জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল--২/ সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল (পর্ব-)

অন্তরীণ থাকে শুধু নিজ হাতে গড়া

পৃথিবীর নানারকম সিস্টেম দেখছি বলেই আরো জানতে ইচ্ছে হয়। তাও কি দেখছি জানোঅনেক কিছু দেখার আছে। দেখারজানার ও শোনার শেষ নেই শুরুও নেই।

--আচ্ছাকি এত দেখো রাতদিনএকটু বলবেআর ম্যাডামচায়ের কাপ দুটোকে কি দোলনার পাশের টী টেবিলটায় রাখতে পারিযদি অবশ্য আজ্ঞা করেন। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তোনতুবা......আবার একটু উস্কানি দিল পলাশ।

--রাখো নাসত্যিএক একদিন যেন বড্ড বেশি বিনয় দেখাও। আর তোমার চা করা তো-বেশ সময় নেবে নর্মাল হতে। আচ্ছা আমিই রেখে এসে বলছিকি দেখছি। তোমার তো নড়তে চড়তে এক বছর। মা ঠিকই বলতেন, 'মিন্টু মেয়ে হতে হতে ছেলে হয়ে গেছে।হি হি করে হাসতে হাসতে চা-এর কাপ দুটো টী টেবিলে রাখতে গেল শিমুল। ফিরে এলে পলাশ এবার মজা করতে লাগল।

--আমার ডাক নাম মিন্টু বেশ ভালো নাম বলোতোমার 'সিমটিনামের সাথে কিন্তু মিল আছে ঠাকুর-ই সব যোগাযোগ করিয়ে দেন।

--হুমতা ঠিকআসল কথায় আসি এবার। আজ আমায় না কথায় পেয়েছে। নির্ভেজাল সুরে বলে ফেলল শিমুল। জিজ্ঞেস করছিলে না কী দেখি এতকত কিছু দেখার আছে এই পৃথিবীতে। মানসিকশারীরিকসাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক। এখন দেখছি কোণের মেঘের আড়ালে ওই আবছা কমলা রঙের সূর্যকে। এই যে কলাকৌশল যিনি সৃষ্টি করলেননিজের মধ্যেই তিনি নিজে প্রতিষ্ঠিত। এটা কিন্তু প্রকৃতির দৈহিক গঠন বিদ্যা ঠিক যেমন অঙ্কনবিদ্যায় পদার্থের ঘনত্ব এবং প্রকৃ্ত দূরত্ব ও আকার দেখানো হয় তেমনি এই প্রাকৃতিক বিদ্যা -কারুরই ধার ধারে না।

তবুও তো একটা ছবি। আবার দেখোরেখার মতো স্থিরও হয়ে নেই। সে উঁকি মেরে দেখছে কি ভাবে সবার বাড়ি নিজেদের সম্মোহনবিদ্যায় সাজানোপ্রয়োগের জন্য নয় বরং মতবাদের দিক দিয়ে সে অন্তরের কথা বুঝতে পারে। চারিদিকে ফোটিনিয়া গাছের সারিগুলো কি সুন্দর দলবদ্ধ হয়ে থাকে সারা বছর। যেন ফোটিনিয়া ট্রেন। যারাই আসে এ বাড়িতে বেড়াতেতারাই খুব পছন্দ করে আমাদের পিছনদিকটাতাই নাবসন্তকালের এই সময়টায় আবার রেড টিপসগুলো সুন্দর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া শাদা ফুলে মাতামাতি করে রাখে । আমি কিন্তু আমাদের দেশে এ গাছ দেখি নি। ওই দেখো মেঘ তো সাঁতড়াতে সাঁতড়াতে উড়ে গেল কোথাও।

আর এটা তো বসন্তকাল। তাই শাদা ফুলগুলোই আগে আসে। আর তাতে ভিড় করে কত পাখির দলঃ নর্দার্ন কার্ডিনালব্লু থ্রোটেড হামিংবার্ডসেটোফাগাটানাগারসোরাগ্রিন হেরনহোয়াইট-উইংগ ডাভভার্মিলং ফ্লাইক্যাচারআমেরিকান রবিন... এইরকম কত রঙ-বেরঙের পাখিরা আসে। নিচের প্যাটিও-তে বার্ড ফীডারে রাখা খাবার কী সুন্দর খুঁটে খায়। আমার খুব ভালো লাগে দেখতে। কিছু কিছু পাখি আবার বার্ডবাথ-এ স্নান করে না। গাছে জল দি যখন সেই কলের মুখের ধারার জলে নেচে নেচে স্নান করে। খুব খুউউব সুন্দর লাগে দেখতে। আর আমার ভুলো মন তো। ক্যামেরা বা মোবিল থাকে না হাতে তখন। সব সময় তো দৌড়োচ্ছি। একটা কাজ সেরে আরেকটা কাজ। আরো বলছি এসব কারণখুব কষ্ট করে এইসব কাজ করি কারুর সাহায্য না নিয়ে। সবাই বলেকরার কি দরকার। সেটাও ঠিক-করি নিজের খেয়ালখুশি মত হয়ত এতসব না করলে আরো অন্য কোন কাজ করতে পারতাম। কিন্তু নেশা। এক পাগলপারা মন আমার।

--ওরে বাবা কত নামের পাখি আসে। আমি তো কিছুই জানি না এসব। তুমি তো Lowe's থেকে আনো সব খাবারতাই না শিমুল? আমার আমেরিকান বন্ধুরা বলছিলওদের বাড়িতে এত রকম পাখি আসে না।

--গরমকালে সকালবেলায় বড় গাছগুলোয় জল দেবার জন্য কলের ট্যাপ খুললেই বেশ কিছু পাখি এসে স্নান সেরে নেয়। হুম! 'Lowes' কাছের (হোম ইম্প্রুভমেন্ট স্টোরথেকেই আনি ওদের খাবার। পাঁউরুটি দিলে কাঠবেড়ালিচড়ুই যদিও বা খায় কিন্তু রেড কার্ডিনাল ওরা তো আবার এখানকার খাবার ছাড়া অন্য খাবার খায় না। চড়াইগুলোর আর কুচি কুচি ওয়ার্ম ইটিং ওয়ার্বলারদের দুস্টুমি দেখি। ভারী মজার দেখতে লাগে। জানো তো-এদের কিন্তু আলাদা ভাবে চেনা খুব মুশকিল। শীতকালে কোথায় যে থাকে এরাকে জানেএদের দেখলে কত স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসে। এখানেই মাঝে মাঝে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি তাই। কারণ শোবার ঘরের পশ্চিমের জানলা দিয়ে তো রোদ্দুর একদম আসেনাপাশের বাড়ির ওই ঢাউস গাছটার জন্য। কি যেন নাম গাছটার। তুমি জানোআজকাল পাশের বাড়ির বাগানের হাল হকিকৎ ও কিচ্ছু দেখা যায় না। কেন যেএত সব জীব-জগতচন্দ্র-সূর্যগ্রহ-নক্ষত্রআবার বিষাক্ত কিছু গাছ-গাছালিকীট পতঙ্গ কে জানে। শান্তি কি আছে ওদের মধ্যেকি বলো?

--ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব তো বলেছেন: “ ঈশ্বরের খুশি।” শোনো ম্যাডাম। আমি তো আর বটানির ছাত্র ছিলাম না। কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি...বলে পৃথিবী তোলপাড় করে হেসে উঠল পলাশ। তুমি এখানে যত পাখি আসে তাদের নাম কি সুন্দর জানোশিমুল ইটস রিয়ালি স্ট্রেঞ্জ!

--তাই বুঝিবটানির ছাত্র-ছাত্রীরা সব গাছজুওলজির ছাত্র ছাত্রীরা সব পাখি চিনবে আর কেউ চিনবে না-এ কোথায় লেখা আছেশুনি। পাখি যে আমার সবচেয়ে প্রিয়। ওদের মধ্যে যাদের চিনতে পারি না গুগলস সার্চ করে নামগুলো জেনে নি। আমি নিজে ভাবিআমি বোধহয় পাখি ছিলাম আগের জন্মে। আমি তো বটানি ও জুওলজি দুটোতেই ডাবল বি এস সি করেছি। আবার এখানে এসে মেজর মাইক্রোবায়োলজি ও মাইনর কেমিষ্ট্রি তে মাস্টার্স করলাম। পি এইচ ডী আর করি নি। কারণ উপযুক্ত কাজ পেয়ে গেলাম তো। বলছি কেন বলোতো-আমি দেখেছি সব সাবজেক্ট-ই ইন্টেরেস্টিংযদি তার মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। সাফল্যের হাসি হেসে বলে উঠল শিমুল।

--বাব্বাঃ তাই নাকিচোখ কপালে রেখে অবাক চোখে দেখল পলাশ। আচ্ছা শিমুলএবার একটু অন্য আলোচনা করি। ডোন্ট মাইন্ডওকে। তুমি পাস্ট লাইফ বিশ্বাস করো?

--ওহ! ইয়েস স্যার। এটাও বিশ্বাস করি যেপাস্ট লাইফ এর কাজকর্মের ভিত্তিতে বর্তমান জীবনের ফলাফল বা একচুয়াল রেজাল্ট আমরা দেখতে পাই। লকডাউনের সময় মহাভারতে দৌপদীর পাস্ট লাইফ পড়ে আমি তো অবাক। ওর কেন পঞ্চস্বামী বলোতোআমি অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি-কিন্তু সবাই বলে মা কুন্তী বলেছিলেন, “ তোমরা যা ভিক্ষা এনেছো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নাও।” না মশাইদ্রৌপদীর আগের দু জন্মের ভিত্তিতে কিন্তু পঞ্চ স্বামী হবার কথা অবধারিত ছিল। আমার এইসব পড়তে খুব ভালো লাগে।

--তাইআরে বলো বলো। দারুন তো। জানতাম না কিছুই।

--দ্রৌপদী প্রথম লাইফে ত্রেতাযুগে যখন দ্বিজকন্যা ছিলেন তখন পতিবাঞ্ছার জন্য শিবের তপস্যা করেছিলেন তখন শিব সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলেন। “পতিং দেহিপতিং দেহি”... এই কথা দ্রৌপদী পাঁচবার বলে বর চেয়েছিলেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে 'পঞ্চস্বামী হবেএই বর দিয়েছিলেন। তখন দ্রৌপদী কেঁদে আছড়ে পড়েন ওনার পায়ে। শিব বলেন, “তোমার পঞ্চস্বামী হবেন ত্রিভুবন বিখ্যাত।”

তার পরের জন্মে কেতকী নাম নিয়ে যখন ধ্যান করছিলেন গঙ্গার ধারে সেইসময় ঋতুমতী সুরভী গাভীর পিছনে পাঁচটা গবরাজে গবরাজে কলহ করার জন্য কেতকীর ধ্যান ভেঙ্গে যায়-ধ্যান ভাঙ্গলেই এই দৃশ্য দেখতে পেয়ে হেসে ফেলেন কেতকী। তাই সুরভী গাভীও অভিশাপ দিয়েছিল কেতকী কে যে, “তোমার যখন পঞ্চস্বামী হবে তখন বুঝবে।” কাজেই বিধির বিধান খন্ডাবার নয়। এটা তো মানতেই হয়। আমি তো বিশ্বাস করি এসব খুব।

সেইজন্যলাইফটাকে সব সময় মনে করি কিছু ছোট গল্প – অনুগল্পের সংকলনপ্রিটেন্ডিং টু বি এ নভেল। ধরা -বাঁধা নাওড়ে সেই সব কথা ছোট ছোট গল্পের আকারে। জীবনকে চলতে দিতে হয়। জানোতোসমস্ত কথারই একটা নির্দ্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময় চলে গেলে সব কথারই মৃত্যু হয়। আমরা জড়পদার্থ হয়ে পড়ি। এ যেন পদ্মপাতায় টলটলে জলের মতো জীবন আমাদের।

মাঝে মাঝে আমি ভাবি আমাদের জীবন একটা ফার্স্ট-ফরোয়ার্ড বাটন ।

(চলবে)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments