জ্বলদর্চি

মা দুর্গা প্রত্যেক বছর আসেন, তবু আমাদের ভাগের ডিম ওরা বেচে দেয় -পর্ব-১/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

মা দুর্গা প্রত্যেক বছর আসেন, তবু আমাদের ভাগের ডিম ওরা বেচে দেয় -পর্ব-১

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


বছরভর অপেক্ষা করে থাকি কবে আমাদের মা আসবেন। মা বলতে, গ্রামের বা বস্তির সেই কালো পটকা, ময়লা কাপড়ের ঘুঁটে কুঁড়োনী মা নয়, এ মা আমাদের মহিষ-মর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারী, চন্ডী, লক্ষী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবানী, কত নাম 'আমাদের মা'-র। তাঁর বিশেষ এক নাম আছে ভগবতী দুর্গা। ভগ মানে ঈশ্বর্য। তাই, ভগবতী মানে ঈশ্বর্যশালিনী। ঈশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি ঈশ্বর্যর নাম 'ভগ'। এই ছয়টি গুণ মা দুর্গার মধ্যে পূর্ণ মহিমায় বিরাজিত। আবার তিনি 'মহামায়া'। 'মায়া' কথাটি এসেছে মা-ধাতু থেকে, অর্থ পরিমাপ করা। মহামায়া মানে মহাপরিমাপনকত্রী। পুরুষোত্তম শ্রী কৃষ্ণ বললেন, "এই যে মায়া দেখছ, মায়ার যা কিছু সব খেলা, এ মায়া কিন্তু আমারই (গীতা ৭/১৪), অর্থাৎ মায়াও তাঁরই সৃষ্টি। ঈশ্বর স্বীয় মহাশক্তি দ্বারা জগত পরিমাপ করে। মায়া আবার প্রকৃতি নামেও আখ্যায়িত হয়। দেবীপূজার প্রাক্কালে বিল্ববৃক্ষে বোধন হয়, বোধন মানে জাগরণ, চেতন করে তোলা। 

তৈত্তিরীয় আরণ্যকে প্রথম দুর্গা শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে শব্দটা যে একটি প্রাচীন শব্দ তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি সর্ববিধ দুঃখ দুর্গতি ও ভয় হরণ করেন তিনিই দুর্গা। তিনিই আমাদের সবার মা। কিন্তু আমাদের জন্মদাত্রী মা, তিনি এসব কিছুই পারেন না, তাই তাঁকে বৃদ্ধ বয়সে বেঁচে থাকতে হলে ছেলে বৌমার করুণার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। নয়তো তাকে কোর্ট যেতে হয়। স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে যে রুরুদৈত্যৈর পুত্র দুর্গামাসুর ইত্যাদি অত্যাচারী অসুরকে বিনাশ করে জগৎবাসীর দুর্গতি নাশ করেছিলেন বলেই তিনি দুর্গা নামে পরিচিত। পুরাণ থেকে জানা যায়, পুরাকালে অসুরদের প্রধান মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন। ব্রহ্মার বরে তিনি ছিলেন পুরুষের অবধ্য। তাই বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতাদের সম্মিলিত তেজে পরম শক্তি নারীরূপে আবির্ভূত হন দুর্গা। সব দেবতা নিজের নিজের অস্ত্র ও তেজ এই দেবীকে দান করেন। যেহেতু পুরুষ পুরুষের সাথে লড়াইতে পারলো না তাই দেবতারা নিয়েছিল ছলনার আশ্রয়। মোহময়ী  নারীরূপ  সৃষ্টি করে, বোকা সরল অবুঝ অসুর হত্যা করার জন্য। এই সর্বশক্তি স্বরূপিনী আদ্যশক্তি হলেন এই 'মা দুর্গা' তার দুর্গা নামটির মধ্যেই অসুর শক্তি নাশের পরিচয়। যুগে যুগে দেবতাদের কল্যাণের জন্য দেবী দুর্গা অত্যাচারী ভোগলোলুপ অসুরদের নিধন করেছিলেন। 

আমরা জানি অসুর দেবতা পরস্পর ভাই। বিষ্ণুপুরাণ বলছে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি কার্যে ব্রতী, তখন রাত্রিকালে ব্রহ্মার মধ্যে তমোগুণ থেকে অসুরদের সৃষ্টি হয়। আর দিনের বেলায় স্বতঃগুণ থেকে দেবতারা। অর্থাৎ অসুররা তমঃস্বভাব। আর দেবতারা স্বত্তঃস্বভাব। তারপর মানুষ দৈত্য যক্ষ্ম, রাক্ষস সব জন্ম নেয়। দেখা যাচ্ছে অসুরেরাও দেবতাদের মতো উন্নত স্তরের জীবন। আসলে দেবতাও অসুর এরা একই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ। এবং দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের বিশেষ একটা পার্থক্য নেই। অসুররা হচ্ছে পরিবারের বড় ছেলে। আর দেবতারা ছোট ছেলে। আমরা সংসার জীবনে দেখেছি যারা বড় হয়, তাদের সংসারে অবদান বেশি। আর ছোটরা বড়দেরই পরিশ্রমে ফুলবাবুর মতো মানুষ হতে থাকে। এবং তারা উচ্ছৃঙ্খল হয়। কাঠক সংহিতার মতে- দেবতা এবং অসুরেরা একই সঙ্গে যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন। দেবতারা যা যা করেছিলেন, অসুররাও তাই তাই করেছিলেন। এই যজ্ঞ চলাকালীন দেবতারা অসুরের থেকে বড় বলে গণ্য হলেন। 

সেই থেকে তাদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। সাপ-নেউলে সম্পর্ক। পুরাণ থেকে জানা যায়, অসুরেরা একসময় সব জিতে নিয়েছিলেন, জেতার পর তারা দেবতাদের ভাগ দেওয়ার জন্য গোটা পৃথিবী মাপ-যোক আরম্ভ করেছিলেন। তা দেখে দেবতারা প্রমাদ গণলেন। তাঁরা মনে মনে ভাবলো, কি করে সমস্ত পৃথিবী অসুরদের কাছ থেকে কেড়ে, তাদের এখান থেকে বিতাড়ন করা যায়। এই ভেবে তারা বিষ্ণুর শরন নিলেন। বিষ্ণুর কাছ থেকে বুদ্ধি পেয়ে, তারা অসুরদের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। অসুররা ভালো মানুষ। তারাও ভাগ দিতে রাজি হল। এইবার বুঝুন অসুররা কত সহজ সরল। দেবতারা হলে তারা ভাগ দিতে চাইতেন না। অসুররা বললেন, ঠিক আছে আমরা জায়গা দেব, ততটা যতটা তোমাদের বিষ্ণুর শুতে জায়গা লাগবে। কিন্তু ছলনাকারী বিষ্ণু ফুলে ফেঁপে গোটা পৃথিবী জুড়ে বিষ্ণু শুয়ে পড়লো। এইভাবে অসুররা দেবতাদের সঙ্গে বাটপাড়ি করল, এবং কষ্ট করে সমগ্র জেতা পৃথিবী থেকে অসুরদের দেবতারা তাড়িয়ে দিল। অসুররা জন্ম থেকে ভালো। কিন্তু দেবতারা তাদের ভালো থাকতে দেয়নি। তাদের সঙ্গে বদমায়েশি বাটপাড়ি করে তাদের নায্য প্রাপ্য থেকে বারবার বঞ্চিত করেছে। যেমন সমুদ্র মন্থনের সময় দেবতারা অসুররা সমান পরিশ্রমের ফসল হিসেবে যখন অমৃত উঠে এলো সমুদ্র থেকে, তখন দেবতারা ছলনা, নৃশংসতায় অসুরদের বঞ্চিত করলো। 

আর মেয়েছেলেদের প্রতি লোভ অসুরদের থেকে দেবতাদের শতগুণে বেশি। তার প্রমাণ পুরাণের প্রতি পৃষ্ঠায় আছে। যেমন- ইন্দ্রকেই ধরুন প্রথমে, গুরু গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে ধর্ষণ করেও, এখনও তার দেবত্ব যায়নি। বহাল তবিয়তে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত। এখনও সবাই তাকে দেবরাজ বলে। আমরাও সবাই জানি। সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার কথাও আমরা সকলে জানি, যে তার নিজের মেয়েকেও ছাড় দেয়নি। আবার যে চাঁদ আমাদের এত আলো দেয় মনে প্রশান্তি জন্মায়, সেও গুরুপত্নীর বিছানায় উঠে পড়েছিল। শুধু দেবতারা কেন তাদের গুরু বৃহস্পতি তাঁর নিজের বৌদিকে দেখে কামার্ত হয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গম সারলেন। যাদের গুরু এমনি শিষ্যরা কেমন হবে বুঝুন। 

দেবতাদের ব্যাপার না হয় গেল মুনি ঋষিদের দেখুন, যেমন ঋষি দীর্ঘতম নিজের ছোট ভাইয়ের বৌকে ও ছাড় দেননি। পরাশর আর সত্যবতী, তাছাড়া মুনি ঋষিদের জলভাত ছিল উর্বশীদের সঙ্গে মেলামেশা। আবার আগেকার দিনে গুরুগৃহে অতিরিক্ত কড়াকড়ির জন্য শিষ্যরা অনেক সময় গুরুপত্নীর সঙ্গে জুটে যেত। আর ক্ষুধার্ত উপবাসী গুরুপত্নীরা ও স্বেচ্ছায় মিলিত হতেন। কিন্তু এই দেবতা আর মুনি ঋষিরা উপদেশ দেন, পরস্ত্রীকে মায়ের চোখে দেখবে। এটা করতে নেই ওটা করো না। পাপ হবে, অমঙ্গল হবে ইত্যাদি। 


আবার আমরা অনেক সময় দেখেছি কাউকে কাউকে আমরা দেবতা বলি, আবার কাউকে ঈশ্বর বলে সম্বোধন করি। যেমন ইন্দ্রদেব, বরুণদেব ইত্যাদি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, ঈশ্বর আর দেবতার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। পুরাণ মতে ঈশ্বর হচ্ছে দেবতাদের দেবতা। তিনি বহু ঈশ্বরের মধ্যে পরম ঈশ্বর। যখন দেবতারা কোনো বিপদে পড়েন, তখন তাদের দেবতা অর্থাৎ ঈশ্বরের শরনাপন্ন হন। পুরাণকারেরা  এক বিরাট পুরুষের সন্ধান দিয়েছেন। অর্থাৎ পরব্রহ্ম এখানে সাকার ঈশ্বরে রূপান্তরিত। দেবতাদের নিয়ে আমরা হাসি ঠাট্টা মশকরা করলেও, পরব্রহ্ম বা ঈশ্বর নিয়ে আমরা তা করিনা। ঈশ্বরের কল্পনায় আমরা রীতিমতো গম্ভীর। দেবতাদের বিভিন্ন রকম নাম আছে মানুষের মত, কিন্তু পরব্রহ্মের কোনো নাম হয় না। দেবতাদের পূজার সময় যখন আমরা ফলমূল দেই, দেখি তারা কিছুই খান না। আসলে দেবতারা ভ্রমরের মতো, ফুলে বসে তাঁর মধু খেয়ে যায়। কিন্তু ফুলটি অবিকল একই থাকে। 

সৃষ্টির সময় ব্রহ্মার মনে হলো জরামরণহীন নিস্তরঙ্গ সৃষ্টির কোনো মানে হয় না। তাছাড়া সৃষ্টির মধ্যে ভালো মন্দ না থাকলে সৃষ্টির কোনো স্বাদ পাওয়া যায় না। সৃষ্টি হবে এমন যার মধ্যে শুভ অশুভ হিংসা দ্বেষ সব কিছু থাকবে। তাই দেবতা, মানুষ, ঋষি মুনি কেউই লোভ হিংসা স্বার্থ নীচতা বাদ দিয়ে তৈরি করলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরাণকাররা আমাদের জানালো, মানুষকে বা অন্যান্য সব সৃষ্টিকে- দেবতা, মুনি, ঋষিদের সম্মান করতে হবে, ভক্তি করতে হবে, তারা বসে বসে খাবে তাদের জন্য পূজা দিতে হবে। তাঁরা আরও বললো, মানুষের বুদ্ধি কম, দেবতাদের বুদ্ধি বেশি। কারণ বুদ্ধি, ক্ষমতা কিংবা গুণাতিশয্যেই মানুষ দেবতা হয়ে যায়। যেমন কৃষ্ণ, রাম, বুদ্ধ ইত্যাদি। যেমন ইন্দ্রের মধ্যে চুরি, প্রবঞ্চনা, লাম্পট্য কিংবা কৃষ্ণের মধ্যে বা গ্রীক দেবতা জিউসের চরিত্রেও আমরা তাই দেখেছি। 

মা দুর্গা সৃষ্টি হয়েছিল দেবতাদের বাঁচাতে। যারা বুদ্ধিতে ধুরন্ধর আর চুরি লাম্পট্যে বদমাশিতে পাকা। আর কাদের হত্যার জন্য, মূর্খ সরল অস্থিরমতি, নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত অসুরদের নিধনের জন্য। সেই একই কায়দা একই ফর্মুলা সুন্দরী রমণী। যেমন আজকাল আমরা দেখি, বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কাছে, বিভিন্ন কাজের সুপারিশের জন্য সুন্দরী মেয়ে দেওয়া হয়। আসলে সেই অফিসারকে বশ করে, তাঁর কাজ হাসিল করে নেওয়া। ( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments