জ্বলদর্চি

প্রতিভা বসু /ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ২
প্রতিভা বসু 

ঈশিতা ভাদুড়ী

কিশোরীবেলার অনেকখানি কেটেছে তাঁর বই পড়ে, লেখা পড়তে পড়তে কবে কখন অন্ধ ভক্ত হয়ে গেলাম তাঁর! তখনও তাঁকে চোখে দেখিনি, নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছিলাম তাঁকে। খুব-ই স্পষ্ট বক্তা আত্মসচেতন নারীর স্বর শুনতে পেতাম তার কলমে।

সেসব বিংশ শতাব্দীতে সত্তর দশকের কথা। তারপর কত জল পার হয়ে গেছে নদীতে। কিন্তু তাঁর স্বরের কোনো পরিবর্তন একবিংশ শতাব্দীতেও টের পাইনি, তাঁর লেখার প্রতি অনুরাগও আমার কমেনি একচুল।
সেই কোন ছোটবেলায় প্রতিবেশী মালামাসী আমাকে বলেছিলেন আমার বিবাহোপলক্ষে প্রতিভা বসু সমগ্র দেবেন। সেই প্রতিভা বসু, যাঁর ‘সমুদ্রহৃদয়’ পড়ে রাতের পর রাত ঘুমাইনি আমি। বিবাহ করাও হলো না, প্রতিভাসমগ্র উপহার পাওয়াও হলো না। শুধুমাত্র সেই না-প্রাপ্তির জন্যেই অবিবাহ খোঁচা দেয় মাঝে-মধ্যে এখনও।

২০০৩ সালে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ১২৫তম জন্মোৎসব করলো যতীন্দ্রমোহন বাগচী স্মারক সমিতি। আমার সম্পাদনায় যতীন্দ্রমোহন বাগচী/১২৫ প্রকাশ উপলক্ষে বিভিন্ন বিদ্বজ্জনের কাছে আমায় যেতে হয়েছে লেখা সংগ্রহের জন্যে। তাঁর কাছেও যেতে হয়েছে দু'একদিন।
যদিও প্রতিভা বসু আমার অত্যন্ত প্রিয় গদ্যকার ছিলেন, যদিও তিনি আমার মায়ের শৈশবের বন্ধুর মা ছিলেন, যদিও তিনি আমাদের ‘সই’ এর হেড সই ছিলেন, কিন্তু সেইভাবে তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ এর আগে আমার হয়নি।

মায়ের পিতামহ যতীন্দ্রমোহন বাগচী মনের মতো করে অনেকখানি জমি নিয়ে হিন্দুস্তান পার্কে বাড়ি করেছিলেন, মায়েরা সেখানে থাকতেন আর পাশেই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-তে বুদ্ধদেব বসু প্রতিভা বসু থাকতেন। তাঁদের কন্যা রুমির সঙ্গে মা খেলতে যেতেন। মায়ের কাছে অনেক শুনেছি প্রতিভা বসুর কথা, মা বলতেন তিনি খুব রাশভারী ছিলেন ইত্যাদি। মায়ের কাছে শোনা কথা আর তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত লেখা পড়ে তাঁর যে চিত্র এঁকেছিলাম আমি, আর আমি যে ব্যক্তিত্বের সামনে বসে সেই তিনি — এই দুজন আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন। আমার সামনে বসে আছেন আমার মায়ের শৈশবের বন্ধু রুমির মা অর্থাৎ আমার দিদিমা। প্রাথমিকভাবে কথাবার্তায়ও দিদিমার মতোই। অত্যস্ত স্নেহসুলভ।
প্রশ্ন করলাম – আপনি ভাল গান করতেন, চারু দত্ত, মেহেদি হসেন, প্রফেসর গুল মহম্মদ খাঁর মতো গুণী মানুষের কাছে গান শিখেছেন, দিলীপকুমার রায়, কাজী নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এসেছেন, আপনি গান ছেড়ে দিলেন কেন?
মৃদু হেসে বললেন, মানুষের একেকটা সময় একেকটা অধ্যায় চলে। ২৫ বছর গানের জগতে ছিলাম, আমার রেকর্ডও ছিল, সেসব এখন আর পাওয়া যায় না। 
-- আপনি কবে থেকে লেখার জগতে এলেন?
-- তুমি কি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছ? বলে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।
-- না না। আমি আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক। আমি আপনাকে পড়তে চাই।
-- মানুষকে পাঠ করা সহজ নয়… আমি তো অনেকদিন ধরেই লিখি… আমার ছোটগল্প ‘মাধবীর জন্য’ প্রকাশিত হয় সেই ১৯৪২ সালে। তার দু-বছর পর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। নামটা ভুলে গেছি, মনে হয় ‘মনোলীনা’। ‘জীবনের জলছবি’ পড়েছো?
-- পড়েছি তো, অনেক কথা জেনেছি। বুদ্ধদেব বসু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কারণে খুবই বিচলিত হয়ে পড়তেন… বুদ্ধদেব বসু খুব সরল ছিলেন…পুত্র পাপ্পার বুদ্ধির ওপর তাঁর কিরকম আস্থা ছিল, ঢাকার স্মৃতি ইত্যাদি…
--রবীন্দ্র-পরবর্তী লেখক বলতে তো আমরা একমাত্র বুদ্ধদেব বসুকেই বুঝি...তাঁর মতো বিরল প্রতিভা আর তো জন্মায়নি আজ অবধি…
এরপর যতীন্দ্রমোহন বাগচী সম্বন্ধে বলতে থাকলেন – আমরা যখন ২০২ নম্বর রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-তে থাকতাম, আমাদের বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে গোটা তিনেক ব্লক পার করে বাঁয়ে ঘুরলেই সোজা যে পথ লেকে গিয়ে পড়ত, যে পাড়াটির মধ্যে দিয়ে যেতাম, সেই পাড়ার নাম হিন্দুস্তান পার্ক ছিল, সেখানেই তোমার বড়দাদুরা থাকতেন। গেট খুললেই সামনে অনেকটা জমি, তারপরেই বাড়ি, সামনে বারান্দা। সেই বারান্দায় যতীন্দ্রমোহন বসে থাকতেন, সামনে সুগন্ধ ফুলের জলছিটানো পাত্র… খুব সৌখীন ছিলেন তোমার বড়দাদু… বুদ্ধদেব বসু তখন সুনামে-দুর্নামে বিখ্যাত ছিলেন…তোমার বড়দাদুও আমার কাছে জানতে চাইলেন আমার স্বামী কতটা মদ্যপান করেন। আমি যখন জানালাম আমার এতদিনের বিবাহিত জীবনে মদ কি বস্তু জানি না আমি, তখন তিনি খুব খুশী হলেন, পিতার স্নেহে আমার মাথায় হাত রাখলেন। 

আমি নবনীতা দেবসেন প্রতিষ্ঠিত 'সই' (অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অব বেঙ্গল)-এর সদস্য ছিলাম বলে তিনি বলতে থাকলেন –তোমরা নতুন যারা লিখছো পুরোনো একজন লেখকের কাছে এসে সম্মান জানিয়েছো, খবরের কাগজে ছবি ছাপিয়েছো, এতে আমি অভিভূত, এর আগে কখনও এমন হয়নি, আমার খুব ভালো লেগেছে, আমি ‘সই’-এর একজনকে এই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম, তোমাকে পেয়ে গেলাম...
তিনি বলে চলেছেন— আমাকে আমার প্রকাশকেরা খুবই খাতির করেন.../ পাপ্পার (শুদ্ধশীল বসু ৪২ বছর বয়সে মারা যান) মারা যাওয়ার পর ওর সমস্ত ফোটো আমি ফেলে দিয়েছিলাম, আজ মনে হয় যদি একটা ফোটো অন্তত থাকতো, বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে ওকে.../ তুমি আমার বাড়ি প্রথম এসেছো আজ, তোমাকে লুচি-তরকারী খেতেই হবে...
ক্রমশ পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো ধীরে ধীরে বিভিন্ন সত্তা প্রকাশ হতে থাকলো তাঁর, কখনও আমাদের হেড সই, কখনও লেখক, কখনও শোকার্ত মা, কখনও আমার দিদিমা, কখনও বুদ্ধদেব বসুর সহধর্মিণী প্রতিভা বসু।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

4 Comments

  1. সুন্দর কথোপকথন আর স্মৃতিচারণ...

    ReplyDelete
  2. কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউতে আক্রান্ত হই। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসি মৃত্যু ছুঁয়ে। প্রতিভা বসুর "জীবনের জলছবি" খুলে বসি। ফিরে পড়ার আনন্দে ফিরে পাই জীবনকে। ঈশিতাদির ঈর্ষণীয় লেখায় সেই আনন্দ আরও ঘনীভূত হল।

    ReplyDelete