জ্বলদর্চি

মা দুর্গা প্রত্যেক বছর আসেন, তবু আমাদের ভাগের ডিম ওরা বেচে দেয় -২/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

মা দুর্গা প্রত্যেক বছর আসেন, তবু আমাদের ভাগের ডিম ওরা বেচে দেয় 

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


পর্ব ---২

অসুরদের একটাই দোষ ছিল- সংযমের অভাব। উপযুক্ত সময়ে কি করা দরকার, সহজে তাদের মাথায় আসতো না। চিন্তা শক্তির অভাব যথেষ্ট ছিল। দেখা গেছে দেবতাদের যত লাভ হয়েছে সব অসুরদের ঠকিয়ে, অথবা ফাঁকি দিয়ে। সভ্যতার অগ্রগতিতে হৃদয়ের দুর্বৃত্তগুলি চেপে রাখা যায় বলেই সেটা সভ্যতা। অসুররা সেটাই পারতো না। তাই তারা আমাদের কাছে অসভ্য ব্যাক্তি বলে পরিচিত। অসুররা এমনিতে সহজ সরল ছিল। তবু তাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে দেবতারা চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। 

একবার অসুর গুরু শুক্রাচার্য সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে দেখে দেবরাজ ইন্দ্র ভয় পেয়ে গেলেন। ভয় পেলেন এই ভেবে যে, যদি গুরু শুক্রাচার্য অসুরদের শিক্ষিত করে তোলে, তবে তাদের আরাম আর আয়াসে থাকা দেবত্ব চলে যাবে। দেবতারা ভালোই বুঝতো, কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে, তাদের মূর্খ রাখতে হবে। ইন্দ্র তাই শুক্রাচার্যের সাধনালব্ধ ধন নষ্ট করার জন্য নিজের মেয়ে জয়ন্তীকে পাঠালো। গুরু শুক্রাচার্য কে যৌবনের তরঙ্গে ভাসিয়ে দিয়ে তার সাধনা নষ্ট করে দিতে। দেবতারা এত নীচ তারা নিজের মেয়েকেও ভেট দিতে রাজি, নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য। অসুর গুরু সাধনা শেষ করে জয়ন্তীকে দেখে ঠিক থাকতে পারলেন না। তিনি তাকে বিয়ে করে দশ বছর মায়াবৃত  হয়ে বিহার করতে লাগলেন। তার ফলেই জন্ম দেবযানীর। ইন্দ্র এই দশ বছর অসুরদের ভুল শিক্ষা দেওয়ার জন্য গুরু বৃহস্পতিকে, শুক্রাচার্যের ছদ্মবেশে অসুরদের কাছে পাঠালেন। দশ বছর ধরে অসুরদের উল্টাপাল্টা শিক্ষা দিলেন, ছদ্মবেশী দেবগুরু বৃহস্পতি। যদিও শুক্রাচার্য ফিরে আসতে বৃহস্পতি ধরা পড়ে পালিয়ে যান। এই ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার দেবতারা অসুরদের ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় বা সর্বসুখের অধিকারী হয়েও তাদের শান্তি নেই। ঘরের মেয়েকে পর্যন্ত কাজে লাগিয়ে অসুরদের শিক্ষা-দীক্ষা সব দিক দিয়ে সর্বস্বান্ত করতে চেয়েছিল। এই ঘটনা বর্তমান আমাদের সমাজে আমরা কি দেখছি না? 

এবার আসি মহিষাসুর প্রসঙ্গে। মহিষাসুর সম্পর্কে যা জানা যায় দেবী ভাগবত, ব্রহ্ম-বৈবর্ত পুরাণ ও কালিকা পুরাণে। ব্রহ্মার পুত্র মরীচি, মরীচির পুত্র কশ্যপ এক বিখ্যাত মুনি। এই কশ্যপ মুনির দুই পুত্র রম্ভ আর করম্ভ। করম্ভের অকাল মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত রম্ভ হঠাৎ বসে গেলেন ঘোরতর তপস্যায়। দেবাদিদেব মহাদেব শিব তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন যে- "যার প্রতি চিত্ত সমর্পণ পূর্বক তুমি তোমার এই নশ্বর দেহটি অর্পণ করবে, তার গর্ভেই জন্ম নেবে তোমার কাঙ্ক্ষিত পরাক্রমশালী পুত্র।" এই বরলাভের আনন্দে রম্ভ একদিন নিজের রাজ্যে ফিরতে ফিরতে এক মহিযরূপী অপ্সরাকে দেখে কামার্ত হন। কামার্ত রম্ভ ওই মহিষীর সঙ্গে মিলিত হন। এবং জন্ম নেয় এক বিচিত্র বর্ণশঙ্কর ভয়ঙ্কর মহাবলীপুরম পুত্রের- মহিষাসুর। এরপর শুরু হলো মূর্খ, অপরিণামদর্শী মহিষাসুরের অতিবিক্রম প্রদর্শন। তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন উদিত হলো- সুর আর অসুর পরস্পর ভাই। তবে দেবতারা কেন শুধু স্বর্গরাজ্য দখল নেবে। এই ভেবে স্বর্গরাজ্য দখলের ছক কষতে লাগলো। মূর্খ গোঁয়াড় মহিষাসুর যখন স্বর্গরাজ্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সে সময় একটা ভুল করে বসলো। ঋষি কাত্যায়নের এক তেজস্বী শিষ্য ছিলেন, নাম রৌদ্রাশ্ব। তিনি যখন গভীর বনে একাগ্রচিত্তে তপস্যায় মগ্ন, তখন মহিষাসুর নারীর ছদ্মবেশে তার ধ্যান ভাঙাতে চাইল। ঋষি তার এই ছলনা বুঝতে পেরে মহিষাসুরকে অভিশাপ দিল- যে স্ত্রী রূপ ধরে তুমি আমায় বিভ্রান্ত করলে, সেই স্ত্রী জাতির হাতে তোমার মৃত্যু হবে। নির্বোধ মহিষাসুর এই কথায় কর্ণপাত না করে, স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করলো। দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে অসুর-রাজ মহিষাসুরের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো। সেই যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রচুর সৈন্য সামন্ত এবং ক্ষয়ক্ষতি হল। শেষ পর্যন্ত দেবতারা পরাজিত হল। মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে নিল। এবং স্বর্গের রাজা হয়ে বসল। দেবতাদের তাড়িয়ে দিল স্বর্গ থেকে।
 দেবতারা রাজ্যহারা হয়ে মর্ত্যের পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু আলালের ঘরে দুলালদের তো এভাবে দিন কাটলে চলে না। তাই সব দেবতা মিলে ব্রহ্মাকে নিয়ে মহাদেব ও বিষ্ণুর কাছে গেল। সেই ভয়ঙ্কর কাহিনী শুনে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এবং অন্যান্য্ দেবতাদের শরীর থেকে তেজ বের হতে লাগল। সেই তেজরাশি একটি বিশাল তেজোদীপ্ত আলোর পুঞ্জে পরিণত হল। মনে হল যেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। সেই আলোকপুঞ্জ থেকে আবিভূর্ত হলেন এক মহাশক্তিময়ী দেবীমূর্তি। 

দেবতারা নিজেরা না পেরে, তাদের সব  অস্ত্রশস্ত্র সেই দেবীর হাতে তুলে দিলেন। দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেবী দুর্গা যুদ্ধের জন্য সুসজ্জিত হলেন। হিমালয় দেবীর বাহনের জন্য একটি সিংহ দিলেন। দিলেন অনেক মূল্যবান রত্ন দীপ্ত অলংকার। এই দেবীই হলেন দূর্গা। 
পুরাণে আবার এক দূর্গা কে আমরা পাই- যিনি পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতীর উগ্র রূপ, কার্তিক ও গণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ। শিবজায়া হিমালয়দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলি দূর্গাপূজা। দেবী পার্বতী দেবতাদের অনুরোধে দুর্গম অসুরকে বধ করেন। তাই দেবী পার্বতী দূর্গা নামে অভিহিত হন। 
এই দুর্গম অসুর হচ্ছে রুরু অসুরের পুত্র। এই রুরু অসুরকে দেবতারা হত্যা করেছিল। সে তার প্রতিশোধ নিতে চাইল। দুর্গমাসুর ভাবলো, যে বেদের বিনিময়ে দেবতাদের কলা বাতাসা জোটে, সেই বেদকে হস্তগত করতে হবে। তাঁর জন্য সে কঠিন তপস্যা আরম্ভ করলো। শেষে ব্রহ্মা উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মা উপস্থিত হতেই, দুর্গমাসুর চার বেদের অধিকার চাইলো। ব্রহ্মা কিছুতেই দিতে রাজি হলো না। দুর্গমাসুর এরপর আরও কঠিন তপস্যা আরম্ভ করলেন। বাধ্য হয়ে ব্রহ্মা দুর্গমাসুরকে চার বেদের অধিকার দিলেন। দুর্গম বেদ সব পাতালে নিয়ে গেল। এরফলে মুনি ঋষিরা পূজার মন্ত্র সব ভুলে গেল। পূজা বন্ধ হতেই, দেবতারা চাল কলা পেল না। স্বর্গে উঠলো হাহাকার। সেই সুযোগে দুর্গমাসুর স্বর্গ আক্রমণ করে দেবতাদের বিতাড়িত করলো। দেবতারা তখন ভগবতী মহামায়ার স্তব আরম্ভ করলেন। মহামায়া তখন শতাক্ষী রূপে আবির্ভূত হলেন। শতাব্দী রূপ থেকে অষ্টাদশভূজা উগ্র দেবীমূর্তি ধারণ করলেন। বত্রিশ জন দেবী হলেন। দেবী ভাগবত পুরাণে এর উল্লেখ আছে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের শেষে বত্রিশ জন দেবীর একসঙ্গের আক্রমণে দুর্গমাসুর বধ হলেন। বধ করার পর দেবী বললেন- "দুর্গম অসুর বধ করে, আজ থেকে জগতে আমি দূর্গা নামে পরিচিত হবো।"

অসুরদের সঙ্গে দেবী দুর্গার ভীষণ যুদ্ধ চলছে। সেকালে যুদ্ধের সময় নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। এতে সৈন্যরা উৎসাহ পেতো। কেউ বাজালেন শঙ্খ, কেউ ঢাক, কেউ বাজালেন মৃদঙ্গ, কেউ রণশিঙ্গা। দেবীর বাহন সিংহও উত্তেজিত হল। সে অসুরদের ওপর লাফিয়ে পড়ল। দেবী দুর্গা, সিংহের আক্রমণে অসুর সৈন্যদের প্রায় সবাই নিহত হলো। দেবগণ আনন্দে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। 

অসুর সৈন্যদের নিহত হতে দেখে এগিয়ে এলেন মহিষাসুরের এক সেনাপতি। তার নাম চিক্ষু। চিক্ষুর সাথেও দেবী দুর্গার ভীষণ যুদ্ধ হলো। কিন্তু দেবী দুর্গার প্রচন্ড আক্রমণের কাছে ব্যর্থ হলো তার সকল প্রচেষ্টা। দেবী দুর্গা শূলের আঘাতে চিক্ষুকে বধ করলেন। এমনিভাবে অসুরদের আরও অনেক বড় বড় বীর দেবী দুর্গার হাতে নিহত হলো। 

অবশেষে যুদ্ধে এল মহিষাসুর নিজেই। ক্রোধে ক্ষোভে জ্বলে উঠলো সে। মহিষের রূপ ধরে সে যুদ্ধ করতে লাগলো। দেবী প্রচন্ড অট্টহাস্য করে আক্রমণ করলেন মহিষাসুরকে। কিন্তু মহিষাসুর অসাধারণ বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলো। অসুরেরা নানারকম মায়া ও জাদুবিদ্যা জানত। নানা প্রকার রূপ ও ধারণ করতে পারত। মহিষাসুর ও জানতো নানা প্রকার মায়া। মহিষাসুর এল হাতির রূপ ধরে। দেবী দুর্গা তলোয়ার দিয়ে হাতির শুঁড়টা দ্বিখণ্ডিত করলেন। সাথে সাথেই মহিষাসুর আবার ধরল মহিষের রূপ। দেবী দুর্গা তখন খড়্গ নিয়ে প্রচন্ড বেগে ধেয়ে গেলেন। সেই খড়্গের আঘাতে মহিষাসুরকে দ্বিখণ্ডিত করলেন। তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। নিহত হলো মহিষাসুর। অবশিষ্ট অসুরেরা এই ভীষণ দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল। 

যুদ্ধে দেবতাদের জয় হল। দেবতারা ফিরে পেলেন তাদের স্বর্গরাজ্য । আর এর প্রধান কৃতিত্ব দেবী দুর্গার।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments