জ্বলদর্চি

ইউরোপ (ইংল্যাণ্ড)-র লোকগল্প (তিন নম্বর শূকরছানার নৈশভোজ)/ চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ইউরোপ  (ইংল্যাণ্ড)
তিন নম্বর শূকরছানার নৈশভোজ 

চিন্ময় দাশ 
 
অনেক অনেক কাল আগের কথা। কত কাল আগের কেউ বলতে পারে না। তখন শূকরছানারা ছড়া বলত। তামাক চিবাত হনুমানের দল। আর মোরগ-মুরগি নাকে নস্যি টানত গতরে শক্তি হবে, এই আশায়। এমনই ছিল দিন কাল। 

  তিনটি ছানা এক শূকরীর। কী নধর চেহারা বাচ্চাগুলোর! আর ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। কিন্তু একটু বড় হতে, বাচ্চাগুলোকে খাওয়ার জোগাবার ব্যবস্থা করতে পারছে না মা। তখন একদিন বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়ে মা বলল—যাও বাছারা, নিজেরাই এবার দুনিয়ার হালচাল বুঝে নাও। নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো।

  প্রথম বাচ্চাটা চলতে চলতে একজন লোকের সাথে দেখা। লোকটা তার খামারে ফসল মাড়াই করছিল। শূকর গিয়ে বলল— ঘরদোর নাই আমার। এক আঁটি খড় দেবে আমাকে? ঘর বানাবো। 
লোকটা না করল না। তার কাছ থেকে খড় নিয়ে নিজের জন্য একটা ঘর বানাল ছানাটা। 

  হয়েছে কী, একটা নেকড়ে ছানাও শিকার শিখছে আজকাল। সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় শিকারের খোঁজে। সেই নেকড়ের চোখে পড়ে গেল ছানাটা।
একদিন সোজা শূকরছানার ঘরে এসে হাজির হয়ে গেল নেকড়ে। দরজায় টোকা দিয়ে বলল—শূকরছানা, শূকরছানা। একটু ভেতরে আসতে দেবে আমাকে? 
ছানাটা বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। জোর গলায় বলল—না, না। কোন মতেই না।

  --রাগিও না বলছি আমাকে। নেকড়ে বলল—আমার এক ফুঁয়ে উড়ে যাবে তোমার এই ঘর।
সত্যি সত্যিই জোরে একটা ফুঁ দিল নেকড়াটা। ঘরের ছাউনি উড়ে গিয়ে পড়ল দূরে। কচমচ করে ছানাটাকে চিবিয়ে খেয়ে নিল নেকড়ে। 
দ্বিতীয় ছানাটাও বেরিয়েছে পথে। একটা লোকের সাথে  দেখা। মাঠের আল থেকে ফার্জের ঝোপ কাটছে সে। ছানাটা গিয়ে বলল—এক আঁটি গাছ দেবে আমাকে? শীত আসছে। ঘর বানাব এ দিয়ে।
লোকটা আপত্তি করল না। নিজের মত একটা ঘরও বানিয়ে নিয়ে ছানাটা।

  নেকড়েটা এর কাছেও এসে হাজির—ছোট্ট বন্ধু আমার। একটু ভেতরে আসতে দেবে আমাকে? 
ভয় পেয়েছে ছানাটা। বলল—না, কোন মতেই না। সরে পড়ো এখান থেকে। 
--আমাকে রাগিও না বলছি। আমার এক ফুঁয়ে কোথায়  উড়ে যাবে তোমার এই ঘরবাড়ি। 
বলে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল নেকড়ে। ঘরের ছাউনি উড়ল। দেওয়াল উড়ল। শূকরছানাটা তখন দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষাৎ যমের সামনে। 

  দেরীর কোন কারণ নাই। কচমচ করে খেতে লেগে গেল নেকড়ে।
ছোট ছানাটা বেরিয়েছে পথে। তার সাথে দেখা হোল একটা লোকের সাথে, ইট গেঁথে ঘর বানাচ্ছে সে। শীতের ঠাণ্ডার কথা বলে, তার কাছ থেকে কতকগুলো ইট নিয়ে এল সে। এবার ঘর বানাল ভারি মজবুত করে। 
নেকড়ে ছিল তক্কেতক্কে। ঠিক এসে হাজির হোল একদিন। বলল—বাড়ি আছ নাকি, বন্ধু। একটু ভেতরে যেতে দাও। 

  ছোট ছানাটা বলল— ওটি হচ্ছে না। চালাকি আমার সাথে চলবে না। কেটে পড়ো। 
নেকড়ে রাগের গলায় বলল—আমাকে রাগিও না। ফল ভালো হবে না তাতে। এক ফুঁয়ে উড়িয়ে তোমার সাধের ঘর। 
--তাই নাকি? রেগে যাবে, আবার ফুঁ দিয়েই ঘর উড়িয়ে দেবে? বাহ, বেশ ভালো কথা। দ্যাখো, পারো কি না। 
ফোঁস-ফাঁস, হুস-হাস অনেক কসরত করেও কিছু করতে পারল না নেকড়ে। কিন্তু বাচ্চা হলেও, জাতে নেকড়ে সে। হাল ছাড়বার পাত্র নয়। 

  রাগ নয়, হুমকি নয়, গলা একেবারে খাদে নামিয়ে নেকড়েটা বলল—কী আর করা যাবে। আর কাউকে বলি গিয়ে। অমন নধর নধর শালগমের খেত। একা একা কি আর সাবাড় করতে ভালো লাগে? 
শালগমের কথায় শূকর ছানাটার মাথা গেল ঘুরে। নেকড়ে যে শালগম খায় না, সেসব ভাবনা তার মাথায় নাই। জিভে জল এসে গেল। চেঁচিয়ে বলল—কোথায় গো শালগমের বাগানটা? 

  নেকড়ে বলল—সেকথা বলতেই তো আগ বাড়িয়ে এসেছিলাম। গাঁয়ের শেষ মাথায়, এক চাষির খেতে দেখে এলাম শালগমগুলো। যেতে চাও, তো বলো। নইলে, অন্য কাউকে ডেকে নিয়ে যাব। 
--আরে কেন যাবো না? যাবোই তো। 
--তবে, এখন তো বেলা হয়ে গেছে। আজ আর হবে না। কাল সকালে তৈরি থেকো। আমি এসে তুলে নিয়ে যাব  তোমাকে। 
--সকালে কখন?
--বেলা করে লাভ নেই। সকাল ৬টায় তৈরি থেকো। বলে চলে গেল নেকড়ে। আসলে নেকড়ের মাথায় ফন্দী খেলছে। ভালো করে আলো ফুটবার আগেই সাবাড় করব ব্যাটাকে। 
শূকরছানাটা ছোট হলে কী হবে, ভারি সেয়ানা। সে করেছে কী, ৫টাতেই বেরিয়ে, শালগমের খেতে চলে গেছে। ৬টা বাজবার আগেই ফিরে এসে ঘরে ঢুকে পড়েছে।

  ঠিক সময়ে নেকড়ে এসে হাজির—কী বন্ধু, তৈরি তো? 
ছানাটা ভেতর থেকেই বলল—তৈরি মানে? আমি সেই কখন উঠে । ভর পেট খেয়ে ফিরে চলে এলাম। তুমি এতক্ষণে এলে? 
  নেকড়েও কম চালাক নয়। সে বলল—আরে ভায়া,  শালগমে তো কেবল পেট ভরে। কিন্তু মন ভরে কি? 
ছানাটা বলল— তাহলে, কীসে মন ভরে? 
নেকড়ে ফিসফিস করে বলল—আরে বন্ধু, আপেল বাগানটার কথা তো বলাই হয়নি তোমাকে।
শূকর জানতে চাইল—সেটা কোথায়? 
--আরে, ঐতো, নদীর গা ঘেঁষে। পাদ্রী সাহেবের বাগান ওটা। তোমার একলা চলে যাওয়ার দরকারটা কী। আমি ঠিক ৫টাতেই চলে আসব। তৈরি থেকো।
চারটে বাজে তখন। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে, পাদ্রী সাহেবের বাগানে হাজির হয়ে গেল শূকর। তারিয়ে তারিয়ে খেলও বেশ কয়েকটা পেট ভরে। 
সবে নেমেছে গাছ থেকে, নেকড়ে এসে হাজির। বলল—তুমি আগেভাগেই এসে গেছ, বন্ধু!
  শূকরছানা হতাশের গলায় বলল—এসে আর লাভটা কী হোল? কুড়োবার লোক সাথে না থাকলে, একা একা কি আর আপেল পাড়া যায়? তাই তোমার জন্য বসে আছি। 

  নেকড়ে মনে ভাবল, এখুনি এটাকে খেয়ে ফেললে, আপেল পাড়া যাবে কী করে? আগে আপেল পেড়ে রাখা  যাক। তারপর মাংস দিয়ে, ব্রেকফাস্ট সারা যাবে। 
 এদিকে ছানাটার মাথায় অন্য ফন্দী। শয়তানটাকে বোকা বানিয়ে সরে পড়তে হবে কোন রকমে। গাছে উঠে আপেল পাড়তে শুরু করে বলল—আমি ফেলছি এক একটা করে। কুড়িয়ে জড়ো করো এক জায়গায়। ধীরে সুস্থে করো। বেশি ছোটাছুটির দরকার নাই। 
একটা আপেল ফেলল, নেকড়ে কুড়িয়ে রাখল সেটা। দ্বিতীয়টা ফেলল, কুড়িয়ে আনল নেকড়ে। তিন নম্বরটা পড়ল একটু দূরে। ঢালের মাথায়। ইচ্ছা করেই সেদিকে ফেলেছে শূকর। 

  নীচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে ফলটা। নেকড়ে চলল সেটার পিছুপিছু। সেই সুযোগে এক লাফ। গাছ থেকে নেমেই সরে পড়ল ছানাটা। 
রাগ চড়ছে নেকড়ের মাথায়। একবারও বাগে আনা যাচ্ছে না হতচ্ছাড়াটাকে। বার বার ফসকে যাচ্ছে। আবার পরদিন এসে হাজির হোল নেকড়ে। 
--বিকেলে মেলা বসছে পাহাড়তলিতে। যাবে না কি, বন্ধু?
--মেলা বসছে, আর যাবো না? কখন যাবে, বলো। 
নেকড়ে বলল—ঠিক ৩টায় এসে যাব আমি।
শূকরছানাটা আজ ভেবে নিয়েছে, এমন শত্রুকে নিয়ে বেশি দিন সামলানো যাবে না। যেভাবেই হোক, নিকেশ করতে হবে বাছাধনকে। দুপুর না হতেই, মেলায় গিয়ে হাজির হোল সে, মেলাটা দেখল ঘুরে ঘুরে। শেষে বড় দেখে ডেকচি কিনল একটা।

  এদিকে হয়েছে কী, নেকড়ে তার রাস্তা বদল করেছে আজ। আজ আর শূকরছানার বাড়ি না গিয়ে, সোজা মেলার পথ ধরেছে। প্রতিদিন ব্যাটা আগেভাগে পৌঁছে বোকা বানিয়ে দেয়। আজ আমি গিয়ে বসে থাকব ওর জন্য।

  সবে ডেকচি নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়েছে শূকর, অমনি দেখল নেকড়ে আসছে হনহন করে। পিলে চমকে গেল ছানাটার। আজ আর রেহাই নাই। কী করা যায় এখন? নেকড়েটার পাশ দিয়েই যেতে হবে তাকে। একটাই তো রাস্তা। 

  তড়িঘড়ি একটা বুদ্ধি এসে গেল মাথায়। ডেকচিটাকে আড়মুখ করে শুইয়ে, কোন রকমে ঢুকে পড়ল তার ভিতর। ঢুকেই আলতো করে একটা ঠেলা। গড়্গড় করে গড়িয়ে নীচে নামতে লাগল গোল পাত্রটা। 

  নেকড়ে তখন এগিয়ে আসছে সেই পথেই। গোলাকার একটা বস্তু ঘড়ঘড়িয়ে তার দিকে এমন তেড়ে আসছে কেন? বেদম ঘাবড়ে গিয়ে, লাফ দিয়ে খানিক তফাতে সরে গেল নেকড়ে বাবাজী। জিনিষটা পেরিয়ে যেতে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। 

  কী হতে পারে এই অদ্ভূত জিনিষটা? মনটা খচখচ করতে লাগল। মন বসল না মেলায়। শূকরছানার টিকিটাও দেখা গেল না। মনে ভার নিয়ে মেলা ছেড়ে ফিরতি পথ ধরল নেকড়ে। 

পথে ভাবল, একবার দেখে যাই, ব্যাটা ঘরে আছে কি না। শূকরছানার ঘরে এসে হাজির হোল সে। 
ছানাটা অনুমান করেই রেখেছে, মেলায় দেখতে না পেয়ে, নেকড়ে আসবেই এখানে। বড় একটা উনুন জ্বেলে, তাতে ডেকচিতে জল গরম করছে সে। 
নেকড়ে এসে হাজির হয়েছে। বাইরে থেকে হাঁক দিল—বাড়ি আছো না কি, বন্ধু? 
--আছিই তো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো। বলেই ডেকচিতে ঢাকনা চাপিয়ে, তার উপর চড়ে বসে রইল শূকর। 

নেকড়ে ভিতরে এসেছে। মন থেকে আজব জিনিষটার ভাবনা সরাতে পারছে না। শূকরকে বলেও ফেলল মনের কথা—মেলায় না গিয়ে, নিজের ঘরেই আছো, খুব ভালো কাজ করেছ তুমি। 

  শূকর বলল—কেন গো? একথা বলছো কেন?
নেকড়ে বলল—আর বলো কেন? কী এক আজব জিনিষ হাজির হয়েছে সেখানে। গোলাকার একটা জিনিষ। আমাকে তো তেড়েই আসছিল সেটা। কোন রকমে সরে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি। বুক ধড়ফড় করছে এখনও। ভাগ্যিস যাওনি তুমি।

  ডেকচির উপর গ্যাঁট হয়ে বসে আছে শূকরছানা। হো-হো করে হেসে বলল—কে বলে আমি মেলায় যাইনি। মেলায় গিয়েছি। এই ডেকচিটা কিনেছি। ডেকচির ভিতরে বসে, আমিই তো এলাম গড়িয়ে গড়িয়ে। এটা কিনলাম মাখন দিয়ে আপেল রান্না করবো বলে। আপেল সেদ্ধ হয়ে এল বলে। একটু বসে যাও। তুমি খেয়ে দেখবে, কেমন সুস্বাদু খাবার। 

  -- তার মানে, তোর ভয়ে আমি মরছি তখন থেকে? দাঁড়া হতভাগা। তোকে খেয়েই স্বাদ মেটাচ্ছি আজ। বলেই এক লাফ শূকরছানাটাকে ধরবে বলে। ছানাটা আগে থেকেই জানত, এমনটা হবে। ফাঁদটা তো তারই পাতা। 

  যেই না নেকড়ে লাফ দিয়েছে, অমনি ঢাকনা নিয়ে টুক করে নীচে লাফিয়ে নেমে এল সে। আর নেকড়ে পড়ল গিয়ে ফুটন্ত জলের মধ্যে। তাড়াতাড়ি আবার ঢাকনাটা চাপা দিয়ে দিল শূকর। সেদ্ধ হোক ভালো করে। 
সেদিন রাতের ভোজটা বেশ জমেছিল শূকরছানার। আর, সেদিন থেকে জীবনও কাটছে বেশ নিশ্চিন্তে। কেউ এসে আর কড়া নেড়ে জানতে চায় না—ভেতরে আসব না কি?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments