জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৬০/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৬০

শ্যামল জানা



সাররিয়েলিজম্, থিম প্রদর্শনী ও অভিনব ক্যাটালগ

    এই ‘Missives Lascives’(কামোদ্দীপক চিঠি)-তে একটি অভিনব প্রচ্ছদ রাখা হয়েছিল৷ আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে— পুরো প্রদর্শনীটির থিম ছিল— ‘EROS’, অর্থাৎ যৌনতা বা কাম৷ এই মূল থিমটিকে কেন্দ্র করে প্রদর্শনীকক্ষগুলির এক-একটি কক্ষে এক-একটি বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনী হয়েছিল৷ প্যারেন্ট তাঁর দায়িত্বে থাকা কক্ষটির নাম দিয়েছিলেন ‘নারী/পুরুষ’ (Masculine/Feminine)৷ এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি এক অভিনব কাজ করলেন৷ তিনি পুরুষদের একটি ধবধবে সাদা জামা ও জ্যাকেট প্রদর্শন করলেন৷ আর, তার গলাটা পুরো পেঁচিয়ে দিলেন মেয়েদের সত্যিকারের মাথার একগোছা লম্বা চুল দিয়ে৷ যেন একটি টাই৷ যা, সাধারণভাবে গলার চারদিকে জামার কলার-এর পুরোটা পেঁচিয়ে যেরকম গিঁট বাঁধা থাকে, ঠিক সেরকম(ছবি-১)! যা প্রদর্শনীর পোস্টারেও ব্যবহার করা হয়েছিল৷



আর, লেখা হিসেবে ছিল— আন্দ্রে পিয়েরে দে মানদিয়ারগেস-এর “The Tide”৷ জয়সি মানসুর-এর “The Point”৷ অ্যালেইন যৌবের্ত-এর “The Fine Pearl”৷ তিনটি লেখা ছিল, যেখানে লেখকের নাম জানা যায়নি৷ তবে লেখাগুলো ছিল বিস্ফোরক বলা যায়৷ দুটো নাম বলি, নাম শুনলেই আঁচ করা যাবে— Letters of a Sadist ও Certificate of Suffering.৷ যাঁ পল সার্ত্র-র একটি নাটক ছিল— No Exit.৷ এরকম missives lascives-এ যে লেখাগুলো ছিল, তার প্রতিটিই ছিল চিন্তাপ্রসূত ও অভিনব৷

এই যে ছদ্ম-নামহীন মেলবক্স-এর ভেতরে শব্দের, বিষয়ের ও ছবির জাক্সটাপজিশন, এর মূল উদ্দেশ্য হল শ্রোতাদের চিন্তাগুলিকে স্বাধীন করে দেওয়া৷ সামান্য কিছু খামের ওপর এক অভিনব ডাকটিকিট লাগানো হয়েছিল, যেগুলি ছিল একেবারেই নিয়ন্ত্রিত৷ ওই ডাকটিকিটের ছবিটা ছিল— এক যুবতী, গাউনের উপরাংশ সরিয়ে তার দুই স্তন অনাবৃত করছে৷ আর, একটা অজানা কারোর হাত গাউনের ওপর দিয়ে তার যোনি ছুঁতে চেষ্টা করছে(ছবি-২ ও ৩)৷





 এই ছবিটি “An edition of Matthew Gregory Lewis’s Ambrosio, or the Monk” থেকে খোদাই(Engraving) করে নকল করা হয়েছিল৷ এই ছবিটি বাছাই করে পছন্দ করেছিলেন আন্দ্রে ব্রেতোঁ স্বয়ং৷ আর, অকপটেই এই ‘Exposition Internationale du Surréalisme 1959-1960,’-এই ঘোষিত লেখাটির সঙ্গে ডাকটিকিটটি ব্যবহার হয়েছিল৷ এবং যখন এই ছবিটি খোদাই(Engraving) করে নকল করা হচ্ছিল, তখন ব্রেতোঁ ও দুশ্যাঁ-র সইদুটিও খোদাই করে এর সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সব ছবিতেই ওঁদের সইদুটি ছাপা অবস্থায় থাকে৷

‘Missives Lascives’(কামোদ্দীপক চিঠি)-র ভেতরে একটি ৭ইঞ্চি ভিনাইলবোর্ড দেওয়া হয়েছিল৷ যার দু-দিকেই ছাপা হয়েছিল একটি করে সাররিয়েলিস্ট কবিতা৷ একটি জয়েস মানসুর (Joyce Mansour)-এর— Religious Intoxication.৷ আর একটি বেঞ্জামিন পিরেট(Benjamin Péret)-এর— The Gallant Ewe.৷ এই আলোচনায়, যে নানা ধরনের লিখিত বিষয় ছিল ‘Missives Lascives’-তে, সেগুলি অত্যন্ত অভিনব হলেও আমরা অধিকাংশ এড়িয়ে যাচ্ছি এই কারণে যে, সেগুলি দৃশ্য শিল্পের আওতায় পড়ছে না৷ কারণ, এ লেখাটি চিত্রশিল্পের ইতিহাস৷

তবে, এই যে সাররিয়েলিস্ট গ্রুপের সাহিত্য ও ছবির যে যৌথ উদ্যোগ, এগুলি জানার ক্ষেত্রে শুধু দৃশ্যশিল্পগুলি(Pictorial works) জানলেও প্রত্যাশা পুরণে তেমন কোনো খামতি থাকে না! কারণ, Boîte Alerte-র মধ্যে যে দৃশ্যশিল্পগুলি রাখা ছিল, সেগুলির স্টাইল ও বিষয় ছিল অত্যন্ত ব্যাপ্ত, অত্যন্ত উঁচু মানের, এবং অত্যন্ত অভিনব, যেগুলি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত যারাই দেখেছে, জেনেছে, অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছে, মনে প্রচণ্ড ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে কারণ, প্রতিটি কাজের মধ্যেই যুক্তি, প্রতিবাদ, ও ইতিবাচক দর্শন ছিল৷ যেমন, Boîte Alerte-তে নামহীন প্রিন্টের যে পাঁচটির সেট, চারটি ওরিজিনাল লিথোগ্রাফ, এবং একটি এচিং ছিল XX-র XIX নম্বরের সংস্করণে, সেগুলির প্রত্যেকটির উপস্থাপনই ছিল— প্রেম(Love), লিঙ্গ(Gender), যৌন-আবেদন(Sexuality) অথবা ধর্ম(Religion) সংক্রান্ত৷

লে মরচেয়াল-এর করা যে এচিং-টি ছিল, সেটি, ওই যে পাঁচটি শিরোনামহীন প্রিন্টগুলি ছিল, তাদেরই সবচেয়ে বিশদ উপস্থাপনা৷ যেখানে তিনি দেখিয়েছেন— একটি নরক-সদৃশ্য গুহা-কন্দরের বিশদ বর্ণনা ক্যাভারি পাহাড়ের দৃশে৷ জেরুজালেম-এর এখানেই যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল৷ ছবির মাঝখানে একটি শিংওলা মাথা৷ এবং দুটো খাড়া পাহাড়ের মাঝখানে একটি শীর্ণকায় শরীরকে জোরে টেনে রাখা আছে৷ আদ্রিয়েন ডক্স-এর একটি লিথোগ্রাফ ছিল৷ যেটি ফ্রোটেজ(গ্রাফাইট দিয়ে ঘষে ঘষে পেনসিলের মতো আঁকা) সাররিয়েলিস্ট টেকনিকে আঁকা৷ যেখানে নানা সজ্জিত উপাদানের মাঝখানে একটি মেয়ের মাথাকে দেখিয়েছেন৷ ম্যাক্স ওয়াল্টার স্যাভানবার্গ কালো লিথোগ্রাফের ওপর স্টাইলিশ সোনালী রঙের সাহায্যে দেখিয়েছেন— তিনটি মুখোশ ও দুটি পা-এর মাঝখান থেকে একটি পেন্ডুলাম ঝুলছে, যা মনুষ্য-প্রজাতির বিষয় নয়(Non-human)(ছবি-৪)৷ 



টয়েন-এর ছবিটি ছিল দুটি গাছের পাতার৷ যাদের ডাঁটিদুটির প্রান্তদেশ লাল, এবং পরস্পর পরস্পরকে যেন এই ছুঁয়ে ফেলবে, ছবিটা এমন৷ আসলে, এই দৃশ্যটি হল উর্বর যৌনক্রিয়ার প্রতীক(ছবি-৫)৷


 আসলে, হোয়ান মিরো-র একটি ছবির প্রিন্টের ভেতরে যে হিংস্রতা ছিল, তার বিপরীতে এই ছবিটি করা৷ মিরোর ছবিটি ছিল— একটি বিকটাকার পুরুষলিঙ্গ বদলে গেছে লতানো আকর্ষ ও থাবায়, যে কিনা নারীর একটি প্রতীকি যোনিকে আক্রমণ করেছে(ছবি-৬)৷


 এছাড়া আর একটি সাররিয়েলিস্ট পদ্ধতি আছে৷ সেটি হল— একটি কাগজে এলোমেলোভাবে তরল রং ফেলে, তারপর ওই অবস্থায় কাগজটিকে ভাঁজ করলে, ওই তরল রঙটি ভাঁজের উল্টোপিঠেও প্রতিসমভাবে(Symmetrically) লেগে যায়৷ যাকে ফোটোগ্রফের ভাষায় বলা হয় মিরর-ইমেজ৷ এখানে রবার্ট বেনাউন-এর ‘দি করিডর’ ছবিটি এভাবে করা(ছবি-৭)৷ 


এই পদ্ধতিটি আসলে মনোরোগ চিকিৎসার অঙ্গ৷ একজন মনোরোগীর মানসিক অবস্থাকে মূল্যায়ন করার জন্য তাকে দিয়ে কাগজে কালি ছিটিয়ে মিরর-ইমেজে যে ছবিটি তৈরি হয়, মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ(Psychologist) সেই ছবিটিকে বিশ্লেষণ করেন৷ এই পদ্ধতির নাম— Inkblot test.৷ যাকে যথার্থ পরিভাষায় বলা হয়— Freudian psychoanalysis Hermann Rorschach.৷ ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সাররিয়েলিস্টরা এই পদ্ধতিতে জোর দিয়েছিলেন৷ বিশেষ করে যেখানে যেখানে সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর অবচেতন(Sub-conscious) মনের রহস্য কাজ করছে৷                          (ক্রমশ) 


আরও পড়ুন 

http://www.jaladarchi.com/2021/09/interview-with-fiction-writer-shirshendu-mukherjee-festival-1428.html




Post a Comment

0 Comments