জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব -(৪০)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব -(৪০)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম


হিন্দুগণ এই বাস্তবসত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে, মানুষের জীবনযাত্রা একটি কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়া এবং সুষ্ঠভাবে জীবন ধারণ পালন ও রক্ষা করার জন্যে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সযত্নে নানা আচরণিক সংস্কার আইন দ্বারাই এই জীবনযাত্রাকে সুন্দর করে তুলতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও কিছু মানসিক ও বাহ্যিক সংস্কার রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়নি। চরম নৈরাজ্যের উদ্ভব হলেই যখন তার বিরুদ্ধে নেতৃত্বের প্রশ্ন জাগে, তখনই সেই নেতৃত্ব দান করেন এমন একজন পুরুষ বা মহিলা, যিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে ধর্ম-রাষ্ট্র সমাজজীবনে সুস্থিতি দান করার জন্যে পরাক্রমশালী পুরোধা-মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অতীতকালে আর্যগণ রাজার স্থান বা রাজত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষায় ছিলেন না। পরবর্তীকালে রাজার উদ্ভব ও রাজত্বলাভ বিষয়টি আসে। রাজত্বলাভের পর রাজা ঐশ্বরিক পুরুষের স্থান লাভ করেন। কারণ রাজার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ভগবান- এই বিশ্বাস জনজীবনকে প্রশান্তি প্রদান করে। রাজাকে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক দিশা দিতে ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রাজধর্ম পালনে রাজার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল, প্রজাসুখ, প্রজার শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ। 

প্রাচীন সমাজ জীবনে নানা দিক থেকে অর্থাৎ ভেতর বাইর সবদিক থেকে একটা অস্থিরতা ও আক্রমণ ভয় জনজীবনকে দুশ্চিন্তায় ও ভয়ে রাখত। এই অবস্থার প্রতিরোধী, শক্তিমান রাজা। এর থেকেই রাজন্য শ্রেণীর উদ্ভব। অতিপ্রাকৃত শক্তির আশীর্বাদ কামনায় ব্রহ্মসন্ধানী পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ শ্রেণীর উদ্ভব ঘটল। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ শ্রেণী বাদ দিয়ে যে শ্রেণীর উদ্ভব ঘটল, তারা ব্যবসা-বাণিজ্য কর্মে নিযুক্ত বণিক সম্প্রদায়। বৈশ্য নামে তারা পরিচিতি পেলেন। যারা কায়িক পরিশ্রম দ্বারা সমাজের অন্যান্য কাজে লিপ্ত বা নিযুক্ত হলেন, তারা শূদ্র নামে পরিচিতি পেলেন। ক্ষত্রিয় শ্রেণি থেকে নির্বাচিত রাজা ক্ষাত্র্যশক্তি প্রয়োগে দেশের শাসনভার ও দেশরক্ষার কাজকে ঈশ্বরনির্দেশিত কাজ বলে মনে করতেন। সত্যধর্ম পালন, সত্যাশ্রয়ী হয়ে সৎ জীবনযাপন করার যাবতীয় উদ্যোগের পিছনে রাজার সুপরিকল্পীত রাজ্যশাসন প্রণালী ছিল। প্রয়োজনে দণ্ড প্রয়োগ দ্বারা স্খলিত বা দুরাচারীদের শাস্তি দান রাজ্যশাসনের অঙ্গ ছিল। 

মহাকাব্য মহাভারতে, সমুদ্রে ফুটো নৌকাকে যেমন পরিত্যাগ করতে হয়, ঠিক সেইভাবেই সংসারে ছয় ধরনের মানুষকে পরিত্যাগ করার কথা আছে: যে শিক্ষক শিক্ষা দান করেন না, যে পুরোহিত ধর্মশাস্ত্র পাঠ করেন না, যে রাজা প্রজাদের রক্ষা করেন না, যে স্ত্রী সুবাক্য ব্যবহার করেন না, যে রাখাল গ্রামে বাস করতে ভালোবাসে না, অর্থাৎ গোচারণভূমিতে গো-সম্পদ পালন করতে অনিচ্ছুক এবং যে নরসুন্দর অর্থাৎ নাপিত বনে বাস করতে চায়। 

অতীতে মানুষের জীবনকে সুপরিচালিত করার লক্ষ্যে নৈতিকতাকে নিবিড়ভাবে রক্ষা করার বিষয়টি কোনভাবেই উপেক্ষিত হত না, এমনকি প্রাচীন চীন দেশেও এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল ছিল যে, মানুষ মূলত ও স্বভাবগত ভাবেই দুর্নীতিপরায়ণ। তাকে সুপথে পরিচালিত করার জন্যে নৈতিকতার নির্ধারিত মানগুলিকে নিয়মিত চর্চা করাতে হবে এবং এ কাজ রাজার বা রাষ্ট্রনায়কের। রাষ্ট্রনায়ক ও দার্শনিক Husn Tze (খ্রিঃ পূঃ ৩০৫-২৩৫) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে Mencius (খ্রিঃ পূঃ ৩৭৩-২৮৯) রচিত কনফুসিয়াসের নীতির বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। Mencius মানুষের মধ্যে স্বভাবগতভাবেই  শুভের অবস্থান রয়েছে- এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন, অপরদিকে Hsun Tze- র মত হল, সব মানুষ স্বভাবগতভাবেই দুর্নীতিপরায়ণ, তাকে ঠিক পথে পরিচালিত করতে শাসনে রাখতে হবে। প্রাচীন রাষ্ট্রনায়কগণ এই কারণেই নৈতিক নীতি নির্ধারণে, আইনকানুনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। 

ভারত ছাড়াও পাশ্চাত্য জগতে এমন উদাহরণ অপ্রতুল নয়। রোমান দার্শনিক নাট্যকার ও রাজনীতিবিদ Seneca (খ্রিঃ পূঃ ৪-খ্রিঃ ৬৫) রোমান সম্রাট নিরোর (Nero খ্রিঃ ৩৭-৬৮) শিক্ষাগুরু ছিলেন। তিনি Stoic দর্শনের প্রবক্তা। তিনি মানুষের স্বভাব 'ভালো থাকা'-র দর্শনটি নিত্য অবস্থান করেছে- এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন। তার মতে রাষ্ট্রই মানুষকে অন্যায় দুর্নীতি ও কুকর্মের দিকে এগিয়ে দেয়।

 খ্রিস্টান চার্চের ফাদারগণ মানুষকে এই পাপ থেকে মুক্ত রাখতেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেন এবং নানা ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের আয়োজন করেন। হিন্দু ধর্মের মধ্যেও মানুষের স্বভাবগত লোভ, পরস্বাপহরণ, পরস্ত্রী কামনা প্রভৃতি নানা ব্যভিচারী মনোভাব সদা ক্রিয়াশীল বলেই ধর্মসূত্রের বন্ধন দিয়ে মানুষকে কুপ্রবৃত্তির কবল থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। দমননীতি প্রয়োগের দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং দণ্ডদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রাচীন ইউরোপের ও এই ব্যবস্থা ছিল। এথেন্সের রাজনীতিবিদ Demosthenes (ডেমোস্থিনিস খ্রিঃ পূঃ ৩৮৪-৩২২) এর মতে আইন ভগবানের দান এবং মহাপুরুষদের আবিষ্কার। সেনেকা, অ্যারিস্টোটল ও এর মতের প্রবক্তা ছিলেন। আইনকে 'King of all Kings' বলা হত।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments