জ্বলদর্চি

পশ্চিম সীমান্তে সব শান্ত /বিজন সাহা

   

পশ্চিম সীমান্তে সব শান্ত 

বিজন সাহা 

এরিখ মারিয়া রেমার্ক লিখেছিলেন “পশ্চিম সীমান্তে সব শান্ত।” কিন্তু বর্তমানে রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্ত অসম্ভব রকমের অশান্ত। দনবাসের উপর যুদ্ধের খাড়া ঝুলছে। মিনস্ক চুক্তি কিছুটা হলেও এক ধরণের স্ট্যাটাস কো ধরে রেখেছিল, বর্তমানে বাইডেন প্রশাসন ইউক্রাইনে নতুন করে অস্ত্র সরবরাহ ও ব্ল্যাক সীতে রণতরী মোতায়েন করায় অবস্থা নাজুক। এর উপর আছে বেলারুশ-পোল্যান্ড সীমান্তে শরণার্থী সমস্যা। 

গ্রীন এনার্জি নিয়ে পশ্চিম ইউরোপের মিসক্যাল্কুলেশন কাম অন্ধবিশ্বাস সেখানে যে জ্বালানী সংকট তৈরি করেছে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এসব মহড়া কিনা কে জানে? পৃথিবীর ইতিহাস ভুলে ভরা। কোন কোন দেশ সেটা স্বীকার করতে পারে, কোন কোন দেশ পারে না। স্তালিনের ভুলের কথা সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসেই স্বীকার করেছিল, যদিও অনেকেই সেটাকে ভাবে ক্ষমতার জন্য খ্রুশেভের উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এর পরে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানো নিয়েও এ দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সমালোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে, হচ্ছে। জার্মানি ফ্যাসিবাদের সমালোচনা করেছে। তবে পৃথিবীর খুব কম দেশই নিজেদের সমালোচনা করতে পারে, ভুল স্বীকার করতে পারে। আমেরিকা স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের প্রায় নির্মূল করার জন্য অনুশোচনা করেছে বলে জানা যায়নি। একই কথা বলা যায় ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও। বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পেছনে সিআইএর জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলেও ভুল স্বীকার করেনি আমেরিকা। এমনকি ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়ায় তাদের কারণে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেলেও এ নিয়ে কোন রকম অনুশোচনা তারা করেনি। বরং বলেছে আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তাদের কখনোই ছিল না। আর যখন কোন মানুষ বা দেশ নিজের ভুল স্বীকার করতে চায় না তখন সে বলির পাঁঠা খোঁজে। 

ইউরোপে যে জ্বালানী সংকট তাতে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ হাত নেই। রাশিয়া চুক্তিমত গ্যাস সরবরাহ করছে। সাপ্লাই বাড়ানোর জন্য নর্থ স্ত্রীম তৈরি করেছে, যেটা অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক এবং পরিবেশ বান্ধব। কিন্তু ইউক্রাইনের কার্ড খেলে পশ্চিমা বিশ্ব সেটা চালু করতে দিচ্ছে না আর একই সঙ্গে রাশিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে। যখন ইউক্রাইনে আর বাল্টিকের দেশগুলোয় রুশ ভাষাভাষীদের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে ইউরোপ আমেরিকা চুপ করে থাকছে, অথচ এরাই নাকি মানবাধিকারের হোলসেল লাইসেন্সধারী। আর এর ফলে কষ্ট পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাশিয়ায় থাকি বলে নয়, বাংলাদেশে জন্ম বলে ভাষার ব্যাপারে আমি একটু বেশি সংবেদনশীল। তাই যখন কোন দেশে মানুষের মাতৃভাষার উপর আঘাত আসে সেটা সমর্থন করতে পারি না। আরও একটা কথা, ২০১৪ সালের আগে বেশ কয়েকবার ক্রিমিয়ায় গেছি। সেখানে অধিকাংশ লোকজন নিজেদের রাশিয়ার নাগরিক বলেই মনে করত। আর সে কারণেই নির্বাচনে তারা ইউক্রাইনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। জানি, পশ্চিমা বিশ্ব সেটা বিশ্বাস করে না, কারণ এটা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। এরা কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেও আমাদের পক্ষে ছিল না। তাহলে কি বুঝতে হবে আমাদের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন মিথ্যা ছিল? বাহান্ন আর একাত্তরের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়া বাঙালি জাতির তো এ বিষয়ে ভুল করার সুযোগ নেই।  

কী আমেরিকা, কী ইউরোপ বর্তমানে বিভিন্ন রকম আভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি করে সৈন্য অপসারণ করে বাইডেন প্রশাসন সমালচনার মুখে। আর সে কারণেই ইউক্রাইনকে ঘিরে এই নাটক। বেলারুশে শরণার্থী নিয়ে যা ঘটছে সেটা অকল্পনীয়। বেলারুশকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব অনেক দিন থেকেই  দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। না, কারণ এটা নয় যে বেলারুশের জনগণের জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে। আসলে বিশ্বের কোন প্রান্তের মানুষের জন্যই তাদের কোন দরদ নেই, যা আছে সেটা তাদের স্বার্থ, ভূ-রাজনৈতিক যোগ বিয়োগের হিসাবনিকাশ। মানুষের কল্যাণই যদি উদ্দেশ্য হত, তাহলে একের পর এক দেশ ধ্বংস করে সেখানে অরাজকতা তৈরি তারা করত না। তবে এক্ষেত্রে তারা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী স্থানীয় রাজনীতিবিদরা। অপেক্ষাকৃত মারজিনাল লোকজনকে নিয়ে তারা নিজেদের পয়সার রাজনৈতিক দল গড়ে তোলে। কারণ একটাই, তাতে এই সমস্ত লোকগুলো তাদের কন্ট্রোলে থাকে। এরপর বিভিন্ন ভাবে এদের দিয়ে স্থানীয় আইন ভঙ্গ করিয়ে গোটা রাজনৈতিক পরিবেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে চায়। বেলারুশের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটেছে, ঘটেছে ইউক্রাইনের ক্ষেত্রে। এখানে শুধু বিরোধী দলই নয়, সরকারি দলের অনেকেই জড়িত ছিল। আসলে মীর জাফর খুঁজতে অ্যাংলো-স্যাক্সদের জুড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো নিজেও তাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। এটা নতুন কিছু নয়। দুই দিক থেকে লাভ করতে গেলে এমনটাই ঘটে। যখন রাশিয়া তাঁকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে অস্বীকার করেছে তখন তিনি গেছেন পশ্চিমাদের কাছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হয় আক্কেল ফিরে এসেছে। আর এ কারণেই ক্ষমতা হারাতে হারাতে ধরে রাখতে পেরেছেন। না, ব্যাপারটা এই নয় যে লুকাশেঙ্কো নির্বাচনে হেরে যেতেন। কিন্তু আমরা সবাই জানি ইউশেঙ্কো ইনুকোভিচের কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয়েও পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে  তৃতীয় রাউন্ডে নির্বাচন করে ইউক্রাইনের প্রেসিডেন্ট হন। যাই হোক, সময় মত ভুল বুঝে লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার বলয়ে ফিরে আসেন। পশ্চিমা বিশ্ব এতে ক্ষুব্ধ, কেননা এভাবে সে বেলারুশকে একেবারেই হারাল। 

আসলে ২০১৪ সালের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব যতই রাশিয়াকে দমাতে চেষ্টা করছে, সে ততই শক্তিশালী হয়েছে, হচ্ছে। সোভিয়েত উত্তর রাশিয়ার প্রধান ভুল ছিল পশ্চিমা বিশ্বের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া। গাইদার সহ অনেকেই বলতেন যে জিনিস ইউরোপ আমেরিকায় কিনতে পাওয়া যায় সেটা দেশে উৎপাদন করে দরকার কি? ফলে রাশিয়ার শিল্প ও কৃষি ধ্বংসের পথে দাঁড়ায়। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে তাকে নিজের অস্তিত্বের জন্যই ঘর সামলাতে হয়। এখন সে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রায় সব দিকেই অনেক বেশি সুরক্ষিত। আর লুকাশেঙ্কোর এই ইউ-টার্নের কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব লুকাশেঙ্কোর উপর যার পর নাই নাখোশ। শুরু হয় অতি পরিচিত নিষেধাজ্ঞার খেলা।      

উল্লেখ করা যেতে পারে যে বেলারুশ আর রাশিয়ার বাগদান পর্ব শেষ হয়েছে ইয়েলৎসিনের আমলে, গত শতাব্দীর নব্বুইয়ের দশকে। তখন লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। ইয়েলৎসিন তখন নিজের জনপ্রিয়তার অভাবে সে পথে যাননি ইউনিয়নের প্রধান হিসেবে লুকাশেঙ্কো জিতে যেতে পারেন সেই আশংকায়। রাজনৈতিক আকাশে পুতিনের আগমনের পর সব বদলে গেছে, লুকাশেঙ্কো পিছুটান দিয়েছেন দ্বিতীয় পাইলট হিসেবে চলতে চান না বলে। তাছাড়া নতুন ইউনিয়নে বেলারুশ কি রাশিয়ার সমকক্ষ থাকবে নাকি ছোট ভাইয়ের রোল প্লে করবে সেটাও প্রশ্ন। বর্তমানে এরা দুটো আলাদা দেশ বিধায় ফর্মালি সমান। ইতিমধ্যে রাশিয়া অনেক বেশি শক্তিশালী আর বেলারুশ অনেক বেশি অন্যদের উপর নির্ভরশীল। সব মিলিয়ে নব্বুইয়ের দশকে যে মিলন ছিল মেঘমুক্ত, এখন সেটা অনেক জটিল। পশ্চিমা বিশ্ব এত সহজে রাজি হবেনা এই মিলনে। অন্য দিকে এখন না হলে কখনও হবে কিনা সেটাও প্রশ্ন, কারণ এ ধরণের ঘটনা সম্ভব শুধু প্রচণ্ড জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপস্থিতিতে। বেলারুশ সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। লুকাশেঙ্কোর একদিকে যেমন দরকার অল্প মূল্যে রাশিয়ার তেল গ্যাস, অন্যদিকে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের পারস্পরিক বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও এই লুকাশেঙ্কোই পোল্যাণ্ডসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে অল্প দামে ফল ও মাংস কিনে মেড ইন বেলারুশ ছাপ দিয়ে রাশিয়ায় চালান দিতেন। যাকে বলে ডাবল এজেন্ট। এই খেলায় ইনুকোভিচ হেরে ক্ষমতাচ্যুত হন, লুকাশেঙ্কো  যাই যাই  করেও টিকে থাকতে সমর্থ হন।
 তবে এটা না রাশিয়ায় না পশ্চিমা বিশ্বে – কোথাও ভাল চোখে দেখা হয় না। সমস্যা হল লুকাশেঙ্কো যত না প্র্যাগমাটিক তার চেয়ে বেশি লোভী। ফিনল্যান্ড প্র্যাগমাটিক তাই সে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া দু পক্ষের সাথেই ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়েই। পোল্যান্ড, ইউক্রাইন, জর্জিয়া, মালদোভা, বাল্টিক দেশগুলো এই নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে দু' দিক থেকেই লাভবান হত। ট্র্যানজিট থেকে ইনকাম যেমন হত, তেমনি হত রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি থেকে। এখন তাদের একমাত্র পণ্য আমেরিকা ও ন্যাটোর কাছে রুশ ফোবিয়া বিক্রি করা।

বিগত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার জের হিসেবে সে দেশের এয়ারলাইন্স বেল-আভিয়া ইউরোপে নিষিদ্ধ। ফলে তারা মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট বাড়িয়েছে। কারণ নিজেদের বিমান বাঁচিয়ে রাখার এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমরা জানি সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই এশিয়া, আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার অনেক লোকজন রাশিয়া,  ইউক্রাইন ও বেলারুশকে ইউরোপের প্রবেশ পথ হিসেবে ব্যবহার করে। এমন কি অনেকেই এখানে পড়াশুনা করতে এসেও সুযোগ বুঝে পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমায়। এই সুযোগই গ্রহণ করেছে ইরাক, আফগানিস্তানের অনেকেই। বিশেষ করে জার্মানি যখন এসব দেশের শরণার্থীদের গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়। পরে সব কাজ হয়েছে বাজার অর্থনীতির নিয়মে। এসব লোকের প্রয়োজন ছিল ইউরোপে ঢোকার, আর বেলারুশের দরকার ছিল বেল-আভিয়া বাঁচিয়ে রাখার। এতদিন এভাবেই সব চলছিল, অনেকটা বাংলাদেশে ইন্ডিয়া থেকে গরু পাচারের মত। সাধারণত সব জেনেও সবাই অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কখনও কখনও কোন প্রয়োজনে এ দিকে নজর দেয়। ফলাফল – কাঁটাতারে মানুষের মৃত দেহ। এই শরণার্থীদের লক্ষ্য ছিল জার্মানি, কেউই পোল্যান্ড বা বাল্টিকের দেশগুলোতে থাকতে চায়নি। তাই তারা চাইলেই চোখ বন্ধ করে থাকতে পারত। এমনকি জার্মানি রাজি ছিল নিজেরাই এদের গ্রহণ করে নিয়ে আসতে। কিন্তু পোল্যান্ড বা বাল্টিকের দেশগুলোর দরকার অস্থিরতা, কারণ এ ভাবেই তারা নর্থ স্ট্রীমের অনুমোদনে বাধা দিতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নর্থ স্ট্রীম চালু হলে পোল্যান্ডও লাভবান হবে। কিন্তু রাজনীতি যখন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে চায় তখন সব যুক্তি, সব সুস্থ চিন্তা অচল। সাময়িক ভাবে হলেও তারা সফল হয়েছে। রাশিয়ার উপর আবার নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে এসেছে। আগে যদি অ্যামেরিকা বলত তারা শুধু পুতিন আর তাঁর বন্ধুদের ক্ষতি করতে চায় এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, এখন বলছে তারা রুশ জনগণের ক্ষতি করতে চায়, তাদের দুর্দশায় ফেলতে চায়। হাজার বছরের ইতিহাস বলে রুশ জাতি যখন বিপদে পড়ে তখনই তারা সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়। জানি না পশ্চিমা বিশ্ব এখন কি ভাবছে। 

আসলে কেউ যদি কোন কিছু অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে তখন সে সমস্ত যুক্তি হারায়। সেই যে  বরজেজিন্সকি  (Zbigniew Brzezinski) লিখেছিলেন ইউক্রাইন ছাড়া রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে দন্তহীন হয়ে পড়বে সেটাকে বেদ বাক্য হিসেবে নিয়েই তারা একের পর এক জুয়া খেলে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে এই সব নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত করছে, তার উন্নয়নের পথকে কন্টকিত করছে কিন্তু রাশিয়া সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে। আর এটাই পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকাকে শান্তিতে ঘুমুতে দিচ্ছে না। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, আন্টিমনোপোলি আমেরিকার অর্থনীতিতে ইতিবাচক কাজ করে আর সেটাকে তারা অতন্ত বিচক্ষণতার সাথে ব্যবহার করলেও বিশ্ব রাজনীতির প্রশ্নে তারা এটাকে এড়িয়ে চলে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি থাকার ফলে সেসব দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমেরিকার দাদাগিরি মেনে নিলেও রাশিয়ার মত কিছু দেশ সেটা করে না, করতে পারে না হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। আর এখানেই শুরু হয় সমস্ত ঝামেলা। আসলে এর শুরু গত কাল নয়, এমনকি ১৯১৭ সালেও নয়। সেই ৯৮৮ সালে যখন কিয়েভস্কি রুশের রাজা ভ্লাদিমির রোম/ভ্যাটিকানকে উপেক্ষা করে কনস্টান্টিনোপল থেকে অর্থোডক্স খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন তখন থেকেই শুরু হয় এই কনফ্রন্টেশন। তাই এক দিনে এটা যাবার নয়। 

পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নিজেকে অপরাজেয় ভাবতে শুরু করে,  যার ফলে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে একের পর এক বিভিন্ন প্রোজেক্ট হাতে নেয়। গায়ের জোরে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র রপ্তানির ফল আমরা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় দেখতে পাই। সোভিয়েত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিলে তারা এ ধরণের  দুঃসাহসিক কাজে হয়তো লিপ্ত হত না। ইউরোপের মাল্টিকালচারাল এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়নি। আগে যখন কম সংখ্যক মানুষ সেখানে যেত তারা সাধারণত সে দেশের সংস্কৃতি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করত। এখন যায় ঝাকে ঝাকে, সাথে নিয়ে যায় নিজেদের সংস্কৃতি, আচার আচরণ। ফলে কালচারাল সংমিশ্রণ হচ্ছে না, উল্টো   ইউরোপীয় তথা খৃস্টান কালচারকে তাদের কাছে নতজানু হতে হচ্ছে। গ্রীন এনার্জির স্লোগান সফল হয়নি। অনেকে মাথায় আনতে চায়না এর ফলে কত বনভূমি নষ্ট করতে হয়, তাছাড়া প্রায়ই নির্ভর করতে হয় প্রকৃতির উপর। মানুষ এক সময় প্রকৃতিকে জয় করেছিল এখন আবার তার কাছে নতি স্বীকার করতে চাইছে ঠিক যেমনটা সারা বিশ্ব নতজানু হয়ে বসছে বিএলএম মুভমেন্টের কাছে। সমস্যা হল, আমাদের যেখানে দরকার ছিল নিজেদের চাহিদা কমানো, সেখানে আমরা অনবরত চাহিদা বাড়িয়ে যাচ্ছি, কেননা পুঁজিবাদের অসীম ক্ষুধা। আসলে আমরা নিজেদের যদি বদলাতে না পারি সমস্ত পরিকল্পনা কাগজেই থেকে যাবে। সেই সাথে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার ফলে রুশ জনগণের একাংশের সব হারানোর ক্ষোভ। রুশরা বলে যদি শান্তি চাও তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। হ্যাঁ, নব্বুইয়ের দশকের দুর্বল রাশিয়াকে কেউ পাত্তা দেয়নি। এখন সে ফিরে আসছে। তাই রাশিয়ার সীমান্তে এত অস্ত্রের ঝনঝনানি। এ থেকে কি মুক্তির পথ নেই?   

এ থেকে মুক্তির তিনটি পথ – রাশিয়া বা আমেরিকা – রাষ্ট্র হিসেবে কোন এক দেশের পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়া, দুই দেশই আর সেই সাথে বিশ্ব থেকে মানব সভ্যতার চিরবিদায় (ফুলস্কেল পারমানবিক যুদ্ধের ফলে) অথবা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি মেনে নেওয়া। তৃতীয় পথ সবার জন্য মঙ্গলকর, তবে আমেরিকা নতি স্বীকার করতে কতটুকু প্রস্তুত তার উপর সব নির্ভর করছে। উপরে ওঠার এটাই সমস্যা – পড়ে যাওয়া খুবই  বেদনাদায়ক।  

শিক্ষক ও গবেষক 
জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments