জ্বলদর্চি

এশিয়া (লাওস)-র লোকগল্প /যত দুর্ভোগ পেঁচার জন্য/ চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—এশিয়া (লাওস)

যত দুর্ভোগ পেঁচার জন্য

চিন্ময় দাশ 

এক গ্রামে বাস করত দুটো ছেলে। এক মায়ের পেটে জন্মানো দুই ভাই তারা। 
তখন বর্ষাকাল। এক দিন বড়ভাই বলল—চল ছোট, ছাতু তুলতে যাই। 
ছাতু তুলতে হলে বনে যেতে হবে। দুই ভাই বেরুল ঘর ছেড়ে। ঘর ছাড়িয়ে গ্রাম। গ্রাম ছাড়িয়ে ধানের মাঠ। মাঠ ছাড়িয়ে তবেই না বন। 
বনে ঢুকে শুরু হোল তাদের ছাতু খোঁজা। এদিকে ওদিকে চোখ চালাতে চালাতে চলেছে দুজনে। কতদূর গিয়েছে, হঠাৎই ঠক করে শক্ত কী একটা যেন এসে পড়ল বড়র মাথায়। বেমালুম চমকে গেছে ভাই দুটি। কী হোল ব্যাপারটা?
তখনই আবারও ঠক। এবার পড়েছে ছোটর মাথায়। তাকিয়ে দেখে, দুটো পেয়ারা গড়াগড়ি যাচ্ছে মাটিতে। তখন হুঁস ফিরল দুজনের। 
চোখ চাইতেই দেখল, একটা ঝাঁকড়া পেয়ারাগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। 
ভারি রাগ হোল ছেলে দুটির। পেয়ারাগাছের তলায় দাঁড়ানো কি দোষের না কি? তাই বলে, পেয়ারা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে হবে গরীব ছেলেদের মাথায়! পেটে দেবার দানাটিও নাই ঘরে। তাই তো ছাতু খুঁজতে আসা। 
রাগী রাগী গলা করে, পেয়ারা গাছকে বড় বলল—ব্যাপারটা কী? এভাবে পেয়ারা ছুঁড়ে মারলে কেন?
গাছ বলল— ঠিকই তো। এভাবে কারও মাথায় পেয়ারা ছুঁড়ে মারা মোটেই ঠিক কাজ নয়। তাও আবার শক্ত কাঁচা পেয়ারা। কিন্তু আমার কী দোষ! কাঠবেড়ালি কুটকুট করে আমার ফলের বোঁটা কেটে দিচ্ছে যে। তাতেই তো পেয়ারা পড়ছে নীচে।
ছেলে দুটো ওপরে তাকিয়ে কাঠবিড়ালিকে দেখতে পেল। রাগের গলা করে বলল—এটা তোমার কেমন ব্যবহার? বসে বসে পেয়ারার বোঁটা কেটে দিচ্ছো কেন? ঠকাস ঠকাস পেয়ারা এসে পড়ছে আমাদের মাথায়!
কাঠবিড়ালি চিঁ-চিঁ করে বলল—কারও মাথায় কাঁচা পেয়ারা পড়া মোটেই ঠিক কাজ নয়। ভারি যন্ত্রনা হয় তাতে।  কিন্তু  আমার কী দোষ? দ্যাখো না, এই সাপটা কেমন আমাকে  পেঁচিয়ে ধরেছে। দম আটকে আসছে আমার। তাতেই তো সামনে যা পেয়েছি, কামড়াচ্ছি।
ভালো করে চেয়ে, ছেলে দুটো একেবারে আঁতকে উঠল। সত্যি সত্যি একটা সাপ পেঁচিয়ে ধরেছে কাঠবেড়ালিটাকে। তারা সাপকে বলল—আরে, আরে, করছটা কী? ওকে এমন করে জড়িয়ে ধরেছ কেন? দম আটকে আসছে তার। তুমি কাঠবেড়ালিকে পেঁচালে। কাঠবেড়ালি পেয়ারার বোঁটা কামড়াল। আর পেয়ারাগুলো এসে পড়ল আমাদের মাথায়।
সাপ বলল—মাথায় পেয়ারা পড়াটা মোটেই ভালো কথা নয়। কিন্তু তাতে আমার কী দোষ? পিঁপড়ে কেন কুটুস করে আমার লেজে কামড়াল? তাতেই তো চমকে গিয়ে যাকে সামনে পেয়েছি, জড়িয়ে ধরে ফেলেছি। 
দুই ভাই খুঁজে খুঁজে পিঁপড়ের কাছে হাজির—কেমন লোক তুমি? হঠাৎ করে সাপের লেজে কামড় বসালে কেন? তুমি সাপের লেজে  কামড়ালে। সাপ চমকে গিয়ে কাঠবেড়ালিকে জড়িয়ে ধরল। কাঠবেড়ালি পেয়ারার বোঁটা কামড়াল। আর পেয়ারা এসে পড়ল আমাদের মাথায়।

পিঁপড়ে বলল—মানছি, পেয়ারা মাথায় পড়াটা মোটেই ভাল কথা নয়। কিন্তু তাতে আমার কী দোষ? তিতির কেন হঠাৎ এসে আমাদের বাসা ভেঙে দিল? তাতেই তো রাগ চড়ে গেল মাথায়। সামনে যা পেয়েছি, কামড়ে দিয়েছি।
বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হোল না। কাছেই পাওয়া গেল তিতিরকে। চুপ করে এক জায়গায় বসে আছে ছোট্ট পাখিটা। ছেলেগুলো তাকে বলল—কেমন লোক হে, তুমি? পাখিটা বলল—কেন, কেন? আমি আবার কী করলাম? 
ছেলেগুলো ধমকে উঠল—কোন আক্কেলে তুমি পিঁপড়ের বাসা ভেঙে দিলে? পিঁপড়ে রেগে গিয়ে সাপের লেজ কামড়ে দিল। তাতে ঘাবড়ে গিয়ে সাপ জড়িয়ে ধরল কাঠবেড়ালিকে। তার দম আটকে যাচ্ছে। সে কামড় বসাল পেয়ারার বোঁটায়। আর সেই পেয়ারা এসে পড়ল আমাদের মাথায়।

পাখি বলল—ঠিক বলেছ। শক্ত পেয়ারা মাথায় পড়াটা একেবারেই ভালো কথা নয়। কিন্তু তাতে আমার কী দোষ? আচমকা একটা তরমুজ ফেটে গিয়ে, তার বীজ ছিটকে এসে, পড়বি তো পড় সোজা আমার চোখে। আমার তো তখন ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। চোখে দেখতে পাচ্ছি না কিছু। সামনে যা ছিল, আঁচড়ে, ঠুকরে তছনছ করে ফেলেছি। 
ছেলে দুটো এবার তরমুজকে গিয়ে বলল— হোলটা কী তোমার? হঠাৎ ফেটে গেলে কেন? ফেটে গিয়ে তোমার বীজ গিয়ে পড়ল তিতিরের চোখে। চোখে অন্ধকার দেখে, সে আঁচড়ে দিল পিঁপড়ের বাসা। পিঁপড়ে রেগে গিয়ে কামড়াল সাপের লেজ। সাপ ঘাবড়ে গিয়ে পেঁচিয়ে ধরল কাঠবেড়ালিকে। ভয় পেয়ে সে কামড়াল পেয়ারার বোঁটায়। কাঁচা পেয়ারা এসে পড়ল আমাদের দুজনের মাথায়। 

তরমুজ বলল—কাঁচা পেয়ারা মাথায় এসে পড়া এক্কেবারে ভালো কথা নয়। বিষম কষ্ট হয় তাতে। কিন্তু আমার কী দোষ? স্কোয়াস এসে পড়ল কেন আমার উপর? পাকা ফলের উপর একটা স্কোয়াস এসে পড়লে, ফেটে গিয়ে বীজ তো ছিটকাবেই। তোমরাই বলো। 
স্কোয়াসের মাচাটা বেশি দূরে নয়। দুই ছেলে গিয়ে গাছটাকে বলল--  নীচে পাকা তরমুজ আছে, সেটা তোমার অজানা নয়। কোন আক্কেলে তুমি তার ঘাড়ে গিয়ে পড়লে? তুমি গিয়ে পড়লে তরমুজের ওপর। তরমুজ  ফেটে, তার বীজ ছিটকে গিয়ে তিতিরের চোখে পড়ল। তার তো অন্ধ হওয়ার জোগাড়। সে ভড়কে গিয়ে পিঁপড়ের বাসা ঘেঁটে দিল। পিঁপড়ে রাগ করে কামড়ে দিল সাপের লেজে। সাপ চমকে গিয়ে পেঁচিয়ে ধরল কাঠবেড়ালিকে। কাঠবেড়ালি কামড় বসাল পেয়ারার বোঁটায়। সেই পেয়ারা পড়ল আমাদের মাথায় এসে। 
--এক্কেবারে ঠিক বলেছ গো। স্কোয়াস বলল—কিন্তু আমার কী দোষ, বলো তোমরা। বলা নাই কওয়া নাই, এক হরিণ এসে গুঁতোতে লাগল আমার মাচায়। সেই ঝাঁকুনি সামলাতে না পেরেই তো সোজা পাকা তরমুজের উপর পড়লাম আমি। এবার তোমরাই বিচার করো।  
ছেলে দুটো চলল হরিণের খোঁজে। খানিক দূরে পাওয়াও গেল তাকে। গোমড়া মুখ করে বসে আছে একটা গাছের নীচে। 

দুজনে সেখানে পৌঁছে, জিজ্ঞেস করল— মাঠে ঘাস-পাতার কি কমতি পড়েছে না কি? খামোখা স্কোয়াসের মাচা খোঁচাতে গিয়েছিলে কেন? তুমি মাচা খোঁচালে। স্কোয়াস  গিয়ে পড়ল পাকা তরমুজের উপর। তরমুজের  বীজ ছিটকে গিয়ে তিতিরের চোখে পড়ল। তার তো অন্ধ হওয়ার জোগাড়। সে ভড়কে গিয়ে পিঁপড়ের বাসা ঘেঁটে দিল। পিঁপড়ে রাগ করে কামড়ে দিল সাপের লেজে। সাপ চমকে গিয়ে পেঁচিয়ে ধরল কাঠবেড়ালিকে। কাঠবেড়ালি কামড় বসাল পেয়ারার বোঁটায়। সেই পেয়ারা পড়ল আমাদের মাথায় এসে। এবার বুঝতে পেরেছ, কী কাণ্ড ঘটিয়েছ তুমি? 
হরিণ চোখ তুলে দেখল দুজনকে। বলল— আগে শোন আমার কথা। তারপর তোমরাই বলবে, আমার কী দোষ। কদিন যাবত শরীরে জুত নাই আমার। গায়েও বেশ জ্বরজ্বর ভাব। তখন খরগোশ বদ্যিকে ডেকে আনা হোল। সে এসে বলে গেল, কাঁচা অলিভ ফল চিবিয়ে খাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। খুঁজে খুঁজে এখানে এসে পেলাম অলিভ গাছটাকে। গাছের কাছে গিয়ে দেখি, কপাল খারাপ আমার। থোকা থোকা ফল ঝুলে আছে গাছে। কিন্তু একটু উঁচুতে। কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। 
ছেলে দুটো বলল—আহারে, বেচারা। মাথার উপরেই ফল। কিন্তু দাঁতে কাটবার উপায় নাই। 

হরিণ বলল—তাহলে আর বলছিটা কী? কী আর করি? নিজের মনে বলতে লাগলাম-- হায় হায়, কী পোড়া কপাল!  পাচ্ছি কোথায় অলিভের নাগাল?
বড় ছেলেটার রাগ হোল খুব। বলল—ছড়া কাটতে, অলিভ পেয়ে গেলে? 
হরিণ বলল—ব্যস্ত হও কেন? বাকিটা শোন আগে। কাছেই একটা গাছের ডালে বসে ছিল একটা পেঁচা। সে যে আমাকে দেখছে আর কথাগুলো শুনছে, খেয়াল করিনি। তো, পেঁচা উপর থেকে বলে উঠল—আঁকশি আনো, আঁকশি আনো। অলিভ তখন পাবেই জেনো। 
--শুনে ভারি আশা জাগল মনে। উৎসাহও পেলাম বেশ। তারপরই ভাবলাম, এখানে কোথায় পাবো আমি আঁকশি? আকাশ পাতাল ভাবছি বসে বসে। আবার পেঁচার গলা— আঁকশি কি আর থাকে গাছে? স্কোয়াস মাচা তো পাশেই আছে। 

--মাথাটা চিড়িক করে উঠল। আর আমাকে পায় কে? বুঝে গেলাম, মাচা থেকে একটা খুঁটি জোগাড় করে আনতে পারলেই, অলিভ পেড়ে ফেলা যাবে। তাই তো দৌড়ে গিয়ে একটা ঢুঁ মেরেছিলাম মাচাটায়। কিন্তু তাতেই যে এমন একটা বেমক্কা ঘটনা ঘটে যাবে, আমি কি ছাই জানতাম? তোমরাই বলো, আমার কী দোষ এতে? 
গাছের ডালেই বসে ছিল পেঁচাটা। সবাই দল বেঁধে গিয়ে হাজির হল তার কাছে।
বড় ভাইটা জিজ্ঞেস করল—তুমি হঠাৎ করে স্কোয়াসের মাচা থেকে আঁকশি ভেঙে আনার পরামর্শ দিতে গিয়েছিলে কেন? তাতেই তো যত বিপত্তি। মাচায় গিয়ে ঢুঁ মারল হরিণ। তাতে স্কোয়াস খসে গিয়ে পাকা তরমুজের উপর পড়ল। তরমুজের বীজ ছিটকে গিয়ে লাগল বেচারা তিতিরের চোখে। চোখে আঁধার দেখে, সে আঁচড়ে দিয়েছে পিঁপড়ের বাসা। রাগ করে সাপের লেজে কামড়েছে পিঁপড়ে। সামনে ছিল একটা কাঠবেড়ালি। ভড়কে গিয়ে তাকেই পেঁচিয়ে ধরেছে সাপ। দম আটকে যাবার জোগাড় তার। সে কামড়াতে লেগেছে পেয়ারার বোঁটা। সেইসব পেয়ারা এসে পড়ল আমাদের দুই ভাইয়ের মাথায়। দুটো আলু গজিয়ে উঠেছে আমাদের দুটো মাথায়। সবাই দ্যাখো তোমরা। 
প্যাঁচার মুখে রা-টি নাই। সে তোতলাতে লাগল-- না, মানে আমি একটু মস্করা করতে গেছলাম হরিণের সাথে। তাতেই ঘটে গেল সব। এতসব হবে আমি কি আর জানতাম?

কম বেশী ফ্যাসাদে পড়েছে সকলেই। তবে বেশি রাগ কাঠবেড়ালির। সাপের পেঁচিয়ে ধরা চাট্টিখানি কথা না কী? কোন রকমে প্রাণটা বেঁচেছে আজ। সে খেঁকিয়ে উঠল—একজনের অসুখ করেছে। গায়ে ধুম জ্বর বেচারার। তার সাথে মস্করা? 
রাগ হরিণেরও কম হয়নি। পেঁচা পরামর্শ না দিলে সে গিয়ে মাচায় ঢুঁ মারত না। আর ঢুঁ না মারলে, এতসব কিছুই ঘটত না। হরিণ বলল—তাহলে, আমিও একটু মস্করা করি তোমার সাথে।
বলেই, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বেদম জোরে এক ঢুঁ মেরে বসল সোজা পেঁচার মুখে। তাতে যা হবার তাই হয়ে গেল। থেঁতলে চ্যাপ্টা আর গোল হয়ে গেল পেঁচার মুখটা। 
তাই দেখে, সবার কী হাসি, কী হাসি। কাঠবিড়ালির তখনও রাগ মেটেনি। সে দৌড়ে গিয়ে খানিকটা কাঁচা হলুদ তুলে আনল। বলল—দাঁড়াও, গোল মুখে টানা চোখ মানায় না। তোমার চোখ দুটোকেও গোল করে দিই। বলেই, চোখের তারাদুটোর দু’পাশে গোল গোল দুটো দাগ কেটে দিল।

সেই থেকে প্যাঁচাদের ঐরকম বিচ্ছিরি মুখ। আর, ইয়াব্বড় দুটো চোখ হলুদ দাগ দিয়ে ঘেরা।  
কাঠপিঁপড়ের কামড়। সোজা ব্যাপার নয় মোটেই। লেজের জ্বালা তখনও মেটেনি সাপের। সে প্যাঁচাকে বলল—তোমার জন্যই যতো বিপত্তি। এজন্য শাস্তি পেতে হবে। তোমাকে সাবধান করে দিলাম—দিনের বেলায় কোন দিন বাসা ছেড়ে বের হবে না তুমি। শিকার করো, বা কারও সাথে আবার মস্করা করার সাধ হোল, সবই করবে রাতের বেলায়। কারও কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু দিনের বেলায় যেন তোমার মুখটিও না দেখা যায়। আর কথা অমান্য করে বেরিয়েছ কী, বুঝবে মজা। আমাকে তো জানো। চুপিসাড়ে এসে, এমন পেঁচিয়ে ধরবো, একেবারে অক্কা। 

সেদিন থেকে দিনেরবেলা বাসা ছেড়ে বের হয় না পেঁচা। আর, মুখখানার যা হাল করে দিয়েছে হরিণ, দিনের আলোয় কাউকে মুখ দেখাবে কেমন করে?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments