জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ -৩ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ  -৩

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়



‘একদিন শুনেছ যে সুর
ফুরায়েছে- পুরানো তা, কোন এক নতুন কিছুর
আছে প্রয়োজন’

এই প্রয়োজন থেকেই ফিরে দেখা জীবনানন্দের কবিতা। নতুন সৃষ্টির প্রতি প্রবল আসক্তিই কবির আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তি। সব সময় তিনি তাগিদ করেছেন নতুন ফর্ম ও বিন্যাসের প্রতি। কাব্যিক স্থাপত্যের নতুন প্রকরণ তাঁকে অবিরাম ভাবিয়েছে।বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা, জরাজীর্ণ জীবনের পঙ্গুতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, অজস্র ভাঙাগড়া, চরম মানসিক সংকট। এর মধ্যে তিনি নতুনের সন্ধান করেছেন।ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর স্মৃতি থেকে, বিকলাঙ্গ জীবনের আত্মিক অস্থিরতা থেকে, অচ্ছিদ্রহতাশার বহুব্যপ্ত বিষাদময়তা থেকে জীবনের বহিবৃত সংকট থেকে বোধি ও স্বপ্নময় মিলনসেতু রচনা তাঁর পক্ষেই সম্ভবপর হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতা যেন এক অনিকেত আহ্বান- ধ্বনি।পড়তে পড়তে আমরা স্বাদ পাই সুদূর যাত্রার। একে  কি নিরুপম যাত্রা বলব? সত্তার অবাধ উন্মোচনের পাশাপাশি  মগ্নচৈতন্যের নিবিড় সংশ্লেষণ  মিশে আছে কবিতার গভীরে।

মানুষের জীবনের ঢের গল্প শেষ
হয়ে গেলে রয়ে যায় চারদিক ঘিরে এই দেশ;
নদী মাঠ পাখিদের ওড়াওড়ি গাছের শিয়রে
কমলা রঙের ঢেউয়ে এসে কিছুক্ষণ খেলা করে।
মনে হয় কোথায় চিহ্নিত এই রৌদ্র ছিল কবে;
মানুষ সার্থক নয়- তবুও সার্থকতর হবেঃ
মনে হত কাজ করে কথা বলে গ্রন্থ মিলিয়ে
মননের তীর থেকে আরও দূর তীরতটে গিয়ে।
সময় নিজেই তবু সবচেয়ে গভীর বিপ্লবী
ফুরিয়ে ফেলেছে সেই দিনরাত্রি সেরা সত্য উদঘাটন সবই
সেদিনের হৃদয়ের উষ্ণ উত্তেজিত স্থির
করে ফেলে অন্য নব কলেবরে গড়েছে শরীর। ( যাত্রী)

তিনি বিশ্বাস করতেন সময়ের চেয়ে গভীর বিপ্লবী আর কেউ নয়। তাই সময়কে স্পর্শ করে নব কলেবরে তিনি নিজের সৃষ্টির রূপান্তর ঘটিয়েছেন।গড়ে নিয়েছেন কবিতার শরীর। এ কথা তিনি প্রবলভাবে মানতেন - “সমস্ত অতীত ও বর্তমান শ্রেষ্ঠ কাব্য তাদের নিজের প্রণালীতে মানুষের চিত্তকে যত বেশি অধিকার করতে পারবে সভ্যতার তত বেশি উপকার” ( কবিতার কথা- পৃ;১৫)

সভ্যতার সংকটকে তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। এবং বুঝেছিলেন  মানুষই তার চালিকাশক্তি। মানুষের মনের সাথে কবিতার সংযোগকে আরও নিবিড় এবং প্রাণময় করা দরকার।  হৃদয়ের অনুভূতি দেশ থেকে আলো না পেলে কবিতা তো  নিছক ক্রিয়া বিশেষণ আর অব্যয়ের সমারোহ মাত্র। তাই "শ্রেষ্ঠ কবিতার ভেতর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই যে, মানুষের তথাকথিত সমাজকে বা সভ্যতাকেই শুধু নয় এমনকী সমস্ত অমানবীয় সৃষ্টিকেও তা যেন ভাঙছে – এবং নতুন করে গড়তে চাচ্ছে; এবং এই সৃজন যেন সমস্ত অসঙ্গতির জট খসিয়ে কোনো একটা সুসীম আনন্দের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।”( কবিতার কথা- পৃ;১৫)

কাব্য এক নান্দনিক শৃঙ্খলা। জীবন ও সত্যকে চরম এক শৃঙ্খলায় বেঁধেছেন জীবনানন্দ। শব্দের ব্যবহার, শব্দের বিচ্ছুরণ ও সুষমাকে কেবলমাত্র বিনোদনের মাধ্যম বানিয়ে তোলেননি। চিন্তা, চেতনা, বোধ ও মননের ভিন্ন এক স্তরে শিল্পকে উর্ত্তীর্ণ করাই কবিতার দায় ও অধিকার। জীবনানন্দের কবিতায় শাসানী নেই, চোখ রাঙানি নেই, গুলি বেয়নেটের শব্দ নেই বলেই তাঁর কবিতা কেবল মায়ারাজ্যের ভাষা, এরকম ধরে নেওয়ার সঙ্গত কোন কারণ নেই। মানুষের যন্ত্রণার উন্মোচন, অবিরাম রক্তমোক্ষন,আত্মিক সংকট এবং সামাজিক নৈরাশ্যের অতলান্ত অন্ধকারেও আলোর সংকেত স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখেন তিনি তাঁর নিজস্ব  ভাষাকল্পে। ক্রেচ বলেছিলেন- "উক্তি এবং উপলব্ধির একাত্মতাই হচ্ছে রসোত্তীর্ণ কবিতা।"


দূরে কাছে কেবলই নগর, ঘর ভাঙে
গ্রামপতনের শব্দ হয় (পৃথিবীলোক)


ইতিহাসে মাঝে মাঝে এরকম শীত অসারতা
নেমে আসে- চারিদিকে জীবনের শুভ্র  অর্থ রয়ে গেছে তবু
রৌদ্রের ফলনে সোনা নারী শস্য  মানুষের হৃদয়ের কাছে,
বন্ধ্যা বলে প্রমাণিত হয়ে তার  লোকোত্তর মাথার নিকটে
স্বর্গের সিঁড়ির মতো;-


যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল
সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে
মহিলারই প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল
টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ূর শয্যার কথা ভুলে
সকালের রূঢ় রৌদ্রে ডুবে যেত কোথায় অকূলে।


আমাদের সন্ততিও আমাদের হৃদয়ের নয়
আমরা মধ্যম পথে বিকেলের ছায়ায় রয়েছি;
একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের আগে;
আরেকটি পৃথিবীর দাবী
স্থির করে নিতে হ’লে লাগে


সকালের আকাশের মতন বয়স;
সে সকাল কখনো আসে না ঘোর, স্বধর্মনিষ্ঠ রাত্রি বিনে।

 


একদিন সমুদ্রের কালো আলোড়নে
উপনিষদেরও শাদা পাতাগুলো ক্রমে ডুবে যাবে…


যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই- প্রীতি নেই
                    করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া


স্থান থেকে স্থানচ্যুত হয়ে
চিহ্ন থেকে অন্য চিহ্ন গিয়ে
ঘড়ির কাঁটার থেকে সময়ের স্নায়ুর স্পন্দন
খসিয়ে বিমুক্ত করে তাকে
দেখা যায় অবিরল শাদা কালো সময়ের ফাঁকে
সৈকত কেবল দূর সৈকতে ফুরায় …।


সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাখাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে
সচ্ছল  কঙ্কাল হয়ে গেছে তারপর…


তাহাদের শ্রেণি, যোনি ঋণ রক্ত  রিরংসা ও ফাঁকি
উঁচু –নীচু নরনারী নিক্তি নিরপেক্ষ হয়ে আজ
মানব সমাজের মতন একাকী
নিবিড় নাবিক হলে ভালো হয়;
হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় নাকি।

১০

যে কবি পেয়েছে শুধু যন্ত্রণার বিষ
শুধু জেনেছে বিষাদ
মাটি আর রক্তের কর্কশ স্বাদ

 তাই উৎসবের কথা তিনি বলেননি, দুর্দশার গানও গাননি, সমকালের অস্থিরতা, মৃত্যু, ক্ষুধা এবং তামসিক জাড্য তাঁর সৃষ্টিকে অন্য এক শৈলী এবং প্রকরণ দিয়েছে। যন্ত্রণার শিল্পময় উন্মোচন এবং তার রক্তাক্ত সংরাগ কখনও রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে কখনও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতাপের বিরুদ্ধে বলতে হয়েছে। এই কারণেই কবিতার কবিতার ভাষাপথকে মুড়ে দিতে হয়েছে অপরিচিত চিত্রকল্পে, আলাদ এক পরিচ্ছদে।

কবি প্রমোদ বসুর এই কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কবি জীবনানন্দ দাশকে দেখতে পাই  ভিন্ন এক রূপে ও বিভায়।

"মুখ্যত রাত্রির পর সকালের উজ্জ্বল বিভায়
তোমার প্রগাঢ় প্রাণ
আজও দেখি জেগে থাকে রূপসী বাংলার ঘরে  ।
জেগে ওঠে এখনও একাকী
দূরতম দারুচিনি দেশে কোন ক্লান্ত প্রাণ, তাই
পৃথিবীর প্রত্যেক প্রহরে অযুত প্রতীক্ষা নিয়ে
আজও বাঁচে নাটোরের বনলতা সেন!


এখনও প্রত্যেক মনে , প্রতিদিন ভ্রমণে ভ্রমণে
তোমারই তো অজেয় অক্ষর!
তোমার শাশ্বত হাতে
নদী, বন,গিরি ও প্রপাতে
আমাদের সমস্ত গান ঘুরে ফেরে,
জাগে, জেগে থাকে অমলিন , উদার।

তিমির নিয়তি ঠেলে
এখনও তোমায় তাই চোখে দেখি,প্রাণে পাই
বিরহ বিষাদে" ( জীবনানন্দের প্রতি)   

 
আবার কবি  মানব চক্রবর্তীর ‘আলো ধরে এগোচ্ছি’  কবিতাটির মধ্যে আমরা অনেকটাই অনুভব করব জীবনানন্দের কাব্যভাবনাকে

‘ আলো ধরে এগোচ্ছি
হাত পা থেকে নিংড়ে দিয়েছি অন্ধকার
উঁচুকপালি নখে পাথর ভেঙেছি দীঘল সুতোর মতো
রক্ত ঝুলছে জরিপাড়

আলো ধরে এগোচ্ছি লাট্টুর খাঁজে খাঁজে লেত্তিমান সময়
মাথায় লোহার আল কেন্দ্রবিন্দুতে ঘিলু সৎকার করছি
আলো ধরে এগোচ্ছি
আমার ঠিকানা নেই ঘরদোর নেই। (আলো ধরে এগোচ্ছি/ মানব চক্রবর্তী)

জীবনানন্দের কবিতায় বাড়ির কথা নেই, ঘরের কথা নেই। এ কথা আমার বারবার লক্ষ্য করেছি। শুধুমাত্র লাশকাটা ঘরের কথা আছে। পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন- “  কবি জীবনানন্দের কোন ঘর ছিল না। মানুষ জীবনানন্দের ছিল কি? আমরা জানি শেষ বেলায় একটা ঘরের জন্য উথাল-পাথাল অন্বেষণে মেতেছিলেন তিনি। প্রিয় পরিজনদের কাছে একও সময়ে তাঁর সবচেয়ে জরুরি সমাচার ছিল, একটা ঘর দেখে দিতে পারো ? আজীবন মনের বাসনার রঙে রাঙানো কোন ঘরে বাস করা হয়নি যেন। যেন একটা একান্ত আপন ঘরের অভাবে  কালি ঝুলি মাখা রয়ে গেছে তাঁর ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার ডালপালাগুলো। যেন রয়েছেন এমন এক ঘরের নির্বাসনে , যেখানে ডানা ছড়ানোর পরিধি নেই। হৃদয়ের স্বচ্ছন্দ শ্বাস প্রশ্বাসের উপযোগী আলো বাতাসময় এক খানা ঘরের প্রয়োজন সেই  কারণেই তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল বন্যার দিনের ডাঙা কিংবা বর্ষার রোদের মতো একান্ত প্রার্থনীয়।”

 
প্রকৃত প্রেমিক যে
নিরবধি তার কোন বদ্ধ খাঁচা নাই
রাজার শিরোপা তাকে বাঁধতে পারে না
প্রকৃত প্রেমিক যে
এক গোছা ধানের জন্য
সে মানুষের কাছে চিরঋণী
একও টুকরো ছায়ার জন্য
সে প্রতিদিন পৃথিবীকে প্রণাম জানায় ( প্রকৃত প্রেমিক/ তুলসী মুখোপাধ্যায়)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

2 Comments

  1. জীবনানন্দ এক যন্ত্রনার নাম।যে যন্ত্রনা আমাদের মুক্তি দেয়।

    ReplyDelete

  2. প্রকৃত প্রেমিক যে
    নিরবধি তার কোন বদ্ধ খাঁচা নাই
    রাজার শিরোপা তাকে বাঁধতে পারে না
    প্রকৃত প্রেমিক যে
    এক গোছা ধানের জন্য
    সে মানুষের কাছে চিরঋণী
    একও টুকরো ছায়ার জন্য
    সে প্রতিদিন পৃথিবীকে প্রণাম জানায় ( প্রকৃত প্রেমিক/ তুলসী মুখোপাধ্যায়)..... অসাধারন লেখা 👌👌

    ReplyDelete