জ্বলদর্চি

বিবেক ধ্বনি বাজুক প্রাণে /প্রসূন কাঞ্জিলাল

বিবেক ধ্বনি বাজুক প্রাণে

প্রসূন কাঞ্জিলাল


স্থান - বজবজ।
দিনটা শুক্রবার। 
১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭ , ফিরে এলেন বিবিদিষানন্দ  ।। 

সকাল সাড়ে ৭টায় লোকাল ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছল। স্টেশন তখন প্রায় ২০ হাজার লোকের ভিড়ে ঠাসা। ভিড় জানে, ওই ট্রেনেই সঙ্গীদের নিয়ে স্পেশাল কম্পার্টমেন্টে রয়েছেন তিনি।

তিনি, গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী বিবিদিষানন্দ। এই শহর তাঁকে শেষ দেখেছে সাত বছর আগে, ১৮৯০ সালে। তখন তিনি ও তাঁর সতীর্থ কয়েক জন তরুণ বরাহনগরের এক পোড়ো বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়ির এক ঘরে প্রয়াত গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির সামনে পুজোপাঠ ও শাস্ত্র আলোচনা করেন, মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শোন। গুরুর মৃত্যুর পর বিরজা হোম করে সন্ন্যাস নিয়েছেন তাঁরা, মাঝে মাঝেই বারাণসী, গাজীপুর, হিমালয়ে একাকী তীর্থদর্শনে বেরিয়ে যান। এক সতীর্থ অখণ্ডানন্দ তো তিব্বতেও চলে গিয়েছিলেন।

বিবিদিষানন্দ অবশ্য তিব্বত যাননি। হরিদ্বার, হৃষীকেশ, আলমোড়া হয়ে সটান চলে গিয়েছিলেন রাজস্থান। সেখানে খেতড়ির রাজা তাঁকে বিবেকানন্দ উপাধি দেন, শিকাগো ধর্মমহাসভায় যাওয়ার জন্য ‘ওরিয়েন্ট’ জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে দেন। আমেরিকা, লন্ডন ঘুরে বিশ্বজয়ী সেই সন্ন্যাসী এই ট্রেনে চেপেই পা রাখবেন তাঁর চেনা শহরের চেনা স্টেশনে। সাত বছর আগে অচেনা তরুণ বিবিদিষানন্দের প্রস্থান কলকাতার মনে দাগ কাটেনি। সেই শহর আজ নতুন বেশে বিবেকানন্দকে দেখতে উদ্বেল।

দিনটা শুক্রবার। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭। কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেনটা আসছে বজবজ থেকে। চটকলের শিল্পশহর, তেলবাহী জাহাজের বন্দর বজবজে ট্রেন যোগাযোগও তৈরি হয়েছে ঠিক সাত বছর আগে। বিবিদিষানন্দ যখন কলকাতা ছাড়ছেন, সেই ১৮৯০ সালে।

সাত বছরে পরিবর্তন অনেক। তৎকালীন মাদ্রাজ, অধুনা চেন্নাই থেকে ‘এস এস মোম্বাসা’ জাহাজে এ বার বিদেশি শিষ্যদের নিয়ে ফিরছেন বিবেকানন্দ। সঙ্গে তাঁর বক্তৃতার অনুলেখক গুডউইন, ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও তাঁর স্ত্রী, আরও অনেকে। বিলেত থেকে ফেরার পথে প্রথমে কলম্বো, সেখান থেকে কান্ডি, জাফনায় এসেছিলেন তাঁরা। তার পর রামনাদের ভারত ভূখণ্ডে। সেখান থেকে মাদুরাই, তিরুচিরাপল্লি হয়ে ট্রেনে মাদ্রাজ।

জায়গায় জায়গায় তাঁকে দেখতে ভিড়, তিরুচিরাপল্লিতে রাত চারটেতে তাঁর ট্রেন থামার কথা। তখনও ফুল, মালা নিয়ে স্টেশনে কয়েক হাজার মানুষ। মাদ্রাজের আগে এক ছোট্ট স্টেশন, সেখানে ট্রেন থামার কথা নয়। কিন্তু বিবেকানন্দ আসছেন জেনে লাইনের ওপর শুয়ে পড়েছে কয়েকশো মানুষ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্লান্ত শরীরে জায়গায় জায়গায় বক্তৃতা দিতে হয়েছে। বিশ্রাম নিতে নিতে চেনা শহরে ফিরবেন বলে ট্রেনে আর উঠলেন না। ১৫ ফেব্রুয়ারি সওয়ার হলেন কলকাতাগামী মোম্বাসা জাহাজে।

ফেরার পথে হুগলি নদীর চড়ায় অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় বজবজে নোঙর ফেলল জাহাজ, কিন্তু তখনকার আইনে সূর্যাস্তের পর জাহাজ থেকে নামা নিষেধ। বিবেকানন্দ ও তাঁর সঙ্গীরা তাই নামলেন ১৯ তারিখ সকালে, সেখান থেকে বজবজ স্টেশন। মাদ্রাজে তাঁকে দেখতে ভিড় করেছেল হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু বজবজ স্টেশন আজ নির্জন, নীরব।

আসলে, অভ্যর্থনা কমিটি তখন শিয়ালদহে। রাজধানী কলকাতার বাইরে বজবজের কথা কেউ ভাবেনি। বাঙালির পরিকল্পনায় এ ভাবেই সে দিন ফাঁক থেকে গিয়েছিল।

ভোরবেলা স্টেশনে পৌঁছেও অপেক্ষা করতে হল বেশ কিছু ক্ষণ। নেটিভ সন্ন্যাসীর জন্য নেই কোনও স্পেশাল ট্রেন। স্টেশন মাস্টার অবশ্য তাঁর ঘরের একটি চেয়ারে সন্ন্যাসীকে বসতে দিলেন, সেই চেয়ার এখন ফেয়ারলি প্লেসের রেল মিউজিয়ামে।

ভোরের লোকাল ট্রেন সাড়ে সাতটায় শিয়ালদহে থেমেছে, স্টেশন তত ক্ষণে মুখরিত ‘জয় পরমহংস রামকৃষ্ণ কি জয়,’ ‘জয় স্বামী বিবেকানন্দ কি জয়’ আওয়াজে। কসমোপলিটান রাজধানী সে দিন হিন্দি ভাষাতেই জয়ধ্বনি তুলেছিল। ভিড় ঠেলে অভ্যর্থনা কমিটির সেক্রেটারি, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন কোনও ক্রমে এগিয়ে গেলেন, বিবেকানন্দকে বসিয়ে দিলেন স্টেশনের বাইরে অপেক্ষারত ল্যান্ডো গাড়িতে।

বিবেকানন্দ সেভিয়ার দম্পতিকে নিয়ে সেই গাড়িতে বসতেই এক দল ছাত্র এগিয়ে এসে ঘোড়া দুটোকে লাগাম থেকে খুলে নিজেরাই গাড়ি টানতে শুরু করল। সামনে ব্যান্ড পার্টি, মাঝে গাড়ি আর পিছনে খোল-করতাল সহ কীর্তনের দল। সেলেব্রিটি বরণের এই রকম ইভেন্ট আগে কখনও দেখেনি কলকাতা।

রাস্তার দু’ধারে ফুল নিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ। সার্কুলার রোডে ‘জয় স্বামীজি’ লেখা তোরণ, ওপরে নহবতখানা। হ্যারিসন রোডের মোড়ে আর একটা, রিপন (সুরেন্দ্রনাথ) কলেজের গেটে লেখা ‘স্বাগত’।

কলকাতা এ দিন একটা ব্যবস্থা করেছিল। রাস্তায় কোনও সভা নয়, শুধু শোভাযাত্রা। ঠিক হয়েছিল, তাঁকে সন্মান জানিয়ে সভা হবে ৯ দিন পরে, ২৮ ফেব্রুয়ারি। শোভাবাজার রাজবাড়িতে। বিস্ত়ৃত প্রাঙ্গণ, অনেকেই সন্ন্যাসীর বক্তৃতা শুনতে পারবে।

বিবেকানন্দের গাড়ি দুপুরবেলায় পৌঁছল বাগবাজারে পশুপতিনাথ বসুর বাড়িতে। এ দিন এখানেই তাঁদের দুপুরের খাওয়ার বন্দোবস্ত। অতঃপর বরাহনগরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়ি। বিদেশি শিষ্যদের সেখানে রেখে তিনি চললেন আলমবাজার।

সাত বছর আগে, যে দিন বিবিদিষানন্দ বেরিয়েছিলেন, মঠ ছিল বরাহনগরের এক পোড়ো বাড়িতে। পরে ১৮৯২ সালে তরুণ সন্ন্যাসীরা চলে আসেন আলমবাজারের এই বাড়িতে। বিবেকানন্দ তখন খেতড়িতে। খবরটা পান চিঠিতে। এই ১৯ ফেব্রুয়ারি আলমবাজার মঠে তাঁর প্রথম পদার্পণ।

প্রবেশদ্বারে কলাগাছ, আম্রপল্লবসহ জলভরা কলসি সাজিয়ে রেখেছেন সতীর্থ অখণ্ডানন্দ ও রামকৃষ্ণানন্দ। অন্যরা কলকাতা গেলেও এই দুই গুরুভাই সারা দিন থেকে গিয়েছেন মঠে, তৈরি হয়েছে ছোটখাটো এক তোরণও।

কলকাতায় ফিরে বিবেকানন্দ দিনের বেলায় বিদেশি শিষ্যদের কাছে, গোপাল লাল শীলের বাগানবাড়িতে থাকেন। রাতে আলমবাজার। কখনও শাস্ত্রচর্চা, কখনও বা জানলায় হ্যামক টাঙিয়ে বই পড়েন। মাঝে মাঝে গুনগুন করেন গীতগোবিন্দের গান।

ফেরার তিন-চার দিন পর বাগবাজারে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের  বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ। সেখানেই চাঁদা নিতে হাজির গোরক্ষিণী সভার এক প্রচারক। ঘটনাটা আজও বিখ্যাত। বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মধ্যভারতে দুর্ভিক্ষে প্রায় আট লাখ লোক মারা গিয়েছে। আপনারা তাঁদের জন্য কিছু করছেন না?’ ভদ্রলোকের উত্তর, ‘না, ওটা ওঁদের কর্মফল।’ বিবেকানন্দের সটান জবাব, ‘তা হলে গরুরাও নিজেদের কর্মফলে কসাইখানায় যাচ্ছে। আমাদের কিছু করার নেই।’ নাছোড়বান্দা ভদ্রলোক বললেন, ‘কিন্তু শাস্ত্র বলে, গরু আমাদের মা।’ বিবেকানন্দের উত্তর, ‘দেখেই বুঝেছি। তা না হলে এমন কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করবেন?’

২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় শোভাবাজার রাজবাড়ির সভা। দালান উপচে পড়ছে মানুষের ভিড়ে। সেখানেই বললেন, ‘আজ সন্ন্যাসী ভাবে আসিনি, ধর্মপ্রচারক হিসেবেও নয়। এসেছি সেই কলকাতাবাসী বালক রূপে।…’

একটার পর একটা বক্তৃতা। শোভাবাজার, স্টার থিয়েটার। ৭ মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি, এত বছর বাদে এলেন দক্ষিণেশ্বর। তবু তাঁকে দেখতে ভিড়ে ভিড়াক্কার। শরীর দিচ্ছে না, কিন্তু মাথায় অনেক পরিকল্পনা। তৈরি করতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের নামে মঠ ও মিশন। জন্মতিথির পর দিনই শরীর সারাতে দার্জিলিঙের উদ্দেশে রওনা হলেন তিনি। সাত বছর পর কলকাতায় এসে বিবেকানন্দ থাকলেন মাত্র ১৬ দিন। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ।

শরীরের কথা কবে আর খেয়াল রাখলেন তিনি? শোভাবাজারে সভার তিন দিন আগেও মার্কিন শিষ্যা ওলি বুলকে লিখছেন, ‘এত ক্লান্ত, জানি না আর ছ’মাসও নিজেকে টানতে পারব কি না। তবে, কলকাতা আর মাদ্রাজে দুটো সেবাকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। মাদ্রাজের লোকেরা বেশ আন্তরিক। কলকাতার বড়লোকেরা স্রেফ দেশপ্রেমের কারণে এ বিষয়ে উৎসাহী, উৎসাহ কাজে পরিণত হবে বলে মনে হয় না।’ বিবেকানন্দ জানতেন, শুধু দেশপ্রেমের বুকনিতে চিঁড়ে ভেজে না।

এই কথাগুলি মনে রাখাতেই এত বছর আগের সেই দিনটার সার্থকতা। আজও বজবজের ‘গুডস ক্যারেজ ইউনিট’-এ পুরনো রেল স্টেশনের অতিথিশালা সাজানো হয় ফুল আর মালায়, বজবজ-শিয়ালদহ লোকালের একটা কামরা ফুল দিয়ে সাজিয়ে সেখানে রাখা হয় ফাইবার গ্লাসে তৈরি বিবেকানন্দের মূর্তি। সেই ট্রেন শিয়ালদহে পৌঁছবে, তার পর আলমবাজার মঠ অবধি পদযাত্রা। দিগ্বিজয়ীর প্রত্যাবর্তন শহর আর কী ভাবেই বা মনে রাখত?

কলকাতায় প্লেগের থাবা, দার্জিলিং থেকে ছুটে এলেন অসুস্থ স্বামী বিবেকানন্দ।।

কোভিডের সঙ্গে লড়াই করে ২০২০ সাল পেরিয়ে এলাম সবাই। দেখলাম মৃত্যুমিছিল, সর্বক্ষণ এক অজানা আশঙ্কা আর মৃত্যুভয়। 

স্মরণাতীতকালে সারা বিশ্বজুড়ে একই সময় এমন অদ্ভুত সংকট বড়ো একটা আসেনি। কোভিডের দাপট রয়েছে এখনও।  ইতিহাস জড়ো করে আমরা বুঝে নিতে চাইছি সর্বংসহা এই পৃথিবী এর আগে ঠিক কতবার তার ওপর হওয়া লাগামছাড়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে   এমন মরণ কামড় ফিরিয়ে দিয়েছে মানুষকে। আশার কথা একটাই, অনেক হারিয়েও শেষপর্যন্ত এই সব কটা লড়াইয়ে বিশ্বাস জিতে গেছে, মানুষ জিতে গেছে। নতুন করে সে তার ভুল ত্রুটি সমবেতভাবে শুধরে বেঁচে উঠেছে। এই বিপর্যস্ত সময়ে আমাদের শহর কলকাতার তেমনই এক জিতে ফিরে আসা সময়ের কথা আজ মনে করব। মনে করব কলকাতার সেই জেতার অক্লান্ত কারিগর কিছু প্রত্যয়ী মানুষের কথা।

সাল ১৮৯৬। কলকাতা তখন কলিকাতা। মানুষ শুনল বোম্বে শহরে এক ভয়ানক রোগ দেখা দিয়েছে, তার নাম প্লেগ, মৃত্যু তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে। প্রায় দুবছর ধরে মুম্বই থেকে ধীরে ধীরে গুজরাট, কচ্ছ, সিন্ধু ও পাঞ্জাবের কিছু অংশ এবং মাদ্রাজ পেরিয়ে সে রোগ কলকাতায় থাবা বসিয়েছিল ১৮৯৮-এর গোড়ার দিকে। ততদিনে কলকাতার মানুষ জেনে গেছে এর আগে দুবার পৃথিবীতে মহামারীর থাবা বসানো এই প্লেগ ৫৪২ খ্রিস্টাব্দে জাস্টিনীয় প্লেগ নামে রোমে এক কোটি মানুষের এবং ১৩৪৬ সালে ইউরোপ মহাদেশের আড়াই লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এবার সে তার করাল গ্রাসে ছিন্নভিন্ন করতে এসেছে ঔপনিবেশিক কলকাতাকে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ইঁদুরের উৎপাত এবং সেই ইঁদুরের গায়ে বসা র্যাট ফ্লি মাছি খুব দ্রুত প্লেগের সংক্রমণ ঘটিয়েছিল মানুষের মধ্যে। প্রতিষেধক হিসেবে ছিল রোগ ছড়ানোর অন্তত এক সপ্তাহ আগে বাধ্যতামূলক টিকাকরণ এবং বাড়িঘর যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখা। নচেৎ সংক্রমণ ও মৃত্যু নিশ্চিত। সব জেনেও করোনা-কবলিত অনেক মানুষই যেমন আজও প্রয়োজনীয় সতর্কতা অমান্য করছেন, একশ কুড়ি বছর আগের অনেক বাঙালিও তেমনটাই করেছিলেন। এর সঙ্গে ছিল ইংরেজের হাতে টিকা নিলে রোগ আরও ছড়াবে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে এমন সব অযৌক্তিক ভয়।  ফলে সীমাহীন বিপর্যয় নেমে এসেছিল বাঙালির জীবনে। কলকাতায় গলির পর গলি উজাড় হয়ে গিয়েছিল প্লেগের রুগীতে।  

ডায়াবেটিক পেশেন্ট স্বামী বিবেকানন্দ তখন ডাক্তারের পরামর্শে দার্জিলিংয়ে। স্বামীজী প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রম তখন চলছে বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে। একই সঙ্গে চলছে বেলুড়ের মূল ভূমিখণ্ডে মঠ স্থানান্তরের কাজ। কলকাতায় প্লেগ মহামারির আকার নিচ্ছে এই নিদারুণ সংবাদে অস্থির হয়ে উঠলেন অসুস্থ বিবেকানন্দ। গুরুভাইদের সঙ্গত বারণ সত্ত্বেও ৩ মে কলকাতায় ফিরলেন তিনি, কারণ এই মানুষটিই ২৯ এপ্রিল বন্ধু ম্যাকলাউডকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি যে শহরে জন্মেছি, সেখানে যদি প্লেগ এসে পড়ে, তবে আমি তার প্রতিকারকল্পে আত্মোৎসর্গ করব বলেই স্থির করেছি।” কলকাতায় তখন এমনই আতঙ্ক যে হিন্দু-মুসলমান একযোগে কাজ ছেড়ে বাড়িতে বসে গেছেন। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ, গাড়ি ঘোড়া স্তব্ধ করে সে যেন স্বতঃস্ফূর্ত এক লক ডাউন। এরকম অবস্থায় বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাইদের জানালেন, মরণভয় তুচ্ছ করে প্লেগরোগীদের সেবা করতে, সচেতন করতে, সরকার নির্দেশিত ওষুধ সরবরাহ করতে। এবং এ কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে যদি নতুন মঠের জমি বিক্রিও করতে হয় তার জন্য সবাই যেন প্রস্তুত থাকে। প্লেগ হাসপাতাল তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। কলকাতায় তখন প্লেগের তাণ্ডবলীলার আশ্রয়স্থল। তাই মানুষ পালাতে শুরু করেছিল কলকাতা ছেড়ে। স্বামী বিবেকানন্দ এইসব মানুষগুলোকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন, কারণ এরাই রোগ জীবাণু বহন করে গ্রামবাংলার অন্যত্র প্লেগ ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে বসেছিল অজান্তে। ঠিক যেন কয়েক মাস আগের কলকাতার ছবি, ইটালির ছবি, বা সারা বিশ্বের ছবি। গভর্মেন্টের কাজে সাহায্য করার জন্য কমিটি গড়া হল রামকৃষ্ণ মিশনের তরফে। সিস্টার নিবেদিতা হলেন তার সম্পাদিকা, স্বামী সদানন্দ প্রধান কার্যাধ্যক্ষ, স্বামী শিবানন্দ, নিত্যানন্দ, আত্মানন্দ ছিলেন অনান্য কর্মী। নিজেদের হাতে এঁরা কলকাতার রাজপথ থেকে বস্তি পরিষ্কার করেছিলেন।  ইংরেজি খবরের কাগজে নিবেদিতা অর্থ সংগ্রহের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন এবং ২১ এপ্রিল ক্লাসিক থিয়েটারে মিশনের ডাকা সভায় স্বামীজীর উপস্থিতিতে ‘প্লেগ ও ছাত্রগণের কর্তব্য’ এই শিরোনামে একটি বক্তৃতা করেছিলেন। এর ফলে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিল অনেক ছাত্ররা। প্রতি রবিবার সন্ধেবেলা ৫৭ নং রামকান্ত স্ট্রিটে জড়ো হয়ে নিবেদিতা নির্দেশ দিতেন ছাত্রদের, ঠিক করে দিতেন এলাকা ভিত্তিক কর্মসূচি। টিকাকরণ যে কত জরুরি,  সরকারি নির্দেশ মেনে চলাই যে রোগ নিরাময়ের একমাত্র পথ তা জনে জনে বুঝিয়ে এসেছেন এরা। কাজ করেছেন প্রত্যক্ষ। আর এ কাজে পাশে পেয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিংবা জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মানুষকে।     

নিজে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামা, প্লেগ রুগীকে সন্তানসম ভালোবাসায় সেবা করে চলা, এমনকি তাদের মৃত্যুতে স্বজন হরানোর যন্ত্রণায় ভেঙে পড়া এই নিবেদিতা কিংবা স্বামীজি বা তাঁর গুরুভাইদের কাছে কৃতজ্ঞ সে সময়ের কলকাতা। আবার এই মানুষগুলোর কপালেই জুটেছে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, টিটকিরি, নিন্দার বাণ। বিদেশি বলে যে কলকাতা নিবেদিতার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলত সেই কলকাতাই নির্লজ্জ সেবা নিয়েছে সিস্টারের হাতে। প্লেগ নিরাময়ে সরকারি নির্দেশ উল্লেখ করে বিবেকানন্দ রচিত লিফলেট বিলিতে স্বামীজীর গুরুভাই অখণ্ডানন্দকে মারতে গিয়েছিল জনতা। কারণ তাদের সন্দেহ হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন ইংরেজের হয়ে প্রচার করছে, সাধুর ছদ্মবেশে এরা গভর্নমেন্টের চর। বিবেকানন্দ যেদিন দার্জিলিং থেকে আসেন তাঁর সঙ্গের গাঁটরি দেখেও তাঁর দিকে তেড়ে গিয়েছিল মানুষ, ভাবখানা এই যে সে গাঁটরিতে আছে প্লেগের টিকা, যা দিলে মৃত্যু অনিবার্য। অতএব মারো সাধুকে। মানুষের এই আত্মঘাতী অজ্ঞতাও যেন চিরকালীন, যার জন্য আজও সব কটা হাসপাতাল খোলা রেখে,  সবরকম সেবাকাজ চালিয়ে যাওয়া বেলুড় মঠ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নোটিশ অনুযায়ী   যেকোনো জমায়েত এড়ানোর নির্দেশ মেনে যখন বিজ্ঞপ্তি জারি করে, কিছু নির্বোধ উক্তি তখন বাতাসে ওড়ে। প্লেগ জনিত কলকাতার সে মহামারী কেটে গেলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল। মৃত্যুর অসহায়তা কাটিয়ে জীবন কথা বলেছিল। আট লক্ষ কলকাতা বাসীকে জিতিয়ে দিয়ে জিতে গিয়েছিল কিছু মানুষ।

তাই, আমাদের ভরসা রাখতে হবে জীবনের উপর। এই চরম দুঃসময়ে প্রয়োজনীয় সতর্কতা এবং সরকারি নির্দেশ মেনে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে এক সুন্দর সকালের জন্য। এই মুহূর্তের আবশ্যিক স্বাস্থ্যবিধি ভবিষ্যতে ঘরের বাইরে আমাদের নিরাপদ পা ফেলার একমাত্র উপায়। আমাদের সদিচ্ছাই এই উপায়ের সহায় হোক।

রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মধ্যে তফাত কী ? এই প্রশ্নের উত্তরে ভগিনী নিবেদিতার স্মরণীয় উত্তর ছিল “অতীত পাঁচ হাজার বছরে ভারতবর্ষ যা কিছু ভেবেছে, তারই প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ। আর আগামী দেড় হাজার বছর ভারত যা কিছু ভাববে, তারই অগ্রিম প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ।”

 নিবেদিতার সঙ্গে স্বামীজির শেষ সাক্ষাৎ হয় তাঁর দেহাবসানের দু’দিন আগে। এ বিষয়ে জোসেফিন ম্যাকলাউড লিখেছেন — তাঁর স্কুলে একটি বিশেষ বিজ্ঞান পড়ানো উচিত হবে কি না, সে ব্যাপারে স্বামীজির মতামত নিতে মঠে যান। স্বামীজি উত্তর দিয়েছিলেন- “তুমি যা করতে চাইছ হয়তো সেটাই ঠিক। তবে কি জান, জাগতিক কোনও কিছুতেই আর মন দিতে পারছি না। আমি এখন মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি।”

দেহাবসানের কয়েক বছর আগে  বিবেকানন্দ কাশ্মীরে বসে আমেরিকান ভক্তদের সামনে পাঠ করেছিলেন ৪ জুলাইয়ের উদ্দেশে তাঁর বিখ্যাত ইংরেজি কবিতা। কে জানত, এই ৪ জুলাইয়েই তাঁর দেহাবসান ঘটবে!ঐ দিনটি আবার আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। যেমনভাবে কেইবা জানত, ঠাকুরের তিরোধান দিবসই  হয়ে উঠবে ভারতের স্বাধীনতা দিবস।

 শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তি তৈরি হয়েছে তাঁর দেহাবসানের অনেক পরে। তার চেয়ে শতগুণ বেশি মূর্তি নগরে নগরে শোভিত হয়েছে তাঁর প্রিয় শিষ্যের, যিনি বেশ কয়েক বার সন্ন্যাস-নাম পরিবর্তন করে সাগর পাড়ি দেওয়ার শেষ মুহূর্তে ‘বিবেকানন্দ’ নাম গ্রহণ করেছিলেন।
 
স্বামী ব্রহ্মানন্দ ডায়েরিতে লিখেছেন- মহাপ্রস্থানের কয়েক সপ্তাহ আগে,৬ ই জুন স্বামীজি বেরিয়েছিলেন তাঁর মৃণালিনী মায়ের সঙ্গে দেখা করতে নদিয়ার বড় জাগুলিয়ায়। ১২ ই জুন  বেলুড়ে ফিরে মহাপ্রয়াণের কুড়ি দিন আগে মিস্টার ক্রিশ্চিনকে লেখা লম্বা এক চিঠিতে সেই প্রসঙ্গে লিখেছেন-“আমি এখন আগের তুলনায় অনেক শক্তিমান। সাত মাইল গরুর গাড়িতে নড়বড়ে রাস্তায় যাত্রা এবং সেইসঙ্গে ট্রেনে ৩৪ মাইল যাত্রার পরেও আমার পা ফুলল না—ড্রপসি ফিরে এল না। আমার নির্ঘাত বিশ্বাস, ওই রোগ আর ফিরছে না।”

 প্রমথনাথ বসু তাঁর ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বইয়ে স্বামীজির দেহাবসনের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন—“রাত্রি ৯টার পরে পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া তিনি শয়ন করিয়াছিলেন এবং ক্ষুদ্র বালক যেরূপ কাঁদিয়া ওঠে সেইরূপ একটা অস্ফুট ধ্বনি করিলেন। তাহার এক মিনিট কি দুই মিনিট পরে পূর্ববৎ আর একটি গভীর নিঃশ্বাস ফেলিলেন। তার পর সব যেন স্থির হইয়া গেল— ক্লান্ত শিশু যেন মার ক্রোড়ে ঘুমাইতে লাগিলেন। দেখিয়া বোধ হইতেছে, যেন তিনি মহাধ্যানে মগ্ন। তখন ৯টা বাজিয়া মিনিট দশেক মাত্র হইয়াছে।”সব সময়ের সঙ্গী “ব্রহ্মচারীটি অল্পবয়স্ক—কিছু বুঝিতে না পারিয়া বয়স্ক সন্ন্যাসীকে (বোধহয় স্বামী নিশ্চয়ানন্দ) ডাকিলেন। নাড়ির গতি অনুভূত না হওয়ায় তিনি আরেকজনকে ডাকিলেন (বোধহয় স্বামী প্রেমানন্দ)। দুইজনেই দেখিলেন নাড়ি নাই। ... প্রেমানন্দ কহিলেন, বোধহয় সমাধি হইয়াছে। ... উচ্চৈঃস্বরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নামকীর্তন হইল, কিন্তু কিছুতেই সমাধিভঙ্গ হইল না। হায় হায়, এ যে মহাসমাধি! স্বামী অদ্বৈতানন্দ এ বার বোধানন্দ স্বামীকে ভাল করিয়া নাড়ি পরীক্ষা করিতে বলিলেন। তিনি কিছুক্ষণ নাড়ি ধরিয়া দাঁড়াইয়া, চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।”

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডেকে আনার কথা হল। আর একজন ছুটলেন কলকাতায় স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দকে ডেকে আনতে। রাত সাড়ে দশটায় তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন। কৃত্রিম উপায়ে চৈতন্য সন্ধানের নানা প্রচেষ্টা হল। তার পর রাত বারোটায় ডাক্তার বললেন, প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে। “পরের দিন ডাক্তার বিপিন ঘোষ দেহ পরীক্ষা করে বললেন, সন্ন্যাস রোগে মৃত্যু হয়েছে। মহেন্দ্রবাবু বলে গিয়েছেন হৃদরোগই মৃত্যুর কারণ। কেউ কেউ বললেন, মাথার শিরা ছিঁড়ে গিয়েছে। “মঠের সন্ন্যাসীদিগের দৃঢ় বিশ্বাস, শ্রীরামকৃষ্ণদেব যাহা বলিতেন তাহাই ঘটিয়াছে, অর্থাৎ স্বামীজি যোগবন্ধনপূর্বক সমাধিতে দেহত্যাগ করিয়াছেন।” ৪ জুলাই ১৯০২ স্বামীজির বয়স ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন। “তিনি প্রায় বলিতেন, আমি চল্লিশ পেরুচ্ছি না।”

পরের দিন নিবেদিতা এলেন সকাল সাতটায়। স্বামীজির মা খবর পেলেন সকালবেলা।ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ এলেন দ্রুত, সঙ্গে তাঁর ভগ্নীপতি। তার পর কাঁদতে কাঁদতে ঢুকলেন জননী ভুবনেশ্বরী, সঙ্গে নাতি ব্রজমোহন ঘোষ। গিরিশচন্দ্র এলেন চিতায় আগুন দেওয়ার সময়ে। মঠপ্রাঙ্গণে দাহকার্য শেষ হল সন্ধ্যা ছ’টায়। শেষকৃত্যে একটু দেরি হল  বালি মিউনিসিপ্যালিটি শ্মশানের বদলে মঠপ্রাঙ্গণে দাহের অনুমতি দিতে প্রথমে  আপত্তি জানিয়েছিল। 

অনেক দিন পরে একজন প্রত্যক্ষদর্শী, চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, ‘বিশ্ববাণী’ পত্রিকায় স্মৃতিচারণে লেখেন-"সকাল ন’টার একটু আগে  বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে শুনলেন মঠের স্বামীজি আর নেই।
সে দিন শনিবার, অফিসে না গিয়ে ভাই দুলালশশীকে নিয়ে “বেলা দশটায় বেলুড়মঠে পৌঁছিলাম।” সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল। “দেখিলাম স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রমুখ কয়েকজন সন্ন্যাসী একখানি সুন্দর খাটে পুষ্পশয্যা রচনায় রত। স্বামীজির ঘরে গিয়ে দেখা গেল, একখানি সুন্দর গালিচার উপরে শায়িত তাঁর বিভূতি-বিভূষিত দেহ। স্বামীজির বামদিকে ভগ্নী নিবেদিতা অশ্রুপূর্ণ নয়নে হাত-পাখার দ্বারা স্বামীজির মাথায় অনবরত বাতাস করিতেছেন। ... স্বামীজির দক্ষিণ করের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের মালার দানাগুলিতে আমি গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করিয়া লইলাম। জপ শেষ হইলে ভগিনী নিবেদিতা চুপিচুপি বলিলেন, ‘Can you sing my friend?’ তখন বন্ধু নিবারণচন্দ্র সুমধুর স্বরে কয়েকটি গান গাইলেন।”

বেলা একটার সময়ে স্বামী সারদানন্দ তরুণদের বললেন, “আমরা ভেঙে পড়েছি। তোরা সকলে ধরাধরি করে স্বামীজির দেহখানি নীচে নামিয়ে আনতে পারবি ?” নীচে নামার পরে শেষ ফোটো নেওয়ার কথা উঠেছিল, কিন্তু রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) বারণ করলেন। এর পর স্বামীজির চরণতল আলতায় রঞ্জিত করে তাঁর পায়ের ছাপ নেওয়া হল। ভগিনী নিবেদিতাও একটি রুমালে স্বামীজির চরণের ছাপ তুলে নিলেন।
বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল পথ ছিল চোরকাঁটায় ভরা, তারই মধ্যে পালঙ্কখানি চন্দনকাঠের চিতার উপরে স্থাপন করা হল। এই সময়ে স্বামীজির কাকিমা ও জ্ঞাতিভাই হাবু দত্ত উপস্থিত হয়ে ক্রন্দন ও বিলাপ করতে লাগলেন।
এক সময়ে “চিতাবহ্নি ক্রমে ক্রমে লেলিহ্যমান ঊর্ধ্বমুখী জিহ্বা বিস্তার সহ ধূ-ধূ করিয়া জ্বলিতে লাগিল।” এই সময়ে অন্য অনেকের সঙ্গে উপস্থিত মহাকবি গিরিশচন্দ্র, বসুমতীর উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্রীম, জলধর সেন প্রমুখ। 

শোকোচ্ছ্বাস চাপতে না পেরে নিবেদিতা জ্বলন্ত চিতার চারপাশে পরিক্রমণ করতে লাগলেন। পাছে তাঁর গাউনে আগুন ধরে যায়, এই ভয়ে কানাই মহারাজ স্বামী ব্রহ্মানন্দের নির্দেশে তাঁর হাত ধরে গঙ্গার ধারে নিয়ে বসালেন। সন্ধ্যার সময়ে জানা গেল, গত রাত থেকে সন্ন্যাসীরা অভুক্ত রয়েছেন। একজন ভক্ত বেরিয়ে গেলেন শোকার্তদের মুখে দেওয়ার জন্য কিছু মিষ্টি কিনতে।

স্বামী অভেদানন্দকে লেখা স্বামী সারদানন্দের চিঠির তারিখ ৭ অগস্ট ১৯০২। এর অনেক আগেই তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল। “স্বামীজির মৃত্যু বড়ই অদ্ভুত! প্রায় দুই মাস পূর্বে তিনি কাশীধামে যান, সেখান হইতে শরীর খুব খারাপ লইয়া আসেন। মঠে ফিরিয়া আসিয়া কবিরাজী চিকিৎসা করান...একমাস ঔষধ ব্যবহারে হাত-পা ফোলা সারিয়া গেল, পেটেও জল রহিল না।”
এর পরেই এক সপ্তাহের জন্য বড় জাগুলিয়া যাওয়ার বর্ণনা। ৬ জুন তিনি শিষ্যা মৃণালিনী বসুর বাড়ি যান এবং মঠে ফেরেন ১২ জুন। “রাত্রি ৪টার সময় সকলকে লইয়া জপ-ধ্যান করিতেন এবং সর্বদাই বলিতেন, ‘আমার কার্য হইয়া গিয়াছে, এখন তোরা সব দ্যাখ শোন, আমায় ছুটি দে’।” এর পরেই ৪ জুলাইয়ের বর্ণনা : “সেদিন ঠাকুরের শয়নঘরে একলা বসিয়া ধ্যান করিলেন... নীচে নামিয়া সকলের সহিত ইলিশ মাছের ঝোল ভাজা ইত্যাদি দিয়া ভাত খাইলেন। খাবার পরে এক ঘণ্টা বিশ্রাম করিয়া সকলকে ডাকিয়া ব্যাকরণ ও যোগ শিক্ষা দেন... পরে ৪টা-৫টা পর্যন্ত বাবুরামের সঙ্গে মঠের বাইরে দু’মাইল বেড়াইয়া আসিলেন। 
...ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘আজ শরীর যেমন সুস্থ, এমন অনেকদিন বোধ করি নাই।’
এর পরে শনিবারের কথা : “পরদিন অপরাহ্নে বেলা ৪টার সময় শরীর অগ্নিসাৎ করা হইল...গঙ্গার পশ্চিম পারে মঠের ভিতরেই তাঁহার অগ্নিসাৎ করা হয়।”

স্বামী প্রেমানন্দের চিঠিটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী-
“তার শরীর বেশ সেরে উঠেছিল। বিশেষ কোনও অসুখই ছিল না। ঠিক ইচ্ছা করে শরীর ছেড়ে দিলেন।...কার্যগতিকে শরৎ, রাখাল দু’চার দিন কলিকাতায় ছিল। পুরাতন লোকের মধ্যে গোপাল দাদা ও আমি সেদিন মঠে ছিলাম।... গঙ্গার একটা ইলিশ মাছ এ বৎসরে এই প্রথম কেনা হলো, তারপর তার দাম নিয়ে আমার সঙ্গে কত রহস্য হতে লাগল। একজন বাঙালি ছেলে ছিল, তাকে বললেন— ‘তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কি দিয়ে পূজা করতে হয় কর।...আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন। আহারের পর নানা কথা কয়ে কিছু বিশ্রাম করিলেন।”

স্বামী গম্ভীরানন্দ বিবেকানন্দ থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন—“এমনও হইতে পারে যে, আমি হয়তো বুঝিব—এই দেহের বাহিরে চলিয়া যাওয়া, এই দেহকে জীর্ণ পোশাকের মতো ফেলিয়া দেওয়াই আমার পক্ষে হিতকর। কিন্তু আমি কোনদিন কর্ম হইতে ক্ষান্ত হইব না।” 
এর পরেই রয়েছে স্বামীজীর ‘৪ জুলাই’ কবিতার বঙ্গানুবাদ :
‘চল প্রভু চল তব বাধাহীন পথে ততদিন—
যতদিন ঐ তব মাধ্যান্দিন প্রখর প্রভায়
প্লাবিত না হয় বিশ্ব, যতদিন নরনারী—
তুলি ঊর্ধ্বশির—নাহি দেখে ছুটেছে শৃঙ্খলভার—
না জানে শিহরানন্দে তাহাদের জীবন নূতন।’

তথ্যসূত্র :---
১. অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ - শংকর। 
২. নিবন্ধ :-- শ্রীমতি পিয়ালী বসু । 
৩. আনন্দবাজার পত্রিকা। 
৪. ইন্টারনেট ইত্যাদি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments