জ্বলদর্চি

শ্যামলকান্তি /নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


শ্যামলকান্তি

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

মহিষাদলে প্রথম কবে যাই ? ১৯৭৪ সালে ? ভাল করে মনে পড়ে না। তবে সেখানেই যে শ্যামলকান্তিকে প্রথম দেখি, এটা খুব স্পষ্ট মনে আছে। লম্বা গড়নের শ্যামবর্ণ রোগা ডিগডিগে ছেলে, বি.এ. পাশ করে গ্রামের বাড়িতে বেকার বসে আছে, হয়তো সেই কারণেই মুখে একটা কাঁচুমাচু ভাব। অথচ সেই বিকেলেই মহিষাদল কলেজের কবি সম্মেলনে সে যখন কবিতা পড়তে উঠল, তখন দেখি তার চেহারা একেবারে পালটে গেছে। মঞ্চে উঠে, মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, তেজি গলায় গোটা তিন-চার কবিতা পড়ে, ঠাস-জমাট সভার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী, ভাল লাগল ?" তাও আবার এমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলল, যেন ভাল লাগুক আর না-ই লাগুক, তাতে তার কিস্যু যায় আসে না।

   কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলুম। সভাস্থলে তার ভক্তও দেখলুম অজস্র। পরে তাকে কাছে ডেকে বলি, “কলকাতায় এলে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।" এ যখনকার কথা, তখন সদ্য আমি 'আনন্দমেলা' পত্রিকার ভার পেয়েছি। সম্পাদনার কাজে আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন লোক দরকার। শ্যামল কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করে; কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমি ওকে 'আনন্দমেলা'য় নিয়ে নিই। শ্যামলের গোটা চাকরি জীবন ওই 'আনন্দমেলা'তেই কেটেছে। ওকে নিয়ে কোনও ঝামেলা যে কখনও আমাকে পোহাতে হয়নি, তা বলব না, তবে একইসঙ্গে বলব, যেমন প্রেস-কপি তৈরি করায়, তেমনি কাগজখানাকে আদ্যন্ত নির্ভুলভাবে বার করায় ওর ভূমিকা ছিল একেবারে নিখুঁত।


  শ্যামলকান্তি নিজে যেমন কবি, তেমনি অন্যদের কবিতা সম্পর্কেও সমান আগ্রহী। তা নইলে সে 'কবিসম্মেলন' কাগজখানা বার করতে যাবে কেন? তার উপরে আবার ত্রৈমাসিক নয়, মাসিক কাগজ। সেই কাগজ ও বছরের পর বছর ধরে নির্দিষ্ট সময়ে বার করে যাচ্ছে। তার জন্যে যে কী পরিমাণ ঝক্কি ওকে সামলাতে হচ্ছে, সেটা কারও না বুঝবার কথা নয়। প্রশ্ন উঠবে, এত ঝক্কি ও সামলাচ্ছে কেন? সামলাচ্ছে কি নিজের কিংবা বিশেষ কোনও কবিগোষ্ঠীর প্রচারের জন্য? কই, তাও তো বলা যাচ্ছে না। যে-কোনও সংখ্যার 'কবি সম্মেলন'-এর পাতা ওলটালেই নিশ্চিত বোঝা যায় যে, এ-কাগজ গোষ্ঠীবাজিতে বিশ্বাস করে না, শ্যামল এ-কাগজ বার করছে স্রেফ সব বয়সের, সব বিশ্বাসের সমস্ত কবিকে এক জায়গায় এনে সম্মিলিত করতে। বিশেষ করে নবীন কবিরা যাতে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়, তার জন্য। এ কি কম কথা ?

  শ্যামলকান্তির কবিতায় বয়োজ্যেষ্ঠ কবিদের কারও কিছু প্রভাব কখনও আমার চোখে পড়েনি। আজও পড়ে না। কবিতা তো এক ধরনের কথা বলা। শ্যামল যে ঢঙে কথা বলে, সেটা ওর সর্বৈব নিজস্ব ঢং। ওর দেখবার চোখ আলাদা, লেখবার হাতও অন্য কারও মতন নয়। ওর কোনও কবিতা পড়েই কখনও আমার মনে হয়নি যে, তাতে আর কারও প্রকাশ ভঙ্গিমার এতটুকু ছায়া পড়েছে। আসলে কবি হিসেবে ওর ভাবনার জগৎটাই একেবারে ভিন্ন ধাঁচের। তাতে যেমন বিস্ময়ের উপাদান আছে অনেকখানি, তেমনি আবার মজাও কিছু কম নেই। কিন্তু যত মজা করেই শ্যামল তার ভাবনার কথা আমাদের শোনাক না কেন, তার মধ্যে থেকে একটা আর্তিও যে আমাদের কানে এসে বাজে, তাও বা ভুলি কী করে? 

  শ্যামল তার সময়ের একজন প্রধান কবি। কিন্তু তার কাজের যে স্বীকৃতি তার প্রাপ্য ছিল তা সে আজও পায়নি। পাবে নিশ্চয়। তার কবিতার সঠিক মূল্যায়নও একদিন হবে। এই তাকে নিয়ে একটি পত্রিকার বিশেষ-সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ দেখছি, হয়তো এরই মধ্য দিয়ে তার সূচনা হল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

2 Comments