জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৫৬ /(উৎসব সংখ্যা ৫)


সম্পাদকীয়,
লক্ষ্মীসোনা বন্ধুরা, পুজোর সাজের ছবি মায়ের ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট করেছ তো? নতুন জামা নতুন জুতোর ছবিতে ক'টা করে লাইক পড়েছে? জানিও কিন্তু। ঐ দেখো পিনাক পরামানিকের তোলা ছবিতে দুটো ছোটো বন্ধু পায়ে আলতা পরছে। কেন? আরে ওদের বাড়িতে লক্ষ্মী পুজো যে। তাই তো ওরা সাজছে। দেখছো না উঠোন জুড়ে ওরা কেমন আলপনা দিয়েছে। আচ্ছা তোমরা কেউ জানো ওদের নাম কি? আমি জানি না গো। হবে হয়তো লক্ষ্মী, দুর্গা, জয়া, কিংবা চন্ডী। হাসছো কেন? চন্ডী তো অনেকের নাম হয়। এই দেখনা ধ্রুব আঙ্কেলের গল্পে একটা গ্রামের সকলের নাম চন্ডী দিয়ে, জয়চন্ডী, দেবচন্ডী, হরচন্ডী। তারবেলা! আচ্ছা এমন সুন্দর আলপনা যে গ্রামে দেওয়া হয় তার নাম জান? আমি বাপু জানি না, তাই গ্রামের নাম দিলাম মনোহরপুর। সেটা কোথায়? তা জানতে হলে পড়তে  হবে সহেলী আন্টির গল্প। কি?  কীভাবে যাবে সেখানে? কেন, তথাগত আঙ্কেলের ছড়ার পাখির মতো উড়ে যাব। আর সেখানে আজ মিনুর জন্মদিন তো। কে মিনু? মিনু হল পারমিতা আন্টির গল্পের বার্থডে গার্ল। বার্থডে গার্লের কত বায়না। শুধু কি বার্থডে গার্ল জয়ন্তী ম্যামের গল্পের তিতুরও খুব বায়না। আরে বায়না কি শুধু তোমরা করো? তোমাদের বন্ধু অঙ্কিত জানিয়েছে কৈলাসে কার্তিক বায়না জুড়েছে ইন্টারনেট টাওয়ার বসানোর জন্য। সত্যিই ইন্টারনেট ছাড়া আজকাল কিছুই জানা যায় না। নেট আছে তবেই না জ্বলদর্চির ছোটোবেলা পড়ে পুজোর সপ্তমীতে কীহবে তা জানতে তপশ্রী আন্টির উপন্যাস পড়তে পারবে। নেট আছে বলেই না ছোটোবেলায় গৌর জেঠুর উপন্যাস পড়ে জানতে পারছো কেউ কেউ পেট ভরাতে চড় থাপ্পড় খায়, অথচ সেই আবার ক্ষুধার্তকে ভাত রান্না করে দেয়। ছোট্টবন্ধু প্রার্থিতা ছাড়াও হরিৎ আঙ্কেলও যে ছড়ার মাধ্যমে পুজোর কথা বলেছে তাও তো নেট থাকলে তবেই পড়তে পারবে। চিত্রশিল্পী শ্যামাপ্রসাদ ব্যানার্জি, চোইন আর মৌসুমী বিশ্বাসের আঁকা ছবিও এই নেট দুনিয়ায় যত সহজে দেখতে পাচ্ছো তত সহজে নেট না থাকলে পেতে নাকি!   - মৌসুমী ঘোষ।



ধারাবাহিক উপন্যাস   

অনিকেত (শেষ পর্ব)

গৌর বৈরাগী


       (নয়)

থানায় ঢুকতে না ঢুকতেই বড়বাবু বললেন, কোথায় ছিলি অনিকেত? দু’বার ফোন করা হয়ে গেছে তোকে। অনিকেত বেশ লজ্জা পেয়েছে। আস্তে করে বলল, অভ্যাস নেই তো তাই শুনতে পাইনি। অভ্যাস না থাকারই কথা। হাতে মোবাইল নিয়ে ঘুরবে এ স্বপ্নেও ভাবেনি সে। গত কয়েকদিন চরকি পাক ঘোরা ঘুরেছে। থানা, হাসপাতাল আর অ্যাম্বুলেন্স এই করতে হল ক’টা দিন। এর মধ্যেই যে আবার বারোয়ারি ক্যান্টিন। 

ক্যান্টিন থেকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে কয়েকটা বাড়িতে পৌঁছবার কাজ। সে অবশ্য একা নয় সৌমেনদা বাইক চালাত আর সে পেছনে হাতে তিন-চারটে প্যাকেট নিয়ে বসে থাকত। কয়েকটি নির্দিষ্ট বাড়িতে প্যাকেটগুলো পৌছে দেবার কাজ। কোথাও সিনিয়ার সিটিজেন, কোথাও আবার করোনার পেশেন্ট। সব কাজ মিটিয়ে থানায় ফিরতে ফিরতে কোন কোন দিন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। তখনো হয়তো খাওয়া হয়নি অনিকেতের। সব দেখেশুনে বড়বাবু বললেন, তোর একটা গাড়ি দরকার মনে হচ্ছে। 

—গাড়ি! অবাক হয়েছিল সে। 

—হ্যাঁ গাড়ি মানে সাইকেল। তখনও সে অবাক। বন্ধুদের কাছে চেয়েচিন্তে নিয়ে সে সাইকেলটা শিখেছিল হয়তো। কিন্তু তার নিজের বলতে কোন সাইকেলই ছিল না। বড়বাবু তাকে সাইকেল দেবেন নাকি! এইরকম যখন ভাবছে বড়বাবুই তখন বলেছিলেন,  যা মালখানায় গিয়ে দেখ। মোটামুটি চালু একটা সাইকেল বেছে নিয়ে আয়।

একটু অবাকই হয়েছিল অনিকেত। মালখানায় গিয়ে দেখেছিল  ভাঙাচোরা  হয়ে পড়ে আছে সাইকেলের স্তুপ। রাস্তায় ওগুলো সিজ করা হয়েছে বিভিন্ন কারণে। পরে আর কেউ থানায় এসে দাবি জানায়নি। একটা সাইকেল বেছে রেখেছিল সে। মিস্ত্রি ডেকে সেটাই আপাতত চালু করে দিয়েছেন বড়বাবু। সেদিকে তাকিয়ে বড়বাবু হাসলেন, ওই দেখ তোর সাইকেল। একেবারে নতুন হয়ে গেছে। চেপে দেখ ঠিক আছে কিনা। এক চক্কর ঘুরে আয়। তোকে একটা কাজে পাঠাব। 

সাইকেলের সিটে উঠে প্যাডেল করতে বেশ লাগল। বেশ চালু গাড়ি। একটু পুরনো যদিও কিন্তু বেশ কাজের। ঘুরে এসে বড়বাবুর  সামনে দাঁড়াতেই, তিনি বললেন, একটা অন্যরকম কাজ। হাসপাতাল থেকে একটা পেশেন্ট কাউকে কিছু না জানিয়ে বাইরে চলে এসেছে। কোভিড পেসেন্ট হিসেবে হাসপাতলে চিকিৎসা হয়েছে তার। খবর যা পেয়েছি তাতে জানা গেছে তার করোনা সেরে গেছে। কোরেন্টাইন পিরিয়ড পার হয়ে গেছে। কিন্তু মুশকিল হল আজ সকাল থেকে তাকে বেডে পাওয়া যাচ্ছে না। সব ডিউটি আমাদের মাথায় উঠেছে আজ। দু’টো টিম বেরিয়ে গেছে। তুইও সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়। পেশেন্টটাকে খুঁজে পেতেই হবে।

সাইকেল নিয়ে তাকেও রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াতে হবে।  এব্যাপারে অনিকেত এক পায়ে খাড়া। আসলে কাজের বাইরে সে থাকতেই পারে না। তার নিজের বলতে কেউ নেই। তার নিজের বলতে সে নিজেই। ভাঙ্গাচোরা একটা ঘর, হ্যাঁ একটাই ঘর। এটাকে তার পৈতৃক বাড়ি বলা যায়। এ বাড়িতে সে একাই থাকে। আর থাকে ছুঁচো, ইদুর, টিকটিকি। একদিন একটা সাপ বেরিয়ে এল তার নড়বড়ে তক্তপোশের তলা থেকে। কী সাপ সে জানেনা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সর্প-দর্শন। অন্য কেউ হলে হয়তো পিটিয়েই  দিত। কিন্তু সে সেসব কিছু করলই না। সাপটা তাকে গ্রাহ্য না করেই হেলে-দুলে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে গেল। ঘরের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে তার এইটুকু। ঘুম ভাঙলেই সে বেরিয়ে যায়। তখন ঘর হয়ে যায় পর। সে ঘোরে, কখনো রাস্তায়, কখনো মধুদার চায়ের দোকানে, কখনো তারা পদের সবজি মাচায়। বিকেলে 'নিউ তেলেভাজা'য় সে রোজ  নিমাই মান্নার হেল্পার হয়ে যায়।

পৃথিবীতে কত কাজ যে পড়ে থাকে মানুষের জন্যে। নিখিল বাবুর বাগান পরিষ্কার করা, অতীনদার জন্যে টোটো ডেকে আনা, নিমাই বিশ্বাসের আলুর বস্তাটাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, মাঞ্জা দেওয়ার সময় ঘুড়ির লাটাই ধরা, নিশিদার সাইকেলের লিক সারিয়ে আনা। কিন্তু সব কাজই একদিন দুম করে বন্ধ হয়ে গেল। কি এক ভাইরাস নাকি এসেছে। তারই ঠেলায় সব বন্ধ। কলকারখানা অফিস দোকান-বাজার এমনকি ট্রেন চলাচলও একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তায় বাস নেই, অটো টোটো রিক্সা এমনকি সাইকেলও চলছে না। রাস্তায় শুধু একা-একা ঘুরছে অনিকেত। তার মাথার চুল উস্কোখুস্কো, হাতে-পায়ে ময়লা, ফিতে ছিড়বো ছিড়বো হাওয়াই চটি পায়ে। সকাল থেকে চা খাওয়া হয়নি তার। বারোটা বেজে যাচ্ছে। শূন্য ধু ধু রাস্তার ধারের ফাঁকা একটা রোয়াকে সে বসে আছে। খিদে এসে জানান দিচ্ছে তাকে। তখনই রোয়াকের ওপারে খোলা জানলায় মুখ রাখলেন হিমাংশুদা। বললেন, অনি, আজ দুপুরে তুমি দু’টো ভাত খাও আমার কাছে। তার খিদের খবর মানুষেরা যে কি করে টের পায়! টের পায় বলেই তাকে কোনদিন অভুক্ত থাকতে হয়নি। আর এখন তো একেবারেই অন্যরকম। এখন খিদে পাওয়া মানুষের কাছে সে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। এটাও এক অন্যরকম ভালোলাগা।

জি টি রোড ধরে যাচ্ছিল অনিকেত বরাবর উত্তর দিক। লোকটা পালিয়ে গেলেও নিশ্চয়ই হাসপাতালের আশেপাশে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে। সদ্য অসুখ থেকে সেরে ওঠা একটা লোক একা একা কতদূর যেতে পারে? লোকটা বেঁটেখাটো, কালো কুলো চেহারা, মাথায় অল্প টাক আছে, বয়স আন্দাজ ষাট। লোকটা পালিয়েছে হাসপাতালের বেড থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। মাথার চুল ছিড়ছে পুলিশ। কপাল ভাল রাস্তায় লোকজন নেই। লোকজন থাকলে তার মধ্যে কোথায় যে ঘাপটি মেরে থাকত লোকটা, কে জানে। ফাঁকা রাস্তায় কাউকে দেখলেই তার সামনে গিয়ে থামছে অনিকেত। রোগীকে এক চটকা দেখলেই বোঝা যায়। চোখ-মুখ দেখে আন্দাজ করা যায়। ঝারা তিনঘন্টা  হয়ে গেল টহল দিচ্ছে সে কিন্তু তেমন লোকের দেখা পাওয়া গেল না। বড় রাস্তায় পুলিশভ্যান টহল দিয়ে গেছে, বাইকও ছুটেছে বেশ কিছু। বাকি ছিল এই গলিঘুঁজি রাস্তাগুলো। সেই রাস্তাগুলো সে আর দু’জন কনস্টবল চক্কর দিয়েছে। এখন সে প্রায় হাক্লান্ত বলা যায়। এখন একটু জিরিয়ে নিলে হয়। তেমনটা ভেবেই সোনাপট্টি বাজারের ভেতর দিয়ে যে রাস্তাটা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে শেষ হয়েছে সেটা ধরে এগিয়ে গেল অনিকেত। হারিয়ে যাওয়া লোকটা গঙ্গার হাওয়া খেতে নিশ্চয়ই এখানে আসবে না। কিন্তু তাকে এবার একটু বসতে হবে। গঙ্গার ঘাটের পাশে একটা হরি মন্দির আছে। মাঝে মাঝে নাম গান হয়। এখন অবশ্য ভাইরাসের ঠেলায় সব বন্ধ। সেখানেই বসতে গিয়ে একটা লোককে দেখতে পেল সে। লোকটা একটা চাদর পেতে মেঝের ওপর শুয়ে ছিল। তাকে বসতে দেখে উঠে বসল। একটু হেসে বলল, তুমিও কি তাকে খুঁজতে বেরিয়েছো নাকি?

লোকটার পরণে ধুতি আর লম্বা ঝুলের জামা। মাথার চুল সাদা। মাথায় টাক নেই। বুকপকেটে আবার কলম। তাকে জিজ্ঞেস করল, সে একজনকে খুঁজতে বেরিয়েছে কিনা। তার মানে এই লোকটা জানে একজনকে খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু কী করে জানলো? সন্দেহ চোখেই তাকাল অনি। তা দেখে হেসে ফেলল লোকটা। বলল, একটু আগে মোটা করে একজন সিভিক পুলিশ এসেছিল। তার কাছে শুনলাম একজন হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে। তুমিও কি তাকেই খুঁজতে এসেছ?  তুমিও পুলিশের লোক নাকি? 

খুঁজতে খুঁজতে হয়ত হারাধনদাই এখানে এসেছিল। এখন তার কথাই বলছে লোকটা। সে যাক, এখন অনিকেত আস্তে করে বলল, সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?

—তা হচ্ছে। লোকটা আবার হাসল। বুট জুতোটা দেখছি পুলিশের। পোশাক-আশাক আবার শরীরের মাপ এর মত নয়। তবে দেখে মনে হচ্ছে বেশ দামী। সাদা পোশাকে পুলিশ অনেক সময় এরকম জামাকাপড় পরে।

—ঠিকই ধরেছেন। আমি পুলিশ নই। তবে তাঁদের হয়ে কিছু কাজটাজ করি। সে আস্তে করে বলল। প্রায় ঘন্টা তিনকের ওপর হয়ে গেল আমিও খুঁজছি।

—এর মধ্যে একজনকেও চোখে পড়ল না?

—কী করে পড়বে? লকডাউনে সব বন্ধ। রাস্তায় লোকজনই নেই। লোকটা বলল রাস্তায় তাকে পাবে না। তুমি বললে লোকটা হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে তার মানে সবে রোগ থেকে উঠেছে, শরীর দুর্বল। সে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে পারে না। 

—তা ঠিক। —তাকে পেতে হলে বন্ধ দোকানের সামনে যে বেঞ্চ পাতা থাকে সেই বেঞ্চের ওপর শোয়া অবস্থায় পেতে পারো। বাড়ির সামনের খোলা রোয়াকেও বসে থাকতে পারে সে। আবার এই আমার মতো কোনো গঙ্গারঘাটে, কোনো হরি মন্দিরে একা একা বসে সময় গুনতে পারে।

—হরিমন্দির, গঙ্গার ঘাট, একা একা এসব শুনে অনিকেতের মনে হল এই লোকটাই সেই লোকটা নাতো? সেই যাকে সে খুঁজছে। কিন্তু এই লোকটার বয়স ষাট নয়, এর চুলে এখনও পাকই ধরেনি। চোখেমুখে অসুস্থতার কোন চিহ্নই নেই। কথাবার্তায় বেশ সুস্থতার ইঙ্গিত। আর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা কোনো পেশেন্টের পোশাক-আশাক এত পরিপাটি থাকারও কথা নয়। থানা থেকে আসবার সময় কেন যে একটি ফটো পাওয়া গেল না। তাহলে এখনি সনাক্ত করতে পারত সে।

লোকটা বলল, কি এত ভাবছো বলতো? অনিকেত চোখমুখ স্বাভাবিক করে বলল, লোকটাকে পেলাম না, বড় খারাপ লাগছে। —কার জন্য খারাপ লাগছে? তোমার নিজের জন্য বুঝি। —না না ওই লোকটার কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে। শুনলুম বাড়িতে এখন ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। ভাইরাসের ভয়ে পাড়া-প্রতিবেশীও তেমন সামনে আসতে ভয় পেয়েছে। অসহায় হয়ে একটা লোক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। তার কথা ভাবলে খারাপ লাগবে না?

লোকটা হাসল। বলল, ভাবলুম, তোমার নিজের কথা ভেবেই তোমার বুঝি কষ্ট হচ্ছে। থানা থেকে তোমাকে একটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। লোকটাকে ঠিক ঠিক খুঁজে নিয়ে আসতে পারলে তোমার সুনাম হত। বলা যায়না তোমার একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারত। 

অনিকেত কথা বলল না। কথাটা ভালো লাগল না তার। সে একমনে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ছিল। খুব অল্প অল্প স্রোত।  হাওয়া দিচ্ছে খুব কম। হরিমন্দির লাগোয়া অশ্বথ গাছটার নিচে ছায়া এসে বসেছে ঘন হয়ে। ধার দিয়ে দুটো জেলে-নৌকো চলে গেল। একমনে এই সব দেখছিল । সে খেয়াল করেনি কখন পাশে প্রতিকার কাকা এসে দাঁড়িয়েছেন। তার পিঠে হাত দিয়ে তিনি বললেন, তুমি?

—হ্যাঁ আমি, কাকা। ওইযে থানা থেকে একজন পালিয়েছে। তাকেই খোঁজা হচ্ছে। তিন ঘন্টা হয়ে গেল তাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও হদিস করতে পারলাম না।

—পারবেও না। পাশে বসতে বসতে বললেন প্রতিকার সান্যাল।  আমি অবশ্য লোকটার খোঁজে যাই নি। গিয়েছিলুম ঘটনার খোঁজে। তা কি অব্যবস্থা বুঝতে পারছ? একটা লোক দিনদুপুরে হাসপাতালের বেড থেকে পালিয়ে গেল। কোনো খোঁজ নেই। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কি হাল দেখ একবার। এটা নিয়ে জোরাল প্রতিবাদ করা উচিত। আজই আমি এই নিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছি। এর মধ্যে লোকটাকে যদি পাওয়া যেত তাহলে জম্পেস হতো স্টোরিটা।

—স্টোরি মানে কী কাকা? —মানে গল্প, গল্প থাকলে চিঠিটা জমে যেত। —তাই নাকি? পাশ থেকে এবার লোকটা কথা বলল। আপনি আপনার লেখায় স্টোরির কথা ভাবছেন বুঝি? —না না স্টোরির কথা ভাবব কেন। আমি ভাবছি প্রতিবাদের কথাটা। লোকটাকে পাওয়া গেলে প্রতিবাদটা জোরাল হতো তাহলে। —তারমানে লোকটাকে পেলে আপনি তার ইন্টারভিউ নিতেন। তার অভিজ্ঞতার কথা শুনতেন। চারপাশে কি অব্যবস্থা চলছে তার নিখুঁত ধারাবিবরণী দিতে পারতেন।

—তাহলে ব্যাপারটা কি রকম জমে যেত একবার ভাবুন। সায় পেয়ে  আবেগে গলা তুললেন প্রতিকার কাকা। জীবন্ত প্রতিবেদন  আর কি। এতে করে আর কিছু না হোক অব্যবস্থা তো বন্ধ হবে। এবার আমি উঠি অনু। চিঠিটা আজকেই মেইল করে দিতে হবে। বলে উঠে পড়লেন প্রতিকার কাকা।

—তুমিও কি এবার উঠবে নাকি? অচেনা লোকটা কথা বললে আবার। তোমাকে তো আবার থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। —আজ্ঞে আমি চুনোপুঁটি, আমি আর কি রিপোর্ট দেবো বলুন। বলতে পারেন আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। —জবাবদিহি কেন? তুমিতো চাকরিও করো না। তোমার আবার দায় কিসের?   

—বড়বাবু যে আমার উপর দায়িত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, তুই পাড়বি অনিকেত, তোর এলেম আছে। এখন শূন্য হাতে ফিরে  বড়বাবু সামনে দাঁড়াব কি করে বলুন? যখন সে ভাবছে এরপর কী করবে কোথায় যাবে, তখনই পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠল। ওপার থেকে বড়বাবুর গলা ভেসে এলো। কিরে অনিকেত, কিছু হদিশ পেলি? বড় বাবুর গলায় আশঙ্কা টের পেল সে। তখন আস্তে করে বলল, না স্যার কোথাও খুঁজে পেলাম না।

—বেশ ফিরে আয়। ফোনটা পকেট রেখে উঠে দাঁড়াল অনিকেত। আমাকে এবার যেতে হবে কাকা। পালিয়ে যাওয়া লোকটাকে না খুঁজেই ফিরে যাবে? —কি আর করবো? চেষ্টা তো কম করিনি। ঘন্টা তিন ধরেই সাইকেলের প্যাডেল করছি।  গায়ে  আর জোর থাকে বলুন? বলে সাইকেলে উঠতে যাচ্ছিল অনিকেত।

লোকটা বলল, দাঁড়াও। তুমিতো থানায় যাবে। আমার হাটখোলায় বাড়ি। তোমার সাইকেলে ডবল ক্যারি করে যদি খানিকটা এগিয়ে দাও তাহলে খানিক উপকার হয়। অনিকেত বলল, আসুন। থানার সামনে সাইকেল থেকে নেমে বড়বাবুর ঘরের দিকে যাবে, অনিকেত দেখল লোকটাও তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সে বলল, আপনি কোথায় যাবেন?

লোকটা হাসল। বলল, এসেছি যখন তখন তোমার বড় বাবুর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকতেই একটা ঘটনা ঘটল। তাকে দেখে নয় তার পাশের লোকটাকে দেখে চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বড়বাবু। শুধু বড়বাবুই বা কেন, তারসঙ্গে মেজবাবু, দুজন কনস্টেবল সবাই যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠল। বড়বাবু চমকে উঠে বললেন, একে কোথায় পেলি?

—একে, মানে পাশের লোকটাকে দেখিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন উনি। ব্যাপারটা কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেনা অনিকেত। সে তখন বলল, আজ্ঞে সোনাপট্টির গঙ্গার ধারে যে হরিমন্দির সেখানেই খুঁজে পেলাম এঁকে।

(দশ)

শেষে তারই ওপর দায়িত্ব পড়ল এই লোকটাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।  লোকটার বাড়ি নতুন পাড়ায়। ফোন করবে বাড়িতে, এমন কোন নম্বর ছিল না থানায়। লোকটা বলল, ওসব ফোন-টোন আমাদের কিছু নেই স্যার। তাই বাড়িতেও ফোন করা গেল না। অবশ্য ফোন থাকলেও কোন কাজ হতো না। জিজ্ঞেস করা করে জানা গেল লোকটার ছেলে মেয়ে থাকলেও বাড়িতে কেউ থাকে না। ছেলে থাকে ডায়মন্ড হারবারে। ওখানে চাকরি করে সে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে সে থাকে আসানসোল। এই লকডাউনের সময় কারো আসা সম্ভব নয়। ফোন থাকলে ফোনে হয়তো খোঁজখবর করত। কিন্তু সেই যন্ত্রটাও খারাপ হয়ে পড়ে আছে। বাড়িতে থাকার মধ্যে শুধু স্ত্রী। কিন্তু তিনিও একজন বারোমেসে রোগী।

মানুষটির জ্বর হয়েছিল। পাড়ার কয়েকজন ছেলে উদ্যোগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। লোকটি বলল, এটাও অনেকখানি। খারাপ জ্বর কমে গিয়েছিল কিন্তু হাসপাতাল ছুটি দিচ্ছিল না তাকে। ওদিকে বাড়িতে একা  অসুস্থ স্ত্রী। যদিও পাড়ার ছেলেরাই বলেছিল, ভলেন্টিয়ার গ্রুপ দেখভাল করবে কাকিমার। খাবার-দাবার ওষুধ যা লাগবে তারাই সব ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু মন কি তাই মানে! খানিক সুস্থ হতেই কাউকে কিছু না বলে হাসপাতাল থেকে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু বেরিয়ে এসে আর রাস্তার দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে ছিল। তারপরই তো দেখা হলো এর সঙ্গে। বলে অনিকেতকে দেখাল লোকটা।

বড়বাবু বললেন, অনিকেত তুই একে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবি? সেই যাওয়া হচ্ছে এখন। বড়বাবু একটা  টোটোকে ডাকতে বলেছিলেন। অনিকেত বলল, তা কেন। আমি ডবল বাইক করেই ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেবো। লোকটা বলল, সেই ভালো। ডবল বাইকেই তো এলাম। কোন অসুবিধা হয়নি।
ঝুট-মুট পয়সা খরচ করার দরকার নেই। 

বড়বাবু রাগ করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তবে বেশ সামলে নিলেন। এই লোকটাকে নিয়ে সারাদিন তো পরিশ্রম কম হয়নি সবার। উদ্বেগও হয়েছে। তবে এখন পাওয়া গেছে এই চিন্তায় আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, তাহলে তাই হোক।

শেষে তাই হল। রডে লোকটাকে বসিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে অনিকেত। লোকটা বড় হালকা-সালকা। ওজন মেরে কেটে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ কেজি। তাই সাইকেলে কেউ চেপেছে বলে মনেই হয় না। লোকটার গায়ে এখনও হাসপাতালের গন্ধ। যখন হাটখোলা পেরুচ্ছে লোকটা আস্তে করে বলল, এক কাপ করে চা খেলে হতো কিন্তু।

কথাটা শুনে মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল অনিকেতের। লোকটার নির্ঘাত খিদে পেয়েছে। হাসপাতাল থেকে সকালেই বেরিয়ে পড়েছে । সকালের ব্রেকফাস্টটা খাওয়া হয়েছে কিনা কে জানে! তারমানে সারাদিন তার পেটে কিছু নেই। এখন তার  খিদে পাওয়া স্বাভাবিক। এদিকে দোকান সব বন্ধ। চায়ের দোকানও খোলা নেই। অবশ্য খোলা থাকলেই যে সুরাহা হত তেমনটা নয়। চায়ের দাম ঐ লোকটা দিতে পারবে না। ওর পকেটে  পয়সা-কড়ি থাকার কথা নয়।  কিন্তু তার পকেটও যে শূন্য। তাই সে চাপা গলায় বলল, বাড়িতে গিয়েই না হয় চা খাবেন।

উত্তরে একটা শুকনো হাসি শুনতে পেল অনি। তারপর  হাসি সরিয়ে লোকটা চাপা গলায়  বলল, আমার এমন কপাল, তোমরা এত উপকার করলে, ঘরে বসিয়ে তোমাকে যে এক কাপ চা খাওয়াব সঙ্গে দুটো বিস্কুট সে উপায় নেই, বুঝলে? 

এটা না বোঝার কিছু নেই। অনিকেত বেশ বুঝতে পারছে, লোকটা তারই মত। প্রায় চালচুলোহীন। তারও যেমন এখন বেশ খিদে পেয়েছে। আসলে সে দেখেছে, গরিব মানুষদের খুব খিদে পায়। খুব ঘন ঘন খিদে পায়। খিদে পায় কিন্তু খাবার পায় না। অন্যদিকে বড়লোকেদের খিদে পায় না কিন্তু খাবার পায় অঢেল। এই যেমন এখন তাদের দুজনেরই খিদে পেয়েছে কিন্তু কোথাও খাবার নেই। অবশ্য রাস্তার দু'ধারে খাবার থাকলেই যে খেতে পেত তাও নয়। তাদের পকেটে পয়সাও নেই।

একমনে সাইকেল চালাচ্ছিল অনিকেত আর ভাবছিল। তখনই লোকটা বলল, কী এত ভাবছো অনিকেত? আপনি আবার আমার নাম জানলেন কি করে? বড়বাবু ওই নামেই তো ডাকলো তোমাকে।

—তা বেশ, তবে আপনার নামটাও জানতে ইচ্ছে করে। —আমার নাম মিহিদানা দত্ত। —বাহ বেশ নাম তো। কথা শুনে লোকটা ছোট করে হাসল। হয়তো হা হা করে হাসারই ইচ্ছে ছিল কিন্তু পেটে একপেট খিদে নিয়ে অমন হাসা সম্ভব নয়। মুখ থেকে হাসি মুছে নিয়ে লোকটা বলল, আমার আবার নাম একটা নয়, বুঝলে। রোজই নতুন নতুন নাম পাবে তুমি। আজকে শুনলে মিহিদানা, আগামীকাল হয়তো শুনবে, আমার নাম সন্দেশ সরকার। তার পরের সপ্তাহে যদি দেখা হয় জানতে পারবে সেদিন আমার নাম হয়ে গেছে লেডিকেনি মন্ডল। 

অনিকেত শব্দ করে হেসে উঠল। তার পরই তার খেয়াল হল, খিদেটা তেমন ভাবে আর জানান দিচ্ছে না। কথায় কথায় খিদেটা সরে গেছে। মিহিদানাকাকা বলল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

—কথা জিজ্ঞেস করার জন্য আবার অনুমতি নিতে হবে কেন? —না বলছি তোমার ওই অনিকেত নামের মানেটা কী? সে হাসল। বলল, আমিও জানতাম না। কিছুদিন আগে  একজন ভলেন্টিয়ার দিদির কাছে শুনলুম আমার নামের মানে নাকি, গৃহহীন। মানে যার ঘর নেই আরকি। কি করে যে বাবা এত ঠিকঠাক একটা নাম রেখেছিল! তার ওপর এত কেতাবি একটা নাম! 

—কী করতেন তোমার বাবা? —কিছুনা, শুনেছি বাবা নাকি পদ্য-টদ্য লিখত। —তারমানে তোমার বাবা রুগী ছিল। —হ্যাঁ রুগী তো বটেই। যাকে দুরারোগ্য রোগ বলা হয় তাই। এই পদ্য রোগে ভুগেই মারা গেল বাবা। আমাদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেনি। ঘর নয়, বাড়ি নয়, অন্নের সংস্থান নয়, শুধু রেখে গেল ওই নামটা। —না আর একটা জিনিস রেখে গেছেন। 

অনিকেত অবাক তাকাল। মিহিদানা কাকার মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে না। তবে আন্দাজ করতে পারছে, মুখটা হাসি হাসি, মুখে এসে বসেছে ভারী এক রহস্য। —কী রেখে গেছে বাবা? —একটা ছেলেকে, যে ছেলে নিজের জন্য ভাবছে না। পরের কথা ভাবতে ভাবতে দিন কাটছে তার। নিজের পেটে খিদে, তবু সে অপরের খিদে মেটাবার কথা ভাবছে। 

—হয়েছে হয়েছে। বলে মিহিদানা কাকাকে থামায় অনিকেত। খিদে পেয়েছে জানি, শুধু আপনার নয় আমারও। সেটা  না মিটিয়ে ভাষণ দিলে হবে? বলতে বলতেই সে সাইকেল থামায়। সামনেই একতলা পুরনো চেনা বাড়িটা। ঘাড় ঘুরিয়ে অনি বলে, আগে এটা ছিল অহি-নকুল ভবন, সেটা বদলে গিয়ে এখন হয়েছে হিমশীতল ভবন। একটা রাগী লোক থাকত এখানে। যার কাজই ছিল ঝগড়া করা। লোকটা আগাপাশতলা বদলে এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাড়িটাও বদলে গিয়ে হয়েছে হিমশীতল ভবন।

মিহিদানা কাকা বলল, বাহ। গরম থেকে ঠান্ডা হওয়ার কারণটা কী? —বলবো, তবে তার আগে আমাদের একটু ঠান্ডা হওয়া দরকার। ভেতরে আগুন জ্বলছে। আগুনে একটু জল না দিলে আর চলে না। বলতে বলতে দরজার কড়া নাড়ল অনিকেত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল যে, তার নাম অদ্ভুত। রোগা পাতলা, শুটকো চেহারার লোকটা ফোকলা দাঁতে একগাল হাসল। বলল, কি খাবে বলো? অনি বলল, কি করে বুঝলে? অদ্ভুত হাসল। বলল, মুখ দেখে।
তোমাদের দেখছি ভাত-খিদে পেয়েছে। মিহিদানা কাকা বলল, কি করে বুঝলে? 

অদ্ভুত আবার বলল, মুখ দেখে। চা-খিদের মুখ একরকম, জলখাবার-খিদের মুখ অন্যরকম, আবার ভাত-খিদের মুখ একেবারে আলাদা। মিহিদানা কাকা বলল, বাহ বেশতো। আর ঝালমুড়ি-খিদে? —সে বলা যাবেখন। আগে ভাতটা বসিয়ে দিই। 

সে যেতেই অহি-নকুল কাকা এসে দাঁড়ালেন। পাশে তাকিয়ে তিনি বললেন, কাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে অনিকেত? —এর নাম মিহিদানা দত্ত। হাসপাতালের বেড থেকে একরকম পালিয়ে এসেছেন বলা যায়। চারদিকে হইহই কান্ড। শেষে ধরা পড়েছেন আমার হাতে। আমার দায়িত্ব পড়েছে একে বাড়ি পৌছে দেবার। এখন দুটো ভাত খাব বলে আপনার এখানে ঢুকে পড়েছি কাকা।

অহি-নকুল  নরম করে বললেন, খাবে, এ আর বেশি কথা কি। কথা শেষ করে, অদ্ভুত, বলে ডাক দিলেন। ওকে ডাকতে হবে না কাকা। ও আগেই এসেছিল। সব শুনে ভাত চাপাতে গেছে। —তাই নাকি? বেশ বেশ, তবে  লোকটা বেশ কাজের, জানো? —লোকটা? —হ্যাঁ লোকটা, লোক ছাড়া আর কিই বা বলি ওই ভূতটাকে!

মিহিদানা দত্ত বলল, ভূত? —ভূত ছাড়া আর কি বা বলা যায় ওকে। সারাদিন গাধার মত পরিশ্রম করে অথচ খাই-খরচা নেই, জলপানি নেই, মাস গেলে মাইনেও নেই। শুধু নিয়ম করে মার খাওয়াতে হবে ওকে। —মার খাওয়াবেন? সেটা আবার কি জিনিস?

অহি-নকুল কাকা বললেন, অদ্ভুত জিনিসই বটে। আমি জন্মে এমন খাবারের কথা শুনিনি। অদ্ভুত শুধু মার খেতে ভালোবাসে। সকালে ব্রেকফাস্টে গালে গোটা পাঁচেক চড় আর পিঠে গোটা দশেক কিল। দুপুরে একটু বেশি দরকার হয়। লাঞ্চ বলে কথা। পিঠে পঞ্চান্ন বার  শংকর মাছের চাবুক না হলে ওর ঠিক মন ভরেনা। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা যেমন চা মুড়ি খাই, ওকেও তখন খেতে হবে গোটা কতক ঘুষি। রাতেরবেলা…

—থাক থাক, মিহিদানা দত্ত কথা বলল মাঝখানে। আমার শুনেই কেমন কষ্ট হচ্ছে। —আর ওর মার খেলেই মন ভরে। পেটও ভরে বলা যায়। মার যে খাবার জিনিস সেটা ওকে দেখেই বোঝা যায়। যাগ্গে যাক, হঠাৎ গলা তুলে অহি-নকুল কাকা, অদ্ভুত অদ্ভুত, বলে ডাকলেন। ভেতর থেকে অদ্ভুত বলল, যাচ্ছি কাকাবাবু।

বলা শেষ হল  আর ভাতের থালাও চলে এল। তাড়া দিল অদ্ভুত। নিন, টেবিলে বসে পড়ুন। আমি সার্ভ করে দিচ্ছি। চেটেপুটে ভাত কটা খেয়ে বড় করে দুটো ঢেকুর তুলল মিহিদানা দত্ত। বলল, এবার তাহলে আসা যাক। —হ্যাঁ আর দেরি করা ঠিক নয়। অনিকেত সাবধানী গলায় বলল, বাড়িতে আবার কাকিমা কেমন আছে না গেলে জানা যাবে না।


(এগারো)

রাত যে খুব বেশি হয়েছে তা নয়। সন্ধেবেলা  এই গলিতে ভূতের মতো অন্ধকার নেমে আসে। সরুগলি, দু'পাশে ঝোপ-জঙ্গল, কটা পুরনো বাড়ির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটিমাত্র ঘরে একটিমাত্র আলো জ্বলে। আশেপাশে একজনকেও চোখে পড়ে না হারাধনের। প্রায় পাঁচ মিনিট হয়ে গেল সে এখানে এসেছে। অনির কাছে শুনেছে তার বাড়ি নামারের বাগানের শেষে। পুরনো মান্ধাতা আমলের একটা বাড়ির একখানা ঘরে সে থাকে। একমাত্র আলো জ্বলা এই ঘরটাই হয়তো সেই ঘরটা। চৌকির ওপর একটা চিমসে বিছানা। মেঝের ওপর ধুলোর আস্তরণ। দরজা আছে পাল্লা নেই। জানলা আছে, গরাদ নেই। বিছানা আছে, বালিশ নেই। 

—অনি অনি, বলে ডাকল হারাধন। ওই ডাকে কেউ সাড়া দিল না। তাহলে গেল কোথায় ছেলেটা। থানা থেকে দেয়া মোবাইলে। বার চারেক রিং করেছে সে। প্রতিবারই মোবাইল বেজে বেজে থেমে গেছে। অথচ এই ভালো খবরটা দেবার ছিল। তাকে অবশ্য কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু এমন একটা খবর না জানানো পর্যন্ত তারও স্বস্তি নেই। কিন্তু পনের-বিশ মিনিট  ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একসময় হতাশ হয়ে পড়ে সে। ঘর থেকে নিচে উঠোনের অন্ধকারে নামতেই চোখে পড়ে অনিকেতকে।

অনিকেত বলে, হারাধনদা তুমি? —হ্যাঁ, অনেকক্ষণই এসেছি। এতক্ষণ কোথায় ছিলি তুই? আশেপাশের সবাই জেনে গেছে আমি একজন ভলেন্টিয়ার, যারা কোভিড পেশেন্টদের দেখভাল করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। সকাল-বিকেল তারা এই ভাঙ্গাঘরেই খবর নিয়ে আসছে। সেই তাদেরই একজনকে দেখতে গেছিলাম হারাধনদা। হারাধন পল্লে বলল, তোর এই খবরটা শুধু পাড়া নয়, শুধু এই শহর নয়, কলকাতাতেও পৌঁছেছে।

অনিকেত বলল, তোমার কথা কিছুই বুঝছি না। হারাধন হাসল। সেটা বোঝাতেই তো এই রাতে তোর বাড়ি চলে এলুম। বড়বাবু তোর নামটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। সরকারের ঘরে তোর নামটা উঠে গেছে জানিস। তুই এখন একজন কোভিড ওয়ারকার। আজ থেকে তুই আর গৃহহীন নয়। তোর একটা ঘর হল অনিকেত। (শেষ)

         



ধারাবাহিক উপন্যাস
গোলোকধাঁধা
তপশ্রী পাল
(পর্ব ২)

আজ সপ্তমী। অনেক ভোরে ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেছে সৌজন্যর। কলা বৌ স্নান করাতে পুকুরে নিয়ে যাচ্ছে নিশ্চই! মা বলেছিলো গতবার! শুয়ে শুয়ে আর ঘুম এলো না। হঠাত মাথায় ঢুকলো আচ্ছা, সেই সূত্রটা কী হতে পারে? “গোলাপী”? না না তা কী করে হবে? গোলাপী তো কোন জিনিস নয়, একটা রঙের নাম! তাহলে? হঠাত মনে পড়লো দুর্গার সামনে মহিষটা! বিশাল মহিষের মুখটা দুর্গার পায়ের নীচে! কিন্তু কী তেজি সেই মুখ! সরাসরি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে! বিশাল দুটো শিং! রাগী দুটো চোখ নিয়ে যেন গুঁতোতে আসছে! মহিষের মুখটাই অন্ততঃ দু আড়াই ফুট উঁচু হবে! ওটাই যেন চোখে পড়ছিলো সবচেয়ে বেশী! এমনকি অসুর আর দুর্গাকে ছাড়িয়ে ঐদিকেই খালি চোখ চলে যাচ্ছিলো! তবে কি শব্দটা হবে “মহিষ”? আজ থেকে কদিন পড়াশোনা বন্ধ। কিন্তু কী এক অস্বস্তিতে সৌজন্যর কোন আনন্দই হচ্ছে না। কে কাল আসছিলো ওদের পিছনে? আর কেই বা ভয় দেখালো সুদক্ষিণাকে? এটা তো একটা কম্পিটিশন! ওদের মতোই আরো কতো গ্রুপ চেষ্টা করছে! এটা তো একটা মজা! এর মধ্যে বিপদের কী আছে বুঝতে পারলো না সৌজন্য। 

কাগজ আসতেই যথারীতি সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়লো সৌজন্য। বাবা বললেন “আমাকে তো একটু পড়তে দে আগে!” সৌজন্য বললো “আমাদের ধাঁধাটা আগে টুকে নিই তারপর তুমি পোড়ো!” বাবা হাসতে লাগলেন। ধাঁধাটা দেখে কিন্তু মাথা খারাপ হয়ে গেলো সৌজন্যর। বেশ প্যাঁচালো! ক্রমে কঠিন হচ্ছে খেলাটা! আজকের ছড়া বলছে –

সোনার গয়না পরে আছেন দুর্গা মা জননী
আড্ডা হবে দেদার তুমি আসবে যখনই
চৌকো মাঠের ধারে যদি ঠাকুর দেখতে ছোটো
পাগলা _____________মারলে গুঁতো পেটটা হবে ফুটো!

এ আবার কেমন ছড়া রে বাবা! কোন প্যান্ডেলের কথা বলছে কিছুই মাথায় ঢুকলো না সৌজন্যর! তবে এটা ঠিক শূন্যস্থানে “ষাঁড়” বা “মহিষ” জাতীয় কিছু একটা শব্দ বসবে। নইলে আর গুঁতোয় পেট ফুটো কী করে হবে? অন্ততঃ এটা ঠিক ঠিক ভাবতে পেরেছে বলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দিলো সৌজন্য। 

কিন্তু না, এরপরে আর কিছুতেই এগোনো যাচ্ছে না। আজ জলখাবারে ছিলো ফ্রেঞ্চ টোস্ট! ডিম দিয়ে নরম নরম ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেতে খুব ভালোবাসে সৌজন্য! আর সঙ্গে টম্যাটো কেচাপ! মন দিয়ে খাওয়া সেরে বন্ধুদের ফোন করতে বসলো সৌজন্য! হান্টার সেভেনের সবার বাড়িতেই এই কদিন বাংলা কাগজটা রাখা শুরু হয়েছে। তাই সবাই ইতিমধ্যেই পড়ে ফেলেছে ছড়াটা! কিন্তু প্যান্ডেলের নামটা কেউই বুঝতে পারছে না। কোথায় সোনার গয়না পরেন দুর্গা আর কোথায়ই বা দেদার আড্ডা হয়? আড্ডা তো সব পুজো প্যান্ডেলেই হয়! তাহলে? শেষে নীলোৎপল বললো “সৌজন্য, তুই বরং আঙ্কলকে একবার জিজ্ঞাসা কর! উনি তো ক্রস-ওয়ার্ড সল্ভ করেন তুই বলেছিলি! তাই এ সব ধাঁধা বুঝতেও পারে! তা ছাড়া সোনার গয়না যখন, কোন ট্রাডিশনাল ঠাকুরের কথা বলা হচ্ছে নিশ্চই! হয়তো ওনাদের আমল থেকেই সেখানের পুজো বিখ্যাত!” গুটি গুটি বাবার কাছে গেলো সৌজন্য। সময় চলে যাচ্ছে। বাবা ছড়াটা পড়ে চুপ করে ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন “জানিস, আমি খুব নস্টালজিক হয়ে পড়ছি ছড়াটার প্রথম দুটো লাইন পড়ে! আমাদের যৌবনে আমরা সবাই আড্ডা মারতে যেতাম একটা বিখ্যাত পুজোর সামনের খোলা মাঠে! সারাদিন কতো যে ভালো ভালো লোকের দেখা পাওয়া যেতো সেখানে! আর চলতো নানা বয়সী কিশোর যুবকদের আড্ডা। গীটার বাজিয়ে গান! এমন আর কোন পুজোয় দেখা যায় না। আর হ্যাঁ, দুর্গাকে এখানে আসল সোনার গয়না পরানো হয় ! প্রতিমা সবসময় হয় ডাকের সাজের।“ সৌজন্য বললো “ডাকের সাজটা কী?” বাবা বললেন “শোলা দিয়ে একরকম বিশেষ গয়না তৈরী হয় দুর্গা আর তার ছেলেমেয়েদের জন্য। সোনালী বা রূপোলী চুমকি বসানো। তারই নাম ডাকের সাজ।“ “প্যান্ডেলের নামটা বলো না! দেরী হয়ে যাচ্ছে তো!” 


সৌজন্যর বাবা বললেন “আমার মনে হচ্ছে এটা ম্যাডক্স স্কোয়ারের প্যান্ডেলের কথা বলা হচ্ছে।“ “কিন্তু মিলছে কী করে? পেট ফুটো কী করে হচ্ছে?” “হা হা্, বুঝতে পারলি না? ম্যাডক্সকে ভাঙ! ম্যাড-অক্স মানে পাগলা ষাঁড়!” মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো সৌজন্যর। কী সহজ আর তারা হাতড়ে মরছিলো! এবার আর প্যান্ডেলে খাওয়াদাওয়া নেই। বক্স দিয়ে যাবে সবার বাড়িতে। কিন্তু হান্টার সেভেন ঠিক করে আজ বাইরেই খেয়ে নেবে তারা। বাবা বললেন ম্যাডক্স স্কোয়ারের ধারে ধারে অনেক স্টল বসে খাবারের। সেখানেই রোল টোল খেয়ে নিলে হবে। হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়লো ওরা। খেয়ে বেরোতে গেলে দেরী হয়ে যায়। রাত করার আর কোন ইচ্ছে নেই ওদের। 

সত্যি ম্যাডক্স স্কোয়ারে বেশ অন্যরকম একটা পরিবেশ। অন্য পুজোর থেকে একেবারে আলাদা। এখানে সব ভালো ভালো লোকজন। মহিলারা অপূর্ব সব শাড়ি গয়নায় সজ্জিত! দুর্গাঠাকুর একেবারে সাবেকী ডাকের সাজের। সারা গায়ে সোনার অলংকার পরিহিতা। দারুণ ঢাক বাজছে প্যান্ডেলে আর প্যান্ডেলের সামনে বসেছে কিশোর যুবক ছেলেমেয়েদের মেলা। এ বছর তাও ভীড় কম। অন্য বছর নাকি আরো বেশী বসে! সেখানে গিটার নিয়ে গানবাজনা হচ্ছে! এই সব দেখতে দেখতে বেশ তেষ্টা পেয়ে গেলো ওদের। এখানে কিন্তু আর ট্রেজার হান্টের গ্রুপ তেমন চোখে পড়ছে না! হয়তো তারা সন্ধের দিকে বেশী আসে অথবা এমনও তো হতে পারে, অনেকেই এই ধাঁধাটা সমাধান করে উঠতে পারেনি এতো তাড়াতাড়ি! একটা স্টলে সবাই কোল্ড ড্রিঙ্ক খেলো ওরা। কিন্তু এমন কোন জিনিস চোখে পড়ছে না তো, যা পরের সূত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে! স্টল থেকে কয়েক প্লেট মোমো নিয়ে মাঠে বসে পড়লো ওরা। এটাই আজকের লাঞ্চ। 

মোমো খেয়ে যখন উঠতে যাচ্ছে, তখন হঠাত কোত্থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে ওদের হাতে এক ঠোঙ্গা বাদাম ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো! কে কী বোঝার আগেই ছেলেটা যেমন এসেছিলো তেমনি কোথায় দৌড়ে চলে গেলো। এক ঠোঙ্গা বাদাম নিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো! সত্যি কী যে হচ্ছে এই ট্রেজার হান্ট নিয়ে! শিবম বিজ্ঞের মতো বললো “এমন হতে পারে পুজো কমিটি জানে, আজকের ধাঁধার উত্তর তাদের প্যান্ডেল আর তাদের বলা আছে বাদাম দিতে। তাই ওরাই পাঠিয়েছে! আমাদের খাতা পেন নিয়ে বসতে দেখে বুঝতে পেরেছে আমরা ট্রেজার হান্টের দল। তাই আমাদের দিলো।“ হঠাত নীলোৎপলের মাথায় কী খেলে গেলো, বললো “ঠিক বলেছিস! পুজো কমিটিগুলো তো জানবেই! আচ্ছা, এই বাদামই আমাদের পরের ধাঁধার সূত্র নয় তো!” সবাই হেসে উঠলো “শেষে বাদাম!” যাই হোক বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে এলো ওরা। এখন অধীর আগ্রহ! আর দুটো দিন বাকী। নবমীর দিনই শেষ প্যান্ডেল! কী লুকোনো আছে সেখানে কে জানে? যে সবার আগে যাবে সেই পাবে! উঃ আর তর সইছে না! আর কোন গ্রুপ না ওদের আগে সল্ভ করে ফেলে! 


অষ্টমীর দিন মা তাড়াতাড়ি ডেকে দিলেন। স্নান টান করে প্যান্ডেলে ভোগের ডালা দিয়ে আসতে হবে তো! তারপর আছে অঞ্জলির পালা। সৌজন্যর মাথায় ও সব কিচ্ছু খেলছে না এবার! আগে কাগজটা দেখতে হবে। দৌড়ে বাবা মার ঘরে গিয়ে দেখে বাবা টিভিতে একমনে পুজো পরিক্রমা দেখে চলেছেন! আশ্চর্য! এই সময় তো বাবা কাগজ পড়েন! সৌজন্য এদিক ওদিক কাগজ খুঁজতে লাগলো। ওর অস্থিরতা দেখে বাবা বললেন “আজ কাগজ আসেনি। একাদশী অবধি আর আসবে না। ডিস্ট্রিবিউটররা এই কদিন কাগজ দিতে পারবে না বলে দিয়েছে তাই কাগজ বেরোনোও বন্ধ! ধপাস করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো যেন সৌজন্য! তাহলে? ট্রেজার হান্ট ফক্কা হয়ে গেলো! কিন্তু তা কী করে হয়? এতো বিজ্ঞাপণ দিয়ে এরকম হবে নাকি? তাড়াতাড়ি বাকিদের ফোন করলো ও। কেউই কিছু বলতে পারলো না! শেষে নীলোৎপলদা বললো “আরে হতাশ হওয়ার কিছু নেই রে বোকা! আমার ফোন নম্বর দিয়েই তো আমাদের গ্রুপ রেজিস্টার করেছিলাম অনলাইনে! তাই আমার ফোনেই ওরা পরের ছড়াটা পাঠিয়ে দিয়েছে!”  যাক বাবা! নিশ্চিন্ত! সৌজন্য ছড়াটা বাবার ফোনে পাঠিয়ে দিতে বললো। অন্যদেরও জিজ্ঞাসা করে তাদের কারো ফোনে পাঠিয়ে দেবে নীলোৎপল। মা এদিকে হাঁক ডাক শুরু করে দিয়েছেন! অষ্টমী পুজোর মন্ত্রপাঠ শুরু হয়ে গেছে! পুজোর ডালা দিয়ে আসতে হবে এক্ষুণি। স্নান করতে দৌড়োলো সৌজন্য। তারপর সেজেগুজে অঞ্জলী দিতে চললো মা বাবার সঙ্গে! এই একদিন বাবা মাকে একদম অন্যরকম লাগে! বাবার পরণে সুন্দর কাজ করা পাঞ্জাবী আর ধুতি! মায়ের চুল খোলা! পরণে একটা লালে সাদায় কী সুন্দর শাড়ি! মা বলে ঢাকাই না কী যেন! মায়ের গায়ে চন্দনের গন্ধ পায় সৌজন্য! মনে হয় মায়ের গায়ের গন্ধ শোঁকে আর কোলে মুখ গোঁজে!

অঞ্জলি দিয়ে এসে বাবার ফোন থেকে ছড়াটা কপি করে নিলো। এবারের ছড়াটা অন্যরকম। কিছু একটা সংগ্রহ করতে হবে এই প্যান্ডেলটা থেকে। সেখানেই বোধহয় থাকবে ফাইনাল ছড়াটা। কী সংগ্রহ করতে হবে আর কোথা থেকে, সেটাও এই ছড়াতেই বলা আছে। এবারের ছড়াটা হলো –

বর্ষা নামে সেই মাসে 
----------তলায় বাস
বারোটি শিবমন্দির 
দুর্গার চারপাশ।
অংক যোগ দিলে পরে 
যতো নম্বর হয়
         ধুতরো ফুলের মাঝে 
আছে পরিচয়!

দুপুরে জমিয়ে খিচুড়ি খেয়ে সবাই বসে পড়ে সল্ভ করতে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সল্ভ করতে হবে, কারণ নইলে অন্য কোন দল শেষ সূত্রটা ওদের আগেই নিয়ে নেবে আর ওরা আউট হয়ে যাবে! অনলাইনে একটা জুম মিটিং, ঠিক স্কুলের মতো, সেট করে দেয় নীলোৎপলদা আর ওরা সবাই চটপট ঢুকে পড়ে। প্রথমেই মন্দিরা বলে “পুজোটা আমার বাড়ির খুব কাছে। আমি বুঝে গেছি কোন প্যান্ডেল!” সবাই সমস্বরে বলে “সে কী রে! তুই এর মধ্যে বুঝে গেলি!” 

মন্দিরা বোদ্ধার মতো গলায় বলে “বর্ষা কখন নামে বল? আষাঢ় মাসে তো? আর কাল তো বাদামের ঠোঙ্গা পেয়েই গেছিস! তাহলে কী দাঁড়ালো বল? আষাঢ় আর বাদাম দিয়ে একটাই পুজো হয়। সেটা হলো –“ মন্দিরা বলার আগেই এবার উপল বলে “আচ্ছা! বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘ! ওটাই তো তোর বাড়ির কাছে!” মন্দিরা বলে “হ্যাঁ, ওটাই আমাদের পাড়ার পুজো আর ওরাই এবার দ্বাদশ শিব মন্দির বানিয়েছে দুর্গার চারদিক ঘিরে!” নীলোৎপল বলে “ব্যাস! তাহলে তো হয়েই গেলো!” মন্দিরা বলে “উঁহু, তার পরের লাইনদুটো কিছুই বুঝছি না! সেই দুটো লাইনেই বলা আছে কী সংগ্রহ করতে হবে আর কোথা থেকে! তোরা কিছু বুঝছিস?” সবাই চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলো। সৌজন্য বললো 
“ঐ পুজো প্যান্ডেলে চল তো আগে!” নীলোৎপল বললো “না রে, প্যান্ডেলে গিয়ে আর ভাবার সময় থাকবে না। তখন জিনিসটা খুঁজে সংগ্রহ করতেই সময় চলে যাবে। যা ভাবার এখনি ভাবতে হবে।“ অভিজ্ঞান বললো “শিবের কোনো নামের কথা বলা হচ্ছে কী?” নীলোৎপল বললো “মন্দ বলিসনি! কিন্তু শিবের তো অসংখ্য নাম! কোনটার কথা বলা হচ্ছে?” মন্দিরা বললো “না রে, ‘অংক যোগ দিলে পরে যতো নম্বর হয়’ এই কথার মানেটা বুঝলেই অনেকটা বোঝা হবে। এখানে শিবের নাম নয়, শিবমন্দিরের কথাই সম্ভবতঃ বলা হচ্ছে। বারোটা শিবমন্দিরের মধ্যে কোনটায় যেতে হবে, সেটাই হয়তো বলা হচ্ছে।“ সুদক্ষিণা বলে “আর লাস্ট লাইনটা ভুলে যাস না ‘ধুতরো ফুলের মাঝে আছে পরিচয়’!” নীলোৎপল বলে “ওটা তো সোজা। শিবমন্দিরে গিয়ে দেখবি ধুতরো ফুল পড়ে আছে অনেক। তার মধ্যেই নিশ্চই শেষ সূত্রের কাগজটা লুকোনো থাকবে!” সবাই ঘাড় নাড়লো। সেটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু কোন শিবমন্দির? সেটা কী করে বোঝা যাবে? সবকটা শিবমন্দিরেই তো ধুতরো ফুল পড়ে থাকতে পারে! বারবার মন্দিরে ঢোকাই তো যাবে না। দারোয়ান একটা মন্দিরেও ঢুকতে দিলে হয়! নাহলে ফাঁক খুঁজে দারোয়ান যখন অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকবে তখন টুক করে ঢুকতে হবে! হঠাত মন্দিরা বলে উঠলো “কেল্লা ফতে! আমি তো আগে বাংলা মিডিয়ামে পড়তাম। বাংলায় নাম্বারকে বলে সংখ্যা আর সেই নাম্বারের ডিজিটকে বলে অংক!” সৌজন্য বলে “তাতে কী হলো?”
মন্দিরা বলে “শিবমন্দিরের সংখ্যা কতো?” উপল চেঁচিয়ে বলে “বারো!” “বেশ, এবার তবে বলো বারোতে কী কী অংক আছে?” সুদক্ষিণা বলে “ও! আচ্ছা! এক আর দুই। যোগ দিলে হলো তিন!” নীলোৎপল বলে “তার মানে তিন নম্বর শিবমন্দির! দারুণ বুদ্ধি রে তোর মন্দিরা! এই জন্যই হান্টার সেভেনে তুই অপরিহার্য!” উপল বলে “অপরি- না কী বললি দাদা, সেটার মানে কী রে?” নীলোৎপল হেসে বলে “এই হলো ইংলিশ মিডিয়ামের প্রব্লেম! অপরিহার্য মানে ইনডিসপেন্সেবল মানে যাকে ছাড়া চলে না, বুঝলি?” সবার মুখে এতোক্ষণে হাসি ফুটলো! যাক গন্তব্য স্থির! মিটিং থেকে বেরিয়ে পড়লো সবাই। কিন্তু আজ মহা মুশকিল। ড্রাইভার আঙ্কল আসেইনি! এবার? অথচ বিকেল প্রায় চারটে বাজে! এখনো না গেলে অন্য কোন দল ঠিক বার করে নেবে কাগজটা! কী মুশকিল!  

ঐ শিবমন্দির থেকেই পেতে হবে সূত্রের ছড়া! আর কোন উপায় নেই। সৌজন্য বাবাকে গিয়ে ধরলো “ও বাবা, আজ আমাদের পেনালটিমেট ডে! তাড়াতাড়ি পৌঁছতেই হবে বাদামতলা! তুমি একটু পৌঁছে দাও না!” অনেকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করার পর বাবা বললেন “আজ তো তোতামাসীরা আসবেন। আমি তো ওখানে তোমাদের নিয়ে ঘুরতে পারবো না। বড়জোর পৌঁছে দিতে পারি। তোমাদের নিজে নিজে চলে আসতে হবে। সেটা কি তোমরা পারবে?” সৌজন্য তাড়াতাড়ি নীলোৎপলদাকে ফোন করলো। নীলোৎপল বললো “আমি কয়েকবার উবেরে করে ফিরেছি। ফেরার সময় আমরা একটা উবের নিয়ে ফিরে আসবো। তুই মেসোমশাইকে বলে দে আমি টেক কেয়ার করবো।“ বাবার খুব একটা ইচ্ছে ছিলো না ওদের একা ছাড়ার, কিন্তু আর তো উপায় নেই। বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের প্যান্ডেল বড়রাস্তা থেকে বেশ ভিতরে। অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু খুব নাম পুজোটার। প্রত্যেকবছর প্রাইজ বাঁধা। হেঁটে গিয়ে প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়ালো ওরা। ওরা প্রাণপণ প্রার্থনা করতে লাগলো যাতে ওদের আগে কোন গ্রুপ না পৌঁছতে পারে!   

ও হরি! প্যান্ডেলের সামনে মস্ত বাঁশের ব্যারিকেড! রাস্তা থেকেই ঠাকুর দেখতে হবে। স্পেশাল কোন দরকার ছাড়া ভিতরে কাউকে ঢুকতেই দিচ্ছে না সিকিউরিটি! হান্টার সেভেন মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রইলো! আরেকটা মুশকিল হলো দুর্গা মাঝখানে। তাঁর দুদিকেই শিবমন্দির। ছটা করে। ডানদিক থেকে তিন নম্বর না বাঁ দিকে থেকে? মন্দিরা বললো “হিন্দু শাস্ত্রে সবকিছু ক্লকওয়াইস চলে, মানে বাঁ থেকে ডানে। তার মানে বাঁ দিক থেকে তিন নম্বরই হওয়া উচিত!” নীলোৎপল বললো “কিন্তু ঐ মন্দিরটা তো একদম সরাসরি! ঢুকলেই দেখা যাবে! কী করবো?” 
(ক্রমশ)



মা দুর্গা VS করোনাসুর

অঙ্কিত ঘোষ
অষ্টম শ্রেণী
সুখচর কর্মদক্ষ চন্দ্রচূড় বিদ্যায়তন 
উত্তর ২৪ পরগণা

মা দুর্গা মহিষাসুরকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন ' তুমি এখন যাও প্রতিবছর তোমাকে বধ করে করে আমার এতগুলি হাত ব্যথা হয়ে গেছে'।
 মহিষাসুর বলেন ' ঠিকই বলেছেন আমারও যাদুবিদ্যাগুলো এখন খুব ' ডিস্টার্ব' করে।'
এমন সময় গনেশ মর্ত্যলোক থেকে গনেশ চতুর্থী কাটিয়ে স্বর্গলোকে এসে বলছেন, - ' মা আপনি খবর পান নি?'
 'মা দূর্গা - ' কী বাবা গনেশ? '
গনেশ - মা, জানো মর্ত্যলোকে এক ভয়াবহ অসুর মহামারি রূপে এসেছে গত এক বছরে।' 
মা দূর্গা - ' কী গত এক বছরে, আর আমি জানি না! ' 
এমন সময় আবার কার্তিক এসে হাজির। সে বলে, 'দেখলে তো মা তোমাকে কত বার বলেছি এখানে একটা ইন্টারনেট এর ব্যবস্থা করতে। বিশ্বকর্মাকাকুকে বলবো নাকি এখানে একটা টাওয়ার বসাতে?'
মা দূর্গা - ' তুই চুপ কর, তা বাবা গনেশ, সে অসুরের নাম কী?'
গনেশ - 'মহারাজাধিরাজ অসুরাসুরের অসুর মহামারির বাদশা, ছাতি ৩৬ ইঞ্চি য্যাইসা, মহিষাসুরের চৌদ্দো পুরুষের বংশধর...'
মা দূর্গা - ' আচ্ছা, আচ্ছা, শর্টকাটে বল'। 
গনেশ - ' করোনাসুর'।
মা দূর্গা - ' ঠিক আছে তাহলে, তাকে ইমেল পাঠিয়ে দাও,  আগামী পরশু আমাদের যুদ্ধ----'

পরশু যুদ্ধের দিন -

মা দুর্গা বাইকে করে যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন, কেন না তার সিংহের করোনা হয়েছে, সে হসপিটালে ভর্তি। মা দুর্গা করোনাসুরকে দেখে বললেন - ' হতচ্ছাড়া, সৃষ্টিছাড়া, বেয়াদপ, বিটকেল, আমার সন্তানদের সর্বনাশ করার সাহস কে দিল তোকে?' 
করোনাসুর - ' আমি কথা কম বলি, আক্রমণ বেশি করি।' 
মা দুর্গা -' কার্তিক কামানে  'কোভিশিল্ড ' ঢোকা আর আক্রমণ কর---'
সুতরাং স্বর্গলোকের অবস্থা আপনারা দেখলেন। যুদ্ধ এখনও চলছে। মা দুর্গাকে জেতাতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে।



আগমনী বার্তা
প্রার্থিতা সরকার
ষষ্ঠ শ্রেণী, হোলি অ্যাঞ্জেল স্কুল, কাটোয়া

        কাশ ফুটেছে নদীর ধারে,
         শিউলি ফোটে ডালে-ডালে।
  
         ঢাক বেজেছে কাঁসির সনে,
          কত আনন্দ হচ্ছে মনে।

         প্যাণ্ডেলে যাই ঠাকুর দেখতে,
           মায়ের প্রসাদ, আরতি নিতে।

           নবমীর রাত্রির অবসানে,
        মন কেঁদে ওঠে বিসর্জনের গানে।।


চোরকুঠুরির মাহুত 

জয়ন্তী মন্ডল

শেষে সুস্মিতা এক ধমক দিয়ে মেয়েকে বলল তুই ঘুমুতে যা তো তিতু। ঘুম থেকে উঠে দেখবি তোর পুতুল বানিয়ে রেখেছি।

তিতুরও গোঁ। সেও মায়ের সঙ্গে কাদা মাটি দিয়ে পুতুল বানাবে। 

 সুস্মিতা মেয়েকে চেনে। পুতুল বানানো তো হবেই না। উলটে মা মেয়েতে চারটি কাদা মেখে একশা হবে। সুস্মিতা এক ধমক দিয়ে বলে দিল তিতু না ঘুমুলে সে পুতুল বানাতে রাজি নয়।

অগত্যা তিতুকে ঘুমোতে যেতেই হল দিদুনের সঙ্গে। 

বৈঠকখানা ঘরটাই ঢুকে সুস্মিতা যখন একরাশ কাদা মাটি হাতে নিল তখন গোটা বাড়ি দুপুরের ভাত ঘুমে নিস্তব্ধ। বাগানে কুসুম গাছটায় একটা বৌ কথা কউ পাখি একটানা ডেকে চলেছে। ঝিঁ ঝিঁ গুলোও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুর ধরেছে।

কতদিন পর গাঁয়ের এমন দুপুরের গন্ধ পেল সুস্মিতা। তা কয়েক যুগ তো বটেই। স্কুলের ছুটি পড়লে গ্রামের বাড়ি মোহনপুরে আসে সুস্মিতা। এবারকার মতো হাতে তেমন লম্বা সময় থাকে না। এখন লকডাউনের জন্যে স্কুল বন্ধ। তবে সপ্তাহে সপ্তাহে দু-এক দিন যেতে হয়। পরপর ক’দিন স্কুলের ডিউটি সেরে এসেছে সে। তাই সুস্মিতার হাতে একটু সময় আছে এবার।

মেয়ের জন্যে পুতুল বানাতে বসেছে সুস্মিতা। ওর ছোট্ট মেয়ে তিতু। বৈঠকখানা ঘরের টেবিলের সামনে চেয়ারটায় বসে সুস্মিতা একরাশ কাদা মাটি থেকে একটুখানি কাদা নিয়ে প্রথমেই একটা ছোট্ট চড়াই বানিয়ে ফেলল। তারপর হাতির শুঁড়খানা। তারপর হাতির লেজ। দুটো কান। সুস্মিতার চোখ ঢুলুঢুলু। যেন রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে তার চোখে।

একটা থপ থপ শব্দ হতেই সুস্মিতা চোখ তুলে দেখে একটা ছোট্ট হাতি সুস্মিতার কাছে দাঁড়িয়ে শুঁড় নাড়ছে। হাতির পিঠে একটা ছোট্ট মাহুত।

সুস্মিতা খানিক ঘাবড়ে গিয়ে কি একটা বলতে গেলে হাতিটা বলল, এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল তোমার?

সুস্মিতা বলল ওমা এখানে হাতি এল কীভাবে? দরজা তো বন্ধ। তোমরা ঢুকলে কোনদিকে?

হাতিটা বলল, আমরা তো এখানেই আছি? 

সুস্মিতা চোখ কপালে তুলে বলল, এ বাড়িতে আবার কবে থেকে হাতি পুষেছে আমি জানি না তো!

হাতিটা বলল, তুমিই তো আমাদের এখানে রেখে গেছো। তোমার মনে নেই বুঝি?

সুস্মিতা বিরক্ত হয়ে বলল, না না এমন আজগুবি কথা আমার মনে থাকার কথা নয়।

মাহুত হাতির পিঠের থেকে ঝপাং করে নেমে এক দৌড়ে বৈঠকখানার চোরকুঠূরি থেকে একটা বড় বাঁশের কঞ্চির ঝুড়ি এনে সুস্মিতার কাছে রাখতেই ঝুড়ি থেকে টপাটপ এক এক করে নেমে এল ভুলু কুকুর টা, দুটো চড়াই ছানা, একটা পুষি বেড়াল। একটা জেলে বউ। তখনো জেলে বৌয়ের হাতে চুনো মাছ ধরার জাল, খালুই।

এবার মনে পড়ল সুস্মিতার। সেবার খুব গরম পড়েছিল বলে সুস্মিতাদের ইস্কুলের ছুটি ক’দিন বাড়িয়ে দিয়েছিল। এদিকে সুস্মিতার গরমের ছুটির পড়া শেষ। এত বড় দুপুর কাটে  কি করে তার। 

তাই গীতা পিসির কাছে বায়না ধরেছিল সুস্মিতা। দুপুরে মায়ের কাজ সেরে  সরকার পুকুর থেকে পিসিকে সুস্মিতার জন্য মাটি এনে দিতে হবে। মাটি দিয়ে পুতুল তৈরি করবে ও। 

তখনই তো রোজ দুপুরবেলা মাটি দিয়ে কত পুতুল বানিয়েছে সুস্মিতা। একটা ভুলুও বানিয়েছিল সুস্মিতা। দুপুরবেলা না ঘুমিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এসব কাদা মাটি দিয়ে পুতুল বানানোর জন্যে মায়ের কাছে কম ধমক খেতে হয়েছে সুস্মিতাকে।

 দ্যাখে ভুলু সুস্মিতার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

সুস্মিতা অবাক হয়ে বলে ভুলু! 

ইস! ভুলুর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সুস্মিতা! যেই না ভুলু বলে ডাক দিল সুস্মিতা। অমনি ভুলু কুঁই কুঁই শব্দে ল্যাজ নাড়তে লাগল।

জেলে বউ সুস্মিতাকে দেখে বলল মাছ লাগবে নাকি সুমু? বাড়ির সকলে সুস্মিতাকে সুমু বলেই ডাকে। ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করো। এখনো ক’টা পুটি আছে খালুই এ। বলো তো বেছে দিয়ে যায়।

জেলে বউকে দেখে সুস্মিতার কত কথাই মনে পড়ে গেল। যে বছর খুব বৃষ্টি হয়েছিল। তারপর বন্যা হল। সুস্মিতাদের খামারটা দিয়েও হু হু করে জল যাচ্ছিল। সেই জলে কত  নৌকো ভাসিয়েছিল সুস্মিতা। নৌকো ভাসাতে এসে একটা বড় মাছ ধরে ফেলেছিল ও। বিকেলে মাছ বিক্রি করতে এসে জেলে বউই তো  মাছটা বেছে দিয়ে গিয়েছিল।

সুস্মিতা পুষিটার আদর করে নাম রেখেছিল মিনি। পুষিটা সুস্মিতার কোল ঘেঁষে বসেছিল।

সুস্মিতা আদর করে ‘কই রে মিনি’ বলে ডাক দিতেই পুষিটা সুস্মিতার কোলে বসার জন্যে দিল এক লাফ।

এই এই বলে সুস্মিতা হাত দিয়ে পুষিটাকে আটকাতে গিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতেই চমকে যায় সুস্মিতা। দ্যাখে তিতু সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে একদলা কাদা।

তাড়াতাড়ি সুস্মিতা তিতুকে কোলে তুলে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরের চোরকুঠুরির দরোজাটা খোলে। দ্যাখে ওর বানানো ঝুড়ি ভর্তি পুতুল যেমন কার তেমনি বসানো আছে চোরকুঠুরিতে। সুস্মিতা ঝুঁকে পুতুলের ঝুড়িটা তোলে। তারপর মেয়ের হাতে পুতুলের ঝুড়িটা দিয়ে বলে এই নে মা। এসব পুতুল সব তোর।



আনন্দটাই আসল
পারমিতা মন্ডল

মিনির আজ জন্মদিন। গ্ৰামের প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। এখন ওর ক্লাস থ্রি। মিনি শান্ত স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে। না কারোর সাথে ঝগড়া করে না মারামারি। তাই ওর অনেক বন্ধু। কিন্তু মিনির আজ খুব মন খারাপ। স্কুলের বারান্দার এক কোণে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মিনির বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে,
- কি রে মিনি, চুপ করে বসে আছিস কেন এভাবে? চল না খেলি!
মিনি কোন উত্তর দেয় না। পাশ থেকে সোনালী বলে ওঠে,
-ওর তো আজ জন্মদিন! আমাকে কয়েক দিন আগে বলেছিল।
রেখা বলে,  তাহলে তো আজ তোর ভীষণ খুশি থাকার কথা!
মিনি এইবার নীরবতা ভাঙ্গে।
- আজ আমার জন্মদিন কিন্তু কেক কাটতে পারবো না। মা বলেছে কেকের অনেক দাম!
একথা শুনে  সবাই চুপ করে যায়। একটু পরে সোনালী বলে ওঠে,
-তো কি হয়েছে! কেক কাটতেই হবে এমন কে বললো? আমার জন্মদিনেও তো কেক কাটিনি। মা পায়েস করে দিয়েছিল।
- কিন্তু আজকাল সবাই জন্মদিনে কেক কাটে। আমিও কাটতে চাই।সবাই বেলুন ফোলায়, কত কি করে! আমার মা যে বাড়িতে কাজে যায় তাদের এক বছরের বাচ্চাটার জন্মদিন ওইভাবেই হয়েছিল।
এই কথা বলে মিনি কাঁদতে কাঁদতে ক্লাসে চলে যায়। ওর বন্ধুরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।

স্কুল থেকে ফেরার সময় মেঠো আলপথে যেতে যেতে রেখা মিনিকে প্রজাপতির পেছনে ছুটতে বলে, জমির জলে পা ডোবাতে বলে। কাশফুল তোলে সবাই। কিন্তু মিনির কোনো পরিবর্তন নেই।মিনির বাড়ি সবার আগে পড়ে। মিনি ওর ছোট্ট মাটির বাড়িতে ঢুকে পড়লে ওর বন্ধুরা বাকি রাস্তা যেতে যেতে বলাবলি করতে থাকে কিভাবে মিনিকে তারা খুশি করবে।

বিকেল বেলা মিনির বন্ধুরা মিনির বাড়ি আসে খেলবে বলে। বারবার ডেকেও মিনির কিছুতেই সাড়া পায় না। মিনির মা বেরিয়ে এসে বলে - মিনি খেলতে যাবে না রে। কিছুতেই ওর মন ভালো করতে পারছি না। আমাদের কি আর সাধ্য আছে কেক কেনার! আজ একটু দুধ নিয়েছিলাম। তাই দিয়ে পায়েস করে দিলাম, ছুঁয়েও দেখলো না।কি যে করি!
মিনির বন্ধুরা ঘরে গিয়ে দেখল, মিনি বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে। ওকে টেনে হিঁচড়ে বের করল ওরা। তারপর জোর করে নিয়ে গেল ওদের সঙ্গে।খেলার মাঠের মাঝে ওরা নিয়ে এলো মিনিকে। তারপর আকাশের দিকে তাকাতে বললো। মিনি দেখলো আকাশে রামধনু উঠেছে।এর আগে ও এতো সুন্দর রামধনু কখনো দেখেনি। পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে দিগন্তজোড়া নীল আকাশে। এসব দেখে মিনি আর মন খারাপ করে থাকতে পারে না। ঠোঁটের এক কোণে হাসি ফুটে ওঠে। তা দেখে মিনির আড়ালে তড়িঘড়ি করে সোনালী ফু দিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট ফোলায়‌। রেখা একটা মোমবাতি জ্বালায়। সুমি একটা প্যাকেট থেকে কয়েকটা আটার লুচি ও সাদা আলুর তরকারি বের করে। তারপর ওরা আমপাতা দিয়ে তৈরি করা একটা মুকুট পরিয়ে দেয় মিনিকে। মিনি এইসব দেখে তো হতভম্ব। মিনির বন্ধুরা হাততালি দেয় ও হ্যাপি বার্থডে গান গায়। মিনি ফু দিয়ে মোমবাতি নেভানোর সাথে সাথেই সোনালী প্লাস্টিকের প্যাকেটের বেলুন ফাটায়। সেখান থেকে ঝরে পড়ে চাঁপা ফুল। তারপর সবাই মিলে মিনিকে লুচি তরকারি খাওয়ায়। মিনিও সবাইকে খাইয়ে দেয়। খুব আনন্দ করে সবাই।মিনিকে ওর বন্ধুরা বলে
- দেখলি তো, কেমন তোর মন ভালো করে দিলাম।

মিনি বাড়ি ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে। মেয়ের মাথায় আমপাতার মুকুট দেখে জিজ্ঞেস করলে মিনি সব বলে মাকে। মা শুনে ওর বন্ধুদের ডাকতে পাঠায়‌। সবাই এলে মিনির মা সবাইকে পেঁয়াজ, লঙ্কা, আমতেল দিয়ে মুড়ি মেখে দেয়। সাথে পায়েস ও নারকোল নাড়ু। সবাই ভীষণ আনন্দ করে খায়। মিনি শেষে বলে, আমি আর কখনো কেক কাটার  বায়না করবো না। আমি বুঝেছি,সবাই মিলে আনন্দ করাটাই আসল‌।কেকের থেকে অনেক বেশি মিষ্টি মায়ের হাতের বানানো পায়েস।
সবাই খুশিতে ভেসে যায়।



গুচ্ছ ছড়া
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


মনের খোলা দ্বার

ঠিক দুপুরে হঠাৎ যদি 
বাঁধন ছেঁড়ার ইচ্ছা করে খুব 
শাসন বাধা উড়িয়ে দিয়ে 
তালপুকুরে দাও না কষে ডুব । 
দেখবে তোমার চারপাশেতে
রক্তচোখের চাউনি নেই তাই
ভীষণ স্বাধীন ------ ইচ্ছা করে 
চোখের সামনে আকাশ বসাই ।  
আকাশ তোমার মনের ভেতর 
এবার তুমি হদিশ পাবে তার 
বাঁধনে আর থাকবে না গোল
দেখবে তুমি মনের খোলা দ্বার।


শরতের মজা

সাদা মেঘে আকাশ জুড়ে
আঁকা নানান ছবি
কখনও ছাগ কখনও বাঘ
কখনও রবি কবি ।

কখনও তারা ব্যস্ত ভীষণ
শুধুই উড়ে যায়
দাঁড়িয়ে গেলেই একটু কোথাও
বৃষ্টি ঝরে যায় ।

শরৎকালের এটাই মজা
রোদ বৃষ্টির খেলা
আলো ছায়ার কাটাকুটি
চলছে সারাবেলা ।


সন্ধ্যা মেয়ে

সূয্যি মামা বসলে পাঠে
চারপাশে সব কালো
রান্নাঘরে মা জ্বালে ওই 
হ্যারিকেনের আলো ।

পাখিরা সব বাসায় ফিরে
কিচিরমিচির করে
পাশের বাড়ির মিতিন মাসি
সন্ধ্যারাগ ধরে ।

একটু কিছু মুখে দিয়েই
বইয়ের পাতা খুলি
দু'চার পাতা পড়ার পরেই
খুব করে হাই তুলি ।

ঘুম তাড়াতে আকাশ দেখি
পূর্ণিমা চাঁদ গোল
সন্ধ্যা মেয়ে গান শোনাতে
কন্ঠে আওয়াজ তোল ।




পাখি পড়ানো
তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

এইগুলো সব গাছের শাখা, ওই নীচেতে মাটি,
তার ওপরে ওই যে মানুষ করছে হাঁটাহাঁটি।
মানুষগুলো হাত-পা ছুঁড়েও উড়তে কি আর পারে!
ওদের পথেও হাঁটিনাকো আমরা অদরকারে।
ডানার বলে, বাতাস ঠেলে, আকাশপথে পাড়ি-
অনায়াসেই দিয়ে পাহাড়চূড়োও ছুঁতে পারি।
এমন ওড়া, দেখেই ওরা, বিমান বানিয়েছে,
আমাদেরই কাউকে খাঁচায় পোষও মানিয়েছে।
তোমায় ওড়া শিখতে হবে এবং হাওয়ায় ভাসা,
নিজের খাবার নিজের জোরে নিজেই নিয়ে আসা।
নিজের বাসা কেমন করে নিজেই বানাতে হয়,
বুদ্ধি নিজের কেমন করে নিজেই শানাতে হয়।
ডানার ওপর ভরসা রেখো, নিজের ওপর আরও,
সাধ্য হবেনাতো ফেলা গিরিখাতেও কারো।
ঝড় বিপদের টের পেলে না প্রাণ বাঁচাবে তবেই!
ব্যাধের তীরে বেঁধার আগে ফুড়ুৎ হতে হবেই।
প্রথম প্রথম উড়তে গিয়ে ব্যর্থ হতেই পারো,
আজ একটু দূর, কাল একটু দূর, পরশু আরও আরও।
আকাশে নেই ভিসার বাঁধন, কাঁটাতারের বেড়া,
পাখসাটে হয়, পৃথিবী জয়, অবাধ ঘোরা-ফেরা। 
ডানা পাওয়ার সৌভাগ্যের কৃতজ্ঞতাবোধে,
বিনয়ী হও, ভালোবেসো, এ ঋণ পরিশোধে।
ইচ্ছে করে মাথায় কারো বিষ্ঠা দিওনাকো,
উচ্চে থাকার দর্পে যেন নিঠুর হয়োনাকো।


জয়চণ্ডী
ধ্রুব মুখোপাধ্যায়
অন্ধকারটা গাঢ় হলেই এক গামলা ফেন-ভাত আর কাঁচা পিঁয়াজে পেটটা ঠাণ্ডা করে জয়চণ্ডী চলে যায় বড় রাস্তার মোড়ে। একটা বট গাছের নিচে একটু জিরিয়ে, হুঁকোতে টান দেয় আর আকাশ দেখে। আকাশের তারা দেখতে ওর বেশ লাগে। অনেক তারার নামও জানে কিন্তু বেশিক্ষণ বসে বসে তারা দেখলে ঝিমুনি আসে। তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। একটা ওর বাবা, ঠিক তার পাশেরটাই ওর মা। তারপর একটু উপরে ওর দাদু, ঠাকুমা আরও কত। নিজের রক্তের লোক সব। কিছু অন্য রক্তের লোকও চোখে পরে। ঠিক তখুনি একরাশ আপসোস চারিপাশ থেকে ঘিরে ধরে। তারপর বেশ কতগুলো মেঘ আকাশের এপাশ থেকে ওপাশ করলেই, ঝুমঝুমির আওয়াজটা কানে আসে। জয়চণ্ডী তখন হাত-পাগুলোকে শূন্যে ছুড়ে শরীরটাকে একটু গরম করে নেয়। আওয়াজটা একেবারে কানের সামনে এলেই ওপাশ থেকে আসা ডাকহরকরার কাঁধের থলেটা নিজের কাঁধে নিয়ে শুরু হয় দৌড়। দৌড়াতে জয়চণ্ডীর দারুন লাগে। চিন্তা নেই, ভাবনা নেই শুধু একটা লক্ষ্য আর সেটাকে উদ্দেশ্য করে দৌড়। দু-পাশের ঘন জঙ্গলের মাঝে, একটা ঝুমঝুমি লাগানো লাঠি আর কাঁধে চিঠির থলে নিয়ে সারারাত ধরে দৌড়। কানে যদিও মাঝেমধ্যেই নানান রকমের আওয়াজ আসে। কারা সব বলে, “বাঁচাও”, “মেরো না” কিংবা “চোখ ফেটে রক্ত ঝড়ে মরবি”। তবে জয়চণ্ডী ফিরেও তাকায় না। আওয়াজ শুনলেই পাশের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে বলে, “মা-রে, আমায় ক্ষমা করিস আর উ’ গুলাকে শান্তি দিস্‌ মা”। আজ থেকে মোটামুটি দু’শো বছর আগে, বছরের পর বছর এই-ই করত জয়চণ্ডী। আসলে ভারতবর্ষের কোথাও তখনও রেল লাইন পাতা হয়নি। এমনকি খবর পাঠানোর জন্য টেলিফোন তো দূরের কথা, টেলিগ্রামও ছিল না। 
পৈতৃক ভিটে, কিছু চাষের জমি আর ডাকহরকরার কাজের মাসিক এক আনা পয়সাতে স্বাছন্দ্যের কোনও অভাব ছিল না। অভাব থাকেই বা কি করে! বাপ-ছেলের দুটো তো মাত্র পেট! বউ মরে গেছে ছেলেটার জন্মানোর সাথে সাথেই। তবে অভাব না থাকলেও একটা ভাব আছে। ভয়! মাঝেমাঝেই ভিতর থেকে মোচড় দিয়ে ওঠে ভয়টা। নিজের, নিজের পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের ভয়। বাবার কথা মনে পরলেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। শক্ত-সামর্থ্য, দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষটা হঠাৎ করে একদিন জিভ উল্টিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত, যেন কেউ ছুঁড়ি গেঁথে দিয়েছে। তারপর টানা দু’রাতের মৃত্যু যন্ত্রণা আর শেষে অসহায় হয়ে বলেছিল, “প্রানটো যে বেরোকতেই পারে না। গাঁয়ের ঠাকুরকে ইকবার ডাক। মন্তর আওড়াক। যমের নুকগুলা যে ঘরে ঢুকতেই পারছেক্‌না।“ আর পুরোহিত মন্ত্র পড়তেই সব শেষ! তবে শেষের আগে জয়চণ্ডীকে বলে গিয়েছিলেন, “আর করিস না উ কাজ। কাওকে করতেও দিস না। ধম্মে সয়ছে না।“ কথাগুলো এখনো কানে বাজে। বড্ড ভয় হয়। ছেলেটা যদি ঐ পথেই পা বাড়ায়! ছেলের ব্যপারে তাই ভীষণ সাবধানী জয়চণ্ডী। সবসময় চোখে চোখে রাখে। রাত্রে কাজে বেরোনোর আগে দেখে নেয় নমচণ্ডীর চোখের পাতাগুলোকে। এমনকি অন্ধকার থাকতেই, নমচণ্ডীর ঘুম ভাঙার আগেই কাজ সেরে ফিরে আসে। চাষের কাজে মাঠেও যায় ছেলেকে নিয়েই। তবুও ভয় হয়। পূর্বপুরুষেরই তো রক্ত!
জয়চণ্ডী পাহাড়ের উপরেই মা চণ্ডীর বেদী। জয়চণ্ডীরা বংশপরম্পরায় মা চণ্ডীর ভক্ত।  এজন্যই ওদের সবারই নাম কিছুনা কিছু চণ্ডী। শিবচণ্ডী, দেবচণ্ডী, হরচণ্ডী আরও কত নাম ওর বাবা জানত। জয়চণ্ডী অবশ্য এত জানেনা। তবে এটা বেশ ভালোভাবেই জানে যে ওদের রক্তে ডাকাতি। একসময় জয়চণ্ডী পাহাড়ের লাগোয়া বড় রাস্তায়, মা চণ্ডীর পূজো করে শুরু হত ডাকাতি। অমাবস্যায় নিয়ম করে গ্রাম-লুঠ আর বাকি সময় এই রাস্তার দিকে চোখ রেখে কাটত রাত। চাকু, ছোঁড়া, তরোয়াল কত অস্ত্র তখন। জয়চণ্ডীও বহুবার গিয়েছে গ্রাম লুঠতে। উন্মাদের মত নিরপরাধ, নিরীহ, হাতজোড় করা মানুষ গুলোর মুণ্ডু, ধর সব আলাদা করে দিয়েছে। ভয়ঙ্কর সব রাত্রি! এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠলে শরীর শিউরে ওঠে। প্রতিটা হত্যা এক একটা অভিশাপ। রাত্রে জঙ্গলের ভিতর থেকে অতৃপ্ত আত্মাগুলো আজও ডাকে জয়চণ্ডীকে। “বাঁচাও” বলে ঠাট্টা করে। জয়চণ্ডী জানে এবং মনেপ্রাণে মানে ওদের অভিশাপেই বাবার ঐ ভয়ঙ্কর মৃত্যু! তাই মনেপ্রাণে চায়, নমচণ্ডী যেন আর ঐ পথে পা না বাড়ায়। বাবার মৃত্যুর পর, বাবার কথা মত আর কোনোদিনও ডাকাতি করেনি জয়চণ্ডী। তবে দলের লোকেরা এখনো আছে। রাত্রে ডাকহরকরার কাজে যখন জয়চণ্ডী পাহাড় লাগোয়া রাস্তাটা পেরোয়, তখন এখনো দলের লোকেরা ওকে টিট্‌কারি করে। ভয়চণ্ডী বলে রাগায়। তবে তাতে ওর কিছু এসে যায় না। জয়চণ্ডী খালি পাহাড়ের উপরের মা চণ্ডীর দিকে তাকিয়ে বলে, “মা-রে, আমাকে ক্ষমা করিস। আত্মাগুলাকে শান্তি দিস মা”।      
ডাকাতি ছাড়ার পর পোস্টমাস্টারের দয়ায় ডাকহরকরার কাজটা পেতে সেরকম বেগ পেতে হয়নি জয়চণ্ডীকে। অল্পবিস্তর লেখাপড়াও শিখিয়ে দিয়েছিল মাস্টার। কিন্তু ইদানীং শরীরটা যেন আর চলে না। বয়সের সাথে সাথে দৌড়ানোর গতিও কমে গিয়েছে অনেক। বাঁধা সময়ে গন্তব্যে পৌঁছালে শ্বাসের টান বাড়ে। ওপাশের পোস্টমাস্টারও আজকাল মাঝে মধ্যেই বলে, “আবার দেরি!“ জয়চণ্ডী তখন মুখ কাচুমাচু করে বলে, “পাহাড়ের ডাকতগুলার সাথে বেধে গিছিল। একপ্রস্থ ঠেঙ্গিয়ে এলাম ব্যটাদের।“ 
“জাতভাইরাও আজকাল ছাড়ছে না তোকে?” পোস্টমাস্টার মুখ বেঁকিয়ে বললে খুব দুঃখ হয়। কিন্তু কিছু বলে না। মনে মনে শুধু বলে, “পাপ ক্ষমা করিস মা।“ এই করে পোস্টমাস্টারও একদিন বলেই দিল, “শোন, ডাকহরকরার কাজ আর তোকে করতে হবে না।“ শরীরটা হালকা হয়ে গিয়েছিল জয়চণ্ডীর। আসলে ঐ চাষের জমি ছাড়া আয় বলতে তো এইটুকুই। প্রতিমাসে এই টাকা’কটা নমচণ্ডীর হাতে বিনা ভাবনায় তুলে দেয়, যাতে পয়সার জন্য পূর্বপুরুষের রক্ত মাথায় না চড়ে। “না মাস্টার। এমন নির্দয় হবেন না। আমি আরও জোরে দৌড়াব।“ হাতজোড় করে সেদিন এক প্রকার ভিক্ষাই চেয়ে ফেলেছিল এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাকাত, জয়চণ্ডী। পোস্টমাস্টারও আর থাকতে পারেনি। মানুষ ভালো হবার চেষ্টা করলে ভগবানও তাকে সাহায্য করে, আর পোস্টমাস্টার তো সেখানে সামান্য একজন মানুষ। তাই হাসি মুখে বলেছিল, “তোর মনটা বড় ভাল রে। ভগবানও তোর সহায়, সেখানে আমি কী করে নির্দয় হয় বল দেখিনি?”
“বুঝলুম না মাস্টার।“ জয়চণ্ডী অবাক হয়ে বললে পোস্টমাস্টার ওর পিঠ চাপড়ে বলেছিল, “শুধু ঐ দৌড়ানোর কাজ আর করতে হবেনা। তবে অন্য কাজে তো বাধা নাই।“ জয়চণ্ডী তৎক্ষণাৎ একটা প্রণাম ঠুকে বলেছিল “যা বলবেন সব করে দিব মাস্টার। শুধু কাজটা কেড়ে লিয়েন না।“ 
“এবারের কাজ কিন্তু আরও কঠিন। সেমাফোর সিগন্যাল ম্যানের কাজ। দৌড়াতে হবে না, তবে সারারাত ধরে জেগে থাকতে হবে সেমাফোর টাওয়ারে” খানিকটা রসিকতা করেই বলল পোস্টমাস্টার। জয়চণ্ডী তখন আকাশ থেকে পড়তে পড়তে বলল, “এফোঁড় ওফোঁড় শুনেছি, কিন্তু বাপের জম্মে সেমাফোর শুনিনি। প্যাটে লাথি কেন মারছেন, মাস্টার?“ পোস্টমাস্টার তখন একটু রাগ দেখিয়েই বলেছিল “এত তাড়া কিসের। আগে তো শোন” আর তারপর বলেছিল বাকিটা।
“আট, দশ মাইল অন্তর অন্তর একটা করে টাওয়ার বসানো হচ্ছে। সেই রকমই একখান বসছে আমাদের এই জয়চণ্ডী পাহাড়ে। তোকে ঐ উপরে বসে একটা টেলিস্কোপ মানে একটা যন্ত্র যাতে চোখ রাখলে দূরের জিনিস ভালো করে দেখা যায়, সেটা নিয়ে এক দিকের টাওয়ারে দেওয়া সংকেত দেখে তোর নিজের টাওয়ারে সেই সংকেতটা বানাতে হবে যাতে উল্টো পাশের টাওয়ারে বসা লোক তোরটা দেখে বানাতে পারে।“  
“সংকেত দেখা অবধি ঠিক আছে মাস্টার, কিন্তু সেটা বানাব কী করে?” কিছুটা ভয় পেয়ে বলল জয়চণ্ডী।
“তোর মতো লেঠেলের পক্ষে এ আবার কাজ? একটা লম্বা কাঠের উপর মানুষের হাতের মত দুপাশে উপর নিচে আড়াআড়ি করে আটকানো থাকবে চারটে লাঠি। আর প্রতিটা লাঠির সাথে আটকানো থাকবে একটা করে দড়ি। তোকে সেই দড়ি টেনে টেনে সংকেতটা হুবহু বানাতে হবে। আমি তোকে দেখিয়ে দেব।“ এই বলে কিছুক্ষণ ভাবল পোস্টমাস্টার, তারপর “চল আজকেই কিছুটা শিখিয়ে দিই” বলে নিজেই খাতা-পেন্সিল নিয়ে সিগন্যালগুলো দেখাতে লাগল। আর সবশেষে বলেছিল, “ফ্রান্স নামে একটা দেশ এটা আবিষ্কার করেছে। আর এই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ওটাকে ভারতবর্ষে আনছে। তুই যেমন দৌড়ে খবর আনিস, সেইরকমই এটা টাওয়ার থেকে টাওয়ার করে আরও কম সময়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর পৌঁছে দেবে।“
বেশ লাগল জয়চণ্ডীর। দুনিয়াটা কত বড়, কতকিছু আছে। নতুন জিনিস শেখার মজাটাই আলাদা। পোস্টমাস্টারকে আবার একবার প্রণাম ঠুকে ফুরফুরে মনে এক দৌড়ে ফিরে এল বাড়ি। পরদিন থেকে, একমাস মাঠে যায়নি জয়চণ্ডী। সারা দিন ধরে মাটির উঠোনে কাঠি দিয়ে দাগ কেটে কেটে অভ্যাস করেছিল পোস্টমাস্টারের শেখানো সেমাফোর সংকেত, সংকেতের হরফ, ভাষা। এমনকি নমচণ্ডীকেও শিখিয়েছিল।

মাস ফিরতেই, জয়চণ্ডী পাহাড়ের কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল, লাল ইটের সেমাফোর টাওয়ার। উপরে একখান কাঠের দণ্ড আর তার দুপাশে উপর-নিচ করে আড়াআড়ি ভাবে লাগানো চারটে লাঠি। লাঠি গুলোর মুখের দিকে একটা করে  লণ্ঠন, অন্ধকারে সংকেত দেবার জন্য। পোস্টমাস্টার সমস্তকিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে চলে গেলে, উপর থেকে চারিপাশটা চোখ মেলে দেখল জয়চণ্ডী। আহা কি সুন্দর! টেলিস্কোপটা চোখে নিতেই সবকিছু যেন হাতের মুঠোয়। অবাক হয়ে দূর থেকে অনেক দূর অবধি দেখল। বাবার জন্য খুব মন খারাপ করছিল। বাবা থাকলে বাবাকেও দেখাত সমস্তটা। এই করতে করতেই হুট করে নামল অন্ধকার। উপর থেকে জঙ্গলের অন্ধকারটা একেবারে অন্যরকম। পাহাড়ের গায়ে রাস্তাটার দিকে তাকালেই ভিতরটা হু হু করে উঠছিল। কত পাপ, কত অভিশাপ কুড়িয়েছে জয়চণ্ডী। ‘তবে এখন তো আর করি না, নমচণ্ডীও করে না’ ভাবতে কিছুটা স্বস্তি হল। কিন্তু ভয়টা গেল না। রক্তের দোষ তো! এসব ভাবলেও সামনের দশ মাইল আগের টাওয়ারের থেকে চোখ কখনও নড়ে নি। অনেকক্ষণ কোনও সংকেতও নেই। তবে সামনে পাহাড়ের কোলে যেন একটা আগুনের হল্কা। টেলিস্কোপটা ঘুরিয়ে দেখল জয়চণ্ডী। পাহাড়ের উপরেই, আগুন জ্বেলে কয়েকজন। ডাকাতি করার সময় এভাবেই কত রাত কাটিয়েছে জয়চন্ডী। “দেখি তো ব্যটারা কী করে?” এই ভেবে বেশ উৎসাহের সাথেই আরও ভালো করে দেখল। একটা থলেতে সোনা, পাথর বসানো গয়না জ্বলজ্বল করছে। থলেটা খুব চেনা চেনা লাগল। ওর ডাকহরকরার থলে দুটোর একটা যেন। তারপর মাঝরাত্রের দূর, অনেক দূর থেকে আসা এক রাশ হাওয়া আগুনটাকে দপ করে জ্বালিয়ে দিতেই, বুকটা হালকা হয়ে গেল জয়চণ্ডীর। ওর ছেড়ে আসা ডাকাত দল। কিন্তু শুধু ডাকাত দলই নয়, তাদের মাঝে লোভে জ্বলজ্বল করা লাল চোখে নমচণ্ডী। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল জয়চণ্ডীর। চোখের সামনে তখন ওর বাবার মুখটা। সেই চোখ, রক্ত, মৃত্যু-ভয়। আর অপেক্ষা করেনি জয়চণ্ডী। বাবার মত নিজের ছেলেকেও ওভাবে অসহায়ের মত মরতে দেখার ভয়ে সেই উঁচু সেমাফোর টাওয়ারের উপর থেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল নিজের শরীর। পাহাড়ের পাথরে থেঁতলান শরীরে নিজের শেষ মুহূর্তেও হেসেছিল জয়চণ্ডী। গোটা শরীর তখন অসাড়। তবে ডান হতটা নড়ছিল। সেই দিয়েই কপালে হাত ঠেকিয়ে একবার শেষ বারের মত প্রনাম করল জয়চণ্ডী। অন্ধকারে, চোখ ফেটে বেরোনো তরলটা রক্ত না জল বুঝতে পারেনি। তবে সেই দিয়েই লিখেছিল, ‘জয়চণ্ডীর থেকে ভয়চণ্ডী ঢের ভালো। আর উ কাজ করিস না নম। ধম্মে সয়ছে না।“ আর চিৎকার করে বলেছিল, “মা, আমার ছেলেটোকেও ক্ষমা করিস। সৎ বুদ্ধি দিস“।           
লেখাগুলো পড়ে নমচণ্ডী আর কোনোদিনও ডাকাতি করেনি। জয়চণ্ডী পাহাড়ের গায়ে রক্তে লেখা কথাগুলোও মুছে গিয়েছে অনেকদিন। কিন্তু সেমাফোর টাওয়ারটা আজও আছে।


ঘনঘোরে মনোহরপুর
সহেলী রায় 

দেবু দু’পাড়া পেরিয়ে প্রায়ই এসে বসে অশ্বত্থ গাছটার কাছে। শেষ যেদিন রিক্সা ভ্যানে সব মালপত্র চাপিয়ে  রওনা দিয়েছিল ওরা নতুন বাড়ির পথে, দেবু যতক্ষণ দেখা যায় গাছটাকে, ততক্ষণ তাকিয়েছিল গাছটার  দিকে। মনে হচ্ছিল দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। বাতাস ভারি হয়ে ছিল। গাছের ঝুরি বেয়ে অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেমে আসছিল। কেন? কেন? সবাই মিলে মনোহরপুর শূন্য করে পালিয়ে যাচ্ছে  তাকে ফেলে? পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি, জমি, গাছ-গাছালি ফেলে, এতটুকু পিছুটান অনুভব না করে চলে যাচ্ছে যে  যেদিকে পারে। এ কেমন অভিশাপ? প্রশ্নটা দেবুকেও রাতদিন তাড়া করে মারে। যদিও কেউ এই নিয়ে কোন আলোচনাতেই যেতে চায় না। সন্তর্পণে এড়িয়ে যায়, পাছে আরও বিপদ এসে জোটে। নতুন ভাড়া বাড়ি  থেকে বেরনোর সময় তাকে পঁই পঁই করে সাবধান করে দেওয়া হয় রোজ, ভুলেও যেন সে পুরনো পাড়ার দিকে না  যায়। ভয়টা যে তার মনেও নেই, তেমন নয়। তবে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলে কী এক অমোঘ নেশার টানে সে চলে আসে বুড়ো অশ্বত্থ গাছটার কাছে। এর বেশি এগোনোর সাহস হয় না যদিও। চুপচাপ বসে গাছটার তলায়। ঘাড় উঁচু করে দেখতে থাকে শাখা-প্রশাখা, পাতা থেকে ঝুলে পড়া লম্বা দড়ির মতো ঝুরিগুলো। কিছু কি বলতে চায় ওরা? দেবু কান পেতে থাকে। শুধু বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ ছাড়া তেমন কিছু  ঠাহর হয় না। দেবুর খালি মনে হয়, মনোহরপুরের শেষ প্রান্তে জন্মযুগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এই গাছটার কাছে অনেক প্রশ্নের উত্তর আছে। যে প্রশ্নগুলো মুখে টুঁ শব্দটি না করে মনোহরপুরের জ্ঞান হওয়া শিশু থেকে  প্রবীণেরা প্রাণপণে খুঁজে চলেছে। দেবু গাছের চারপাশটা প্রদক্ষিণ করে, তারপর হতাশ হয়ে প্রতিদিনের মতোই ফিরে যায় বাবা, মা ভাইয়ের সংসারে। 
‘কীরে, মোহনদা বলল, তুই নাকি সাইকেল নিয়ে পাড়ার দিকে গিয়েছিলি?’ 
খেতে বসে বাবার ধমক খেয়ে দেবু নড়েচড়ে বসল। ভাতের গ্রাস পাকাতে পাকাতে ভাবছিল কী উত্তর দেওয়া যায়।
‘ঢুকিনি তো। অশ্বত্থতলা অব্দি গিয়েই চলে এসেছি’। 
দেবু বুঝতে পারল, মিথ্যে বলে লাভ নেই। বাবা মোহনকাকার কথা অবিশ্বাস করবেন না। দেবু মায়ের মুখের দিকে তাকাল। খাওয়া বন্ধ করে কেমন যেন ফ্যাকাসে মুখে বসে আছেন মা। 
‘কেন? বারণ করিনি? চারিদিকে বিপদ গ্রাস করে বসে আছে আমাদের। কী চাস? ডেকে এ পাড়াতেও নিয়ে আসি তাদের?’
বাবামায়ের উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে দেবু বোঝে। তাই বলে সকলে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে, এ কেমন? মনোহরপুরে জন্ম তার। ছাপাখানার পাশের মাঠে বাবার সঙ্গে বল নিয়ে খেলা শুরু, বছর পাঁচেক বয়স হতেই নিমো, গোপাল, সিধু কত বন্ধু মিলে বিকেল থেকে ছাপাখানার মাঠ দাপানো। সন্ধে নেমে গেলেও হুঁশ থাকে না বাড়ি ফেরার। হ্যাঁ, প্রাইমারি স্কুলের পর হাই স্কুল মনোহরপুরে নেই বলে তাদের আসতে হয় টাউন স্কুলে। সেই সুবাদে সাইকেল জোটে। যেন পঙ্খীরাজের পাখনা। হুশ হুশ করে যেদিকে চাও ছুটে বেড়াও।   ফাঁকা ধানজমি, নিমগাছ, জামরুল গাছে হুটোপাটি, সেসব কী এত সহজে মুছে যায়? বাবাও সাইকেল চেপে  টাউনে আসতেন রোজ। টাউন হাসপাতালের অফিসে কাজ করেন বাবা। সন্ধের পরে যে যার বাসায় ফিরে খানিক জিরিয়ে কুলোজ্যাঠার চায়ের দোকান সরগরম করতে তাঁরাও পিছপা হতেন না। আশেপাশের কাকী,  মায়েরা মিলেও কারোর না কারোর উঠোন রোয়াকে বসে চলত কলকলানি। সমস্ত অস্তাচলে পাঠিয়ে এ কেমন  নীরবতা দেবু বোঝে না। দেবু এখন অষ্টম শ্রেণী। স্কুলে গেলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় ঠিকই। তবে  মনোহরপুরের বন্ধুরা আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত নয়। দেবু অনেকবার চেষ্টা করেছে বিষয়টা নিয়ে কথা বলার।  কেউ থামিয়েছে, কেউ উঠে চলে গেছে, কেউ প্রতিবাদ করে বলেছে, এই নিয়ে কথা বলা বারণ, দেবু তার খেলাপ করলে বড়োদের জানানো হবে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর শুধু হতাশায় ঘেরা কিছু মুখ ঘুরে  ফেরে। ছোট ভাই শিবুও সন্ধে থেকেই ভয় ভোলার বাহানায় ঘুমিয়ে পড়ে।  
বাবার ভয়, মায়ের আতঙ্ক সবকিছু বুঝে দেবু মাথা নীচু করে থাকে। বন্ধুরা বিভিন্ন পাড়ায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। সবাই যেন আলাদা গ্রহের মানুষ। 

২)
‘দেবব্রত?’
জলদগম্ভীর ডাক শুনে দেবু পিছন ফিরে তাকায়। মিলন স্যর। সকলের অত্যন্ত পছন্দের শিক্ষক তিনি। দেবুরও আদর্শ মিলন স্যর। স্যর শুধু ভালো পড়ান তা নয়, সকলের সঙ্গে এমন বন্ধুর মত মেশেন, কত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, সকলেই মুগ্ধ হয়ে থাকে স্যরের ক্লাসে।   
‘হ্যাঁ স্যর’। 
দেবু টিফিন ব্রেকে করিডর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল। স্যরের ডাক পেয়ে ফিরে গেল।
‘কী ব্যাপার বলো তো, ক’দিন ধরেই দেখছি তুমি একা একা থাকো, ব্রেকে ছেলেরা মাঠে খেলে, তুমি যাও না সেখানে?’ 
মিলন স্যরের কথায় দেবু খানিক লজ্জা পেল। কেউ বলেছে নাকি স্যর সত্যি টের পেয়েছেন? দেবুর সংশয় হয়।  
‘তেমন কিছু নয় স্যর। এমনিই’। 
মিলন স্যর যেন দেবুর কথায় ঠিক সহমত হন না। ঈষৎ ভুরু কুঁচকে থাকেন। 
‘মনোহরপুরের গোটা বাষট্টি পরিবারের বাস জানি। ছোট পাড়া। আজব সব কান্ডকারখানার খবর আসছিল বটে। একসময় এই ছোট ছোট খবরগুলোই বিশাল আকার ধারণ করল। প্রশাসন পর্যন্ত তৎপর হয়ে মানুষজনকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করল। আমি জানি তুমি খুব সংবেদনশীল দেবব্রত। বাকিদের মতো নও। সবসময়ই নানারকম উদ্ভাবনী শক্তি তোমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার ধারণা, তুমি চিন্তায় ডুবে আছ’। 
মিলন স্যরের কথায় দেবুর হঠাৎ মনে হল একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা তাকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছে। এই  প্রথম কেউ মনোহরপুর নিয়ে কথা বলছেন। তাও মিলন স্যরের মতো একজন ব্যক্তিত্ব। দেবুর আভ্যন্তরীণ  আলোগুলি একটু একটু করে যেন ফুটে উঠতে চাইছে। চশমার পেছনে মিলন স্যরের বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটোর  দিকে  সরাসরি তাকিয়ে দেবু কিছুটা সম্মতির লক্ষণ জানাল। স্যর দেবুর কাঁধে হাত রেখে করিডর দিয়ে  হাঁটতে লাগলেন। 
‘স্যর আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না’। 
যে কথাটা গত চার মাস যাবৎ কাউকেই বলেনি সেটাই আজ বলল দেবু স্যরকে। 
‘মেনে যে নিতেও নেই। যাইহোক, আমার বাড়ি চেনো তো? পোস্টাপিসের পাশেই। ইচ্ছে হলে আসতে পারো, কথা হবে’। 
দেবুকে ছেড়ে স্যর এগিয়ে গেলেন স্টাফরুমের দিকে। দেবুর শিরা বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসছে।   সমাধানের রাস্তা নাকি বিপদের সঙ্কেত? দোলাচলে ডুবে যাচ্ছে দেবুর মন।  
বাবার বকুনির পর থেকে দেবুর স্কুলের পর বাড়ি থেকে বেরনো বারণ। স্কুলও ঠিকঠাক যাচ্ছে কিনা নজর রাখা হয়। তাও সন্ধেবেলা বাবা মার কাছে মিলন স্যরের বাড়ি যাওয়ার আবদারটুকু রাখল দেবু। প্রথমে নেতিবাচক কথপোকথন হলেও শেষমেশ রাজি হলেন বাবা, তবে উনি নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবেন তেমনই শর্ত আরোপ হল। 
মিলন স্যরের বাড়িতে আরও সব ছাত্রেরা আসে। কেউ পড়া বোঝে, কেউ স্কুলের ম্যাগাজিনের আলোচনা নিয়ে, কেউ খেলার মাঠের কথা নিয়ে। বসার ঘরে দেবুও বসে রইল। তবে চুপচাপ। বাকি কোনকিছুতেই যেন তার উৎসাহ নেই। সবাই একে একে চলে যেতে, মিলন স্যর বাইরের সদর বন্ধ করে দিলেন।
‘বলো তো দেবব্রত, কী এত ভাবছ?’
দেবু মনের ভেতর কথাগুলো সাজাচ্ছিল এতক্ষণ, ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।  
‘মনোহরপুরেই জন্ম আমার, শুধু আমার কেন? বাবারও। দাদুর আমলের বাড়ি। ছোট, একতলা হলেও, আমাদের বাড়ি। ধূলোবালি, খেলাধূলা, ওঠাবসা করতে করতে এত বড় হলাম। বছর দেড়েক আগে খবর  পেলাম, কানুকাকুর ছেলে ধ্রুবকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরদিন বড় ট্যাঙ্কটার কাছে পাওয়া গেল ওকে, তবে মৃত। থানা পুলিশ পরীক্ষা করে জানা গেল, কোনকিছুর ফাঁসে শ্বাসরোধ হয়ে চলে গেছে ধ্রুব।  এরপর আরও কত  নাম এভাবে চলে গেল। পাড়ার গরুবাছুর, কুকুর, বেড়াল সব উধাও হয়ে গেল। সকালে উঠেই এদিক ওদিক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত। কেউ কোন কুলকিনারা করতে পারল না’।  
দেবুর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। মিলন স্যর বললেন,
‘তারপর?’
‘আমাদের মনোহরপুরের ওই একটিই জল ট্যাঙ্ক। বাষট্টি পরিবারে ওখান থেকেই জলসরবরাহ হয়। কিছুদিন  ধরে খুব জলকষ্ট শুরু হল। কখনো জল আসে, কখনো আসে না। বিডিও স্যরের তত্ত্বাবধানে দু’বার ট্যাঙ্কের  নীচে লোক পাঠানো হল, প্রথমবার সমাধানের জন্য। কিন্তু প্রথম লোকটি আর ট্যাঙ্কের তলা থেকে না ফিরে আসায় দ্বিতীয়জন নামল তাকে খুঁজতে। সেও ফিরল না। ওপর থেকে তার কোমরের দড়ি ধরে টানাটানিতে শধু মাত্র দড়িটিই উঠে এল। প্রশাসন, ইঞ্জিনীয়ার সকলেই এলেন একে একে। এক ভয়াল শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পায় না কেউ, প্রাণের ভয়ে কেউ এগোতেও চায় না। এসে গেল মনোহরপুর খালি করার নির্দেশ। যদিও আশ্বাস দেওয়া হয় খুব শীঘ্রই সমস্যার সমাধান করে সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তারও আটমাস কেটে গেল। কেউ ঢোকেই না সেখানে। কীভাবে ফিরব আমরা স্যর?’ 
মিলন স্যর দেবুর মাথায় হাত রাখলেন। দেবু কান্নায় ভেঙে পড়েছে।
‘তোমার একটা বিষয় ভালো লাগছে আমার দেবব্রত। তুমি অন্তত ভাবছ, বাকিরা তো নিস্তব্ধ। পুজো আচার, ভূত, সংস্কার সব আঁকড়ে বসে আছেন। কিন্তু এভাবে ভয় পেলে কোনদিনই ফিরতে পারবে না তোমরা। ভয়  মানুষের সবচাইতে বড় শত্রু। ভয়কে জয় না করতে পারলে মানুষ পিছিয়ে পড়বে।’ 
মিলন স্যরের কথায় কিছুটা বল পেল দেবু। কিন্তু অশ্বত্থ গাছটার কথা কিছুতেই বলতে পারল না। এভাবেই বেশ কয়েকটি বিকেলে পড়া বোঝার নাম করে দেবু মিলন স্যরের বাড়ি আসাযাওয়া শুরু করল। প্রথমদিকে বাবা সঙ্গে করে আসলেও, পরে দেবুকে ভরসা করতে শুরু করলেন । 
আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে খানিক পোস্টাপিসের রাস্তায় এগিয়েও দেবু সাইকেল ঘোরালো। দোকানপাট, ইট কাঠের বাড়িঘর পেছনে ফেলে পৌঁছে গেল অশ্বত্থ গাছটার কাছে। একী কে শুয়ে আছে   ওখানে? শুয়ে নাকি মৃত? দেবু ভয়ে ভয়ে কাছে এগোল। এতো মনোহরপুরের রাজু পাগলা। বাড়ি বাড়ি খাবার চেয়ে বেড়াত। রাতে অশ্বত্থতলাতেই এসে শুয়ে থাকত। বহুদিন তাকে দেখা যায়নি। সবাই ভেবেছিল, ও আর  নেই। দেবু ঝুঁকে পড়ল ওর মুখের কাছে। তখনই পাগলটা লাফ মেরে উঠে বসে হাসতে লাগল খুব। দেবু ছিটকে গেল দু’পা পেছনে।  
‘এয়েচিস?’ 
রাজু জিগেস করল। গাছের ঝুরির মতোই তার দাঁড়ি গোঁফের দড়ি নেমেছে। চোখের কোণে পিচুটির দলা।  ছেঁড়া একটা জামা আর গামছা জড়ানো পরনে। তবে হাসিখানা একেবারে দুশ্চিন্তাহীন। কোন বিপদই যেন তাকে ছোঁয়নি।   
‘তুমি কোথায় ছিলে অ্যাদ্দিন?’ 
দেবু দূর থেকেই জিগেস করল।
‘কেন? ওই পাড়াতেই। কেউ নাই। খাবার নাই। বড্ড খিদে, আমাদের। দুজনেরই খিদে পেয়েছে। খেতে দিবি?’ 
যদিও পাগলের কথা। তাও দেবুর মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। কার কথা বলছে পাগলটা? দেবুর পড়ার ব্যাগে একটা কেকের প্যাকেট আর জল ছিল। মা স্কুলের টিফিনে দিয়েছিলেন। খাওয়া হয়নি। দেবু সেটাই এগিয়ে দিল পাগলটাকে।   
‘কার কথা বলছ? কার খিদে পেয়েছে?’
দেবু সাহস করে জানতে চাইল। রাজু পাগলা খাবার পেয়ে মহাখুশি। কেকে কামড় বসাতে বসাতে বারবার গাছের ওপর দিকে তাকাচ্ছে সে। দেবুও খানিক এগিয়ে এসে দেখল ওপর দিকে। গাছের কিছু ডালপালা যেন ফোঁস ফোঁস করছে। দেবু আরও খানিক এগোল। তখনই ঘটল অঘটনটা। পেছন থেকে কেউ টেনে যেন আঁছড়ে ফেলে দিল তাকে। কোনরকমে সামলে নিয়ে দেখল পাগলটাই ফেলে দিয়েছে তাকে।
‘বললাম না ওর খিদে পেয়েছে। তুই সামনে গেলেই আস্ত গিলে খাবে, খুব সাহস না তোর? যা পালা বলছি’। 
পাগলটা খুব হাঁপাচ্ছে। 
‘না আজ জেনেই যাব, কার কথা বলছ?’
দেবুরও জেদ চেপে গেল। রাজু পাগলা আঙুল তুলে গাছটার দিকে দেখাল। দেবু শিউড়ে উঠল। এতদিন বোঝা   যায়নি। গাছের ছালের সঙ্গে মিশেছিল। প্রকান্ড এক ময়াল সাপ। হিস হিস শব্দ করতে করতে পাক ছাড়াতে ছাড়াতে নেমে আসছে দেবুর দিকেই। দেবু সাইকেল ফেলে পাগলটাকে হিড় হিড় করে টানতে টানতে মনোহরপুরের পথেই ছুটতে লাগল। অশ্বত্থ গাছের ওপারে কিছু লোকজনের গলা পাওয়া গেল তখনি। 
‘দেবব্রত স্টপ। আমরা এসে গেছি, ভয় পেয়ো না’।  
মিলন স্যর আরও লোকজন সঙ্গে করে এসে হাজির। দানবীয় চেহারার সাপটা তখন হেলতে দুলতে মনোহরপুরের রাস্তায়। তবে কিছুটা ক্লান্ত, অবসন্ন। জলট্যাঙ্ক পর্যন্ত এসে সে থামল, তারপর ধীরে ধীরে ট্যাঙ্কের  গা বেয়ে খানিক উঠে নেমে যেতে লাগল নীচের দিকে। সবাই তখন এগিয়ে এসেছে। ট্যাঙ্কের নীচে প্রকান্ড সুরঙ্গ পথ বানিয়ে নিয়েছে সে। সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে লোকালয় থেকে বাঁচতে। খিদের তাড়নায় বেরিয়ে আসে, মানুষজনকে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়, ভবিষ্যতের খাদ্যের জন্য, যেহেতু মৃতদেহ  সরিয়ে ফেলা হয়, তাই সে অভুক্ত থাকে। ট্যাঙ্কের মুখ এমনভাবে পেঁচিয়ে থাকে, জল সরবরাহের ব্যাঘাত ঘটে।  শুধুমাত্র সেই দুজন লোক তার খিদে নিবারণ করেছিল যারা ট্যাঙ্কের নীচে নেমে আর ওঠেনি। তার খিদে মেটাতেই উধাও হয়েছিল পাড়ার গরু কুকুর। মনোহরপুর খালি হয়ে যাওয়ার পর সে পুরোপুরি বেরিয়ে আসে। অশ্বত্থগাছেই জড়িয়ে আশ্রয় নেয়, খিদেতে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে।  
রাজুকে ঘিরে ধরেছে গোটা দল। মিলন স্যরের বাড়ি দেবু না পৌঁছলে স্যরের সন্দেহ হয়। উনি লোকজন সঙ্গে নিয়ে মনোহরপুরের প্রান্তে অশ্বত্থ গাছতলায় এসেই বুঝতে পারেন, যা ভেবেছিলেন তাই। দেবু এখানেই এসেছে।  
‘আমি তো রাতে দেখেছিলাম দানবটাকে। এগিয়ে আসত আমার দিকে। আমি গাছে উঠে বসে থাকতুম। দু’রাত ছিলুম। দেখলাম সবাই চলে যাচ্ছে। আমিও পালিয়ে গেলাম। এলাম যখন, কেউ নেই। গাছে শুতে  এসে দেখি সে ব্যাটা আমার জায়গা নিয়েছে। তবে আমিও তাকে ছুঁইনা, সেও না। দুজনেরই যে বড় খিদে’।   
সকলেই বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে রাজু পাগলার দিকে। 
‘ঠিকই, আসলে ওদের কেউ ক্ষতি না করলে ওরাও করে না। যারা চলে গেছে নিশ্চয় তারা ভয়ে কোন ক্ষতি করতে চেয়েছিল সাপটার, তাই এই পরিণতি। এছাড়া কোনভাবে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে, খিদের তাড়না তো আছেই’। 
মিলন স্যরের কথা শুনতে তখন লোক ভেঙে পড়ছে। পুলিশ, বনদপ্তর সবাই কাজে লেগে পড়েছে।
মিলন স্যর দেবুর মাথায় হাত রাখলেন।  
‘আমাদের ছাত্রদল। ভয়কে জয় করার প্রবল তাগিদ। এটার দরকার। ভাগ্যিস দেবব্রতর অন্বেষণের নেশা ছিল। তা নাহলে মনোহরপুর আর ফিরে পাওয়া যেত না। অজানা আতঙ্কে কেটে যেত সকলের জীবন’। 
দেবুকে তখন কাঁধে তুলে নিয়েছে গোটা মনোহরপুরবাসী। উল্লাস চলছে রাস্তা জুড়ে। দেবুর তখনো ঘোর কাটেনি। ভাগ্যিস স্যর ছিলেন। রোজ একটু একটু করে সাহসের বীজ বুনেছেন দেবুর মাথায়। আর রাজু পাগলা? কতটা মানবিকতা বোধ তার। সে বুঝেছে ওই অবলা জীবের খিদে।  
ঘুমপাড়ানি ওষুধ দিয়ে ময়ালটিকে খাঁচাগাড়িতে তোলা হয়েছে। দেবুর খুব অসহায় লাগল তাকে। সে ঠিকই   ভেবেছিল। এই অশ্বত্থ গাছটাই জানে সব উত্তর। কতবার এসে অনুভব করেছে গাছটা যেন ফুলেফেঁপে উঠছে।  দেবু আবার গাছতলায় এসে বসল। গুঁড়িটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। প্রশান্তির হাওয়া বইছে। দেবুর চোখ জুড়িয়ে আসছে।
রাতে যেন দিনের আলোর ঢল মনোহরপুরে। সমস্ত কলরব ছাপিয়ে দেবুর কানে একটাই শব্দ, ‘হিস হিস’।  সারারাত একই ছন্দে বেজে গেল শব্দটি। দেবু ঘুমচ্ছে তার মনোহরপুরের ছোট্ট ঘরে। মনোহরপুর ঘুমচ্ছে নিশ্চিন্তের বেড়াজালে।

আরও পড়ুন 




Post a Comment

0 Comments