জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত/ পর্ব-৭ /সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত   
  পর্ব-৭

সুদর্শন নন্দী 

১৪ই ডিসেম্বর ১৮৮২। বিজয়েরা এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে।ভগবানের কথা হচ্ছে সবার সাথে। 
কথায় কথায় বিজয়কে ঠাকুর বললেন— কামিনী-কাঞ্চনে জীবকে বদ্ধ করে। জীবের স্বাধীনতা যায়। কামিনী থেকেই কাঞ্চনের দরকার। তার জন্য পরের দাসত্ব। স্বাধীনতা চলে যায়। তোমার মনের মতো কাজ করতে পার না। এবার একটি গোল শোনালেন উপমা হিসেবে জাতে বিষয়টি পরিস্কার হয় ভক্তদের কাছে। জয়পুরে গোবিন্দজীর পূজারীরা প্রথম প্রথম বিবাহ করে নাই। তখন খুব তেজস্বী ছিল। রাজা একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তা তারা যায় নাই। বলেছিল, ‘রাজাকে আসতে বল’। তারপর রাজা ও পাঁচজনে তাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন রাজার সঙ্গে দেখা করবার জন্য, আর কাহারও ডাকতে হল না। নিজে নিজেই গিয়ে উপস্থিত। ‘মহারাজ, আশীর্বাদ করতে এসেছি, এই নির্মাল্য এনেছি, ধারণ করুন।’ কাজে কাজেই আসতে হয়; আজ ঘর তুলতে হবে, আজ ছেলের অন্নপ্রাসন, আজ হাতেখড়ি — এই সব।
শোনালেন আরেকটি গল্প। ঈশ্বর লাভে দাসত্ব এক অন্তরায়। তা বোঝাতে  বললেন বারশো ন্যাড়া আর তেরশো নেড়ী তার সাক্ষী উদম সাড়ী — এ গল্প । নিত্যানন্দ গোস্বামীর ছেলে বীরভদ্রের তেরশো ন্যাড়া শিষ্য ছিল। তারা যখন সিদ্ধ হয়ে গেল, তখন বীরভদ্রের ভয় হল। তিনি ভাবতে লাগলেন, ‘এরা সিদ্ধ হল, লোককে যা বলবে তাই ফলবে; যেদিক দিয়ে যাবে সেইদিকেই ভয়; কেননা, লোক না জেনে যদি অপরাধ করে, তাদের অনিষ্ট হবে।’ এই ভেবে বীরভদ্র তাদের বললেন, তোমরা গঙ্গায় গিয়ে সন্ধ্যা-আহ্নিক করে এস। ন্যাড়াদের এত তেজ যে, ধ্যান করতে করতে সমাধি হল। কখন জোয়ার মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে হুঁশ নাই। আবার ভাঁটা পড়েছে তবু ধ্যান ভাঙে না। তেরশোর মধ্যে একশো বুঝেছিল — বীরভদ্র কি বলবেন। গুরুর বাক্য লঙ্ঘন করতে নাই, তাই তারা সরে পড়ল, আর বীরভদ্রের সঙ্গে দেখা করলে না। বাকী বারশো দেখা করলে। বীরভদ্র বললেন, ‘এই তেরশো নেড়ী তোমাদের সেবা করবে। তোমরা এদের বিয়ে কর।’ ওরা বললে, ‘যে আজ্ঞা, কিন্তু আমাদের মধ্যে একশ'জন কোথায় চলে গেছে।’ ওই বারশোর এখন প্রত্যেকের সেবাদাসীর সঙ্গে থাকতে লাগল। তখন আর সে তেজ নাই, সে তপস্যার বল নাই। মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকাতে আর সে বল রইল না; কেননা সে সঙ্গে স্বাধীনতা লোপ হয়ে যায়। (বিজয়ের প্রতি) তোমরা নিজে নিজে তো দেখছ, পরের কর্ম স্বীকার করে কি হয়ে রয়েছ। আর দেখ, অত পাশ করা, কত ইংরাজী পড়া পণ্ডিত, মনিবের চাকরি স্বীকার করে তাদের বুট জুতার গোঁজা দুবেলা খায়। এর কারণ কেবল ‘কামিনী’। বিয়ে করে নদের হাট বসিয়ে আর হাট তোলবার জো নাই। তাই এত অপমানবোধ, অত দাসত্বের যন্ত্রণা।

  বিজয়ের সাথে ঠাকুরের লোকশিক্ষা নিয়ে কথা হচ্ছে। কথা হচ্ছে সদ্‌গুরু কাঁচা গুরু আর পাকা গুরু নিয়ে। 
 বিজয়কে ঠাকুর একটি ঘটনার মাধ্যমে বললেন- 
আমি একদিন পঞ্চবটীর কাছ দিয়ে ঝাউতলায় বাহ্যে যাচ্ছিলাম। শুনতে পেলুম যে, একটা কোলা ব্যাঙ খুব ডাকছে। বোধ হল সাপে ধরেছে। অনেকক্ষণ পরে যখন ফিরে আসছি, তখনও দেখি, ব্যাঙটা খুব ডাকছে। একবার উঁকি মেরে দেখলুম কি হয়েছে। দেখি, একটা ঢোঁড়ায় ব্যাঙটাকে ধরেছে — ছাড়তেও পাচ্ছে না — গিলতেও পাচ্ছে না — ব্যাঙটার যন্ত্রণা ঘুচছে না। তখন ভাবলাম, ওরে! যদি জাতসাপে ধরত, তিন ডাকের পর ব্যাঙটা চুপ হয়ে যেত। এ-একটা ঢোঁড়ায় ধরেছে কি না, তাই সাপটারও যন্ত্রণা, ব্যাঙটারও যন্ত্রণা!

ঠাকুর বললেন, যদি সদ্‌গুরু হয়, জীবের অহংকার তিন ডাকে ঘুচে। গুরু কাঁচা হলে গুরুরও যন্ত্রণা, শিষ্যেরও যন্ত্রণা! শিষ্যেরও অহংকার আর ঘুচে না, সংসারবন্ধন আর কাটে না। কাঁচা গুরুর পাল্লায় পড়লে শিষ্য মুক্ত হয় না।”

এবার আলোচনা হচ্ছে জীবের স্বভাব নিয়ে।উপাধি, অর্থ, সম্মান এসব হলে কি অবস্থা হয় জীবের। এ  অবস্থা জীবের ভগবান লাভের অন্তরায়।  

উপমা দিয়ে ঠাকুর সরল ভাবে বললেন বিষয়টি। 
বললেন-এক-একটি উপাধি হয়, আর জীবের স্বভাব বদলে যায়। যে কালোপেড়ে কাপড় পরে আছে, অমনি দেখবে, তার নিধুর টপ্পার তান এসে জোটে; আর তাস খেলা, বেড়াতে যাবার সময় হাতে ছড়ি (stick) এইসব এসে জোটে। রোগা লোকও যদি বুট জুতা পরে সে অমনি শিস দিতে আরম্ভ করে, সিঁড়ি উঠবার সময় সাহেবদের মতো লাফিয়ে উঠতে থাকে। মানুষের হাতে যদি কলম থাকে, এমনি কলমের গুণ যে, সে অমনি একটা কাগজ-টাগজ পেলেই তার উপর ফ্যাসফ্যাস করে টান দিতে থাকবে।
বললেন টাকার উপমা দিয়ে। টাকাও একটি বিলক্ষণ উপাধি। টাকা হলেই মানুষ আর-একরকম হয়ে যায়, সে মানুষ থাকে না।

এবার শোনালেন একটি গল্প। বললেন-এখানে একজন ব্রাহ্মণ আসা-যাওয়া করত। সে বাহিরে বেশ বিনয়ী ছিল। কিছুদিন পরে আমরা কোন্নগরে গেছলুম। হৃদে সঙ্গে ছিল। নৌকা থেকে যাই নামছি, দেখি সেই ব্রাহ্মণ গঙ্গার ধারে বসে আছে। বোধ হয়, হাওয়া খাচ্ছিল। আমাদের দেখে বলছে, ‘কি ঠাকুর! বলি — আছ কেমন?’ তার কথার স্বর শুনে আমি হৃদেকে বললাম, ‘ওরে হৃদে! এ লোকটার টাকা হয়েছে, তাই এইরকম কথা।’ ভাগ্নে হৃদয় হাসতে লাগল গল্প শুনে।
ঠাকুর আবার একটি উপমা দিলেন গল্পের মাধ্যমে। -একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা ছিল। একটা হাতি সেই গর্ত ডিঙিয়ে গিছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিকে লাথি দেখাতে লাগল। আর বললে, তোর এত বড় সাধ্য যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস! টাকার এত অহংকার।
                                                     (ক্রমশঃ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
              

Post a Comment

0 Comments