জ্বলদর্চি

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি /প্রসূন কাঞ্জিলাল

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি

প্রসূন কাঞ্জিলাল  


একুশ আমাদের অহংকার। একুশের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা আন্দোলন জাতীয় জীবনে একটি বিশেষ স্মরণীয় দিন, যা অনাগত কালে ও যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতিকে প্রেরণা দান করবে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির সংস্কৃতি ও সাহিত্যে চেতনার ফসল হিসেবে বিরাজ করছে। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে যে সংগ্রাম হয়েছিল, যত রক্ত ঝরেছিল তা বাংলা সাহিত্যে স্থান পেয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রকে করেছে সমৃদ্ধ। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার মানুষকে দিয়েছে কথা বলার অধিকার ও সাহিত্য সৃষ্টির স্বাধীনতা। আমার এক পরিচিত অগ্রজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দারুন একটা অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৬৩ সাল। তিনি প্রথম বিদেশ যাচ্ছেন প্লেনে চেপে, কলকাতা থেকে। প্লেনটা প্রথম থামে করাচিতে। ভোরবেলা। চারিদিকে কুয়াশা। তবু তাঁর কৌতূহলী মন বাধা মানে না। দৃষ্টি চলে যায় জানলা ছাড়িয়ে এদিক-ওদিক। হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় চোখ। বিশাল একটা হোর্ডিং। তাতে বড় বড় হরফে বাংলায় লেখা 'করাচি বিমানবন্দর'। তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। খোদ কলকাতা বিমানবন্দরে তখনও বাংলায় লেখা হয়নি। আর অত দূরে -- অত হাজার মাইল দূরে বাংলায় লেখা!
    
আসলে হয়েছিল কি, শ্রী গঙ্গোপাধ্যায় যখন করাচিতে যান তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সঙ্গেই ছিল বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। তাই করাচি বিমানবন্দরেও ছিল বাংলা ভাষার ব্যবহার। সেটা অবশ্য আপনা-আপনি হয়নি। ছিল বহু বাঙালির আত্মত্যাগ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, সংগঠিত আন্দোলন। ছিল বরকত, রফিক, জব্বারদের শহীদ হওয়া। রক্ত ঝরানো একুশে ফেব্রুয়ারি …! তাই সম্ভব হয়েছিল বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদালাভ। 

একুশ আমাদের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম , তা আমাদের চেতনাকে শানিত করে। একুশের আছে নানা কবিতা ও গান। এ দেশের কবি, সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকাররা একুশকে ধারণ করেছেন তাদের লেখায়, সুরে ও কণ্ঠে। আর সেই সব গান, কবিতা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। একুশকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে পথ দেখায়।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/
আমি কি ভুলিতে পারি।’

 একুশের এই একটি গান আমাদের একুশের চেতনার সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে, যা আমরা কখনই ভুলতে পারি না। এ গান শুনলেই মনে হয় আমরা ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতে ফিরে যাই যেদিন সালাম, রফিক, জব্বারেরা মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এ গান তাই চির অম্লান।

আরেকটি গান এখনও সবার মুখে মুখে ফেরে। সেটি হল ---

 ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ 

গানের মতো কবিতায়ও বারবার উঠে এসেছে অমর একুশ। একুশের প্রথম কবিতাটি লিখেছেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সেই কবিতার চরণে আছে, ----

‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।’

কবিতাটির আরেকটি জায়গায় আছে--

 ‘যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে/যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/তাদের জন্য আমি ফাঁসির দাবি করছি।’ 

শামসুর রাহমানের "বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা" কবিতার একটি চরণে আছে,---

 ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কি থাকে আমার? উনিশশো বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছে সগৌরবে মহীয়সী।/ সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।’

আহসান হাবীব তার "মিছিলে অনেক মুখ" কবিতায় লিখেছেন---

 ‘মিছিলে অনেক মুখ/ দেখো দেখো প্রতি মুখে তার/সমস্ত দেশের বুক থরো থরো/উত্তেজিত/শপথে উজ্জ্বল!’/সূর্যের দীপ্তিতে আঁকা মিছিলের মুখগুলি দেখো/ দেখো দৃপ্ত বুক তার/ দেখো তার পায়ের রেখায়/ দেশের প্রাণের বন্যা উচ্ছল উত্তাল।’

কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তার "স্মৃতিস্তম্ভ" কবিতায় লিখছেন, ----

‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে।’

এভাবেই কবি-সাহিত্যিকরা আমাদের চেতনার বুদবুদে একুশের চেতনাকে শানিত করেছেন বারবার। এসব গান, কবিতা এখনও আমাদের মধ্যে চিন্তার খোরাক জোগায়। ভাষা সংগ্রামের একুশের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

একুশের বাংলা সাহিত্য এই অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ভাষার জন্য যে জাতি প্রাণ দিয়েছে, তার ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে লেখা আছে। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষায় বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তে পিচঢালা কালাে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। তাদের এ আত্মত্যাগের ফসল বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেশ, দেশের মানুষ বা মাতৃভাষার জন্য এ আত্মত্যাগ পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশের ইতিহাসে নেই। তাই একুশ জড়িয়ে আছে আমাদের সামগ্রিক ও জাতীয় চেতনায়। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কবি-লেখকগণ তাদের সাহিত্যের মুখ্য উপকরণ হিসেবে একুশকে গ্রহণ করেছেন। আর সেসব মনীষীরা হলেন- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, শওকত ওসমান, কবি শামসুর রাহমান প্রমুখ।

 একুশ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন-- 'মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়।' তিনি আরও বলেছেন, বাঙালির প্রাণের দাবি, মনের দাবি বাংলা ভাষা। এ ভাষায় তাদের কথা বলতে না দিলে তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবে।'

"মােদের ভাষার প্রাণ
একুশ করেছে দান
একুশ মােদের পাথেয়
একুশকে করাে নাকো হেয়।"

একুশ সম্পর্কে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর উক্তিটি বাংলা সাহিত্যে একুশের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।

বাহান্নর একুশে ফেরুয়ারিতে মাতৃভাষার জন্য যেসব তরুণ নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল, স্বাধীনতা উত্তরকালেও সে মাতৃভাষা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের শিরায় শিরায় প্রবহমান। শামসুর রাহমান, মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সিকান্দার আবু জাফর, মুনীর চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ-কাল ও সমাজের সমকালীন আবহে বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিকান্দার আবু জাফর তার "সংগ্রাম চলবেই" কবিতায় লিখেছেন—


"জনতার সংগ্রাম চলবেই।
আমাদের সংগ্রাম চলবেই ।"

কবির এ সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে, নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। একুশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম কবিতা লেখেন কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। তাঁর রচিত "কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি" কবিতাটি একুশের অন্যতম সেরা কবিতা। "স্বাধীনতা তুমি" কবিতায়ও কবি শামসুর রাহমান একুশের চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি লিখেছেন—

"স্বাধীনতা তুমি
শহিদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা !"

ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী লিখেছেন ‘কবর’ নাটক । একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- জহির রায়হানের 'আরেক ফাল্গুন', শওকত ওসমানের 'আর্তনাদ', সেলিনা হােসেনের "নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি"।  একুশ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া' এবং 'Let there be Light' । এছাড়াও একুশ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক ছােটোগল্পও ।

 একুশের চেতনা দেশের সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিদদের সাহিত্য রচনা করার প্রেরণা যুগিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হওয়ার পর বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও চর্চার প্রতি আগ্রহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। সেই সাথে শিল্পী ও সাহিত্যিকগণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গােষ্ঠীর উদ্ভব, নানা পত্র-পত্রিকার জন্ম, গল্প-কবিতা, প্রবন্ধ উপন্যাস-নাটকে স্বাধিকার অর্জনে দীপ্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে।  বাংলার তেজোময় সাহিত্যিকবৃন্দ তাঁদের সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম দিয়ে জাতির বিবেককে বারবার নাড়া দিয়েছেন। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের অতীত স্মৃতিকে অধিকতর উজ্জ্বল করে তুলেছেন কবি শামসুর রাহমান, শওকত ওসমান, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, হুমায়ুন আজাদ, আল-মাহমুদ, জাহানারা আরজু, আব্দুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ সাহিত্যিক । ওদেশের সাহিত্যিকগণ একুশের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে বাংলা সাহিত্যের পরিধিকে বর্ধিত করেছেন। 

 ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি চির অম্লান ঘটনা। একুশের চেতনা বা প্রভাব আমাদের সাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। একুশ কেন্দ্রিক সাহিত্য আমাদের এনে দিয়েছে আত্মপরিচয়ের প্রেরণা ও আত্মনির্মাণের যােজনা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে একুশের তাৎপর্য সঠিকভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী কলম ধরেছেন। 

আমরা জানি ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস একদিকে যেমন আনন্দের তেমনি অন্যদিকে বেদনার। ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা বিদায় নিলে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর অমানবিক অত্যাচার । পাকিস্তানিরা এদেশকে শােষণ করার জন্য প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির প্রাণপ্রিয় মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছে। তারা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। কিন্তু বাঙালি তা মেনে নিতে পারেনি। গড়ে তুলেছে তীব্র প্রতিবাদ। ক্রমে ক্রমে এ আন্দোলন বাড়তে থাকে এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এক প্রবল বিস্ফোরণে পরিণত হয়। এ আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ও আরও অনেকে জীবন দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করার ও ভাষার মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন। এই আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশ উন্নীত হয় এক স্বতন্ত্র মর্যাদায়। সেই থেকে একুশ হয়ে ওঠে সংগ্রামের উৎস, চেতনার অধ্যায় । মহান একুশ শিখিয়েছে জাতীয় স্বার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে। এমনকি একুশের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে ও অধিকার রক্ষা করে মাথা উচু করে বাঁচার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে শিখেছে। এক কথায় বলা যায়, একুশই বাংলার সকল আন্দোলনের পেছনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

দেশভাগ হবার পরেই পূর্ব পাকিস্তানে দাবি উঠেছিল বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমান মর্যাদা দিতে হবে। পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রতিটি বাঙালি সদস্যকে মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ দিতে হবে। সেই দাবি মতো প্রস্তাব উঠেছিল গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর নেতৃত্বে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ চেয়েছিলেন ধর্মের আড়ালে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা কায়েম করতে। সেই সংকীর্ণ স্বার্থেই ১৯৫২র ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু'। এই ঘোষণার কয়েক দিন পর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ছাত্রছাত্রীরা বিশাল মিছিল বের করেন। সরকারও নীরব থাকে না। উত্তাল মিছিলে সেনাবাহিনী বর্বর আক্রমণ হানে। গুলি চালায় এলোপাথাড়ি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বেশ ক'টি তরতাজা প্রাণ। এই মর্মান্তিক ঘটনায় আন্দোলন থেমে তো যায়ই না, বরং অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। শুধু ঢাকায় নয়, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন প্রসারিত হয়। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েই উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়। প্রথমে আরবি হরফে বাংলা লেখার মতো হাস্যকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বাংলাকে মেনে নেওয়া হয়।

এর পরেও অবশ্য বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের 'ইসলামীকরণ' ঘটাবার, জোর করে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রচুর আরবি ফারসি শব্দ ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে পুরোপুরি 'মুসলমানের ভাষা' করে তোলবার চেষ্টা চলেছিল। হিন্দু দেব-দেবী আর প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির চিহ্ন আছে এমন বই শুধু অপাঠ্য হয়নি, বাদ পড়েছিলেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। স্বীকৃত হয়েছিলেন শুধুমাত্র গরীবুল্লাহ, আলাওল, কায়কোবাদরা।

এই বন্ধ্যাকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ঐতিহাসিক কারণেই সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭১-এর ১৬ ই ডিসেম্বর গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। যে দেশের রাষ্ট্রভাষা শুধু বাংলা নয়, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম মাধ্যম বাংলা, শুধুই বাংলা। পৃথিবীর অনেক দেশে মনে করা হয় বাংলা হলো বাংলাদেশেরেই ভাষা। বোঝাতে হয় এক সময়কার অবিভক্ত বাংলার একটা অংশ আজ বাংলাদেশ। আর একটা পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও বাংলাচর্চা হয়। সেই বোঝানোর প্রয়োজনীয়তাও বোধ হয় ফুরাবে। শেষের সেদিন আর বেশি দেরি নেই।

যাইহোক। বাংলাদেশে অফিস-আদালত স্কুল-কলেজ সর্বত্রই বাংলা। দেওয়াল-লিখন, পোস্টার, দোকানের হোর্ডিং, যানবাহনের নম্বর, বাড়ির নেমপ্লেট সব কিছুই লেখা হয় বাংলায়। একেবারে ওপর থেকে নিচু পর্যন্ত সবাই সাহিত্য ভালোবাসেন। রিক্সাওয়ালা, বাড়ির ভৃত্যরা যেমন মনোযোগী পাঠক, তেমনই প্রশাসনিক কর্তারা, এমনকি হাইকোর্টের বিচারকরাও সাহিত্যচর্চা করেন, কবিতা লেখেন। আমাদের এখানে যেমন পঁচিশে বৈশাখ বা বইমেলা উপলক্ষে লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা বের হয়, ওখানেও তেমনি বের হয় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে। এছাড়া সারা বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনের অজস্র প্রকাশনা তো আছেই। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ শহরে নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। ও দেশে সাহিত্যচর্চা করে, কবিতা লিখেই একজন গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারেন, যদি অবশ্য তাঁর লেখা মোটামুটি জনপ্রিয়তা পায়।

বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক লেখকের সংখ্যা প্রচুর। লেখালেখিও যথেষ্ট। সাহিত্যচর্চার সবটাই যে উন্নত মানের, তা অবশ্য নয়। তবু স্মরণে রাখার মতো গল্প উপন্যাস লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ , আলাউদ্দিন আল আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জ্যোতির্ময় দত্ত, সেলিনা হোসেন, রফিক আজাদ, শওকত ওসমান, হুমায়ূন আহমেদ। এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কম-বেশি কবিতাও লিখেছেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ শামসুর রহমানের। আর প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমর, আহমদ শরীফের। বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যেরও ভালো কাজ হয়েছে। শুধু সাহিত্য নয়, বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর -- বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে ওঠার পর, শিল্প, সঙ্গীত, নাটকেও কাজ হচ্ছে। সেলিম আল দীন সহ বেশ কয়েকজন নাট্যকর্মী দেশজ ঐতিহ্য থেকে নিত্যনতুন কাজ করছেন।

অথচ এ বঙ্গে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক চিত্রটা কেমন? অতিশয়োক্তির মতো শোনাবে, তবু বাস্তব সত্য এটাই নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে এ বঙ্গের বাসিন্দারা ক্রমশই অমনোযোগী হয়ে পড়ছেন। গ্রাম-মফস্বলে একটা সুস্থ বাংলা সংস্কৃতি চর্চা থাকলেও কলকাতা-কেন্দ্রিক এলিট-ঘেঁষা বলয়টি যেন কিছুটা উন্নাসিক। নির্বিচারে মেনে নিচ্ছেন হিন্দি সংস্কৃতির দাপট। এর একটা কারণ হয়তো রাষ্ট্রীয় কাঠামো। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সর্বত্রই এই একটি ভাষাতেই কথা বলা, পথ চলা। কিন্তু ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে তো তা নয়। সুতরাং কিছু অসুবিধা এখানে আছেই। কিন্তু সর্বোপরি যে সমস্যা তা হল মানসিকতার অভাব। বাংলা যে শুধু কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা নয়, একটি মুক্তমনা জাতির দীর্ঘদিনের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার আদরের মাধ্যম এবং পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষাগুলির সম-পংক্তিতেই যে এর স্থান, এই মোদ্দা কথাটাই স্মরণে থাকছে না এই বঙ্গের বাসিন্দাদের। বাংলায় কথা বলতে, গান করতে তাঁরা আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যা এখন আর তাঁদের টানে না। দ্বিজেন্দ্র রজনীকান্ত অতুলপ্রসাদের গানে তাঁরা ক্লান্তি অনুভব করেন। বাংলা আধুনিক গানে, লোকসংগীতে, গণসঙ্গীতে তাঁরা মনের শান্তি, প্রাণের আরাম, প্রেরণার রসদ পান না।

ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। প্রথমত নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ ক্রমশই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমন প্রতিবেশ গড়ে উঠছে না যাতে তারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে, নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়। সাম্প্রতিক বাংলা ব্যান্ড ও কয়েকটি ভালো মানের বাংলা সিনেমার কথা মাথায় রেখেও এ কথা বলা যায়। শুধু উচ্চবিত্ত বাড়ির ছেলে-মেয়েরাই নয়, মধ্যবিত্ত বাড়ির পড়ুয়ারাও বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাটা লজ্জার ব্যাপার বলে গণ্য করছে। আর নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর পড়ুয়ারা, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর যারা পুরোপুরি নির্ভরশীল, তারা সরকারি শিক্ষানীতির দোলায়িত-চিত্ততার কারণে বাংলা ইংরেজি কোনওটাই ভালো ভাবে শিখছে না। দ্বিতীয়তঃ প্রশাসনিক স্তরেও বাংলাভাষাকে কাজের ভাষা করে তোলবার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশের সব সরকারি কাজ বাংলায় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও এ রাজ্যে সরকারি কোনও স্তরের কাজকর্মে পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার হয়নি। যা হয়েছে তা শুধুই কথার ফুলঝুরি, আর কথা খেলাপের ধারাবাহিকতা।

এই ধারাবাহিকথাতেই যে আর একটা একুশে ফেব্রুয়ারি সংযোজিত হবে, তাতে আর সন্দেহ কি! একে তো 'ও দেশে'র ব্যাপার! তাতে আবার নয় নয় করে এতগুলো বছর কেটে গেল! সুতরাং আর কেন! 

অতএব, 
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি /
এখন তো ভুলে যেতেই পারি।।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

5 Comments

  1. অসাধারন । প্রণাম নেবেন স্যার।🙏

    ReplyDelete
  2. অপূর্ব, জয় বাংলা ভাষা, এতো সুন্দর মধুর ভাষা বিশ্বে আর নেই । গর্বিত আমি বাংলায় কথা বলি, আমি বাঙালি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে অনেক বেশি ধন্যবাদ
      🙏💕

      Delete
  3. অপূর্ব সুন্দর লেখা। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। আপনাকে ধন্যবাদ। ২১ ফেব্রুয়ারি অমর শহীদদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। আমি বাঙালি বাংলা আমার প্রাণ।

    ReplyDelete