জ্বলদর্চি

আউটসোর্সিং /শোভা পাল (বেরা)

 আউটসোর্সিং

শোভা পাল (বেরা)

বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশকে যখন প্রতিষ্ঠানগুলি খরচ কমিয়ে বেশি লাভের চিন্তা করে তখন থেকেই আউটসোর্সিং শুরু হয়। পেশাদার ব্যবসায়ীদের কাছে এখন এটা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কাজের পরিধি এখন শুধুমাত্র নিজের দেশে গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অর্থনীতিতে এর সুপ্রভাব থাকলেও এর খারাপ দিকও কিছু আছে। দুটি দিকের কথাই এখানে আলোচনা করা হয়েছে।

কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির দ্বারা করানো হয়ে থাকে তাকেই মূলত আউটসোর্সিং বলা হয়। অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ নিজেরা না করে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে করিয়ে নেওয়া। অনেক কাজ আছে যেগুলো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবসময় করা যায় না বা যদিও করানো যায় তা খরচ অনেক বেশি পড়ে এবং অনেক সময়, সময়ও বেশি লাগে তখন প্রতিষ্ঠানগুলি ওই কাজগুলো বাইরে থেকে করিয়ে নেয়, এটাই হল আউটসোর্সিং।

আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গেই সম্পর্কিত আরেকটি শব্দ ফ্রিল্যান্সিং। প্রতিষ্ঠানিকভাবে না করে ব্যক্তিগতভাবে যখন কেউ আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন তখন তাদের ফ্রিল্যান্সার বলা হয়। নিজের স্বাধীনতা এবং পছন্দমত কাজ করাই হল ফ্রিল্যান্সিং। যিনি কাজ দেবেন তার সাথে যোগাযোগ হবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কে কাজ দেবেন কি কাজ সে সম্পর্কে সমস্ত কিছু তথ্য দেওয়া থাকে ওয়েবসাইটে। দুজনার মাঝখানে থেকে কাজ এবং অর্থপ্রাপ্তির বিষয় নিশ্চিত করে সেই ওয়েবসাইট। মূলত কম্পিউটারের সাহায্যে করা যায় এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে আদান প্রদান করা যায় এমন যেকোনো কাজই করা সম্ভব ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে। এখানে একদিকে রয়েছে যখন ইচ্ছা তখন কাজ করার স্বাধীনতা, অন্যদিকে রয়েছে কাজের ধরন বাছাই করার স্বাধীনতা। এখানে রয়েছে টাইপিং (ডেটা এন্ট্রি) থেকে শুরু করে গ্রাফিক ডিজাইন ওয়েব পেজ তৈরী, ফটোগ্রাফি ভিডিও এডিটিং, অ্যানিমেশন, প্রোগ্রামিং, সফটওয়ার তৈরী সবকিছুই করা সম্ভব। যদি একটি কম্পিউটার আর তাতে ইন্টারনেট সংযোগ থাকে তাহলেই ফ্রিল্যান্সার যে কোনো জায়গাতে বসেই যখন খুশি আউট সোর্সিংয়ের কাজগুলো করতে পারেন।

বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিংয়ের বিশাল বাজারে ভারতের পাশাপাশি ফিলিপিনস্, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া এবং আরও অনেক দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আউটসোর্সিংয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে সমস্যাগুলি হল ধীরগতির ইন্টারনেট এবং এই কাজ করে পাওয়া টাকা নিজের দেশে নিজের অ্যাকাউন্টে আনা। এছাড়া আর একটি বড় বাধা হচ্ছে বিদ্যুৎ সমস্যা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে অনেক সময় সময় মতো কাজ ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়াও আউটসোর্সিংয়ে আর একটি সমস্যা হল কোম্পানীর ভিতরকার তথ্যের নিরাপত্তা। এর মধ্যে সংস্থার গোপনীয়তা প্রকাশ পেতে পারে। আউটসোর্সিংয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে চাই সুলভ মূল্যে দ্রুতগতি ইন্টারনেট পরিষেবা এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার উন্নতি। এছাড়া বিশেষভাবে প্রয়োজন নতুন নতুন টেকনোলজির প্রফেশনাল ট্রেনিং।

ভারতে এখনও আউটসোর্সিংকে পেশা হিসাবে মেনে নিতে পারেন না অনেকেই। কারণ পেশা হিসাবে এখন তেমন সম্মান দেয় না ফ্রিল্যান্সারদের, এর আসল কারণ হল তার কাজ বা কাজের প্রক্রিয়া অধিকাংশ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না। একে পেশা করে ভবিষ্যৎ গড়তে হলে অবশ্যই তাকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। নিজের মধ্যে উদ্ভাবনী গুণ থাকতে হবে। যোগাযোগের জন্য কম্পিউটারের পাশাপাশি ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। যে যে শাখায় এক্সপার্ট তার সে শাখায় কাজ করা উচিত। যে সব সাইট আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় সেইসব সাইটকে  বলা হয় ফ্রিল্যান্স মার্কেট প্লেস। ওডেক্স, ফ্রিল্যান্সার হল এ ধরনের জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের উদাহরণ। এছাড়াও বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে ফ্রিল্যান্সিং আউটসোর্সিং লিখে সার্চ করলেও অনেক ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে। ফ্রিল্যান্সার হিসাব কাজ করার জন্য আগে নির্দিষ্ট বিষয় নির্বাচন করতে হবে এবং তার উপর দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যদি কারও আঁকাআঁকি ভালো লাগে তাহলে তার ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স ডিজাইন নির্বাচন ঠিক হবে। যদি কারো লেখালেখি তাহলে লেখালেখিতেই ফ্রিল্যান্সার হতে পারেন। মূল ব্যাপার হল যার যে কাজ ভাল লাগে সেই কাজেই নিজেকে দক্ষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারলে সাফল্য আসবে। দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি মার্কেট প্লেস সম্পর্কেও ভাল ধারণা থাকতে হবে। নিজেকে সবসময় আপ-টু-ডেট রাখতে হবে তার জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।

আউটসোর্সিং তরুণ প্রজন্মের কাছে কর্মসংস্থানের এক অভাবনীয় সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে  বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ এসেছে। আউটসোর্সিংয়ের জনপ্রিয়তা ও মানুষের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু উদ্যোক্তা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষকে প্রতারিত করছে। যদিও আমরা জানি বিশ্বের সব জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্স মার্কেট প্লেসের রেজিস্ট্রেশন ফি কিন্তু এসব সাইটে ফি নিয়ে তরুণদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এবং একসময় তাদের ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দিচ্ছে।  সর্বোপরি অর্থের বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন, কমিশন প্রথা বিষয়ের উপর দক্ষতা না থাকা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ আউটসোর্সিং এর কাজকে বিভ্রান্ত করছে। চটকদার বিজ্ঞাপনের কারণে আউটসোর্সিং সম্পর্কে ধারণা নেই এরকম অনেকের মনে বিরূপ ধারণার জন্ম দিচ্ছে। তাই ফ্রিল্যান্স মার্কেট প্লেসে ঢুকতে গেলে সতর্কতা মেনে এগোতে হবে।

আমরা এখন আমাদের সমাজের উপর এর প্রভাব দেখতে চাই। এর প্রভাবের ফলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার যে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে তা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়।বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত তার দক্ষ,শিক্ষিত  মানবসম্পদই ইনফরমেশন টেকনলজির সাফল্যের চাবিকাঠি, যা ভারতের অর্থনীতিকে উন্নত করেছে।মহিলারাও অনেকে এই পেশায় যুক্ত হয়ে তাদের ভবিষ্যৎ এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে দৃঢ় করতে পারেন।কিন্তু এই  আউটসোর্সিংয়ের হাত ধরে আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে বৈদেশিক সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনযা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে । একথা সত্য যে এর মাধ্যমে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং আয় করার সুযোগ পাচ্ছে। তথাপি  মনে হয় আমাদের অতীত সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পেশাগত জীবনের সাথে ব্যক্তিগত জীবনের দূরত্ব বজায় রাখাই কাম্য।

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা, কম খরচে গুণগতমানসম্পন্ন উৎপাদন, বিভিন্ন সমস্যার সহজ সমাধানের উপায় হিসাবে আউটসোর্সিংকে গ্রহণ করা হয়েছে। চীন, ফিলিপাইন এর মতো দেশ থেকেও এর সুযোগ পাওয়া গেলেও সহজ ডেটা এন্ট্রি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল বিষয়ের উপযুক্ত ও দক্ষ ব্যক্তির সহজলভ্যতার জন্য আউটসোর্সিং- এর ক্ষেত্রে  ভারতের জুড়ি মেলে না। বিশেষ করে সফ্টওয়ার আউটসোর্সিংয়ে অনেক উন্নত দেশই ভারতকে প্রথম স্থান দিয়েছে।  কারণ হিসাবে বলা যায় এই ক্ষেত্রে যারা কাজ করেন তারা অনেক বেশী দক্ষ এবং নিজেদেরকে সবসময় বিভিন্ন ট্রেনিং এর  মাধ্যমে উপযুক্ত করে রাখার চেষ্টা করেন। এছাড়াও তারা নতুন নতুন ধারণা দিতে পারেন। বর্তমানে এক সার্ভেতে  আশি শতাংশ ইউরোপীয়ান এবং আমেরিকান আউটসোর্সিং ফার্ম ভারতকে এক নম্বর আউটসোর্সিং ডেস্টিনেশন বলে চিহ্নিত করেছে।

ভারতের মতো দেশে যেখানে বহু কোটি মানুষ শিক্ষিত বেকার সেখানে আউটসোর্সিংয়ের মা ব্যবস্থা নিজেই করা সম্ভব। তবে তার জন্য চাই পরিশ্রম, পরিশ্রম ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

1 Comments

  1. ভাই আপনার আটিকেল টা পরে অনেক ভালো লাগলো

    অনলাইন ইনকাম সাইট ২০২২ ফ্রিল্যান্সিং করে প্রতি মাসে 60 থেকে 70 হাজার
    ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার আগে আপনাকে যে সমস্ত বিষয়বস্তু জানতে হবে
    যদি আপনি না জেনে কোন মার্কেটপ্লেসে এপ্লাই করে থাকেন
    তাহলে আপনি অযথা সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয় তাই পুরো
    আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন আরো পড়ুন

    ReplyDelete