জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত /পর্ব-১০/সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত  
পর্ব-১০
সুদর্শন নন্দী 

১৮৮৩, ৫ই জুন। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর ভক্তদের সাথে রয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ হাজরা কে বললেন —  তিনিই আস্তিক, তিনিই নাস্তিক; তিনিই ভাল, তিনিই মন্দ; তিনিই সৎ, তিনিই অসৎ; জাগা, ঘুম এ-সব অবস্থা তাঁরই; আবার তিনি এ-সব অবস্থার পার।
এরপর শোনালেন গল্প।

  একজন চাষার বেশি বয়সে একটি ছেলে হয়েছিল। ছেলেটিকে খুব যত্ন করে। ছেলেটি ক্রমে বড় হল। একদিন চাষা ক্ষেতে কাজ করছে, এমন সময় একজন এসে খবর দিলে যে, ছেলেটির ভারী অসুখ। ছেলে যায় যায়। বাড়িতে এসে দেখে, ছেলে মারা গেছে। পরিবার খুব কাঁদছে, কিন্তু চাষার চোখে একটুও জল নাই। পরিবার প্রতিবেশীদের কাছে তাই আরও দুঃখ করতে লাগল যে, এমন ছেলেটি গেল এঁর চোখে একটু জল পর্যন্ত নাই। অনেকক্ষণ পরে চাষা পরিবারকে সম্বোধন করে বললে, ‘কেন কাঁদছি না জানো? আমি কাল স্বপন দেখেছিলুম যে, রাজা হয়েছি, আর সাত ছেলের বাপ হয়েছি। স্বপনে দেখলুম যে, ছেলেগুলি রূপে গুণে সুন্দর। ক্রমে বড় হল বিদ্যা ধর্ম উপার্জন কল্লে। এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল; এখন ভাবছি যে, তোমার ওই এক ছেলের জন্য কাঁদব, কি আমার সাত ছেলের জন্য কাঁদব।’ জ্ঞানীদের মতে স্বপন অবস্থাও যেমন সত্য, জাগা অবস্থাও তেমনি সত্য।  

১৮৮৩, ১০ই জুন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ  ভক্তসঙ্গে রয়েছেন। 
  ঠাকুর বলছেন, এক বই আর কিছু নাই। সেই পরব্রহ্ম ‘আমি’ যতক্ষণ রেখে দেন, ততক্ষণ দেখান যে, আদ্যাশক্তিরূপে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন।যিনিই ব্রহ্ম তিনিই আদ্যাশক্তি।এবার তিনি এক রাজার উপমা দিলেন। একজন রাজা বলেছিল যে, আমায় এককথায় জ্ঞান দিতে হবে। যোগী বললে, আচ্ছা তুমি এককথাতেই জ্ঞান পাবে। খানিকক্ষণ পরে রাজার কাছে হঠাৎ একজন যাদুকর এসে উপস্থিত। রাজা দেখলে, সে এসে কেবল দুটো আঙুল ঘুরাচ্ছে, আর বলছে, ‘রাজা, এই দেখ, এই দেখ।’ রাজা অবাক্‌ হয়ে দেখছে। খানিকক্ষণ পরে দেখে দুটো আঙুল একটা আঙুল হয়ে গেছে। যাদুকর একটা আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে বলছে, ‘রাজা, এই দেখ, এই দেখ।’ অর্থাৎ ব্রহ্ম আর আদ্যাশক্তি প্রথম দুটা বোধ হয়। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর দুটা থাকে না! অভেদ! এক! যে একের দুই নাই। অদ্বৈতম্‌।

  ১৮৮৩, ১৫ই জুন। দশহরা আজ। দক্ষিণেশ্বরে ভক্তদের  নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রাখাল, অধর, মাস্টার, রাখালের বাপ, বাপের শ্বশুর সবাই রয়েছেন। 
শ্বশুর জিজ্ঞাসা করলেন — মহাশয়, গৃহস্থাশ্রমে কি ভগবান লাভ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে পাঁকাল মাছের উপমা দিয়ে বললেন — কেন হবে না? পাঁকাল মাছের মতো থাক। সে পাঁকে থাকে, কিন্তু গায়ে পাঁক নাই। আর ঘুষকীর মতো থাক। সে ঘর-কন্নার সব কাজ করে কিন্তু  মন উপপতির উপর পড়ে থাকে। ঈশ্বরের উপর মন ফেলে রেখে সংসারের কাজ সব কর। কিন্তু বড় কঠিন। 

  ঠাকুর আবার তেঁতুল, আচারের এবং সোনা গলানোর উপমা দিলেন। বললেন-আমি ব্রহ্মজ্ঞানীদের বলেছিলুম, যে-ঘরে আচার তেঁতুল আর জলের জালা সেই ঘরেই বিকারের রোগী! কেমন করে রোগ সারবে? আচার তেঁতুল মনে করলে মুখে জল সরে। পুরুষের পক্ষে স্ত্রীলোক আচার তেঁতুলের মতো। আর বিষয় তৃষ্ণা সর্বদাই লেগে আছে; ওইটি জলের জালা। এ তৃষ্ণার শেষ নাই। বিকারের রোগী বলে, এক জালা জল খাব! বড় কঠিন। সংসারে নানা গোল। এদিকে যাবি, কোঁস্তা ফেলে মারব; ওদিকে যাবি, ঝাঁটা ফেলে মারব; এদিকে যাবি জুতো ফেলে মারব। আর নির্জন না হলে ভগবানচিন্তা হয় না। সোনা গলিয়ে গয়না গড়ব তা যদি গলাবার সময় পাঁচবার ডাকে, তাহলে সোনা গলানো কেমন করে হয়? চাল কাঁড়ছ একলা বসে কাঁড়তে হয়। এক-একবার চাল হাত করে তুলে দেখতে হয়, কেমন সাফ হল। কাঁড়তে কাঁড়তে যদি পাঁচবার ডাকবে, ভাল কাঁড়া কেমন করে হয়?
একজন ভক্ত জানতে চাইলেন — মহাশয়, এখন উপায় কি?
ঠাকুর এবার বুড়ী ছোঁয়ার উদাহরণ দিলেন। বললেন-কিছুদিন নির্জনে থাকতে হয়। বুড়ী ছুঁয়ে ফেললে আর ভয় নাই। সোনা হলে তারপরে যেখানেই থাক। নির্জনে থেকে যদি ভক্তিলাভ হয়, যদি ভগবানলাভ হয়, তাহলে সংসারেও থাকা যায়। (রাখালের বাপের প্রতি) তাই তো ছোকরাদের থাকতে বলি। কেননা, এখানে দিন কতক থাকলে ভগবানে ভক্তি হবে। তখন বেশ সংসারে গিয়ে থাকতে পারবে।”
সাধন নিয়ে কথা হচ্ছে। বললেন সাধন বড় দরকার। তবে হবে না কেন? ঠিক বিশ্বাস যদি হয়, তাহলে আর বেশি খাটতে হয় না। গুরুবাক্যে বিশ্বাস!

  ঠাকুর এবার উপমা দিয়ে বললেন-ব্যাসদেব যমুনা পার হবেন, গোপীরা এসে উপস্থিত। গোপীরাও পার হবে কিন্তু খেয়া মিলছে না। গোপীরা বললে, ঠাকুর! এখন কি হবে? ব্যাসদেব বললেন, আচ্ছা তোদের পার করে দিচ্ছি, কিন্তু আমার বড় খিদে পেয়েছে, কিছু আছে? গোপীদের কাছে দুধ, ক্ষীর, নবনী অনেক ছিল, সমস্ত ভক্ষণ করলেন। গোপীরা বললে, ঠাকুর পারের কি হল। ব্যাসদেব তখন তীরে গিয়ে দাঁড়ালেন; বললেন, হে যমুনে, যদি আজ কিছু খেয়ে না থাকি, তোমার জল দুভাগ হয়ে যাবে, আর আমরা সব সেই পথ দিয়ে পার হয়ে যাব। বলতে বলতে জল দুধারে সরে গেল। গোপীরা অবাক্‌; ভাবতে লাগল — উনি এইমাত্র এত খেলেন, আবার বলছেন, ‘যদি আমি কিছু খেয়ে না থাকি? 
১৮৮৩, ১৭ই জুন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নিজের ঘরে আহার সেরে বিশ্রাম করছেন। অধর ও মাস্টার এসে প্রণাম করলেন। একজন তান্ত্রিক ভক্তও এসেছেন। রাখাল, হাজরা, রামলাল প্রভৃতি ঠাকুরের কাছে আজকাল থাকেন। সংসার নিয়ে কথা হচ্ছে।  

  শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের জনক রাজার উপমা দিয়ে বলছেন— সংসারে হবে না কেন? তবে বড় কঠিন। জনকাদি জ্ঞানলাভ করে সংসারে এসেছিলেন। তবুও ভয়! নিষ্কাম সংসারীরও ভয়। ভৈরবীকে দেখে জনক মুখ হেঁট করেছিল; স্ত্রীদর্শনে সঙ্কোচ হয়েছে! ভৈরবী বললে, জনক! তোমার দেখছি এখনও জ্ঞান হয় নাই; তোমার স্ত্রী-পুরুষ বোধ রয়েছে। কাজলের ঘরে যতই সেয়ানা হও না কেন, একটু না একটু কালো দাগ গায়ে লাগবে। 

  এবার বিড়ালের উপমা টেনে বললেন- বীরভক্তিই সার; ঠিক ভক্তের কোন ভয় ভাবনা নাই। মা সব জানে। বিড়াল ইঁদুরকে ধরে একরকম করে, কিন্তু নিজের ছানাকে আর-একরকম করে ধরে।

  ১৮৮৩, ৬ই জুন। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-দেবালয়ে, শিবমন্দিরে সিঁড়িতে বসে আছেন। গরম খুব। একটু পরে সন্ধ্যা হবে।  মাস্টার এসে ঠাকুরকে প্রণাম করে তাঁর পাদমূলে শিবমন্দিরের সিঁড়িতে বসলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে পানা পুকুরের ও নুনের পুতুলের উপমা দিয়ে বললেন — তাঁকে কি বুঝা যায় গা! আমিও কখন তাঁকে ভাবি ভাল, কখন ভাবি মন্দ। তাঁর মহামায়ার ভিতের আমাদের রেখেছেন। কখন তিনি হুঁশ করেন, কখন তিনি অজ্ঞান করেন। একবার অজ্ঞানটা চলে যায়, আবার ঘিরে ফেলে। পানা ঢাকা পুকুর, ঢিল মারলে খানিকটা জল দেখা যায়, আবার খানিকক্ষণ পরে পানা নাচতে নাচতে এসে সে জলটুকুও ঢেকে ফেলে। আমরা কি বুঝব! এক সের ঘটিতে কি দশ সের দুধ ধরে? নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিয়ে আর খবর দেয় না। গলে মিশে যায়।                                    (ক্রমশঃ) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
  

Post a Comment

0 Comments