জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত /পর্ব-৮/সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত     
পর্ব-৮

সুদর্শন নন্দী 

 ১লা জানুয়ারি ১৮৮৩। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে রাখাল,হাজরা, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তের সাথে বসে আছেন। ইশ্বরের স্বরূপ সাকার নিরাকার নিয়ে কথা হচ্ছে। 
ঠাকুর বললেন- কেউ কেউ বলে, ঈশ্বর সাকার, তিনি নিরাকার নন। এই বলে ঝগড়া করে। যে বৈষ্ণব, সে বেদান্তবাদীর সঙ্গে ঝগড়া করে।যদি ঈশ্বর সাক্ষাৎ দর্শন হয়, তাহলে ঠিক বলা যায়। যে দর্শন করেছে, সে ঠিক জানে ঈশ্বর সাকার, আবার নিরাকার। আরও তিনি কত কি আছেন তা বলা যায় না।

এবার ঠাকুর  হাতির উপমা দিয়ে বোঝাচ্ছেন ভক্তদের।
বললেন-কতকগুলো কানা একটা হাতির কাছে এসে পড়েছিল। একজন লোক বলে দিলে, এ-জানোয়ারটির নাম হাতি। তখন কানাদের জিজ্ঞাসা করা হল হাতিটা কিরকম? তারা হাতির গা স্পর্শ করতে লাগল। একজন বললে, ‘হাতি একটা থামের মতো!’ সে কানাটি কেবল হাতির পা স্পর্শ করেছিল। আর-একজন বললে, ‘হাতিটা একটা কুলোর মতো!’ সে কেবল একটা কানে হাত দিয়ে দেখেছিল। এইরকম যারা শুঁড়ে কি পেটে হাত দিয়ে দেখেছিল তারা নানা প্রকার বলতে লাগল। তেমনি ঈশ্বর সম্বন্ধে যে যতটুকু দেখেছে সে মনে করেছে, ইশ্বর এমনি, আর কিছু নয়।

ইশ্বরের স্বরূপ বোঝাতে ঠাকুর  এবার গিরগিটির উপমা  দিলেন। ভক্তদের দের বললেন-একজন লোক বাহ্যে থেকে ফিরে এসে বললে গাছতলায় একটি সুন্দর লাল গিরগিটি দেখে এলুম। আর-একজন বললে, আমি তোমার আগে সেই গাছতলায় গিছলুম — লাল কেন হবে? সে সবুজ, আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আর-একজন বললে, ও আমি বেশ জানি, তোমাদের আগে গিছলাম, সে গিরগিটি আমিও দেখেছি। সে লালও নয়, সবুজও নয়, স্বচক্ষে দেখেছি নীল। আর দুইজন ছিল তারা বললে, হলদে, পাঁশটে — নানা রঙ। শেষে সব ঝগড়া বেধে গেল। সকলে জানে, আমি যা দেখেছি, তাই ঠিক। তাদের ঝগড়া দেখে একজন লোক জিজ্ঞাসা করলে, ব্যাপার কি? যখন সব বিবরণ শুনলে, তখন বললে, আমি ওই গাছতলাতেই থাকি; আর ওই জানোয়ার কি আমি চিনি। তোমরা প্রত্যেকে যা বলছ, তা সব সত্য; ও গিরগিটি, — কখন সবুজ, কখন নীল, এইরূপ নানা রঙ হয়। আবার কখন দেখি, একেবারে কোন রঙ নাই। নির্গুণ।

শুধু উপমা দিয়ে ঠাকুর ভক্তদের বুঝিয়ে দিলেন ঈশ্বরের স্বরূপ। শুধু শুকন উওদেশে যা বোধগম্য হত না তা স্রেফ উপমা সহকারে বিসগয়তি ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে দিলেন। 
১৮৮৩এর ৮ই এপ্রিল।ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে। রাখাল, মণিলাল, মাস্টার সব ভক্তেরা উপস্থিত। খানিক বাদে এলেন ব্রাহ্ম ভক্তরা। আন্তরিক ভক্তি ও দেখানো ভক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে।

ঠাকুর দুই বন্ধুর কথা দিয়ে শুরু করলেন। বললেন-যেমন ভাব তেমনি লাভ। দুজন বন্ধু পথে যাচ্ছে। এক যায়গায় ভাগবত পাঠ হচ্ছিল। একজন বন্ধু বললে, ‘এস ভাই, একটু ভাগবত শুনি।’ আর-একজন একটু উঁকি মেরে দেখল। তারপর সে সেখান থেকে চলে গিয়ে বেশ্যালয়ে গেল। সেখানে খানিকক্ষণ পরে তার মনে বড় বিরক্তি এল। সে আপনা-আপনি বলতে লাগল, ‘ধিক্‌ আমাকে! বন্ধু আমার হরি কথা শুনছে, আর আমি কোথায় পড়ে আছি!’ এদিকে যে ভাগবত শুনছে, তারও ধিক্কার হয়েছে। সে ভাবছে, ‘আমি কি বোকা! কি ব্যাড় ব্যাড় করে বকছে, আর আমি এখানে বসে আছি! বন্ধু আমার কেমন আমোদ-আহ্লাদ করছে।’ এরা যখন মরে গেল, যে ভাগবত শুনেছিল, তাকে যমদূত নিয়ে গেল; যে বেশ্যালয়ে গিছিল, তাকে বিষ্ণুদূত বৈকুণ্ঠে নিয়ে গেল। ভগবান মন দেখেন। কে কি করছে, কোথায় পড়ে আছে তা দেখেন না। 

ঠাকুর এবার উপমা দিয়ে বললেন অহংকারের কথা। যতক্ষণ অহংকার ততক্ষণ অজ্ঞান। অহংকার থাকতে মুক্তি নাই।
গরুগুলো হাম্‌মা হাম্‌মা করে, আর ছাগলগুলো ম্যা ম্যা করে। তাই ওদের কত যন্ত্রণা। কসায়ে কাটে; জুতো, ঢোলের চামড়া তৈয়ার করে। যন্ত্রণার শেষ নাই। হিন্দিতে ‘হাম্‌’ মানে আমি, আর ‘ম্যায়’ মানেও আমি। ‘আমি’ ‘আমি’ করে বলে কত কর্মভোগ। শেষে নাড়ীভুঁড়ি থেকে ধুনুরীর তাঁত তৈয়ার করে। তখন ধুনুরীর হাতে 
‘তুঁহুতুঁহু’ বলে, অর্থাৎ ‘তুমি তুমি’। তুমি তুমি বলার পর তবে নিস্তার! আর ভুগতে হয় না।   

১৫ই এপ্রিল, ১৮৮৩। শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণাপূজা উপলক্ষে ঠাকুর ভক্তসঙ্গে সুরেন্দ্রভবনে ĺআছেন। 
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বৈদ্যনাথের প্রতি বললেন — তর্ক করা ভাল নয়; আপনি কি বল?
বৈদ্যনাথ বললেন— আজ্ঞে হাঁ, তর্ক করা ভাবটি জ্ঞান হলে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বললেন— Thank you। সকলের হাস্য মুখেই হাসি। । তোমার হবে! ঈশ্বরের কথা যদি কেউ বলে, লোকে বিশ্বাস করে না। যদি কোন মহাপুরুষ বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখেছি তবুও সাধারণ লোকে সেই মহাপুরুষের কথা লয় না। লোকে মনে করে, ও যদি ঈশ্বর দেখেছে, আমাদের দেখিয়ে দিগ্‌। কিন্তু একদিনে কি নাড়ী দেখতে শেখা যায়? বৈদ্যের সঙ্গে অনেকদিন ধরে ঘুরতে হয়; তখন কোন্‌টা কফের কোন্‌টা বায়ূর কোন্‌টা পিত্তের নাড়ী বলা যেতে পারে। যাদের নাড়ী দেখা ব্যবসা, তাদের সঙ্গ করতে হয়। 
উপরের উপমার সাথে আরেকটি উপমাও দিলেন ঠাকুর যাতে ভক্তেরা ঈশ্বরের কথা বিষয়ে বুঝতে পারে। বললেন-অমুক নম্বরের সুতা, যে-সে কি চিনতে পারে? সুতোর ব্যবসা করো, যারা ব্যবসা করে, তাদের দোকানে কিছুদিন থাক, তবে কোন্‌টা চল্লিশ নম্বর, কোন্‌টা একচল্লিশ নম্বরের সুতা ঝাঁ করে বলতে পারবে।
পরের আলোচনা ১৮৮৩, ২২শে এপ্রিল তারিখে।শ্রীরামকৃষ্ণ সিঁথির ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে কথা বলছেন। 
ব্রাহ্মভক্ত ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন— ভোগান্ত কিরূপ?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন — কামিনী-কাঞ্চন ভোগ। এবার উপমা দিয়ে বোঝালেন বিষয়টি। বললেন-যে ঘরে আচার তেঁতুল আর জলের জালা, সে ঘরে বিকারের রোগী থাকলে মুশকিল! টাকা-কড়ি, মান-সম্ভ্রম, দেহসুখ এই সব ভোগ একবার না হয়ে গেলে — ভোগান্ত না হলে — সকলের ইশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা আসে না।
এবার ব্রাহ্মভক্ত জিজ্ঞাসা করলেন — বৈরাগ্য কি করে হয়? আর সকলের হয় না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার উপমা সহকারে বোঝালেন। — ভোগের শান্তি না হলে বৈরাগ্য হয় না। ছোট ছেলেকে খাবার আর পুতুল দিয়ে বেশ ভুলানো যায়। কিন্তু যখন খাওয়া হয়ে গেল, আর পুতুল নিয়ে খেলা হয়ে গেল, তখন “মা যাব” বলে। মার কাছে নিয়ে না গেলে পুতুল ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আর চিৎকার করে কাঁদে।
ছোট ছেলে আর পুতুলের উপমা দিয়ে ভক্তের সমস্ত জিজ্ঞাসা দূর করলেন। 

১৮৮৩, ২২শে এপ্রিল সিঁথির ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুর।  শ্রীরামকৃষ্ণ ও আচার্য শ্রীবেচারাম — বেদান্ত ও ব্রহ্মতত্ত্ব প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। 
শ্রীরামকৃষ্ণ জানতে চাইলেন — আচ্ছা, নিরাকারও সত্য আর সাকারও সত্য; আপনি কি বল?
আচার্য বললেন— আজ্ঞা, নিরাকার যেমন Electric Current (তড়িৎ-প্রবাহ) চক্ষে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, দুই সত্য। শুধু নিরাকার বলা কিরূপ জানো? বলে তিনি উপমা দিলেন। বললেন, যেমন রোশনচৌকির একজন পোঁ ধরে থাকে — তার বাঁশির সাত ফোকর সত্ত্বেও। কিন্তু আর-একজন দেখ কত রাগ-রাগিণী বাজায়! সেরূপ সাকারবাদীরা দেখে ঈশ্বরকে কতভাবে সম্ভোগ  করে! শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর — নানাভাবে। কি জানো, অমৃতকুণ্ডে কোনও রকমে পড়া। তা স্তব করেই হোক অথবা কেউ ধাক্কা মেরেছে আর তুমি কুণ্ডে পড়ে গেছ, একই ফল। দুই জনেই অমর হবে!   সত্যি বলতে কি, ঠাকুরের এসব উপমা দুর্বল স্মৃতির মানুষজনও কখনো ভুলতে পারবেন না। 
                                                        (ক্রমশঃ)
  
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 
         
    

Post a Comment

0 Comments