জ্বলদর্চি

শ্যামলকান্তি/ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়


শ্যামলকান্তি 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শ্যামলের সঙ্গে আগে পরিচয়, না কি তার কবিতার সঙ্গে, সেটা এতকাল পরে আর বলা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে পরিচয়ের অন্তত তিন যুগ পেরিয়ে গেছে। শুধু মনে আছে ঝাঁকড়া চুল, ছিপছিপে চেহারা এবং এক মুখ হাসি নিয়ে শ্যামল সতত ব্যস্ত থাকত নানাবিধ কাজে। আমাদের দেশ-এর ঘরটা ছিল শ্যামলের দফতর আনন্দমেলার মুখোমুখি। প্রায়ই চলে আসত আমার বা সুনীলের কাছে। বেশিক্ষণ থাকত না।

  আমি যখন আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদ বিভাগে ছিলাম তখনও শ্যামল মাঝে মাঝে নীরেনদার দূত হয়ে আমাকে লেখার তাগাদা দিতে যেত। কিন্তু তাগাদা মোটেই করত না, বরং আমার ঢিলেমির প্রতি তার একটু সহানুভূতিই ছিল।

  শ্যামলকে কখনও কারও সঙ্গে কর্কশ বা কটু ব্যবহার করতে দেখিনি, সর্বদাই একটু রক্ষণাত্মক ছিল। ঝগড়া বিবাদ কারও সঙ্গেই ছিল না তার। আমি তার ছেলেটির খুব খোঁজ খবর নিতাম। ছেলের অনেক গল্প করত সে।

 আসলে আমি একজন কবিতাপ্রেমী মানুষ। গদ্য লিখি, কিন্তু বেশি পড়ি কবিতাই। কবিতা হয়তো একটু বুঝতেও পারি, শ্যামলকান্তি দাশের প্রতি আমার স্নেহের বিশেষ একটা কারণ হল, তার কবিতা। তার প্রজন্মের যে দুজন কবিকে গুরুত্ব দিতেই হবে তার মধ্যে একজন শ্যামলকান্তি, অন্য জন রতনতনু ঘাটী। এই দুজনের বন্ধুত্বও ছিল খুব।

  শ্যামলের কবিতা সম্পর্কিত কার্যকলাপ শুধু লেখাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, কবিতাচর্চার ব্যাপ্তি ও বিস্তার ঘটানোর জন্য সে এখনও এক নিরলস কর্মী। মেদিনীপুরের একাধিক কবি আমাকে বলেছেন, এই জেলায় কবিতা চর্চার যে ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে তার পিছনে একক প্রেরণা হল শ্যামলকান্তি। কত জায়গায় কত বড় বড় কবিতা উৎসবের সংগঠন যে সে করেছে তার হিসেব নেই, এবং এতে প্রবল সাড়াও পড়ে গিয়েছিল একসময়ে।

 তখন আনন্দমেলার সম্পাদক ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি যেমন শক্তিমান কবি, তেমনি ছন্দবিদ এবং বাংলা ভাষার একজন বিশেষজ্ঞও বটে। বানান, ছন্দ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। তাঁর প্রভাবেই কিনা একথা জানি না শ্যামলেরও ওইসব বিষয়ে গভীর ব্যুৎপত্তি আছে।

  একটা ব্যাপার খুব ভাল লাগত। শ্যামলকান্তির কোনও কবিতা পড়ে ভাল লাগলে যখনই তাকে ডেকে প্রশংসা করেছি তখনই সে ভারী সংকুচিত হয়ে প্রসঙ্গটা বিনয়ের সঙ্গে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে। এই লাজুকতা তার নিরহংকারতারই পরিচায়ক, এযুগে যখন তাহংকারই মানুষের ভূষণ তখন এ এক দুর্লভ গুণ বলেই আমার মনে হয়।

  শ্যামলকান্তির কাছে আমার ব্যক্তিগত একটু ঋণও আছে। আমি অগোছালো এবং অসংগঠিত এক মানুষ। আমার লেখার ফাইল কপি অনেকগুলিই হারিয়ে গেছে, আর আজকাল ফাইলকপির পাটও নেই। ফলে যখনই আমার পুরোনো লেখার প্রয়োজন পড়েছে আমি সর্বদা শ্যামলের শরণাপন্ন হয়েছি। অতিশয় যত্নে সে আমার বেশির ভাগ প্রকাশিত লেখাই জমিয়ে রেখেছে, তার সাহায্য না পেলে আমার অনেক বই-ই প্রকাশ করা সম্ভব হত না। আনন্দমেলায় আমার লেখার প্রুফ শ্যামল দেখলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতাম, তাতে ভুল ভ্রান্তি থাকবে না। 

  এই বিনম্র স্বভাব, হাস্যমুখ ও নিরলস যুবকটি এখন আর তত যুবক নেই। আনন্দবাজার পত্রিকা অর্থাৎ আনন্দমেলা থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে সে চলে যাওয়ার পর অনেকদিন তার অভাব অনুভব করেছি। নিজের লেখার খোঁজ আমি যত না জানতাম তার চেয়ে বেশি জানত শ্যামল।

  মাঝখানে বেশ কয়েক বছর তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। নানা কর্ম ব্যস্ততায় খোঁজখবরও তেমন নেওয়া হয়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে তার কবিতা পত্র-পত্রিকায় দেখলে সাগ্রহে পড়েছি। শ্যামলের কবিতার ভিতরে কিছু যাদুতো আছেই।

  অনেকদিন পরে তার সঙ্গে যখন আবার যোগাযোগ হল, তখন দেখি তার চুল ও গোঁফে কিছু পাক ধরেছে, একটু বয়সের ভার এসেছে চেহারায়। তবু শিশু সুলভ হাসিটি অমলিন আছে। 

  শুনতে পাই অবসরের জীবনেও তার কর্মব্যস্ততায় ভাঁটা পড়েনি, আর তার কাজ সবকিছু কবিতাকে ঘিরেই। কবিতাই তার জীবনের চালিকাশক্তি, সে একজন অত্যন্ত শক্তিমান কবি, অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক এবং বোদ্ধা, আর এই গুণগুলোই শ্যামলকে এক অনন্য বিশিষ্টতা দিয়েছে।

  শ্যামলকান্তি সুদীর্ঘজীবী হোক, কবিতায় মগ্ন হয়ে থাক, অনেক সম্মান ও ভালবাসার ভরে উঠুক—এই প্রার্থনা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

1 Comments

  1. শ্যামলদা, আমাদের কাছে কবিতাস্তম্ভ।

    ReplyDelete