জ্বলদর্চি

বিজ্ঞান-সাধিকা রসায়নবিদ ড. রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪৬


বিজ্ঞানাকাশ থেকে অকালে ঝরে গেল যে নক্ষত্র-প্রাণ ―
বিজ্ঞান-সাধিকা রসায়নবিদ ড. রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


'প্রাত্যহিক জীবন থেকে বিজ্ঞানকে আলাদা করা যাবে না। আমার কাছে বিজ্ঞান জীবনের খানিক ব্যাখ্যা দেয়। মৃত্যুর পর জীবনের অস্তিত্বের যে-অন্ধবিশ্বাস, তোমার সে-ভ্রান্ত ধারণার অদ্ভুত অপব্যাখ্যা আমি মানি না। আমাদের উত্তর-পুরুষের বিশ্বাস, ভবিষ্যতের আমি এবং এককভাবে তোমার ও অন্যান্য সকলের ভবিষ্যতের কাঠগড়ায় তোমার বিশ্বাস ঝুলে রয়েছে। আমার মনে হয় তোমরা খুব স্বার্থপর। স্রষ্টা কে বা কী? আমি বিশ্বাসের কোনও কারণ দেখি না যে বিশ্বের এক ক্ষুদ্র কোণে আদি পদার্থ কিংবা প্রোটোপ্লাজমের স্রষ্টার, যদি তাঁর অস্তিত্ব থাকত, আমাদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার কোনও কারণ বা বাসনা আছে'― 
দীর্ঘ একখান চিঠি লিখে ঈশ্বর-বিশ্বাসী পিতাকে ঈশ্বর সম্বন্ধে নিজের মনের কথা খোলাখুলি ব্যক্ত করল নাস্তিক মেয়ে। সে-মেয়ে স্রষ্টা গড-এর চাইতে বিজ্ঞানকে এগিয়ে রাখে। বিজ্ঞান-ই তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। সেখানে ভগবানের আসন শূন্য। ভগবানে অবিশ্বাস তার জন্মগত। আপনা আপনি তার মধ্যে গ্রথিত হয়েছে ধর্মের অসারতার ধারণা। মেয়েবেলায় তার বন্ধুরা সবাই যখন চার্চের প্রার্থনায় ভীড় জমাত, সে তখন স্কুলের হোমওয়ার্ক সারতে বেশি ভালোবাসত। যদিও সে ইহুদি ঐতিহ্য কখনও ত্যাগ করেনি। নিজের ছোট্ট বোনকে বোঝাত― সবসময়ের জন্য, সচেতনভাবে সে একজন ইহুদি। জীবনে একবার, যখন সে কেমব্রিজে পড়ে, তার দাদুর অনেক অনুনয়-বিনয়ে ইহুদি সোসাইটিতে যায় সে।
       

এ হেন অকুতোভয় মহিলা বিজ্ঞান-সাধিকা আর কেউ নন, তিনি প্রখ্যাত রসায়নবিদ ড. রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন। ক্ষণজন্মা এই বৈজ্ঞানিক জন্মেছিলেন লন্ডনের নটিংহিল এলাকার ৫০ চেপস্টো ভিলায়; ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পঁচিশে জুলাই। এক সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ ইহুদি পরিবারে জন্ম তাঁর। তাই হয়তো খুব উদার-মনা মুক্ত চিন্তার অধিকারী ছিলেন তিনি। বাবা এলিস আর্থার ফ্র্যাঙ্কলিন (১৮৯৪―১৯৬৪) লন্ডনের একজন প্রথিতযশা ধনাঢ্য ব্যাঙ্ক-মালিক। মায়ের নাম মুরিয়েল ফ্রান্সেস ওয়ালেই (১৮৯৪―১৯৭৬)। মা-বাবা দুজনেরই সামাজিক কাজে ভীষণ উৎসাহ। ইউরোপের যাযাবর ইহুদি লোকজনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টার কসুর করতেন না তাঁরা।

  অল্প বয়স থেকে ছোট্ট ফ্র্যাঙ্কলিন অত্যন্ত মেধাবী ছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সে নরল্যান্ড প্লেস স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। বিদ্যালয়টি পশ্চিম লন্ডনের একটি বেসরকারি স্কুল। শৈশব থেকে পাটিগণিতের অঙ্ক কষে সে বড় হয়েছে, আনন্দ পেয়েছে। ক্রিকেট ও হকিতে তার দারুণ উৎসাহ। নয় বছর বয়সে মেয়েদের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে। সাসেক্স-এর লিন্ডোরেস স্কুল ফর ইয়ং লেডি'স বোর্ডিং স্কুলটি সমুদ্রের কিনারে অবস্থিত। মেয়ের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বাড়ির লোকজন যারপরনাই চিন্তিত ছিল। সমুদ্রের ধারে স্কুল হওয়াতে তাদের চিন্তা আংশিক দূর হল। ভগ্ন-স্বাস্থ্য মেয়ের জন্য এর চাইতে ভালো পরিবেশ আর হয় না।  

  বিজ্ঞান আর গণিতে তুখোড় সে-মেয়ে। সেসময় ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি লন্ডনের খুব অল্প সংখ্যক গার্লস স্কুলে পড়ানো হত। সেরকমই এক স্কুল― সেন্ট পলস গার্লস স্কুল। ঐতিহ্যের স্কুলবাড়িটির অবস্থান পশ্চিম লন্ডনের হ্যামারস্মিথ এলাকায়। শুধুমাত্র বিজ্ঞানে পাণ্ডিত্য লাভের আশায় সেন্ট পলস গার্লস স্কুলে চলে আসে কিশোরী ফ্র্যাঙ্কলিন। তখন বয়স সবেমাত্র এগারো বছর। গোটা ক্লাসের মধ্যে সে প্রথম। সবার প্রথম। পরীক্ষায় প্রথম হবার সুবাদে স্কুলে দারুণ জনপ্রিয়। সেই সঙ্গে অনায়াসে জিতে নেয় বাৎসরিক পুরস্কারের ডালি। বিজ্ঞান, ল্যাটিন, স্পোর্টস ও ফরাসি ভাষায় বেশ দখল তার। একমাত্র দুর্বলতার জায়গা মিউজিক। সবমিলিয়ে দুর্দান্ত সময় কাটে স্কুলে। ১৯৩৮ সালে, ছ'টি বিষয়ে ডিসটিঙ্কসন নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে। সঙ্গে সঙ্গে জিতে নেয় ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপ। তিন বছরের জন্য মাসিক তিরিশ ডলার ভাতা। দাদুর অনুদান পাঁচ ডলার। সবমিলিয়ে বেশ ভালো রকম টাকা। অবশ্য হজম হয়নি সে-বৃত্তি। বাবা উস্কে দিলেন তার ভেতরের আবেগ― 
'স্কলারশিপের টাকা কোনও দুস্থ যাযাবর স্টুডেন্টকে দান করে দাও।'

        

স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কেমব্রিজের নিউহ্যাম কলেজে স্নাতকে অ্যাডমিশন নেয় সে। সেটা ১৯৩৮ সাল। কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে শুরু হল পড়াশুনা। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল সে। তারপর নিউহ্যাম কলেজের রিসার্চ ফেলোশিপ প্রাপ্তি ও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ল্যাব‍রেটরি জয়েন। স্বনামধন্য প্রফেসর রোনাল্ড জর্জ রেফর্ড নরিস ছিলেন তাঁর গাইড। পরে অধ্যাপক নরিস রসায়ন থেকে নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন। অধ্যাপক ন‍রিস-এর অধীনে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা গেল না তাঁর। অগত্যা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মি. নরিস-এর ল্যাব‍রেটরি ছেড়ে দিলেন তিনি। ১৯৪২-এ সহকারী রিসার্চ অফিসার হয়ে এলেন ব্রিটিশ কোল ইউটিলাইজেশন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (BCURA)-এ। তখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের সাইরেন বাজছে ঘন ঘন। এখানে রিসার্চ চলাকালে খুড়তুতো বোন ইরিন ফ্র্যাঙ্কলিন-এর সঙ্গে 'এয়ার রেইড ওয়াড্রেন' স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নিযুক্ত করলেন নিজেকে। যুদ্ধফেরৎ মানুষজনের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন নিঃসংকোচে। সেবাকর্মের পাশাপাশি কয়লা নিয়ে জোরকদমে চলছে রিসার্চের কাজ। তৈরি করে ফেললেন 'গ্যাস মাস্কস'। এই কাজের সুবাদে ১৯৪৫-এ ডক্টরেট উপাধি পেয়ে গেলেন। 

  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭-এর ১৪ই ফেব্রুয়ারি তিনি ফরাসি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা জ্যাকস মেরিং-এর ল্যাবে একজন গবেষকের চাকুরি নিলেন। ১৯৫০ সালে পেলেন 'টার্নার এবং নিওয়াল ফেলোশিপ'। কিংস কলেজ লন্ডনে সে-বৃত্তির মেয়াদ তিন বছর। ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (MRC)-এর বায়োফিজিক্স ইউনিটে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট পদে কাজ শুরু করলেন। এখানকার ডিরেক্টর তখন প্রফেসর জন র‍্যানডাল। বায়োফিজিক্স ইউনিটে তাঁর কাজ ছিল মূলত দ্রবনে প্রোটিন আর ফ্যাট জাতীয় পদার্থের রঞ্জন-রশ্মি বিবর্তন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA) ফাইবার নিয়ে গবেষণা করতে বলা হয়। সেসময় কিংস কলেজে DNA বিষয়ে এক্সপার্ট একমাত্র তিনি। একই বিভাগে পরে যোগ দিলেন মরিস উইলকিনস এবং তাঁর ছাত্র রেমন্ড গসলিং।

  তখনও পর্যন্ত DNA অণুর প্রকৃত গঠন কী জানা যায়নি। DNA অণুর স্ট্রাকচার জানতে আদা জল খেয়ে নামলেন মিস ফ্র্যাঙ্কলিন। তাঁর সঙ্গী স্টুডেন্ট রেমন্ড গসলিং। রঞ্জন রশ্মি (এক্স-রশ্মি) অপবর্তন কৌশল ব্যবহারে মিস ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আদ্যোপান্ত একজন এক্সপার্ট। শুরু হল কঠোর অধ্যবসায়। নূতন এক ধরনের এক্স-রশ্মি নল আবিষ্কার করলেন তিনি। টিউবটি অতি সুক্ষ্ম ফোকাস করার যন্ত্র। এ যন্ত্র ব্যবহার করে DNA অণুর গঠন জানবার চেষ্টা করেন কুমারী ফ্র্যাঙ্কলিন। উল্টোদিকে, উইলকিনস একটি দোকান থেকে মাইক্রোক্যামরা অর্ডার করেন। পরে এ যন্ত্রের আরও উন্নতি ঘটিয়ে গবেষণায় ব্যবহার করেন ফ্র্যাঙ্কলিন। এ হেন যন্ত্র নিয়ে আংশিক মন কষাকষি শুরু দুপক্ষে― উইলকিনস আর ফ্র্যাঙ্কলিন। পরের জনের শ্যেন দৃষ্টির সম্মুখে হামেশাই আড়ষ্টতায় পড়ত তাঁর কলিগরা। ফলতঃ তাঁকে সমীহ করে চলে সকলে। 

      


  ফ্র্যাঙ্কলিন-এর উন্নত মানের যন্ত্রে DNA অণুর ভালো কোয়ালিটির ইমেজ ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করেন যে DNA স্যাম্পল দুই অবস্থায় থাকে। প্রথমত, ৭৫ শতাংশের বেশি আর্দ্রতায় DNA সুঁতো লম্বা আর রোগা হয়। অন্যদিকে, যখন শুষ্ক থাকে, সেটা হয় খাটো আর মোটা। প্রথম ক্ষেত্রের আর্দ্র DNA অণুর কথা প্রথম ঘোষণা করলেন তিনি। পরে সেই আর্দ্র DNA অণুর নামকরণ করেন 'কেলাসিত DNA'। DNA কেলাস গঠনের উপর সর্বপ্রথম তথ্য রেকর্ড করে রাখলেন নিজের নোটবুকে― 
'Evidence for spiral structure. Straight chain untwisted is highly improbable. Absence of reflections on meridian in crystalline form suggests spiral structure.'
অর্থাৎ, তিনি পেয়ে গেছেন DNA আণবিক পারটিক্যালের আসল স্পাইরাল গঠন বা হেলিক্যাল স্ট্রাকচার। কেমন সে-স্পাইরাল আকৃতি? দুটো চেইন বা সুতোর দু'প্রান্ত দুই হাতে ধরে ঘড়ির কাঁটার দিকে কিংবা বিপরীত দিকে মোচড় দিলে যে-গঠন তৈরি হবে; সেটাই স্পাইরাল বা হেলিক্যাল আকৃতি। এ হেন আশ্চর্য তথ্য কিংস কলেজের একটি বক্তৃতায় সর্বপ্রথম পরিবেশন করলেন তিনি; ১৯৫১ সালের নভেম্বরে। লেকচার নোটে তিনি লিখলেন―
'The results suggest a helical structure (which must be very closely packed) containing 2, 3 or 4 co-axial nucleic acid chains per helical unit, and having the phosphate groups near the outside.'

  এ হেন DNA অণুর আর্দ্র এবং কেলাসিত রূপকে ফ্র্যাঙ্কলিন যথাক্রমে 'A' এবং 'B' নামে অভিহিত করেন। যদিও তৎক্ষণাৎ A-DNA অণুর গুণাবলীর সন্ধান পাওয়া যায়নি, আবিষ্কারের ষাট বছর পর তা আবিষ্কার হয়। কিন্তু সমস্যা বাধল উইলকিনস আর ফ্র্যাঙ্কলিন-এর মধ্যে। মি. র‍্যানডাল DNA সম্বন্ধীয় তাঁদের কাজ ভাগ করে দিলেন। ফ্র্যাঙ্কলিন-এর ভাগে পড়ল DNA-এর A-দশার তথ্য আহরণ। অন্যদিকে, উইলকিনস-এর ভাগে রইল B-দশার তথ্য সংগ্রহের গুরুদায়িত্ব। ১৯৫১ সালের শেষে দেখা গেল― B-DNA অণুর গঠনের দিশা পেয়ে গেছেন মি. উইলকিনস এবং সেটি হল হেলিক্স-এর মতো। কিন্তু A-DNA অণুর হেলিক্স গঠন দেখাতে ব্যর্থ হলেন মিস ফ্র্যাঙ্কলিন। ১৯৫২ সালের মে মাসে তিনি আবার A-DNA অণুর অসামঞ্জস্য ইমেজ রেকর্ড করেছিলেন। সবচেয়ে মজার অথচ গোপন খবর হল, ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে ড. উইলকিনস ঘোষণা করেছিলেন যে DNA উভয় অণুর গঠন হেলিক্যাল প্রকৃতির। ইতিপূর্বে, ফ্র্যাঙ্কলিন আর গসলিং গভীর দুঃখের সঙ্গে A-DNA-এর হেলিক্যাল গঠনের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করে বলেন―
'It is with great regret that we have to announce the death, on Friday 18-th July 1952 of DNA helix (crystalline).'

     

  গভীর দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করে দিলেন ঠিকই; মনের মধ্যে খুঁতখুঁতে ভাব লেগেই থাকল অহরহ। পূর্ণ উদ্যমে আবার শুরু করলেন গবেষণা। এবার ভিন্ন প্রযুক্তির সাহায্য নিলেন। মিলল হাতে-নাতে সাফল্য। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে ফ্র্যাঙ্কলিন DNA অণুর উভয় দশার পুনর্মিলন ঘটালেন। বললেন― 
'DNA উভয় দশার হেলিক্স গঠন রয়েছে।' 
লিখে ফেললেন তিনখানা পাণ্ডুলিপি। পাঠিয়ে দিলেন কোপেনহেগেনে 'অ্যাকটা ক্রিস্টালোগ্রাফিকা' জার্নালের সদর দপ্তরে। প্রথম দুটি পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ থাকল ডাবল হেলিক্স DNA মেরুদণ্ডের ইমেজ। A-DNA সম্পর্কে তাঁর দুটি পাণ্ডুলিপি কোপেনহেগেন পৌঁছল ১৯৫৩ সালের ৬-ই মার্চ। ঠিক তার একদিন পরে, ৭-ই মার্চ তারিখে ক্যাভেনডিস ল্যাবরেটরির দুই দিকপাল ফ্রান্সিস ক্রিক আর জেমস ওয়াটসন-এর B-DNA মডেল সংবলিত পাণ্ডুলিপি পৌঁছয় অ্যাকটা ক্রিস্টালোগ্রাফিকা দপ্তরে। জনশ্রুতি আছে, শেষোক্ত দুই পণ্ডিত মিস ফ্র্যাঙ্কলিন-এর তথ্য চুরি করেছেন। শুধু তাই নয়, DNA গঠন আবিষ্কারের কৃতিত্ব ফ্র্যাঙ্কলিন'কে দিতে নারাজ তারা। মিস ফ্র্যাঙ্কলিন-এর তাতে কিছু যায় আসেনি। রাজনীতির অঙ্ক তিনি ভালো বোঝেন না। নিজের গবেষণার বিষয়বস্তু তাঁর জ্ঞাত। তাঁর তৃতীয় পাণ্ডুলিপিটি ছিল B-DNA-এর উপর, যা পত্রিকার দপ্তরে পৌঁছায় ১৭-ই মার্চ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ।
          

  ১৯৫৩-এর মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়। কিংস কলেজ ছেড়ে ফ্র্যাঙ্কলিন রওনা হলেন বির্কবেক কলেজ। কিংস কলেজ ত্যাগের কারণ সম্ভবত প্রফেশনাল জেলাসিও লিঙ্গভেদ সমস্যা। ট্রান্সফার জনিত এই বিয়োগ-গাথা তাঁর নিজের কথায় 'রাজপ্রাসাদ থেকে ঘিঞ্জি বস্তি' এলাকায় উত্তোরণ! পরক্ষণেই তাঁর বোধোদয় হয়। মনে মনে স্বাগতোক্তি করেন― 'সবদিক থেকে আনন্দদায়ক'। এদিকে যে-চেয়ারম্যান মি. জন ডেসমন্ড বার্নাল তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বির্কবেক কলেজে আনলেন, ফের তিনিই ফ্র্যাঙ্কলিন-এর বিরোধিতা করে বসলেন। তাঁকে বললেন― নিউক্লিক অ্যাসিডের গবেষণা বন্ধ রাখতে। মি. বার্নাল-এর সক্রিয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ফ্র্যাঙ্কলিন অনুজ সহকারী গসলিং-এর পিএইচডি থিসিস কমপ্লিট করতে সাহায্য করেন। তারপর দুজনে একসঙ্গে DNA অণুর A-দশার দ্বৈত হেলিক্স রিসার্চ পেপার 'নেচার' পত্রিকার অফিসে পাঠান। আর্টিক্যালটি ছাপার অক্ষরে বের হয় ২৫শে জুলাই, ১৯৫৩ তারিখে। পরের বছরের শেষের দিকে মি. বার্নাল 'এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিল' থেকে কুমারী ফ্র্যাঙ্কলিন-এর জন্য ফান্ড জোগাড়ের ব্যবস্থা করেন। তারপর থেকে ফ্র্যাঙ্কলিন সায়েন্টিফিক সুপারভাইজার হিসাবে গবেষণার কাজে আজীবন লিপ্ত ছিলেন। এসময় ইউরোপের বিভিন্ন কলেজ-ইউনিভার্সিটি থেকে স্টুডেন্টের দল তাঁর কাছে গবেষণার জন্য ভীড় জমায়। কিংস কলেজ থেকে ফিজিক্স স্টুডেন্ট জন ফিঞ্চ তাঁর রিসার্চ গ্রুপে অংশগ্রহণ করে। এমন আরও অনেক ছাত্র তাঁর দলে যোগ দেয়। এসময় থেকে তিনি অপর নিউক্লিক অ্যাসিড RNA (রাইবো-নিউক্লিক অ্যাসিড) অণু নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৫-এ টোব্যাকো মোজ্যেইক ভাইরাস (TMV) নিয়ে গবেষণা লব্ধ প্রবন্ধ নেচার পত্রিকায় ছাপেন। 

  ১৯৫৮ সালে প্রথম বড় আন্তর্জাতিক মিলনমেলা বসবে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস-এ। 'এক্সপো ৫৮'। এ হেন বিশ্বমেলায় পাঁচ ফুট লম্বা TMV ভাইরাসের মডেল তৈরির আমন্ত্রণ পান ফ্র্যাঙ্কলিন। বরাত পেয়ে তিনি মডেল তৈরি করা আরম্ভ করলেন। সেটা ১৯৫৭ সাল। টেবিল টেনিস বল আর প্লাস্টিকের তৈরি বাইসাইকেলের হাতলের গ্রিপ দিয়ে বানানো হয়েছিল সেটি। পেল্লাই সাইজের দৈত্যাকার মডেলটি বিশ্বমেলায় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান প্যাভিলিয়নে ঠাঁই পায়, যার শুভ উদ্বোধন হয় ১৭-ই এপ্রিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু খুবই দুঃখের ঘটনা― মডেলের উদ্ভাবক একদিন আগে, ১৬-ই এপ্রিল চিরঘুমে ঢলে পড়েন। 

  অবশ্য, স্বল্পায়ু এই বিজ্ঞান সাধিকার জীবন তরী ডুবে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা অনেক আগে দেখা গিয়েছিল। সালটা ১৯৫৬; বছরের মধ্যভাগ। গবেষণার কাজে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে গেলেন কুমারী ফ্র্যাঙ্কলিন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন সেখানে। তখন তিনি রয়েছেন নিউইয়র্ক শহরে। এত বেশি অসুস্থ যে নিজের স্কার্টের বুতাম লাগাতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তলপেট ফুলে ঢোল। ওই রকম অবস্থায় লন্ডন রওনা হয়ে গেলেন। লন্ডনে ডাক্তার মেয়ার লিভিংস্টোন-এর চেম্বারে গেলেন কনসাল্ট করতে―আশু কর্তব্য কী? শারীরিক পরিবর্তন দেখে ডাক্তার লিভিংস্টোন তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন―
'আপনি কি প্রেগন্যান্ট?'
'আমার ধারণা, হয়তো তাই!'― রসিকতার ছলে মুখে মৃদু হাসি টেনে বললেন বিজ্ঞানী। 
আকাশকুসুম ভেবে ভেবে প্রেসক্রিপশনের উপর 'URGENT' লিখে দিয়েই খালাস ডাক্তার লিভিংস্টোন। সেপ্টেম্বরের চার তারিখে হবে অপারেশন। হাসপাতালে ভর্তি হলেন ফ্র্যাঙ্কলিন। তাঁর তলপেট কেটে বড় বড় দুটো টিউমার বের করে আনেন ডাক্তাররা। বেশ কিছুদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে বসে কাটে তাঁর। বাড়িতে ফিরেও নিস্তার নেই। সম্পূর্ণ রেস্ট দরকার তাঁর। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ডাক্তারের হাজার বারণ সত্ত্বেও বাড়ি ফিরে গবেষণার কাজে নিযুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। ফলে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পেলেন না। পুরোপুরি সেরে ওঠার আগেই কাজের চাপে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। সেটা ১৯৫৭ সালের শেষ ভাগ। ভর্তি করা হল রয়্যাল মার্সডেন হসপিটালে। আগের চাইতে অবস্থা আরও বেগতিক। অবস্থা খারাপ দেখে দোসরা ডিসেম্বর অবশেষে তৈরি হল উইলনামা। উইলে পরিবারের সদস্যদের ভাগ করে দিলেন নিজের যাবতীয় সম্পত্তি। সে-যাত্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন তিনি, অসম্ভব মনের জোর সম্বল করে। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে যোগ দিলেন কাজে। ২৫-শে ফেব্রুয়ারি বায়োফিজিক্স বিভাগে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট পদে প্রমোশন হল তাঁর। আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। তিরিশে মার্চ আবার অসুস্থ বোধ করলে লন্ডনের চেলসিতে ভর্তি করা হল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হল না তাঁর। এবার সব শেষ। ওভারিয়ান ক্যান্সার কেড়ে নিল তাঁর প্রাণের স্পন্দন। প্রিয় বৈজ্ঞানিক ১৬-ই মার্চ চিরতরে পাড়ি দিলেন না-ফেরার দেশে।
        


তাঁর মৃত্যুর পরে একটা মজার ঘটনা ঘটল। জীবিত অবস্থায় কখনও মিস ফ্র্যাঙ্কলিন-এর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়নি। অথচ তাঁর মৃত্যুর অব্যাহতি পরে, ১৯৬২ সালে, DNA অণুর গঠন আবিষ্কার করে ড. ফ্রান্সিস ক্রিক, ড. জেমস ওয়াটসন এবং ড. মরিস উইলকিনস রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন। কে জানে, বেঁচে থাকলে হয়তো ১৯৬২ সালের নোবেল লর‍্যিয়েট হিসাবে মিস রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন-এর নাম স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করত! সেজন্য অবশ্য ইতিহাসে তাঁর অবস্থান একজন 'Wronged Heroine', 'Dark Lady of DNA', 'Forgotten Heroine', 'Feminist Icon', 'Sylvia Plath of molecular biology'― ভিন্ন ভিন্ন নামে খ্যাত।

তথ্যসূত্র :
●Rosalind Franklin & DNA ― Anne Sayre
●Rosalind Franklin : Biography, Facts & DNA ― Britannica
●Rosalind Franklin : A Crucial Contribution ― Nature
●Rosalind Franklin : DNA, Facts & Death ― Biography
●Rosalind Franklin and the double Helix ― Physics Today
●Rosalind Franklin ― Wikipedia
●Rosalind Franklin ― Encyclopedia 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments