জ্বলদর্চি

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ--৩ /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ৩

উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে দুই বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞের আবির্ভাব ঘটে। এঁরা হলেন পন্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে (১৮৬০-১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ) যিনি সংগীতশাস্ত্র সম্বন্ধে গবেষণা করে উত্তর ভারতীয় সংগীতের এক নতুন অধ্যায় আমাদের সামনে তুলে ধরেন। ভাতখন্ডেজী প্রবর্তিত মতবাদই বর্তমানে সমগ্র উত্তর ভারতে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। বিলাবল ঠাটকে শুদ্ধ ঠাট ধরে নিয়ে হিন্দুস্থানী পদ্ধতিতে মোট দশটি ঠাটের মধ্যেই তিনি সমস্ত রাগ গুলিকে বিভক্ত করেছেন। দ্বিতীয়জন হলেন পন্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর পলুস্কর (১৮৭২-১৯৩১) যিনি জনসাধারণের মধ্যে সংগীতের ক্রিয়াত্মক (creative) রূপের প্রচার করেছিলেন। ভারতীয় সংগীতের প্রচার ক্ষেত্রে এই দুজন ব্যক্তিত্বের অবদান অনস্বীকার্য।         
  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি অন্যতম প্রাচীন ধারা হলো 'ধ্রুপদ'। দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত কৌশলগত ও জটিল সুরের কাঠামোয় তৈরী এই বিশেষ ধরনের সংগীতের রচনায় স্তুতি করা হত হিন্দু দেব-দেবীদের বিশেষতঃ শ্রীকৃষ্ণের। দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমান আগ্রাসনের পরে এই রীতি তার কৌলিন্যতা হারিয়ে ফেলল কারণ মুসলমান শিল্পীরা ধ্রুপদ গাইবার সময় এই রক্ষনশীলতার সাথে পারস্য সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। এই ভাবে ধ্রুপদ ভারতীয় সংগীতের নিজস্ব স্বতন্ত্রতার সাথে মিশ্র সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হলো। উত্তর ভারতে মুসলমান শাসন ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে 'ধ্রুপদ' তার নিজস্ব কৌলীনতা ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল।
  
  ধ্রুপদ গানকে অনেকে বলেন আদি গান। কিন্তু এ'কথা সঠিক নয়, কারণ ধ্রুপদের পূর্বে প্রবন্ধ শ্রেণীর গান ছিল। সে কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। কবি জয়দেব দশম শতাব্দীতে ‘গীতগোবিন্দম্’ গ্রন্থে প্রবন্ধ গীতের সূচনা করেছিলেন। কোন কোন মতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ধ্রুপদ গানের সৃষ্টি হয়েছে, আবার কোন কোন সঙ্গীত পণ্ডিতেরা উল্লেখ করেছেন ষোড়শ শতাব্দীতে গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ ধুপদ গানের স্রষ্টা এবং ধ্রুপদ গানের প্রচারে শ্রেষ্ঠ পোষকতায় তার অবদান চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভাবের মাধুর্য, ভাষার শুদ্ধতা, গীতরীতির গাম্ভীর্য ও ছন্দের নানা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ধ্রুপদ গান আজও শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। সম্রাট আকবরের সমসাময়িক কালে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ তানসেন, বৈজু বাওরা, গোপাললাল প্রভৃতির সঙ্গীত জীবন ধ্রুপদ গানে সমৃদ্ধ।ধ্রুপদ গানের অবয়ব খেয়াল গানের থেকেও বড়। এর চারটি ভাগ - স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। অবশ্য কেবলমাত্র স্থায়ী ও অন্তরার ধ্রুপদও শোনা যায়। ধ্রুপদ গানের ক্ষেত্রে তালগুলি বাজানো হয় পাখোয়াজে। অবশ্য বর্তমানে তবলাতেও সঙ্গত করা হচ্ছে। তবে তাতে ধ্রুপদের গম্ভীর প্রকৃতির গানের বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা যথাযথ রক্ষিত হয় না। ধ্রুপদ গানের গায়কদের 'কলাবন্ত' নামে অভিহিত করা হতো।   
  
  ধ্রুপদ গানের স্রষ্টা হিসেবে যেমন রাজা মানসিংহ তোমরকে চিহ্নিত করা হয় অনুরূপভাবে ধামার গানের স্রষ্টা হিসেবে পন্ডিত হরিদাস স্বামীর নাম উল্লেখ করা হয়। ধামার গান হল চৌদ্দ মাত্রার বিষম ছন্দের একটি তাল। ধামার তালের গানগুলিকে ধামার নামে চিহ্নিত করা হয়। বসন্তকালে হোলি উৎসবের সময় এই তালে হোরি গান গাওয়া হতো। ধামার গানের কথাগুলি ধ্রুপদ অপেক্ষা হালকা প্রকৃতির, প্রধানত রাধা কৃষ্ণের দোল যাত্রার বিষয়বস্তু নিয়ে ধামার গানগুলি রচিত হয়। এক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে হোলি সম্বন্ধীয় গান মাত্রেই ধামার নয়। বর্তমানের খেয়াল গায়কেরা খেয়াল বা ঠুমরি গানের পরে যে হোলির গান পরিবেশন করেন তা হলো চৌদ্দ মাত্রার এবং এই চৌদ্দ মাত্রার তালের নাম 'দীপচন্দী'। চোদ্দ মাত্রার বিষম ছন্দের তালে যে গান গাওয়া হয় তা শুদ্ধ ধামার গান।   
  
  এই সময় থেকে শুরু হল শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্য একটি ধারা 'খেয়াল', যা ধ্রুপদের মত তাল, লয় বা সুরের কাঠামোয় ততখানি দৃঢ়ভাবে বদ্ধ নয়। প্রাচীন ধ্রুপদ বা সুফি-সন্তদের 'কাওয়ালী' থেকে খেয়াল গানের নতুন নতুন রূপ গড়ে তোলার কৃতিত্ব ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের সভাগায়ক সংগীত সম্রাট তানসেনের বা তার উত্তরসূরীদের। খেয়াল শব্দটির উদ্ভব হয়েছে উর্দু ভাষা থেকে যার অর্থ হলো কল্পনা। কিছু প্রাথমিক নিয়ম কানুন বজায় রেখে খেয়াল গানে জোর দেওয়া হতো শিল্পীর কল্পনা শক্তির উপরে যাতে তিনি নিজের ইচ্ছেমতো রাগের রূপ প্রকাশ করতে পারেন। খেয়াল গানের সৃষ্টি হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত উর্দু কবি আমীর খসরুর সময়ে, কিন্তু খেয়ালের যে গায়কি রীতিতে বর্তমানে গাওয়া হয় তার সৃষ্টি অষ্টাদশ শতকে ও ঊনবিংশ শতকে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ ও তারপরে আউধ বা অযোধ্যার নবাবের সময়কালে।       
                                                                                                ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments