জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-১/প্রীতম সেনগুপ্ত


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত 

পর্ব ১

শুরুর কথা


স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ - ভক্তমালিকা’ গ্রন্থের ভূমিকায় স্বামী মাধবানন্দজী লিখেছেন--“শ্রীভগবান্ যখন জগতে অবতীর্ণ হন তখন তাঁহার দুইটি মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। প্রথম--যুগ প্রয়োজন অনুসারে ধর্মের গ্লানি-অপনোদন, দ্বিতীয়-- রসাস্বাদন। এই উভয় কার্যের সহায়করূপে তিনি বিশেষ বিশেষ যোগ্য পাত্রকেও ধরাধামে আনয়ন করেন। ইঁহারা বিভিন্ন স্থানে জন্মগ্রহণ করিলেও যথাসময়ে তাঁহার সহিত মিলিত হন এবং তাঁহার কৃপায় অচিরে নিজ নিজ স্বরূপ ও তাঁহার সহিত তাঁহাদের চিরন্তন সম্বন্ধ অবগত হন। এইরূপে তাঁহারা নিজেরা তো কৃতকৃত্য হনই, অধিকন্তু শ্রীভগবানের পূর্বোক্ত দ্বিবিধ লীলাপুষ্টির সহায়কও হন। ইহাদের মধ্যে কেহ তাঁহার অঙ্গ, কেহ উপাঙ্গ, কেহ বা তাঁহার পার্ষদাদি। ভগবান্ যতদিন স্থূলদেহে সংসারে বিরাজমান থাকেন, ততদিন ইঁহারা তাঁহাকে লইয়া আনন্দ করিয়া থাকেন ও সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাকেও আনন্দ দেন এবং তাঁহার উপদেশ-অনুসারে নিজ নিজ ধর্মজীবন গঠন করেন। পরে ভগবান্ স্থূলশরীর ত্যাগ করিলে ইঁহারা তাঁহার আরব্ধ লোককল্যাণকার্যে আত্মনিয়োগ করিয়া যথাকালে স্ব স্ব ধামে প্রয়াণ করেন।”(শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা--স্বামী গম্ভীরানন্দ) 

                              

   বলা বাহুল্য ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবনলীলাকে উপলক্ষ করেই উপরোক্ত রচনা। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ষোলোজন ত্যাগী সন্ন্যাসী সন্তানদের জীবন নিয়ে পর্যালোচনায় প্রয়াসী  হওয়ার অবকাশে নিতান্ত সত্যটি জানাই যে এর ভিত্তি তাঁর প্রতি এক অতি দুর্বল মানবের ততোধিক দুর্বল ভক্তির সোচ্চার ঘোষণা। একে ‘অতি সাহস’ বললেও কম বলা হয়। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার বাসনা। কিন্তু একটা কথা ভীষণ জরুরি যে, এঁদের জীবন নিয়ে ভাবনা চিন্তা চর্চা আখেরে মনের গতিকে উর্ধ্বমুখী করে তোলে। চন্দন ঘষলে যেমন সুগন্ধ নির্গত হয়, তাঁদের জীবনালোচনা আমাদের মতো অতি ক্ষুদ্র জীবকেও অনাস্বাদিত আনন্দের ভুবনে পৌঁছে দেয়। আর দেবে নাই বা কেন,তাঁরা তো সকলেই অবতারলীলার সহায়ক, পূর্বনির্দিষ্ট জন। আর এই সবের মূলে বিরাজমান পরমপুরুষ তিনিই--শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর প্রধানতম সন্ন্যাসী সন্তান স্বামী বিবেকানন্দ স্বকীয় ভাষায় একটি চিঠিতে লিখেছেন এইরকম--“ভায়া,রামকৃষ্ণ পরমহংস যে ভগবানের বাবা, তাতে আমার সন্দেহমাত্র নাই।... দাদা, বেদ- বেদান্ত,পুরাণ-ভাগবতে যে কি আছে, তা রামকৃষ্ণ পরমহংসকে না পড়লে কিছুতেই বুঝা যাবে না।  His life is a searchlight of infinite power thrown upon the whole mass of Indian religious thought. He was the living commentary to the Vedas and to their aim. He had lived in one life the whole cycle of the national religious existence in India.” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয়) 

           

                    

  আর তাঁর শুদ্ধসত্ত্ব ত্যাগী বৈরাগ্যবান সন্তানদের বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ কী বলেছেন ? তিনি নরেন্দ্রনাথকে হোমাপাখির সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন --“এই ছেলেটিকে দেখছ, এখানে একরকম। দুরন্ত ছেলে বাবার কাছে যখন বসে, যেন জুজুটি, আবার চাঁদনিতে যখন খেলে তখন আর এক মূর্তি। এরা নিত্যসিদ্ধের থাক। এরা সংসারে কখনও বদ্ধ হয় না। একটু বয়স হলেই চৈতন্য হয়, আর ভগবানের দিকে চলে যায়। এরা সংসারে আসে জীবশিক্ষার জন্য । এদের সংসারের বস্তু কিছু ভাল লাগে না--এরা কামিনীকাঞ্চনে কখনও আসক্ত হয় না।

  বেদে আছে হোমাপাখির কথা। খুব উঁচু আকাশে সে পাখি থাকে। সেই আকাশেতেই ডিম  পাড়ে। ডিম পাড়লে ডিমটা পড়তে থাকে-- কিন্তু এত উঁচু যে, অনেকদিন থেকে ডিমটা পড়তে থাকে। ডিম পড়তে পড়তে ফুটে যায়। তখন ছানাটা পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে তার চোখ ফোটে ও ডানা বেরোয়। চোখ ফুটলেই দেখতে পায় যে, সে পড়ে যাচ্ছে, মাটিতে লাগলে একেবারে চুরমার হয়ে যাবে। তখন সে পাখি মার দিকে একেবারে চোঁচা দৌড় দেয়, আর উঁচুতে উঠে যায়।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম কথিত, উদ্বোধন কার্যালয়) 

            বস্তুতপক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা ছিলেন স্বকীয় ভাব বৈশিষ্ট্যে একেকজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। ভাবতে অবাক লাগে  ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ জুড়ে যে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক প্লাবন ঘটেছিল এই কলকাতা শহরে তার কথা। এর তুলনা মেলা ভার। পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক দশকগুলিতেও যার রেশ বজায় ছিল পরিপূর্ণরূপে। এইসব মহাপুরুষেরা তখন সশরীরে বিরাজ করেছেন এই ধরাধামে। অবতার বরিষ্ঠের ষোলোজন সন্ন্যাসী সন্তানেরা হলেন-- স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী যোগানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী নিরঞ্জনানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, স্বামী অদ্ভুতানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ, স্বামী অদ্বৈতানন্দ, স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ, স্বামী অখণ্ডানন্দ, স্বামী সুবোধানন্দ ও স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। এঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজন ঈশ্বরকোটি ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের মূল ধারক বাহক ছিলেন এই ষোলোজন শক্তিমান মহাপুরুষ। তাঁদের অত্যাশ্চর্য জীবনকাহিনি অনুপ্রেরণামূলক।  ভারতের সনাতন ভাবনার গভীরতম সত্তার অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়কর অনুরণন ঘটতে দেখা গিয়েছে এঁদের জীবনে। শ্রীরামকৃষ্ণের মতোই তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানেরাও ছিলেন একেকজন আলোর দিশারী। 

     এই প্রসঙ্গে বলি, স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধানতম শিষ্য সন্তান হলেও আমরা জীবনালোচনা পর্বগুলি শুরু করব লাটু মহারাজ অর্থাৎ স্বামী অদ্ভুতানন্দর জীবনকথায়। তাঁর অত্যাশ্চর্য জীবনকথা শ্রীরামকৃষ্ণের অপার মহিমাই প্রকাশ করে। শ্রীরামকৃষ্ণ হলেন সেই বাগানের মালি যাঁর কৃপাপুষ্ট লালন পালনে স্বর্গীয় কুসুমরাজি প্রস্ফুটিত হয়। তেমনই এক স্বর্গীয় পুষ্প স্বামী অদ্ভুতানন্দ। তিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মিরাকল(miracle)। অনন্ত ভাবময় ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছামাত্র কী না করতে পারেন ! এক লহমায় তা ফলবতী হয়। অদ্ভুতানন্দজীর জীবনকথা পাঠ করলে সম্যকভাবে বোঝা যায় সে কথা। সেই অসামান্য জীবনালেখ্য বর্ণনায় প্রয়াসী হব পরবর্তী পর্বে। আলোচনা পর্বগুলিতে আমরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব, শ্রীশ্রীমা ও স্বামী বিবেকানন্দের নাম যথাক্রমে ঠাকুর, শ্রীমা ও স্বামীজীরূপে উল্লেখ করব। শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানেরা যোগ ও ভাবাদর্শের প্রত্যেকেই অনন্য। কে বড় কে ছোট সেই বিচার করা মূর্খামির নামান্তর। শুধু ত্যাগী সন্তানরাই বা কেন, গৃহীভক্ত বা স্ত্রী ভক্তদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সকলেই তাঁর অসীম করুণা লাভ করেছিলেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিকারের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে হয়--

            ভক্তমধ্যে ছোট বড় জ্ঞান হয় ভ্রম,/সকলে আমার পূজ্য বুঝিবে এমন।/ছোট বড় বিচারেতে নাহি অধিকার।/সকলে বুঝিবে রামকৃষ্ণ পরিবার।। 

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments