জ্বলদর্চি

শেরশাহ’ : সিদ্ধার্থ মালহোত্রার ‘বিক্রম’ অবতার/ রাকেশ সিংহ দেব

শেরশাহ’ : সিদ্ধার্থ মালহোত্রার ‘বিক্রম’ অবতার


পরিচালক - বিষ্ণু বর্ধন
অভিনয় - সিদ্ধার্থ মালহোত্রা, কিয়ারা আডবানী, শতাফ ফিগার, নিকিতিন ধীর, অনিল চিরঞ্জিত, সাহিল বৈদ, রাজ অর্জুন, শিব পন্ডিত প্রমুখ।

রিলিজ – ১২ আগস্ট ২০২১, আমাজন প্রাইম  ভিডিয়ো

রেটিং - 4 / 5
 
‘আমরা শান্তি চাই এটা সারা দুনিয়া দেখেছে, এবার দুনিয়া চাক্ষুষ করবে শান্তি রক্ষার্থে আমাদের শক্তি প্রদর্শন।’- ১৯৯৯ সালে জাতীয় টেলিভিশনের পর্দায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী-র এই ঘোষণার পরেই শুরু হয় ভারত পাকিস্তানের মধ্যে কার্গিলের যুদ্ধ। যুদ্ধ, দেশপ্রেম, বলিদান যেকোন ওয়ার মুভির প্রাথমিক শর্ত। সেই প্রেক্ষিতে কার্গিলের যুদ্ধ এবং তার বীর চরিত্রদের বীরগাথা নিয়ে সেলুলয়েডের পর্দায় সিনেমা বলিউডে নতুন নয়। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘গুঞ্জন সাক্সেনা : দ্য কার্গিল গার্ল’। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ২০০৩ সালে জে পি দত্ত পরিচালিত 'এল ও সি কার্গিল’।


   এই ছবিতে পরমবীর চক্র ক্যাপ্টেন 'বিক্রম বাত্রা’-র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিষেক বচ্চন। আর কার্গিলের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার অদম্য সাহস ও অতুলনীয় দেশপ্রেম যা কার্গিলের শিখরে  ভারতের বিজয়ে অসামান্য অবদান রেখেছে, তাই নিয়েই তৈরি হয়েছে সিনেমা 'শেরশাহ’। ‘শেরশাহ’ ছিল বিক্রম বাত্রার কোড নেম। ১৯৯৯-এ যখন কার্গিলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে মুখোমুখি, তখন ভারতীয় ভূখন্ড পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নিয়ে রুক্ষ, শীতল, মৃত্যু-সঙ্কুল পার্বত্য পথে তার ডেল্টা বাহিনী নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন অকুতোভয় বিক্রম। প্রাণোচ্ছ্বল সেই তরুণের জীবন কাহিনিকেই কিছুটা সিনেমার রঙে রাঙিয়ে দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন পরিচালক বিষ্ণু বর্ধন। যাঁর নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সিদ্ধার্থ মালহোত্রা। কার্গিল যুদ্ধের সময়কালে তার বন্ধুর উদ্বেগের মুহূর্তে সদা হাস্যময় বিক্রম হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘তিরঙ্গা লেহরাকে আউঙ্গা, ইয়া ফির তিরঙ্গেমে লিপটকে কে আউঙ্গা। পর আউঙ্গা জরুর।’ এভাবেই নিজের আশৈশব লালিত স্বপ্ন পূরণ করে ফিরেছিলেন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। কার্গিল যুদ্ধে ভারতীয় ভূখন্ডে ত্রিবর্ণ পতাকা উড়িয়েছিলেন, কিন্তু নিজেকে পতাকায় মুড়ে দেশের প্রতি কর্তব্যের, সাহসিকতার, শৌর্যের, বীরত্বের, আত্ম বলিদানের এক চিরন্তন নিদর্শন হয়ে ফিরেছিলেন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। এমন পরম বীরেরাই তো থেমে থাকতে জানেনা, অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানেনা, আরামের কোলে শরীর শুইয়ে দিতে জানেনা। তাইতো আনস্টপেবল বিক্রম বাত্রা ভিকট্রি সিগন্যাল করেছিলেন 'ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর'। অমর করে গিয়েছিলেন সেইসময়কার পেপসির এই ট্যাগলাইন।  মরনোত্তর সম্মানিত হয়েছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘পরম বীর চক্র’ –তে। বলিউডে যে ফর্মুলা মেনে ভার-পাকিস্তানের যুদ্ধের সিনেমা তৈরি হয় তার থেকে আলাদা নয় 'শেরশাহ'। তবে এই ছবি একটু ব্যতিক্রম। কারণ এখানে বিক্রম বাত্রার যোদ্ধা জীবনের সাথে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে বিক্রম বাত্রার ব্যক্তিগত জীবন। হিমাচলের পালমপুরের এক সাধারণ শিক্ষকের ছেলে কীভাবে ‘শেরশাহ’ হয়ে উঠলেন সেই গল্প দেখতে খুব একটা মন্দ লাগবে না। 'ফৌজি তো ফৌজি হোতা হ্যায়, কহি ভি পেয়দা হো সাকতা হ্যায়'। বিক্রম বাত্রার জীবন ছিল এই আপ্তবাক্যের জীবন্ত প্রমাণ। ছবিতে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার শৈশবকাল থেকে তাঁর বেড়ে ওঠা, কলেজ জীবনে ডিম্পল চিমার‌ ভালোবাসা পাওয়া এবং ১৯৯৯ সালে ১৩ জম্মু কাশ্মীর রাইফেলসে নিযুক্ত হয়ে লেফট্যানেন্ট হিসেবে কাশ্মীরের সোপিয়ারেতে পোস্টিং সবই সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মাত্র ২৪ বছর বয়সী এক যুবক দেশের জন্য নিজের জীবনের আত্মাহুতি দিয়েও কীভাবে দেশবাসীর মনের মনিকোঠায় নায়কের মত বেঁচে থাকে, সেই কাহিনী দর্শকদের চোখের কোন ভারী করবেই। ছবিটির শেষে সময় যেন থমকে দাঁড়ায় ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার সাক্ষাৎকারের ক্লিপিংসে। তাঁর হাস্যময় মুখ অজান্তেই মন ভারী করে তোলে। 

অভিনয়ের দিক থেকে সিদ্ধার্থ মালহোত্র এবং কিয়ারা আডবাণীর প্রশংসা করতেই হয়। বাস্তবের ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার চরিত্রের মধ্যেই ফিল্মি ছোঁওয়া ছিল যা পরবর্তীতে ওঁনার প্রেমিকা ডিম্পল চিমার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে আমারা সকলেই জানি। সেই দিকটিও সযত্নে তুলে ধরেছেন সিদ্ধার্থ। বিক্রম-ডিম্পলের অসম্পূর্ণ প্রেম কাহিনি কোথাও যেন একটা আলাদা সম্পূর্ণতা পায় শাশ্বত ভালবাসায়। শতাফ ফিগার, নিকিতিন ধীর, অনিল চিরঞ্জিত, সাহিল বৈদ, রাজ অর্জুন, শিব পন্ডিতের অভিনয়ও চোখে পড়ে। তবে ‘শেরশাহ’-র পুরো কাহিনি জুড়েই দর্শকের চোখ আটকে থাকবে সিদ্ধার্থ-কিয়ারার উপরেই। বিক্রম বাত্রার পরিবারের তাঁর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম থেকেই পছন্দ ছিলেন সিদ্ধার্থ মালহোত্রা। তিনি সেই বিশ্বাসের প্রতি সুবিচার করেছেন। তবে ওটিটির পর্দায় অনেক যুদ্ধের দৃশ্য সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি, হয়ত বড়পর্দায় তা দারুণভাবে ফুটে উঠত। প্রসঙ্গত, বলিউডে যুদ্ধ নিয়ে আগেও অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে, তবে সেদিক দিয়ে 'শেরশাহ' অন্যদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। বলাই বাহুল্য, ‘শেরশাহ’-কে শুধুমাত্র দেশাত্মবোধে পরিপূর্ণ এক সংলাপময় অতিরঞ্জিত বলিউডি ছবি হিসেবে উপস্থাপিত করতে চাননি পরিচালক। যে গল্পের শুরু থেকে শেষ সবটাই দর্শকদের জানা তা কিছুটা সিনেম্যাটিক রঙ চড়িয়ে বায়োপিক হতেই পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যঘটনাকে অতিরঞ্জিত না করেও নতুনত্বের স্বাদ দেওয়াটাই পরিচালকের মুনশিয়ানা। যেখানে পরিচালক বিষ্ণু বর্ধন এবং চিত্রনাট্যকার সন্দীপ শ্রীবাস্তব তাদের মুনশিয়ানা সফলভাবে দেখিয়েছেন। সিনেমার গানগুলো বেশ শ্রুতিমধুর এবং সেগু‌লো সিনেমার আবেগ এবং গতি দুটি ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে, নির্মেদ এক বায়োপিকের শরীরে অতিরিক্ত মেদ হিসেবে ঝুলে থাকেনি। এখনও দেখা না হয়ে থাকলে এখনই সপরিবারে দেখে ফেলুন ভারত মাতার এই বীর সন্তানের বীরগাথা।


রেটিং
5 – অসাধারণ
4 – বেশ ভালো
3 – ভালো
2- দেখতে পারেন
1 – না দেখলেও চলবে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments