জ্বলদর্চি

সেকাল-একাল সম্মিলক কালাকাল/তরুণ সান্যাল

সেকাল-একাল সম্মিলক কালাকাল

তরুণ সান্যাল

আমার বাল্যকালটাকে সেকাল ধরলে, প্রায় নব্বই ধরি ধরি বয়সটাকে একালীন বলে ধরতে হবে। অথচ আমার ধারণা গতকালের সঙ্গে আজকের ফারাকটা খুবই কম। মনে হচ্ছে, আমার বালক বয়সটাই ঝোলায় পুরে কোথায় না কোথায় নিয়ে গিয়েছে। পেছনে ফেলে রেখে গেছে হ্যামেলিনের বংশীবাদক এই বৃদ্ধ আমাকে। আসলে আমার বয়সীদের ছেলেবেলাই ছিল না। ত্রিশ দশকের, বিশ শতকে ছিল অর্থনীতির মন্দা। বয়স্ক তরুণদের ছিল পকেট ফাঁকা। সেই বিচারে সদ্য পৃথিবীর মুখ দেখা শিশুটির প্রয়োজনের কথা কারো মনে পড়ার কথা নয়। ভাগ্যিস গোরুর দুধ ছিল সন্তা ও নির্ভেজাল। ছিল রবিশন বার্লি, দুধের বাটি ও ঝিনুক, দুগ্ধপোষ্য হতে না হতেই তন্ডুল পোষ্য হয়েছি। বেবিস্যুটের বদলে আকাশ-পরিধেয় পেয়েছি, রঙচঙে ছবির বইয়ের বদলে হাতে এসেছে বর্ণপরিচয় - শিশুশিক্ষা, আলোকিত পরিবারে সহজপাঠ। টিভি সিনেমার কথা তো ভাবাই অসম্ভব ছিল।

কাঁধে এক বাক্স নিয়ে জনৈক, গোল কাঁচের অন্তরালের ওপাড়ের হাওড়া কা ব্রিজ দেখো, তাজমহল দেখো, সাহেব রাজা রানি দেখো শুনিয়ে বিশ্বদর্শন করাতো। হাওড়ার ব্রিজটাও ছিল জলে ভাসানো নৌকায় নৌকায় গিঁট বাঁধা পন্টুন ব্রিজ। সাহেব রাজা-রানি গ্রেট ব্রিটেনের পাঁচ নম্বর বা ছ-নম্বর জর্জের কথা মনে পড়ায়। তাঁদের ছোট মেয়ে মার্গারেট নামটি পছন্দ হতো। পূজার ভাসানের দিনে যে মেলা বসতো, সেখানে মিলতো মাটির মাছ, গোরু, ভেড়া। পাওয়া যেত কাঠের লাটিম, ছই তোলা নৌকা, আহ্লাদি মমি পুতুল, এমনকি পাঁচমুড়ার মাটির ঘোড়া।

গ্রাম থেকে রেল স্টেশনের দূরত্ব ছিল মাইল পনেরো। বাহন ছিল কিছুটা গরুর গাড়ি, কিছুটা এক ঘোড়ায় টানা টমটম বা এক্কা, বর্ষার সময় অবশ্য পলি তোলা ব্যক্তিগত পানশি বা ভাড়া করা সীটের গহনার নৌকা। ট্রেন ছিল কয়লার ধোঁয়া ছড়ানো ইঞ্জিনের। ছিল যাত্রীদের জন্য ফার্স্ট ক্লাস, সেকেণ্ড ক্লাস, ইন্টার ক্লাস ও থার্ড ক্লাস। এমন কি সাহেব সুবো ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদেরও বাহন কামরা। ছিল বড় বড় নদীতে স্টিমারও। প্রচুর আনাজ মিলতো, ফলের মধ্যে পাওয়া যেত আম-কাঁঠাল-আতা নোনা সবেদা ইত্যাদি। মাছও ছিল অঢেল। পণ্যের তুলনায় জনসংখ্যা কম ছিল বলেই হোক, বা সাধারণের কেনবার ক্ষমতা কম ছিল বলেই হোক, দাম ছিল কম। এক সের খাঁটি দুধের দাম ছিল এক আনা (বারো আনায় এক টাকা)। শখানেক টাকায় ছোটখাটো পারিবারিক দুর্গাপূজাও নিষ্পন্ন হতো। পাড়াতুতো সবাই কোনো না কোনো সম্পর্কগত নাম পেতো। অমৃক কাকা, তমুক দাদা এই ধরণের। ধান ভানা হতো ঢেঁকিতে। সেই ঢেঁকি ছাঁটা চাল কুলোয় তুলে, হাওয়ায় উড়িয়ে তুষ ছাড়ানো হতো। আপাত ভারি চাল কাছেই ঝরে পড়তো। তুষ উড়ে যেতো হাওয়ার অনুকূলে। অমনি ছিল গ্রামগুলি জমিদারের বাড়িগুলি মাঝখানে ঘিরে তার স্তরে স্তরে নানা জাতপাতের মানুষ, আবার প্রতি জাতের প্রধানের বাড়ি ছিল তাদের স্ব-জাতির উচ্চ-বড় হিসাবে। কিন্তু সবারই নাম ছিল জ্যাঠা, মামা, কাকা, দাদা ইত্যাদি। আমি ব্রাহ্মণবালক ছিলাম বলে অনেকের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম না। এমনকি অনুষ্ঠানেও ছোঁয়াছুঁই ব্যাপারটা ছিল।

 মুসলিম গ্রামেও প্রধান শেখ, সৈয়দ  হুজুর ছিলেন গ্রামের মধ্যমণি। এঁদের মধ্যে জাত-পাত ছিল না বটে, তবু জন্ম ভৌলিকা অনুযায়ী বাড়ি গড়া হতো। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে যে অনেক রাত আছে, ধর্ম আছে তখনই মনে হতো। অবশ্য হিন্দু- মুসলমান ভিন্নধর্মী ছিল। হিন্দু ঘেরাটোপের মধ্যে শাক্ত, শৈব তো বটেই, জেলে মালোদের সঙ্গে কামার কুমোরের উপাসনা এক ছিল না। তাছাড়া আবার সেখানেও জাতপাতে ছোঁয়া ছুঁই ছিল। ধর্মে এক ছিল না।

ছিল দৈনিক সবজি বা প্রয়োজনীয় মশলাপাতির দোকান। মাছের বাজার, ছিল সপ্তাহে দুবার হাট। দূর দূরান্তের বিক্রেতারা সওদা যোগান দিতো সেখানে। স্কুল বাড়িও ছিল মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারের ছেলেরা ম্যাট্রিক পাশ করাটাই গৌরবের বলে মনে করতো। এক চান্সে  পাশ করাটা ছিল মেধার প্রমাণ। অন্য পরিবারের ছেলেরা ক্লাস ফোর পাশ হলেই শিক্ষিত বলে গণ্য হতো। মেয়েদের লেখাপড়ার বালাই ছিল না। তবে সম্পন্ন ঘরের মেয়েরা হারমনিয়াম সহযোগে গান শিখতো, কেউ লেখাপড়াতেও এগিয়ে যেতো। মেয়েদের বিদ্যালয় সংখ্যায় ছিল কম।

গ্রামে যাত্রা-থিয়েটার ছিল। ছিল জাতপাতভিত্তিক লোকগীতি। পাঁচালি ধর্মগ্রন্থ বা কিস্যাপাঠ। হিন্দু মুসলনানের মধ্যে রেওয়াজ ছিল পাঠন পাঠন। এই যে ছবিটা দেখা হলো, সেটি আমার ধারণা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) আগে পর্যন্ত। আমাদের রাজ্যে ঐ মহাযুদ্ধের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলিম শাসন সমস্যা দেখা গেল (১৯৩৯)। এমনকি স্বাধীন ভারত না বিশেষ বিশেষ ধর্মগোষ্ঠী অধ্যূষিত ভারত না মজুর চাষীদের জীবন জীবিকার লড়াইয়ে জয়ী মহাযুদ্ধের প্রভাবজনিত সঙ্কটের সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে যায়। ১৯৩৮-এ চাষীদের পক্ষে ব্যবস্থা নেবার সদিচ্ছা। ১৯৩৯ সালে মুসলিম স্বাধিকারের পক্ষাবলম্বী মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব, হিন্দু মহাসভার উদ্ভব ১৯৪২-এর স্বাধীনতা বিপ্লব, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৫ সালে যুদ্ধোত্তর দেশে আজাদ হিন্দ বাহিনীর মুক্তির পক্ষে আন্দোলন, ১৯৪৬এ সাম্প্রদায়িক হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কুকীর্তি, ১৯৪৬ সালে তেভাগার জন্য আধিয়ার কৃষকের অধিকার সংগ্রাম এবং ক্রিপস দৌত্য থেকে র‍্যাডক্লিফ বাঁটোয়ারা গোটা উপমহাদেশকেই নাড়িয়ে দেয়। তখন সদ্য স্কুলের পাঠ নিচ্ছি। যুদ্ধের ডামাডোলে লেখার কাগজ মিলতো না, জামা-প্যান্ট পরার কাপড় পাওয়া যেতো না, লেখার কালি ছিল অপ্রতুল। তাছাড়া আঞ্চলিক ব্যবধান ঘটেছিল সম্প্রদায়ের পরিচয়ে। এই ভয়াবহতা  'সেকালের যুগ' যদি হয়, সে যুগ যেন আর কখনো ফিরে না আসে।

দেশ ভাগ তো হলো। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। রাতারাতি প্রায় হিন্দু-মুসলমান সহপাঠী বন্ধুদের ছেড়ে ভিটে মাটি ছাড়া হয়ে পশ্চিমবাংলায় আসি। পিতৃদেব ও অন্য জ্যেষ্ঠরা বলতেন ঐ কৃত্রিম বিভাজন ঠেকবার নয়। কিন্তু ১৯৭১ সাল পর্যন্ততো টিকে গেল। সব কালো মেঘেরই জ্বলদর্চি  পড়ে থাকে। বাঙালির এক নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ভূমি বহু রক্তপাতের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। ভারতভূমিও গড়ে তুলেছে সাংবিধানিক বৃহত্তম গণতন্ত্র।

এখনকার যে সময় ফেলে গেলাম, সেটি ভৌম নয়, সম্পূর্ণ যান্ত্রিক। মনের গড়নও হয়ে উঠছে যান্ত্রিক। বিশ তলা, বাইশতলা বাড়ি, সামনে জলাশয়, ক্লাব ঘর, পুস্তকের ভারে পিঠকুঁজো বালক-বালিকারা খেলা বলতে কম্পিউটার গেম,  অপরের খেলা দেখে উল্লাস। কানে মুঠো ফোন, স্বদেশী লিখন পঠন বাতিল হচ্ছে। মহাযুদ্ধের ফল যেমন তা পারমাণবিক  অস্ত্র এবং পরমাণুর চেয়ে ছোট বস্তু ন্যানো, এখনকার সমাজটাই হয়ে উঠেছে ন্যানো গঠনে তাই। এক লহমায় তোমার স্বর পৌঁছে যাবে দূরে দূরান্তরে, মহাকাশে পৌঁছে যাচ্ছে তোমার পায়ের ছাপ। কিন্তু মনের গড়নটা বা নক্সাটা দ্রুতগামী ও যান্ত্রিক হলে, একালটা হয়ে পড়বে যন্ত্র-সর্বস্ব। অন্তত তাই দেখছি। একাল না সেকাল, কোনটা ভালো, বলতে পারছি না। গোলাপ ফুল পেতে গেলে কাঁটার খোঁচা পেতে হয়। আমাদের সেকালের কাঁটার খোঁচার সঙ্গে তুলনা করলে বলব, পুরনো দিনে ছিল কাঁটার সংখ্যা অনেক বেশি। পরিবার, সমাজ, বাহন, আচার আচরণ সংস্কার সব নিয়ে। এখন ঘটে যাচ্ছে সমধর্মী হোমোজিনিয়াম। সময়তো বসে থাকে না, সে বদল হবেই। কাঁটার ঘা খাওয়া মানুষ এক পুরনো-নতুনের সম্মিলক গড়বে। ভালোই হবে।

প্রকৃতি ও মানুষ এবং বিশ্বজগৎ যদি এক সূত্রে ধরা যায়, তবে তো বেশ হয়। পরিবর্তনের কালে বহু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। মা-সেই বেদনা বোঝেন, জানেন। শিশু তা জানে না। মানব-সমাজ-শিশু, বেদনাদীর্ণ প্রকৃতি জননী ও যান্ত্রিক  স্ক্যালপেলের সমন্বয়ে যে সমাজ কাঠামো দেখছে, মানুষ যদি আপনার শ্রম ও মনীষার মূল্য পায়, এখনকার সমাজ হবে সর্বোত্তম।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments