ট নৈতিক জীবন, কৃষিসমাজ --- শ্রম যেখানে জীবনধারণের জন্য, জীবিকার জন্য নয়।

স্বাধীনতার পর ভারতে শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৪.৫ লক্ষেরও বেশি স্কুল, ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক-শিক্ষণের মহাবিদ্যালয়, বেশ কিছু শিক্ষা সংক্রান্ত গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। উৎকর্ষতা লাভের জন্য সংগ্রাম, নতুন কিছু প্রবর্তনের উৎসাহ, দুঃসাহসিক কাজের ঝুঁকি নেওয়া সীমাবদ্ধ সামান্য কিছু মানুষের মধ্যে। বাকি মানুষ হয় হুকুম তামিল করে অথবা সুবিধাভোগী।  

নঈ তালিম ও প্রাথমিক শিক্ষা:-----

গান্ধীজির শিক্ষানীতি সমাজ সংস্কারের পথ ধরেই হয়েছিল। তাই সেই নীতিকে ফিরে দেখার প্রয়োজন পড়েছে। গান্ধীজির বুনিয়াদি শিক্ষা ছিল সকলের জন্য। সব শিশুর জন্য। সব রাষ্ট্রকেই বুঝে নিতে হবে কী ধরনের নাগরিক সে তৈরি করবে। সৃষ্টিশীল, মৌলিক চিন্তার অধিকারী, সাহসী উদার, নাকি সঙ্কীর্ণ মনের এবং অন্যদের ঘৃণার চোখে দেখে এমন।

তাই ৬ থেকে ১১ বছর বয়সের শিশুদের শিক্ষার সেই তালিম প্রয়োজন, যা উপরোক্ত উৎকৃষ্ট নাগরিক তৈরিতে সক্ষম। হিন্দুস্তানি তালিম সংঘ গান্ধীজির শিক্ষানীতিকে ভিত্তি করে যে পাঠক্রম তৈরি করেছিল, তা হল :---

1.  ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, এর থেকেই আসবে পরিবেশকে পরিষ্কার রাখা।

2.  গ্রামীণ শিল্পের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ও সেই জ্ঞানের সাহায্যে আরও উন্নতি।

3.  শিক্ষকের ভূমিকা শিশুকে শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ করে দেওয়া নয়, তার সামর্থ্য ও ক্ষমতাকে আবিষ্কার করে তাকে উপযুক্ত কাজে প্রেরণা ও দায়িত্ব দেওয়া। এইভাবে গণতান্ত্রিক উদ্যোগকে উৎসাহিত করা।

4.  ছেলে ও মেয়েকে সমান স্থান দেওয়া।

5.  প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ যত্ন নেওয়া।

6.  দেশ পরিচালনার দক্ষতা ও ক্ষমতাগুলি বাড়ানোর জন্য বিশেষ তালিম দেওয়া। যেমন ভোটিং, ডিবেট প্রভৃতিতে অংশ নেওয়ানো।   

 
বুনিয়াদি শিক্ষার প্রস্তাবিত কাঠামো:-----

নতুন একদল শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা আজ সবচেয়ে বেশি যারা বুনিয়াদি শিক্ষাক্রমকে সঠিক আত্মস্থ করতে পারবেন। শিক্ষা দেওয়া তাদের কাছে একঘেয়ে নয় বা শুধু জীবিকার জন্যও নয়। শুধুমাত্র টাকার অঙ্ক বাড়ালেই তাদের মনোভাব (attitude) বদলাবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মিড-ডে মিল গরিব ছেলেমেয়েদের লোভ দেখিয়ে স্কুলে আনার জন্য শুধু নয়, শিশুর পুষ্টিই তার মূল কারণ।

বিদ্যালয় বা গৃহে পরিচ্ছন্নতায় শিশুর অংশগ্রহণ শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে না। নিজের বাড়িতে কাজ আর রাস্তার ধারে অন্যলোকের চায়ের দোকানের কাজ এক নয়।

অভিভাবকদের ক্রমান্বয়ে জীবিকার সন্ধানে স্থান পরিবর্তন শিশুদের শিক্ষার বিরাট অন্তরায়। তাই আবাসিক স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্যচর্চা, খেলাধূলা স্থানাভাবে শহরের স্কুলগুলিতে হয় না। অথচ এটা আবশ্যিক। আমাদের দেশ তাই খেলাধূলায় পিছিয়ে থাকে। কিন্তু ক্রীড়াদর্শক সবচেয়ে বেশি। আমরা সমালোচক ও তারিফ করার মানুষ যত সৃষ্টি করি, খেলায় অংশগ্রহণকারী তত তৈরি করতে পারছি না।

গান্ধীজি শিক্ষাকে জীবনমুখী করার কথা বলেছেন। শিক্ষা তথা জ্ঞান নির্ভর করে স্থান, কাল ও পরিবেশের ওপর। বিজ্ঞান --- যা বিশেষ জ্ঞান, তাই যদি ‘সত্য’ হয়, টেকনোলজি বা প্রযুক্তিই তৈরি করে সত্যাগ্রহী। সেই সত্যাগ্রহী প্রযুক্তির ব্যবহারে তার সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারে এবং সমস্যার সমাধানও করে ফেলে। গ্রামে গ্রামে সেই সত্যাগ্রহী তৈরি করবে বুনিয়াদি শিক্ষা।

বুনিয়াদি শিক্ষার পাঠক্রম কর্মকেন্দ্রিক। সেই কর্মের মধ্য দিয়ে শিশুর শিক্ষা সম্পন্ন হবে। এই কর্ম কখনও কখনও শিল্পের রূপ নেবে। তাই বুনিয়াদি শিক্ষা শিল্পকেন্দ্রিক --- craft centred। পাঠক্রমের কেন্দ্রে থাকতে পারে বয়ন বা কৃষি; থাকতে পারে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ অথবা তথ্যযন্ত্র; থাকতে পারে অতি আধুনিক কোন শিল্প যা সংশ্লিষ্ট বসতিতে সহজ ও সুলভ। পাঠক্রম সেই শিল্পকে ঘিরে শিশুশিক্ষায় নানা বিষয়কে আনবে। সেই বিষয়গুলির সঙ্গে সম্যক পরিচয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।

ধরা যাক, চরকা কেন্দ্রিক বয়নশিল্পের কথা। এই বয়ন থেকে অনেক বিষয় আসবে,যেমন --- 

বয়ন শিল্প >>    জমি/মাটি  >>  বৃক্ষরোপণ/বৃক্ষের বৃদ্ধির পর্যায়  >>  ফল  >>  তুলো    আহরণ পদ্ধতি  >>  সংরক্ষণ পদ্ধতি   >>    নানা প্রকারের তুলো  >>  তুলো থেকে সুতো  >>  সুতো কাটার যন্ত্র  >>  কুটির শিল্প/বৃহৎ শিল্প  >>  সুতো রঙ করা  >>  নানা ধরনের তাঁত  >>  কাপড় তৈরি নক্সা  >>  রক্ষণ  >>  বিক্রয় প্রভৃতি।

পাঠক্রমের প্রয়োজনে শিশুর বয়স অনুযায়ী একাধিক শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিশুর নানা ধরনের কাজ করার ফল হবে :---     

১. ইন্দ্রিয়গুলির সম্যকচর্চা; 
২. নানা কৌশল আয়ত্ত্বকরণ;
৩. ব্যবহারিক কর্মদক্ষতা অর্জন; 
৪. শ্রমের মর্যাদা সম্বন্ধে প্রত্যয়; 
৫. শ্রেণীর অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির সম্পর্ক; 
৬. শৃঙ্খলাবোধের সঞ্চার; 
৭. মূল্যবোধ আয়ত্ত্ব করা; 
৮. সকলের সঙ্গে কাজ করার অভ্যাস; 
৯. নেতৃত্ব দেওয়ার কৃৎ কৌশল এবং 
১০. নেতৃত্ব মেনে কাজ করার মানসিকতা।

খেলাধূলা হবে উদ্দেশ্যমূলক ও গঠনমূলক। লক্ষ্য হবে স্বাস্থ্যের উন্নতি, শৃঙ্খলাজ্ঞান ও ব্যক্তিস্বত্তার বিকাশ। নৃত্যগীত, অভিনয়, বিতর্কসভা, পত্রিকা, সাহিত্যসভা, শিক্ষামূলক ভ্রমণ এসবের মধ্য দিয়ে শিশুর নান্দনিক সম্ভাবনার বিকাশ।

    বুনিয়াদি শিক্ষার ধারাকে কীভাবে সময়ানুগ ও সচল করা যায় সে সম্বন্ধে কিছু আলোচনা ও বিতর্ক আরম্ভ করার দায় আমাদের সকলের। বুনিয়াদি শিক্ষাকে গান্ধীজির সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ দান বলা হয়।

    বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে হাতে কলমে কাজ হবে, উৎপাদন হবে। তবু একথা মনে রাখতে হবে যে বুনিয়াদি বিদ্যালয়টি একটি শিক্ষাকেন্দ্র, কারখানা নয়। উৎপন্ন দ্রব্য থেকে বিদ্যালয়ের খরচের কিয়দংশ আসতে পারে মাত্র। বুনিয়াদি শিক্ষা বিষয়ে অভিজ্ঞ ও কৃতি শিক্ষাবিদদের নিয়ে পাঠক্রম তৈরি করা যেতে পারে। আপাতত বুনিয়াদি শিক্ষার একটা সমান্তরাল ধারাই না হয় চলুক ।।


*তথ্যসূত্র ও গ্রন্থঋণ :----*

1.Mahatma Gandhi on Education, By Anil Dutta Mishra, Vikas Publishing.2015.

2. Mahatma: Life of Mohandas Karamchand Gandhi, by D.G. Tendulkar. (1951) 

3.Mahatma Gandhi, by Piyarilal and Sushila Nyar. 

4.‌Gandhi Behind the Mask of Divinity, by G.B. Singh. 

5. Mohandas Gandhi:- By, Todd, Anne M.(2004) Marty, Martin E.,( 1928) Philadelphia: Chelsea House.

6. Gandhi: Illus. Collected and Arranged by Vithalbhai K. Jhaveri ; Foreword by Jawaharlal Nehru.

7. Internet etc.....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments