জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প— আয়ারল্যাণ্ড (এস্কিমো)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প— আয়ারল্যাণ্ড (এস্কিমো)

চিন্ময় দাশ 


আগুন রঙের কঙ্কাল

অনেক কাল আগের কথা। উত্তর আয়ারল্যাণ্ডের বেল্লেক গঞ্জের কাছে বরফে ঢাকা এক গ্রাম। গ্রামে ছিল একটি অনাথ ছেলে। অনাথ মানেই গরীব। গ্রামের লোকেদের দয়ায় পেট চলত ছেলেটার। 

  এর ওর ফাইফরমাস খেটে দিত একটা রুটি বা এক টুকরো মাংসের জন্য। দেশে তো মন্দ লোকেরও অভাব নাই। একটা রুটির জন্য কেউ বা সারা দিনভর খাটিয়ে নিত ছেলেটাকে। কেউ ভিখিরী বলে টিটকারী দিত। কেউ মজা করত তাকে নিয়ে। একে অভাবী, তার উপর অনাথ এবং বয়সে নেহাতই ছোট। মুখ বুজেই সব সইতে হত তাকে। হুকুম খাটতে হত সকলেরই। 

  একদিন রাতের ঘটনা। বরফ পড়া ঠাণ্ডা রাত। একটা ঘরে বসে মজলিশ চলছে একদল লোকের। ফাই-ফরমাস খাটার জন্য রাখা হয়েছে ছেলাটাকে। হাসি-ঠাট্টায় একেবারে নরক গুলজার অবস্থা সেখানে। 

  একটা লোক হঠাৎ  ছেলেটাকে বলল—বাইরে গিয়ে দেখে আয়, আবহাওয়াটা ঠিক কেমন?

  পায়ে চামড়ার জুতো নাই ছেলেটার। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডার ভয়ে বাইরে যাওয়ার আদৌ ইচ্ছা নাই তার। 

  একজন ধাক্কা মেরে বাইরে ঠেলে দিল তাকে-- খুব তালেবর হয়েছিস বুঝি? কথা কানে যায় না?

  বাইরে থেকে ঘুরে এসে, ছেলেটা বলল—বরফ পড়াটা থেমেছে। কিন্তু জব্বর কনকনে ঠাণ্ডা। 

  যেন ভূতে পেয়ে বসল লোকগুলোকে। ছেলেটাকে নিয়ে খেলা করবার মতলব চেপে বসল তাদের মাথায়। খানিক ক্ষণ বাদে বাদেই ছেলেটাকে বাইরে পাঠাতে লাগাল তারা। এটা দেখে আয়, ওটার অবস্থা কেমন, বাইরে রাস্তার বরফ কতটা পুরু হয়েছে, ঠিকঠাক মেপে আয়—এই সব বাহানা করে, বারবার বাইরে পাঠাচ্ছে বেচারা ছেলেটাকে। 

  বাচ্চা ছেলে। বাইরে ঠাণ্ডা যেন সূচের মত বিঁধছে গায়ে। তার চেয়েও বড় কষ্ট, লোকগুলো তাকে নিয়ে এমন বীভৎস মজা করছে, হেসে গড়িয়ে পড়ছে এ ওর গায়ে। মা-বাপ মরা গরীবের অসহায় অনাথ ছেলে। মজা করতে ভারি আনন্দ হচ্ছে লোকগুলোর।

  একবার ছেলেটা তাড়াহুড়ো করে বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে বলল—উত্তরের পাহাড়ের মাথায় আগুনের গোলার মত কিছু একটা দেখলাম। এক্কেবারে পূণ্ণিমার চাঁদের মত, গোল আর উজ্বল। 

  লোকগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ল তার কথায়। বলল—এসব ছোটখাটো ব্যাপার বলিস কেন আমাদের। ভালো করে দেখে আয় তো, একটা আস্ত তিমি মাছ পাহাড়ের মাথায় চড়ে বসেছে কি না। তুই তো সূতো থেকে শাবল সবই দেখতে পাস কিনা। 

 আবার ঘর ফাটানো হাসি লোকগুলোর। 

  ছেলেটা আবার গেল বাইরে। এবারে তাড়াহুড়ো করে ফিরে এসে বলল— সিত্যি গো, আগুনের গোলাটা একেবারে আমাদের এই ঘরটার কাছে এসে পড়েছে। 

  কথা শুনে, লোকগুলো তো হেসে আকুল। কিন্তু ছেলেটা ভয়ে তড়িগড়ি করে সেখান থেকে সরে পড়ল। বাক্স-প্যাঁটরার আড়ালে গিয়ে বসে পড়ল জড়োসড়ো হয়ে। 


  বরফের ঘরের মাথায় একটা ফুটো থাকে, চামড়া দিয়ে ঢাকা। তখনই লোকগুলোর চোখে পড়ল, ভয়ঙ্কর কারও একটা চেহারা নাচছে চামড়ার ঢাকনাটার ওপর। দেখতে না দেখতে সেটা নেমে এসে হাজির হয়েছে একেবারে দরজার মুখটাতেই। একটা মানুষের কঙ্কাল। হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসছে কঙ্কালটা।

  আকস্মিক ঘটনায় বোবা হয়ে গেছে লোকগুলো। হামাগুড়ি দিয়েই তাদের একেবারে সামনে এসে হাজির হোল কঙ্কালটা। অমনি একেবারে যাদুর মত বদলে গেল ঘরের ভেতরের অবস্থা। ভেতরে ছিল আট-দশটা লোক। ভয়ে না কি কে জানে, সকলেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে কঙ্কালটার সামনে। 

  অমনি পিছনমুখে ঘুরে গেল সেই কঙ্কাল। দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। তখন কী অবাক কাণ্ড! আট-দশটা লোকও চলেছে তার পেছন পেছন। হেঁটে হেঁটে নয়। সেভাবেই হামাগুড়ি দিয়ে। দুই হাঁটু আর দুটো হাতের পাতা মেঝেতে ঠেকানো। হামাগুড়ি দিতে দিতে কঙ্কালের পিছনে চলেছে সবাই। যেন অদৃশ্য কোন সুতোয় বাঁধা হয়েছে লোকগুলো। সূতোর টানে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে তারা। 

  ঘর পেরিয়ে চৌকাট। চৌকাট পার হয়ে বাইরের রাস্তায়। রাস্তা মানে, পুরু বরফের বিছানা। দু’পাশেও উঁচু বরফের দেওয়াল। কনকনে ঠাণ্ডা। হাত আর হাঁটুগুলো যেন কেটে কেটে যাচ্ছে বরফের ছুরিতে। কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে পড়া তো দূরের কথা, থেমে যেতেও পারছে না কেউ। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা যেন তার সুরের সূতোয় বেঁধে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লোকগুলোকে।  

  চলতে চলতে গ্রাম শেষ হবার মুখে তখন। আর এগোতে হোল না লোকগুলোকে। এক এক করে সবগুলোই মারা পাড়ল ভয়ানক ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে। কঙ্কালটাকেও আর দেখা গেল না।

  সকাল হোল। গ্রামের যারা শিকারে বেরিয়েছিল, গ্রাম ছাড়াবার মুখে লোকগুলোকে পড়ে থাকতে দেখে, থমকে গেল তারা। গ্রামেরই লোক সবাই। দেখল, সবাই মারা পড়েছে। কারণটা কী? 

  বরফের উপর দাগ ধরে ধরে ঘরটার সামনে এসে হাজির হোল তারা। অনাথা ছেলেটা তখনও জড়সড় হয়ে বসে আছে ভিতরে। কাঁপছে থরথর করে। 

  গোটা গ্রাম এসে ভেঙে পড়েছে ঘরটার সামনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কথা জেনে নেওয়া হোল ছেলেটার মুখ থেকে। দল বেঁধে আবার সবাই চলল মৃতদেহগুলোর কাছে। 

  দেখা গেল, সেখান থেকে সরু একটা দাগ দেখা যাচ্ছে বরফের উপর। কৌতুহল হোল তাদের। কয়েকজন দাগটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। কিছুদূর এগিয়ে একটা পাহাড়। সেই পাহাড়ের তলাতেই গ্রামের কবরখানা। তারই একেবারে একটেরে, একটা কবরে এসে শেষ হয়েছে বারফের দাগটা। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। সবাই বিস্মিত। হোল কী ব্যাপারটা? 

  গাঁয়ের  মোড়ল ছিল দলে। সব দেখে, তার মুখে আলতো হাসি। মোড়ল বলল-- চিনতে পারছ না কেউ কবরটা। কত দিন আর? বছর আটেক হবে। এই ছেলের বাবাকেই তো পোঁতা হয়েছিল এখানে!

(জীবিত হোক কি মৃত, কোন বাবা আর নিত্যদিন তার অসহায় ছেলের এমন হেনস্থা সইতে পারে?)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

http://www.jaladarchi.com/2021/08/african-tanzania-folklore-lion-share-chinmoy-das.html


Post a Comment

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো গল্পটা।

    ReplyDelete
  2. দূর্দান্ত। অসাধারণ একটি গল্প পড়লাম। এই রূপক গল্পকথার আড়ালে নির্মম এক সত্য আছে। এত্তো ভালো লাগলো যে দু- বার পড়েই ফেললাম। অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো লেখক-কে , হোক না অন্যদেশের গল্প, এভাবে হাজির করবার জন্য। ইস্ যদি আমাদের ছোটোবেলার খুদে পাঠকরা পড়ত, ভীষণ ভালো লাগতো। জ্বলদর্চির সম্পাদক মহাশয়কে বলব ওদের জন্য এমন গল্প হাজির করবার জন্য।

    ReplyDelete