জ্বলদর্চি

একলা পাগল/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একলা পাগল 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কবি শ্যামলকান্তি দাশকে বহুদিন ধরে চিনি। খুব সম্ভব তার ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার সময় থেকে। যতদূর মনে পড়ে মেদিনীপুরের মহিষাদল কলেজের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রথমে আমি এই সুঠাম শ্যামবর্ণ যুবকটিকে দেখি। নিশ্চয়ই তার কোনো বৈশিষ্ট্য, লেখায় বা ব্যবহারে, তখনই চোখে পড়েছিল, যেই জন্যে সেই ঘটনা আমার মনে আছে। তারপর থেকে শ্যামলকান্তির লেখা এবং জীবনযাপন দুটিই আমি অনুসরণ করেছি। যেমন 'কৃত্তিবাস' যখন মাসিক পত্রিকা হয়ে বেরোয় তখন শ্যামল সেখানে কাজ করেছে কিছুদিন। তখন 'কৃত্তিবাস' কার্যালয় প্রতিদিন খোলা থাকত। শ্যামল সারা দুপুর সেই অফিস সামলাত। সন্ধের দিকে যেতাম আমি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং আর এক শ্যামল, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শ্যামল বহু তরুণ কবি ও গল্পকারের রচনা মনোনয়নে সাহায্য করেও নিজের লেখা চালিয়ে গিয়েছে। তখনই লক্ষ্য করেছি বাংলাভাষার ওপর এই ছেলেটির খুব দখল আছে এবং ব্যাকরণ জ্ঞানও খুব বেশি। মফসসল থেকে আসা এই কবিটি কলকাতার তরুণ কবিদের মধ্যে দাপটে নিজের স্থান অধিকার করে নেয়, তার নিজস্ব ভাষা ব্যবহারে।

কৃত্তিবাসে চাকরি করলে তো জীবিকার সংস্থান হয় না। তাই শ্যামল এসে যোগ দেয় আনন্দবাজারের 'আনন্দমেলা' দপ্তরে। সেখানেও তো আমার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ। ওই পত্রিকায় সে আমাকে দিয়ে জোর করে অনেক লেখা লিখিয়েছে। আবার আমিও তাকে মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে কৃত্তিবাসের জন্য লিখতে বলেছি।

পত্রিকা সম্পাদনারও একটা নেশা আছে। 'আনন্দমেলা' থেকে অবসর নেওয়ার পর শ্যামল নানান পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এবং তার নিজস্ব পত্রিকা 'কবিসম্মেলন' বাংলাভাষায় একটি বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। এই পত্রিকাটির প্রতি সংখ্যায় নতুন নতুন কবিদের কবিতা এবং অন্যান্য রচনার বৈচিত্র্য দেখে বোঝা যায় শ্যামল এই সম্পাদনার কাজে কতটা পরিশ্রমী। ব্যক্তিগত স্বভাবে সে খানিকটা জেদি ও গোঁয়ার। তার পরিশ্রম করার ক্ষমতাও সেরকমই অসাধারণ। তবে আমার সঙ্গে ব্যবহারে মাঝে মাঝে তার কিছু কিছু মান অভিমান ও ক্ষোভের পরিচয় পাওয়া গেছে। কিন্তু তা মিটে যেতেও দেখি সময়মতো। শুধু নিজের রচনা নিয়ে মগ্ন থাকাই নয়, আরও অনেকের সঙ্গে মিশে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা তার সর্বক্ষণের। এই গুণটি খুবই দুর্লভ। কবিরা সাধারণত আত্মনিমগ্ন আর কিছুটা স্বার্থপর হয়—এরকম গুজব আছে। শ্যামল এই গুজবের প্রতিবাদের প্রতিমূর্তি। মাঝেমাঝেই শ্যামল আমার কাছে এসে দু'একজন নতুন কবির কবিতা দেখিয়ে প্রাণখোলা প্রশংসা করেছে। মল্লিকা সেনগুপ্ত, জয়দেব বসু এবং আরও কয়েকজনের কবিতা সে আমাকে এনে দেখিয়েছে। শ্যামলের সূত্রেই আমি এদের চিনেছি। অথচ শ্যামল নিজের লেখা অযাচিত ভাবে কখনও দেখাতে চায়নি।

শ্যামলের একটি মাত্র দুর্বলতার কথাই আমি জানি, সে পারতপক্ষে গদ্য লিখতে চায় না। কয়েকবার আমার নির্দেশও সে অমান্য করেছে। যদিও আমার ধারণা গল্প উপন্যাস না হোক প্রবন্ধ বা গ্রন্থ সমালোচনার যোগ্য লেখার ক্ষমতা তার নিশ্চিত ছিল।

 কবি শ্যামলকান্তির কবিতা বিশ্লেষণের জায়গা এটা নয়, শুধু এটুকু বলা দরকার শ্যামল একসময় তার কবিতাকে বড়ো বেশি জটিল এবং রূপকাশ্রিত করে তুলেছিল। এটা আমার তেমন পছন্দের নয়। খুব আনন্দের কথা তার সাম্প্রতিকতম কবিতার বই 'একলা পাগল'-এ সে সহজ সুন্দরের অনুসরণ করেছে। এই কবিতাগুলি বহু বর্ণ।

'পিঠে চাবুক মারছে বিদ্যুৎ,
 মা মাগো ধরিত্রী আমার, 
খাওয়া দাওয়ার সময় এরকমই। 
কোনো বাছবিচার নেই

অনেকদিন পরে আবার
জিভে বাংলার স্বাদ পাচ্ছি।'

বই-এর নামটিও খুব উপযুক্ত হয়েছে। তবে এই নামে রমাপ্রসাদ বণিকের একটি অপূর্ব সুন্দর নাটক আছে। নানা কাজে জড়িয়ে থাকলেও কবিরা কিছুটা একলা তো বটেই। আর পাগল না হলে কি কবিতা লেখা যায় না কি?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

2 Comments

  1. শ্যামলকান্তি দাশ আমার খুব প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় কবি। আলোচনাটি ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. আমি শ্যামল কান্তি দাশের স্নেহধন্য। সুনীলদার লেখাটি খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete