জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম / পর্ব- ৩৩/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম 
 পর্ব- ৩৩

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে রাষ্ট্রের ভূমিকা

এগারো শতকে তথাকথিত পোপ বিপ্লবের(Papal Revolution) মাধ্যমে রোমের পোপের নেতৃত্বে পুরোহিত শ্রেণী স্বাধিকারের দাবি তোলে। এ সময়ে সমগ্র ইউরোপ অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলো। এক কথায় রাজন্য শ্রেণি দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। অন্য দিকে সম্পত্তি এবং সংগঠনের জোরে পুরোহিত শ্রেণি শক্তিশালী হয়েছিলো। এ সময়ে ইউরোপের মোট ভূখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ ছিলো গির্জার মালিকানাধীন। এ পরিস্থিতিতে ১০৭৫ সালে পোপ সপ্তম গ্রেগরী বলেন যে গির্জার বিষয়সম্পত্তি, বিশপদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করবার অধিকার, পুরোহিতদের বিচার, এমন কি রাজাকে বরখাস্ত করবার অধিকারও পোপের আছে, আর সব রাজাদেরই পবিত্র কর্তব্য পোপের, এবং একমাত্র পোপেরই পদচুম্বন করা। 

  বারো শতকের পোপের নেতৃত্বে পুরোহিত শ্রেণীর সাংগঠনিক শক্তি আরো বৃদ্ধি পায় এবং পোপ গেলাসিয়াসের "দুই জগৎ" তত্ত্বের পরিবর্তে "দুই তরবারি" তত্ত্ব (Two Swords Doctrine) পোপদের দ্বারা ঘোষিত হয়। "আধ্যাত্বিক তরবারি"-র মালিক পুরোহিত শ্রেণি, আর "জাগতিক তরবারি"-র মালিক রাজা, সামন্ত, নগরশাসক এবং অন্যান্য রাজনৈতিক অধিকারীবর্গ, অর্থাৎ রাজন্য বা ক্ষত্রিয় শ্রেণি। এই অবস্থায় ইউরোপে তিনশো বছর ধরে পুরোহিত শ্রেণী ও রাজন্য শ্রেণীর মধ্যে কিছুটা স্বার্থের সংঘাত লেগে থাকলেও সৈন্যবাহিনী ও প্রশাসনের উপর একচ্ছত্র অধিকারের বলে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রই গির্জাকে, অর্থাৎ রাজন্য শ্রেণিই পুরোহিত শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। প্রকৃতপক্ষে চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন এবং বিভিন্ন জার্মান রাজ্যে পোপ এবং গির্জার উপর রাষ্ট্রের কর্তব্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। স্পেনে গির্জা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, ধর্মীয় আদালতগুলোকে রাষ্ট্রীয় আদালতের অধীন করা হয়, এবং পুরোহিত শ্রেণীর অধিকার খর্ব করে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অধীনে ধর্মদ্রোহীদের জন্য ইনকুইজিশন প্রথা চালু করা হয়। তাছাড়া ইউরোপে রেনেসাঁস বা বৌদ্ধিক নবজাগরণের পটভূমিতে এই দুই শতকে পাদুয়ার মারসিলিয়াস (১২৭৫-১৩৪২) সহ কিছু তাত্ত্বিক লেখক আবির্ভূত হয়েছিলেন, যারা ধর্মীয় ব্যাপারেও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। ম্যাকিয়াভেলির "দ্য প্রিন্স" (১৫১৩) গ্রন্থে সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধর্মহীন, ন্যায়নীতিহীন রাজনীতির সমর্থনও রেনেসাঁসেরই ফলশ্রুতি। 

  পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পশ্চিম ইউরোপে এক ধরনের অনুন্নত ধনতন্ত্র জন্মলাভ করেছিলো। এক দিকে বেশি পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে আঞ্চলিক ভিত্তিতে হস্তশিল্পের বড় বড় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিলো। অন্য দিকে ব্যাংক ও লগ্নি ব্যবসায়ের মাধ্যমে আর্থিক ধণতন্ত্র (financial capitalism) জন্মলাভ করেছিল। ভেনিস, ফ্লোরেন্স, দক্ষিণ জার্মানি, ফ্লান্ডার্স, হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড ছিল এর উদাহরণ। অন্য দিকে এ সময়ে পূবে পশ্চিমে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন এবং আন্তর্জাতিক ক্রীতদাস ব্যবসায়ের মাধ্যমে ইউরোপে প্রচুর ধনের আমদানি হতে থাকে। ফলে এক নতুন শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ী বুর্জোয়া শ্রেণি সৃষ্টি হয়, ব্যক্তিগত লাভই ছিল যাদের সমৃদ্ধির মূল প্রেরণা। অথচ প্রচলিত রোমান ক্যাথলিক ধর্ম ছিল দারিদ্র্যের সমর্থক, ব্যক্তিগত মুনাফা ও সুদের বিরোধী, এবং জাগতিক ভোগবাসনার কঠোর সমালোচক। এহেন খ্রিষ্ট ধর্মের দৃষ্টি ছিল পরলোকে নিবন্ধ। 

  এই পরিস্থিতিতেই ঘটে রেফরমেশন বা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের অভ্যুদয়। খ্রিষ্ট ধর্মের এই নূতন শাখা ব্যক্তিগত মুনাফা এবং জাগতিক ভোগবাসনাকে ঈশ্বরভক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে ঘোষণা করলো, আর পুরোহিত শ্রেণীর মধ্যস্থতার প্রয়োজন অস্বীকার করে মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের সম্ভাবনা এবং প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিলো। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে সামন্ততন্ত্রের অপক্ষায় এবং গণতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে প্রধানত উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে ও আর্থিক আনুকূল্যে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম শক্তিশালী হয়ে উঠলো। আর দেশে দেশে প্রধানত ধনতন্ত্রের সুরক্ষিত বাজারের প্রয়োজনে রোমের পোপের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় বাণিজ্যনীতি (Mercantilism) প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ জন্মলাভ করলো। ইংল্যান্ডে ১৫৩৪ সালের সার্বভৌমত্ব আইন (Supremacy Act) এর মাধ্যমে রোমের পোপের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে জাতীয় চার্চের উপরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতেও অনুরূপ ব্যবস্থা প্রচলিত হলো। এই পরিস্থিতিতে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত ফ্রান্স এবং জার্মানিতে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে অনেকগুলো গৃহযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জার্মানির রাজাদের মধ্যে যুদ্ধের শেষে যে অগসবার্গ শান্তিচুক্তি (১৫৫৫) প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে বলা হয় যে প্রত্যেক রাজারই অধিকার আছে নিজ নিজ রাজ্যে ইচ্ছেমত ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রবর্তন করবার, আর রাজার ধর্মই হবে দেশের সব মানুষের ধর্ম। অন্য সব ধর্মকে নিষিদ্ধ করা হবে। এই চুক্তি দ্বারা চার্চ বা গির্জার উপর রাজার নিরঙ্কুশ প্রভুত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধের পরে ১৫৯৮ সালে একটি অনুশাসনের (Edict of Nantes) মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রাধীন ক্যাথলিক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হলো। 

  অনুরূপ ভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে স্পেনে ক্যাথলিক ধর্ম এবং নেদারল্যান্ডস-এ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপের ত্রিশ বৎসরের যুদ্ধের (Thirty Year's War) শেষে যে ওয়েস্টফালিয়া শান্তিচুক্তির (১৬৪৮) মাধ্যমে শান্তি স্থাপিত হয়, তাতে অগসবার্গ শান্তিচুক্তির শর্তগুলোকে সমর্থন করে ধর্মের উপর রাজাদের সার্বভৌম অধিকার স্বীকার করবার সঙ্গে সঙ্গে বিধর্মীদের নিজ পরিবারের মধ্যে (প্রকাশ্যে নয়) নিজ নিজ ধর্মপালনের অধিকার দেওয়া হয়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments