জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে- ৪/ রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৪

মেজকাকা বাড়ির কাছে রামজীবনপুরে বদলি হয়ে আসাতে কাকিমা ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতে এলেন।  মেজকাকা মুকুলেসুর রহমান খান সরকারি অফিসার ছিলেন। ওঁরা আসাতে আমার জীবন সম্বন্ধে ধারণা বদলে যেতে লাগল। বিশেষকরে বাইরের জগৎটাকে জানা বোঝার পরিধিটা অনেকখানি বেড়ে গেল। মেজকাকার তখন চারছেলে, দুইমেয়ে। সবার বড় শোভানারাদি, সবার ছোট মীরা, মাঝে চার ভাই। গ্রামে আসার পর আর এক জনের জন্ম হয়। ওদের চালচলন, জীবনযাত্রা দেখে আমার খুব  অবাক লাগত। মেজকাকিমা রোজ বিকেলে চুল বেঁধে কপালে টিপ, সিঁথিতে সিন্দুর দিয়ে কি সুন্দর করে সাজতেন। মা ও সাজত, তবে সিঁদুর পরত না। দাদাগুলোর আচার আচরণে কেমন একটা চালাক চালাক ভাব, দুষ্টুও ছিল। সোভানারাদিকে খুব ভাল লাগত। কি সুন্দর ঘর গুছিয়ে রাখত, রোজ বিকেলে হারমোনিয়াম নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বসত। ছোটবোন মীরাকে চুল বেঁধে সাজিয়ে দিত। আমাকেও সাজিয়ে দিত। মীরা একটু কেমন যেন। জেদি, পাগলাটে ধরণের। আড়ালে সবাই ওকে ‘মীরাখেপী’ বলত। কাকাও খুব রাগী ছিলেন। তবে কাকার অনেক ভাল গুণও ছিল। হোমিয়প্যাথি চিকিৎসা সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান ছিল। মায়ের কাকার ওষুধে ভরসা ছিল অগাধ। তবে কাকা প্র্যাকটিস করতেন না।  কাকার যে গুণটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল সেটা হল মেজকাকা দারুণ কবিতা লিখতেন। তা দেখেই আমার কবি হওয়ার সাধ জাগে। খাতা-পেন নিয়ে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই ছন্দ মেলাতে পারলাম না।  চেষ্টা করা বন্ধ করলেও মনের মধ্যে ইচ্ছেটা থেকে গেল।  মেজকাকা গানও লিখতেন, সেই গানে নিজে সুর দিয়ে নিজেই গাইতেন।
      গ্রামে আসার অল্প কিছুদিন পরেই কাকার জীবনে এমন একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল, যাকে দুর্ঘটনাই বলা উচিৎ। ১৯৬৫ সাল, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। ওই ছোট বয়সেই বড়দের আলোচনা থেকে বুঝেছিলাম এই যুদ্ধে আমাদেরই ভয় বেশি। সবাই কেমন ভয়ে সিটিয়ে থাকত সবসময়। তার যে যথেষ্ট কারণ ছিল, আর সেটা যে কত নিদারুণ, তা টের পেলাম কয়েকদিন পর। শীতের রাত, সবাই যে যার ঘরে লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমচ্ছে। আমি আর ভাই বাবা মায়ের সঙ্গে একই খাটে ঘুমচ্ছিলাম। হঠাৎ কীসের যেন আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যেতে দেখি ছোট ভাইটা ঘুমিয়ে আছে, বাবা মা কেউ নেই। ঘরের বাইরে অনেক মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে দেখি মেজকাকার ঘরের সামনে খুব ভিড়। ভেতরে ঢুকে মাকে দেখতে পেলাম।  মেজকাকিমার পাশে মা বসে আছেন। শুনলাম মেজকাকাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সেইসময় পাকিস্তানের চরবৃত্তি করতে পারেন এই সন্দেহে শহর ও গ্রামের প্রভাব ও ক্ষমতাশালী মুসলিমদের পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে  রাখছিল। কিন্তু তাই বলে মেজকাকাকে! সেদিনের ঘটনাটা ছিল, আমাদের বাড়ির পাশেই বাসরাস্তা, রাস্তার ওপারে আবুকাকার বোন আনুরাপিসির বাড়ি। মাঝরাতে বাচ্চা কাঁদছিল বলে ঘুম ভেঙ্গে গেলে পিসিই প্রথম আমাদের সদর দরজার বাইরে বিড়ির আগুন দেখতে পায়।  চোখ সয়ে গেলে কয়েকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে ভাবে পুলিশ বাবাকে ধরতে এসেছে। পিসি একাধারে বুদ্ধিমতী এবং সাহসী ছিল। যেমনি ভাবা অমনি কাজ। লন্ঠনটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে।  আমাদের বাড়ির পিছন দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ পথ আটকায়। পিসি বলে, আলো নিভে গেছে, অন্ধকারে বাচ্চা কাঁদছে। লন্ঠন ধরাতে যাচ্ছি। পুলিশ পথ ছেড়ে দিলে পিসি পেছনে গিয়ে আমাদের শোবার ঘরের জানালায় টোকা দিয়ে চাপা স্বরে ডাকতে থাকে, বড়দাদা, ও বড়দাদা। বাবা মা দুজনেরই ঘুম ভেঙ্গে যায়। পিসি তখন বলে, বড়দাদা পুলিশ তোমাকে  ধরতে এসছে, তুমি ভাবির একটা শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বেরিয়ে যাও। বাবা শান্তশিষ্ট নির্বিবাদী মানুষ। কি করবেন ভেবে না পেয়ে চাদরে মাথা ঢেকে দরজা খুলে বেরতেই একজন পুলিশ বাবার হাতটা চেপে ধরে বলেন,এই যে, উনি পালিয়া যাচ্ছিলেন। আমাদের  পাশের সিংপাড়ায় একটা বদ লোক থাকত, সেই খাঁদু সিং চিনিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে এসেছিল।  সে বাবাকে দেখে বলল, ইনি নন, ওনার ভাই। ইতিমধ্যে মেজকাকাও বেরিয়ে এসেছেন, সারা পাড়া জেগে গেছে।  কাকাকে দেখে একজন অফিসার বলেন, মি. খান, আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। কাকা বললেন, কোথায়?  তা বলা যাবেনা। সামান্য সময় চেয়েনিয়ে কাকা ভেতরে এসে কাকিমাকে একটা ব্যগে লুঙ্গি,গামছা ভরে দিতে বলে প্যান্ট-শার্ট পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।

            আমি জেগে ওঠার আগেই কাকাকে নিয়ে চলে গেছে। কাকা অফিস আর গানবাজনা, লেখালিখি নিয়ে থাকতেন। অন্য কোনও বিষয়ে মাথা ঘামাতেন না।  বরং একটু হিন্দু ঘেঁষা হওয়ার কারণে গ্রামের মুসলিমরা কাকাকে এড়িয়ে চলত। এইরকম একজন মানুষকে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়ায় কেন ধরে নিয়ে গিয়ে  ৮/৯ মাস আটকে রাখা হয়ে ছিল তার কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এই ঘটনা আমার শিশুমনে এতখানি ভয়ের সঞ্চার করেছিল যে আতংকে ঘুমতে পারতাম না,মনে হত ঘুমিয়ে পড়লেই পুলিশ এসে বাবাকেও ধরে নিয়ে যাবে। মনে পড়ে, মেজকাকা বাড়ি  ফিরেছিলেন দুর্গাপুজোর সময়।
          জমানো টাকাপয়সা না থাকলেও বাবা আমাদের প্রয়োজন মত সব কিছুর জোগান দিয়ে যেতেন। আমরাও আমাদের চাওয়া পাওয়াগুলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতাম। তবুও আমার সঙ্গে এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা আমার কল্পনাতেও ছিলনা। ছোট ঠাকুরদার মেজছেলে পিনটুকাকা রাউরকেল্লায় চাকরি করতেন। বন্ধুর অনুরোধে কাকা তাঁর বোনের জন্য ওখান থেকে একজোড়া সাদা জুতো এনেছিলেন। জুতোজোড়া খুব সুন্দর দেখতে। সাদার ওপর সবুজ ও সোনালি জরি, চুমকির কাজ করা ছিল। জুতোজোড়া বোনের পায়ে না হওয়াতে তিনি যখন ফেরৎ দিতে এসেছিলেন, মেজদা তখন পিনটুকাকার সঙ্গে কথা বলছিল। মেজদার জুতোজোড়া খুব পছন্দ হয়। আমার কথা ভেবে মাকে নিয়ে এসে দেখায়। আমাকে ডেকে পা গলিয়ে দেখতে বললে, আমার পায়ে খুব সুন্দর ফিট করে।  আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল, এত সুন্দর জুতো পরা দূরে থাক, কোনদিন চোখেও দেখিনি! দাম ছিল ৮টাকা। মা  বললেন, ৮ টাকা দিতে পারবনা, ৫ টাকায় দিলে নিতে পারি। কাকা তাতেই রাজি হলেন। কিন্তু আমার আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ি হলনা। পিনটুকাকার দিদির মেয়ে জানু দিদিমাকে জানিয়ে দেয়, আমাকে তিনটাকা কমে জুতোজোড়া দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা উনি কাজের লোককে পাঠিয়ে জুতোজোড়া ফেরৎ নিয়ে যান। আমার  সিনড্রেলা সাজার শখ নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।  সেদিনের ঘটনা আজও ভুলতে পারিনি।
            একবার একজনের ছাগল গলার দড়ি ছিড়ে ওঁদের ফসলে মুখ দিয়ে ছিল। উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হালের বলদ দিয়ে ছাগল মালিকের সমস্ত বীজতলা খাইয়ে শোধ নিয়েছিলেন। টাকার জন্য উনি কী না করেছেন। মেজমেয়ে হেনাপিসি স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে আসেন। উনি সেই সুযোগে হেনাপিসির আর তাঁর নিজের সমস্ত গহনা বিক্রি করে হাস্কিং মেশিন বসান। এর থেকে প্রচুর আয় হতে  থাকে। সেইসব টাকা দিয়ে জমি, বাবুইমাঠ কিনতে থাকেন, এছাড়া বন্ধকি ব্যবসা ছিল, মেশিনে ধান ভাঙ্গা  হয়ে যখন চাল ড্রামে পড়ত, তখন ২/১ মুঠো চাল পাশের একটি ড্রামে জমা করা হত। যারা কাজ করত, তাদের বলাছিল।  সারাদিনে অনেক চাল জমা হত। উনি সেই চাল বাড়িতে এনে বিক্রি করতেন।

              হেনাপিসি গর্ভবতী অবস্থায় বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে এসেছিলেন। ছোটছেলের জন্ম হয় আমার জন্মের ৪ মাস পরে দাদু বাড়িতেই।  যখন হাতে অনেক টাকাপয়সা এল তখন ছোট ঠাকুমা হেনাপিসিকে ভারি ভারি গহনা দিয়ে সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠালেন। স্বামী ততদিনে বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার করছে। পিসিকে তালাক দিয়ে ফিরিয়ে দিলেন।  পিসি ফিরে  এসে সংসারের কাজ এবং মায়ের প্রতিনিধি হয়ে জমিজমা ইত্যাদি দেখাশোনা করতে থাকলেন।  ভাইদের বিয়ের পর ধিরে ধিরে হেনাপিসি বাড়ির কাজের লোক হয়ে গেল।  ছেলেদুটিও ছিল যাকে বলে একেবারে গবেট। পড়াশোনা হলই না, দিদিমা বসিয়ে খাওয়ানোর লোক নন। মুনিশ মজুরদের সঙ্গে চাষের কাজে লাগিয়ে দেন।
        একসময় ছোটঠাকুমা পাড়ার এক চাষি দবির মিয়াঁর সঙ্গে হেনাপিসির দ্বিতীয় বিয়ে দেন। দবির মিয়াঁ মোটামুটি বড় চাষি ছিলেন। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুয়েই  নানারকম ফসল ফলিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন। আম-কাঁঠালেরও বাগান ছিল। কিন্তু পুত্রসন্তান ছিলনা। চারটি সন্তানই মেয়ে। এদিকে হেনাপিসির দুটিই ছেলে। তাই ভেবেছিলেন হেনাপিসিকে বিয়ে করলে তিনিও পুত্রসন্তানের বাবা হতে পারবেন।  তখন এবং এখনও অনেক শিক্ষিত পরিবার বিশ্বাস করতে চাননা, সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে তাতে মায়ের কোন ভূমিকা থাকেনা। একবিঘা উর্বরা জমি হেনাপিসির নামে লিখে দিলে, ছোটঠাকুমা খুশি খুশি দবির মিয়াঁর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন। কিন্তু কোনও সন্তান না হওয়াতে তালাক হয়ে গেল। পিসি একবিঘা জমি পেল। এর কিছুদিন পর পাড়ার ভিতরেই কিছু বাস্তুজমি কিনে সেখানে মাটির কোঠা বাড়ি বানিয়ে উঠে যান।  বড়ছেলের বিয়ে দেন এবং তার পরেই অসুস্থ হয়ে মারা যান। ছোটঠাকুমা ভেবেছিলেন মেয়ে পাশে আছে, শেষ বয়সে মায়ের সেবা করবে। কিন্ত এক্ষেত্রেও উল্টোটা ঘটল।  হেনাপিসি আগে মারা গেলেন। ছোট ঠাকুমাকেই মেয়ের সেবা করতে হয়েছিল।
                                                                             ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments