জ্বলদর্চি

Zen Z Poetry Manifesto-1/Arun Das

Zen Z Poetry Manifesto/Arun Das
জেন জেড কবিতার ম্যানিফেস্টো/অরুণ দাস

পর্ব-১

এক .

বস্তু বিষয় প্রাণ শব্দ ধ্বনির সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অনুভবই কবিতার প্রাণ। এই অনুভবের পথ অতিক্রম করলে কবি এক উজ্জ্বল সৌন্দর্যময় সোনালি জগতে পৌঁছান।
 বর্ণ ও শব্দ হল অলৌকিক সঙ্কেতসূত্র। যা যেমন রহস্যময় তেমনি অত্যন্ত শক্তিসম্পন্ন। শব্দ এমন এক প্রতীক, যার ব্যবহারের নৈপুণ্যে বদলে দেওয়া যায় প্রথাগত ভাবনাকে। কবিতা শব্দরূপে প্রকাশিত ব্রহ্ম। বস্তু ও বিষয়ের চিন্তায় ‘শব্দ' এমন এক প্রতীক যার সঠিক ব্যবহারে আমরা কল্পনাতীত অনন্তের ধারণাকে জাগ্রত করতে পারি।

আমাদের বহুরূপী বাহ্যিক জগতের মতো একটি বর্ণময় অন্তর্জগত আছে। বাইরে জগতের চমৎকারিত্ব, বিস্ময়, সৌন্দর্য, বিশালতা ও মহিমা আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু তা অন্তর্জগতের অনন্ত গুণ, অনন্ত শক্তি, অনন্ত আনন্দ, অনন্ত শান্তির প্রতিরূপ মাত্র। প্রাণী বা বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত মনের প্রকৃত স্বরূপ নিহিত আছে অন্তর্জগতে।

আমাদের এই বাহ্যজগতের দ্বন্দ্বময় রূপকে ছাড়াতে পারলে কবি পৌঁছে যেতে পারেন এই সত্য স্বরূপে। যা উচ্চতর চেতনা থেকে আরো সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর পরম চেতনায় পৌঁছে দেয় কবির অনুভবকে। উচ্চতর চেতনা কবির আত্মিক জ্ঞানকে জাগিয়ে তোলে ফলে বস্তু-বিশ্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভবের দরজা তাঁর সামনে খুলে যায়। কিন্তু পরমচেতনা কবির সামনে খুলে দেয় অজ্ঞানতার জ্ঞান ও পারিমার্থিক জ্ঞানের দরজা ৷ যার সাহায্যে তিনি উপলব্ধি করেন বস্তু-বিশ্বের পূর্ণাঙ্গ স্বরূপ। যা তাঁকে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও অতিসূক্ষ্ম অনুভবের পথে নিয়ে যায়। প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর মধ্যেকার দর্শনকে অতি সহজে অনুভব করতে পারেন তিনি। কবি অনুভব করেন ত্রিমূর্তি, ত্রিকালদর্শী, পরম চেতনার সূক্ষ্ম ধ্বনিকে। আর এখান থেকেই সূচনা হয় জেড্ প্রজন্মের কবিতা যুগের।

দুই.

উচ্চতর চেতনার খোঁজ যেন আত্মার স্বরূপের খোঁজ, আত্মিক অন্বেষণের সুখ। আত্মার সূক্ষ্ম ভাবের অনুভব। পরমচেতনা উপলব্ধ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগ। আরো সূক্ষাতিসূক্ষ অনুভবের উপলব্ধি।

প্রতিটি বস্তু, ভাবনা, বিষয়ের মধ্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সত্য-বিষয়-ভাবনা-সূক্ষ্ম দর্শন লুকিয়ে থাকে। কবি পরমচেতনায় এই সূক্ষ্ম দর্শনকে উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তার তৃপ্তি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। ব্যক্তিগত সুখের প্রভাব ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিধিতে জাগ্রত হতে চায়।

তিন.

শব্দ 'ব্ৰহ্ম'। প্রকৃত পক্ষে বর্ণ-ই ব্রহ্ম। বর্ণ-ই ব্রহ্মাণ্ড। উচ্চতর চেতনায় এই ব্রহ্মের মধ্যেকার স্বরূপকে আবিষ্কার করা যায়। কথায় বলে ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করা যায়। পরমচেতনায় এই স্বরূপের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ ঘটিয়ে পরমাত্মিক আনন্দ লাভ করা যায়।

উচ্চতর চেতনায় ব্রহ্মকে সত্য এবং তা থেকে নির্গত শক্তিকে মিথ্যা মনে হয়। কিন্তু যেহেতু ব্রহ্ম সত্য, তা থেকে উদ্ভাসিত শক্তিরাশিও সত্য। জড় জাগতিক শক্তি যদিও সাময়িক, কিন্তু তা মিথ্যা নয়। এই সততার উপলব্ধিই পরমচেতনার কবির কাছে পূর্ণ জ্ঞান। এটিই তাঁর কাছে প্রকৃত পারিমার্থিক স্তর। এই পর্যায়ে উন্নীত হয়ে তিনি জগতের সব কিছুকে চিন্ময় শক্তির স্ফুলিঙ্গ রূপে উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি বস্তু-বিষয় উপাদানের প্রকৃত স্বরূপ, পরম সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবেন।

চার.

আপাতদৃষ্টিতে আমরা কোনো বস্তু-প্রাণী-দৃশ্য-বিষয়ের যা কিছু দেখি তা তার বাহ্যিক সত্য। দেহাত্মবোধ দ্বারা অনুভূত সত্য।

এই সত্যের বাইরেও বস্তু-প্রাণী-দৃশ্য বিষয়ের এক অন্তর্নিহিত মহৎ সত্য আছে। যা তার পরম সত্য। কবি তাঁর হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে এই পরম সত্যকে অনুভব করতে পারলে, দেহাত্মবোধ থেকে মুক্ত হতে পারবেন। এর ফলে সৃষ্টির প্রকৃত সৌন্দর্যের দরজা তাঁর সামনে খুলে যায়। তাঁকে মুক্ত করে। অনুভূতি গভীর-গভীরতর করে। অনুভবের এই সত্যকে উপলব্ধি করে তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারলেই কবি জীবন পূর্ণ সার্থক হয়।


পাঁচ.

উচ্চতর চেতনায় মানুষ আবেগবর্জিত হতে চান। পরমচেতনায় আবেগ এক অন্যতম উপাদান। সু ও স্ব-নিয়ন্ত্রিক আবেগ-চেতনা-অবচেতনা ও অচেতনের আত্মিক উপলব্ধির দ্বারা কবি পরমচেতনার স্বরূপকে অনুধাবন করতে পারেন।

ব্যক্তি বা বস্তুমনের প্রতিটি উপাদানই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

উচ্চতর চেতনায় কবির সামনে বস্তু-বিষয়ের সূক্ষ্মতম অনুভবের পথ খুলে দেয়। কিন্তু আবেগ-অবচেতনার বর্জন তাঁর অনুভূতিকে সীমায়িত করে। আর পরমচেতনায় কবি বস্তু-বিষয়ের সূক্ষ্মতম ধ্বনিকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে উপলব্ধি করতে পারেন। তার কাছে কল্পনা-আবেগ-চেতন-উচ্চতর চেতন, প্রতিটিই অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান।

উচ্চতর চেতনা ব্যক্তিকে নিজের প্রকৃত স্বরূপ ও পারিপার্শ্বিকতার উপলব্ধিতে সাহায্য করে। কিন্তু এর অর্থ আবেগ-চেতনা কিংবা অবচেতনাকে বর্জন নয়। এদের সুনিয়ন্ত্রণ। পূর্বলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অস্বীকার নয় বরং তাকে উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে নিজের আত্মিক উপলব্ধিকে উন্নিত করা।

অর্থাৎ উচ্চতর চেতনার জ্ঞান অর্থে পূর্বলব্ধ জ্ঞানের সম্পূর্ণ বর্জন কখনো নয়। তা ঘটলে কবি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়বেন। ফলে কবির আত্মিক উন্নতি ঘটলেও পরমচেতনায় ভাবনাকে অনুভব করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।


ছয়.

উচ্চতর চেতনায় কবি প্রামাণিক সূত্রকে অগ্রাহ্য করতে চান। আপন আত্মিক শক্তিকে জাগ্রত করে বস্তু বিশ্বের জ্ঞান আহরণ করেন। জ্ঞান এখানে সীমাময়। প্রামাণিক সূত্র থেকে প্রাপ্তজ্ঞানকে স্বীকার করেই পরমচেতনার পথে সহজে পৌঁছানো যায়। জ্ঞান সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র পরিধিতে ব্যপ্ত হয় না। এখানে জ্ঞানের কোনো সীমা নেই। জ্ঞান অসীম, অনন্ত।

পরমচেতনায় শব্দের সংযোগ কবিতার যান্ত্রিক কাঠিন্যকে প্রকাশ করে না। এর সাহায্যে মন্ত্রের মধ্যেকার পরমাত্মিক জগতকে অনুধাবন করা যায়। ছোঁয়া যায় বর্ণের মধ্যেকার ব্রহ্ম ও ব্রহ্মাণ্ডকে।

উচ্চতর চেতনায় শব্দের সংযোগ কবির উপলব্ধির পরিধিকে বিস্তৃত করে। এখানে বস্তুবিষয়ের স্বরূপকে জানা যায়। পরমচেতনায় শব্দের সংযোগ, উপলব্ধির আত্মিক-পরম পরিধিকে বিস্তৃত করে। বস্তুবিষয়ের স্বরূপের সঙ্গে কবির আত্মিক স্বরূপের সংযোগকে অনুভব ও প্রকাশ করা যায়।


সাত.

বস্তু ও বিশ্বের প্রকৃত জ্ঞানই উপলব্ধির পরম সত্য। এর সঙ্গে প্রয়োজন সব ইন্দ্রিয়ের উপর কবির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক জ্ঞান আহরণের ক্ষমতার বাইরে যে সকল জ্ঞানতত্ত্ব আছে অসম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ইন্দ্রিয়ের উপর কবির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হলে জ্ঞানের উপলব্ধিও যথার্থ হয়। এই জ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগের দ্বারা কবি তাঁর অনুভবকে কবিতায় পূর্ণাঙ্গভাবে ধরে রাখতে পারেন। উচ্চতর চেতনা কবির প্রভূত আত্মিক উন্নতি ঘটায়। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ না হলে পরমচেতনার পারিমার্থিক জ্ঞান তাঁর কাছে অস্পস্ট হয়ে পড়ে। পরমচেতনার পূর্ণ উপলব্ধি তাঁর দ্বারা সম্ভব হয় না।


আট.

মানুষের মন অনন্ত পাঠশালা। আমাদের সব জ্ঞানই মনের অংশ মাত্র। বাইরের জগতের সৌন্দর্য আমাদের হৃদয় মনকে অনুরণিত করলে মনের গভীরে নতুন নতুন শিক্ষনীয় বিষয় তৈরী হয় ।

মনের গভীরে বিক্ষিপ্ত থাকা বিষয়গুলির শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার নামই শিক্ষা। বাহ্যিক বা আত্মিক সব জ্ঞানই মনের গভীরে থাকে। এই জ্ঞানের কিছু স্পষ্ট হয়, কিছু অবচেতনার গভীরে আচ্ছন্ন থাকে। মনের গভীরে অনুরণন এই আচ্ছন্নতাকে মুক্ত করে। অজানা অচেনা জ্ঞানের ভাণ্ডার অবচেতনা থেকে চেতনায় মুক্ত হয়। ফলে অজ্ঞানতার অন্ধকার মুছে যায়। অর্থাৎ জ্ঞানলাভ আসলে অবচেতন বা অচেতনে আবদ্ধ পূর্ণলব্ধ জ্ঞানের মুক্তি। পূর্বলব্ধ অনুভূতির মুক্তি। পূর্বলব্ধ সংস্কার সমষ্টি ও জ্ঞান ভাণ্ডারের আবিষ্কার।

কবি মনের শক্তিকে একাগ্রভাবে কেন্দ্রীভূত করে কোনো বস্তু-বিষয়ের অধ্যয়নই প্রকৃত কাজ। এটাই জ্ঞানের অজানা অচেনা রহস্যময় জগৎ সন্ধানের একমাত্র পথ।


নয়.

উচ্চতর চেতনায় কবি উপলব্ধি করতে পারেন জড় জাগতিক আকাশের মধ্যেকার নানা অজানা অসাধারণ রহস্যকে। তিনি আবিষ্কার করেন বস্তু-বিষয়ের মায়াময় অজানা রূপ। কিন্তু এই মায়াময় জড় জাগতিক আকাশের বাইরে রয়েছে এক পরম সৌন্দর্যময় জগৎ।

তা অতিক্রম করতে পারলে অনুভব করা যাবে জীব জগতের অতীন্দ্রিয় স্বরূপ, প্রকৃত স্বরূপ।

পরমচেতনার খোঁজ কবিকে নিয়ে যাবে সেই অসম্ভব মুগ্ধতার সৌন্দর্যময় অপূর্ব জগতে ৷


দ্শ.

উচ্চতর চেতনায় ব্যক্তির আত্মিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। স্ব-স্বত্বাকে তিনি অনুধাবন করতে পারেন। ফলে প্রাকৃতিক বস্তু-বিষয়ের অন্তর্নিহিত সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন।

কিন্তু কেবল জড় জাগতিক জ্ঞান সঞ্চয়ে ব্যস্ত থাকলে এবং তার সাহায্যে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করলে তিনি অস্তিত্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে আবদ্ধ হয়ে পড়েন।

এক্ষেত্রে তাঁর খোঁজ যেন সীমার মধ্যে অসীমকে খোঁজার প্রয়াস। 

অন্যদিকে ব্যক্তি আত্মিক জ্ঞানের উন্মোচনের পর যথার্থ জ্ঞান অনুশীলন করলে পরমচেতনার পারিপার্শ্বিক জ্ঞানের জগৎকে ছুঁয়ে ফেলতে পারেন।

যা বস্তু-বিষয়-বিশ্বের প্রকৃত, পূর্ণ ও পরমসত্য। পরম জ্ঞানতত্ত্ব। আর এই পরম কারণকে খুঁজে, তার সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধির যথার্থ প্রয়োগেই গড়ে উঠবে পরমচেতনার কবিতা। যা পাঠক মননকে অনুরণিত করবে। আবেগ, চেতন, অচেতন, উচ্চতর চেতন, অবচেতনা-এর সমন্বয়ে খুলে দেবে এক পৃথক ও পূর্ণ জ্যোতির্ময় জগৎ-এর পথ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments