জ্বলদর্চি

বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় /অর্ণব মিত্র

বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

অর্ণব মিত্র 


২০০০ সালের বইমেলায় ঘুরছিলাম বন্ধু সুব্রতর সাথে। তখন কলকাতার আর্ট কলেজে পড়ি। সেই সময় নোবেল পুরস্কার পাওয়া লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ–এর বেশ নাম বাঙালি পাঠকের মধ্যে। তাঁর বইগুলির মধ্যে ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’,‘একশো বছরের নিসঙ্গতা’ও ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখেনা’ অনুবাদের মাধ্যমে বাংলায় পাঠকের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এই তিনটি বই এর মধ্যে সব থেকে বেশি নাম শোনা যেত প‍্যপিরাস প্রকাশনার হাল্কা মাটি রঙের প্রচ্ছদে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ বইটির। প্রচ্ছদের মাঝখান থেকে নিচ অবধি ইট রঙের রেখাচিত্রে একটি মোরগ অ্যাঁকা ছিল। বইটি ওই লেখকের অন্য বইগুলির তুলনায় পাতলা ও তাই দামও কম। আর কলেজে পড়ার সময় হাতে থাকত না টাকা। তাই বন্ধু সুব্রত-র কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে কিনেছিলাম ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখেনা’ বইটি। বইটির প্রচ্ছদে লেখা ‘১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত, ভূমিকা ও অনুবাদ–মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন বই-পড়ার জগতে আমি নতুন,জানতাম না মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কে!।       
                                           
অনেক পরে জেনেছি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন সেরা অনুবাদক। এই পরিচিতি তিনি লাভ করেছেন প্রায় পাঁচ-দশক ধরে। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে তার অবদান বিশ্বমানের। বাংলা সাহিত্যে কৃক্তিবাস ওঝা ও কাশীরাম দাস রামায়ণ ও মহাভারতের ভাবানুবাদ করেছিলেন। এখন বাংলায় প্রায় গোটা বিশ্বসাহিত্য আমাদের হাতে চলে এসেছে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে।

তিনি অনুবাদ করেছিলেন সব দেশের সাহিত্য, শুধু ইউরোপের নয়। লাতিন আমেরিকা, আরব ও আফ্রিকার সাহিত্যের কথাও ভেবেছেন। আর তার সাথে নিরলসভাবে অনুবাদ করেছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সাহিত্য। 

  তিনি কবিতাও লিখেছেন। একটি অন্য ধারায়। নিজে কবিতা লিখেছেন বলেই কবিতা অনুবাদ করতেও ভালবাসতেন। সম্পাদনা ও অনুবাদ করেছিলেন লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী কবিতার। সংকলনটির নামছিল ‘এই স্বপ্ন,এই গন্তব্য’। অনুবাদ করেছিলেন পাবলো নেরুদা ও নিকানো পাররার কবিতা। বাঙালি কবিতা পাঠক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়– এর মতো পেয়েছে আর একজন কবিতা-অনুবাদক।

  তিনি ছিলেন ১৯৫৬ সালের যাদবপুর বিশ্ব্যবিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রথম ব্যচ-এর ছাত্র। পরে সেই বিভাগের অধ্যাপক হয়েছিলেন। তবে তিনি তার আগে ইউরোপ ও আমেরিকা ঘুরে এসেছেন। পোল্যান্ড ও কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়েছেন তিনি।পড়ানোর জন্য গেছেন মায়ানমার এর রেঙ্গুনেও। এসব জায়গায় গিয়ে সেখানেই তার বিভিন্ন ভাষা ও দেশের সাহিত্যের বৈচিত্র্য সমন্ধে ধারণা তৈরি হয়। তার মনে হতে থাকে এইসব সাহিত্য বাংলায় নিয়ে আসা দরকার।তাই তিনি অনুবাদের মাধ্যমে প্রথম লাতিন আমেরিকার লেখক গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজের সাথে বাঙালি পাঠকের পরিচয় হয়।যাদবপুরের পাঠ্যক্রমেও মারকেজকে নিয়ে আসেন বাংলাতে, ১৯৭১ সালে। তার অনুবাদে মারকেজের ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ ও ‘একশো বছরের নিসঙ্গতা’ বইগুলি জনপ্রিয় হয়। তখনও মারকেজ নোবেল পাননি। পেলেন ১৯৮২ সালে তার বই ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’– ও ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’বই-এর জন্য। তাই তার প্রিয়বন্ধু সদ্যপ্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ এক সময় বলেছিলেন ‘মানববাবু যে লেখকদের অনুবাদ করেন তারা আসলে কোথাও নেই, কিন্তু কয়বছর পর দেখা যায় তারাই নোবেল পাচ্ছেন’। মারকেজ ছাড়াও তাঁর আনুবাদে ‘লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সংগ্রহ’-তে স্থান পেয়েছে সেখানকার সাহিত্যিক মাচাদো আসিস, মারিয়ানো আসুয়েলা,আলেহ কারপেন্তিয়ের,হুয়ান রুলফো ও কার্লোস ফুএন্তেসের রচনা। এই প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক ও গল্পকার রাহুল দাশগুপ্ত তার একটি প্রবন্ধে লেখেন ‘লাতিন আমেরিকাকে এত ভাল করে, গভীরভাবে জানার সুযোগ বাঙালি আগে কখনও পায়নি’। 

তিনি ভারতীয় সাহিত্য নিয়েও কাজ করেছেন। তিনটি ‘আধুনিক ভারতীয় গল্প’-এর বই সম্পাদনা করেছিলেন। এতে আছে প্রেমচন্দ, ভগবতীচরণ পানিগ্রাহী, ইস্মাত চুগতাই, ভৈকম মহম্মদ বসীর,কৃষাণ চন্দর–এর মত লেখকেরা। এছাড়া তিনি ‘ভেদ বিভে্দ’ নামে একটি গল্প-সঙ্কলন সম্পাদনা করেছিলেন। এতে দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পকারদের মধ্যে আছেন মুল্করাজ আনন্দ, সাদ্দাত হাসান মানটো,রাজেন্দর সিং বেদী,অমৃতা প্রিতমরা। এছাড়া তিনি আলাদা করে তার প্রিয় সাহিত্যিক মালায়ালাম গল্পকার ভৈকম মহম্মদ বসীর–এর শ্রেষ্ঠ গল্প অনুবাদ করেছিলেন। 

তিনি কবিতা ও অনুবাদ ছাড়া গদ্যও লিখেছেন। তার দুটি গদ্যের বই হল ‘বাস্তবের কুহক ও কুহকের বাস্তব’ ও ‘আত্মহত্যার অধিকার ও অনান্য সনদ’। এতে তাঁর আলোচনায় বিশ্ব ও ভারতীয় সাহিত্যের বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য বলতে তিনি বোঝেন ভারতের সব প্রদেশের প্রতিনিধি হতে পারে এমন সাহিত্য। তাই তার সারাজীবনের কাজ ছিল এই লেখাগুলিকে বাঙালি পাঠকের কাছে নিয়ে আসা। এ ব্যপারে তিনি বলেন আমরা এটুকু শুধু বলতে পারি যে বাংলা ভাষা কোন সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে নেই,বিভিন্ন ভাষা হতে আহরণ করে তা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে’। পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাসংসদ তার অনুবাদ করা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজের জাদুবাস্তব ধারার ছোটোগল্প ‘এ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ এনরমাস উইংস’ একাদশ শ্রেণীর পাঠক্রমে স্থান দিয়েছে। এরফলে তিনি ধীরে ধিরে অনুবাদক হিসেবে সাধারণ বাঙালি পাঠকের মধ্যেও পরিচিতিলাভ করেছিলেন।

  রাহুল দাশগুপ্ত তার প্রবন্ধে বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছেন ‘মানবেন্দ্রর অনুবাদ করা কাজগুলির বৈচিত্র্য ও বিস্তার দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। কি করে একজন মানুষের পক্ষে এভাবে গোটা বিশ্বের সাহিত্যকে আতস্থ করা সম্ভব?’। এই প্রবন্ধে বাংলায় অনুবাদ-কর্মের সমস্যা নিয়ে তিনি লেখেন ‘বাংলায় অনেক সমস্যা নিয়ে একজন অনুবাদককে কাজ করতে হয়।এখানে অনুবাদ করার মতো কোনওরকম অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নেই। মানবেন্দ্রের যাবতীয় অনুবাদগুলিকে এক জায়গায় নিয়ে এলে, তা বাংলা সাহিত্যে একটি কালজয়ী অবদান বলে পরিগণিত হবে বলেই মনে হয়’।

করোনা অতিমারির জন্য দু-বছর বন্ধ থাকার পর আবার ২০২২-এর কলকাতা বইমেলা হতে চলেছে। তবে এই বইমেলায় অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর দেখা যাবে না। পাঁচ দশক ধরে নিরলস অনুবাদের কলমটি এসে থেমেগেল ২০২০ সালে। করোনা কেড়ে নিল আর একজন সাহিত্য-সাধককে। বাংলায় তার থেকে ভাল অনুবাদক এরপর আর কি পাওয়া যাবে!–এই দুশ্চিন্তা রেখে গেলেন।


তথ্য সাহায্য,
ইপ্সিতা হালদের-এর প্রবন্ধ,আনন্দবাজার পত্রিকা।‘বর্ণিক’পত্রিকা জানুয়ারী সংখ্যা,কৃত্তিবাস পত্রিকা।

চিত্র- লেখক

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

2 Comments

  1. সুনীল গাঙ্গুলীর 'অন্য দেশের কবিতা' আমায় স্কুল (মিত্র স্কুল, ভবানীপুর) থেকে দেওয়া পুরস্কারের মধ্যে ছিল অন্যতম। এই বইয়ের হাত ধরেই আমার রিল্কে, র‍্যাম্ব ইত্যাদি কবি ও তাঁদের কবিতা ও বিশ্ব সাহিত্যের সাথে পরিচয়। দুঃখের কথা মানবেন্দ্র -বাবুর অনুবাদের সাথে আমার পরিচয় নেই। কতো কিছুই যে জানি না! অর্ণবের লেখার মাধ্যমে পরিচয় হল। মারকেজ, ফুয়েন্তেস, নেরুদা ইত্যাদি লেখকদের সাথে পরিচয় ইংরেজীর মাধ্যমে। আশা করি বাংলাতেও হবে মানবেন্দ্র বাবুর হাত ধরে।

    ReplyDelete
  2. অর্ণবকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete