জ্বলদর্চি

বিজয়াদি, বিজয়া মুখোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ৯


বিজয়াদি, বিজয়া মুখোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী


‘বিশ্বের সমস্যাপূরণের ভার / তোকে দেওয়া হয়নি, পুঁটি। / ভারতবর্ষ বোমা বানবে কিনা / আমেরিকা ভিয়েতনাম ছাড়বে কবে / অটোমেশনের বিরুদ্ধে গনস্বাক্ষর জরুরি – / এ সব ভাবনা তোর নয়। / বিকেলে গা ধুয়ে তুই খোঁপা বাঁধ / লক্ষ্মীবিলাস তেল দিয়ে, / মাসির দেওয়া পার্ল পাউডার / মুখে আলতো করে মাখ / কাগজ পোড়ানো ঝুরো টিপ পর কপালে / সন্ধ্যামালতির থোকা গুঁজে দে খোপায় / বর্ষায় ঘন সবুজ শাড়ি / তোকে মানায় ভালো।…’ - কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের  এই ‘পুঁটিকে সাজে না’ কবিতাটি পড়ে নারীবাদী কবিতা মনে হলেও, তাঁর কবিতার মূল চরিত্র বুঝতে গেলে তাঁকে পড়তে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। আসলে একজন নারীর কবিতা বলতে পাঠক যা বোঝে, সেই জায়গা উত্তীর্ণ করে তাঁর লেখা বিস্তৃতি পেয়েছে।

১৯৭৭ অথবা ৭৮-এ আমি প্রথম পড়ি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতা। আমার জীবনের বেশ কিছু সময় হিন্দুস্তান পার্কে ইলাবাসে কেটেছে, বেড়ে ওঠার সময়ে। এই বেড়ে ওঠায় যে দুটির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল আমার সঙ্গে, সেই দুটি হলো বালিগঞ্জ ইন্সটিট্যুট লাইব্রেরী আর আইডিয়াল বুক স্টোর, দুটোই গড়িয়াহাটে। আইডিয়াল বুক স্টোরে দাঁড়িয়ে কত যে কবিতার বই পড়েছি ভাবা যায় না। পাবলো নেরুদা পড়েছি। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই একে একে তখন বুদ্ধদেব বসু, কবিতা সিংহ, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, শামসুর রাহমান, বিনয় মজুমদার, আল মাহমুদ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন, বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই দোকানের কর্মচারীরা এবং ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত মালিক আমার হৃদয়ে অনেকখানি রয়ে গেছেন আজও। সব সময় তো বই কিনতামও না, পড়ে চলে আসতাম, পরের দিন আবার যেতাম, তাঁরা পরম আদরেই বই বার করে দিতেন। রক্তের মধ্যে কবিতার শিরশিরানি ওই আইডিয়াল বুক স্টোর থেকেই…

পরবর্তীকালে ঠুংরী নামে একটি পত্রিকা করেছিলাম কিছুদিন। তখন বহু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম। মেঘমল্লার বিল্ডিং-এ শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বিজয়া মুখোপাধ্যায়-এর ফ্ল্যাটে গিয়ে কবিতা সংগ্রহ করেছিলাম পত্রিকার জন্যে। সে অনেকদিন আগের কথা, ১৯৮৫ সাল, তখন তাঁদের পুত্র সায়ন খুবই ছোট। 

একবার হিন্দুস্তান পার্কের মোড়ে নবনীতা দেব সেনের সঙ্গে দেখা, উল্টোউল্টি। নবনীতাদি কোথাও যাচ্ছিলেন, আর আমি কোথাও থেকে ফিরছিলাম। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে বললেন ‘কৃত্তিবাসের আড্ডায় যাচ্ছি, চল’। বোঝো কান্ড! বাড়িতে বলা নেই কওয়া নেই, তখন মোবাইল বলে বস্তুও নেই। তাছাড়া হঠাৎ করে কৃত্তিবাসের আড্ডায় যাবোই বা কেন! কিন্তু তখন ‘না’ বলা অত সোজা ছিল না, বিশেষত মায়ের বন্ধুকে। মৃদুস্বরে বললাম বাড়িতে বলা নেই। তৎক্ষণাৎ কাকে দিয়ে যেন আমাদের বাড়িতে খবরও পাঠিয়ে দিলেন নবনীতাদি। ব্যস হয়ে গেল আমার যাওয়া মঞ্জুর, পৌঁছে গেলাম কৃত্তিবাসের আডায়। সেদিন নাটকের রিহার্সাল ছিল। নবনীতাদির কৃত্তিবাসের সেই রিহার্সাল থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার ছিল, চলে গেলেন বিজয়াদির হাতে আমাকে সঁপে দিয়ে। এইবার বিজয়াদির তত্ত্বাবধান শুরু হলো, ঠিকভাবে খেলাম কিনা ইত্যাদি। নবনীতাদি, বিজয়াদি তখনও তো ‘দিদি’ হননি আমার। রাত হয়েছিল বলে একদম বাড়ির দরজায় শরৎদা বিজয়াদি নামিয়ে দিয়ে গেলেন। গাড়িতে আসতে আসতে অনেক কথা হলো, সেইদিন থেকেই সখ্যতার শুরু আমাদের। কীভাবে যে তাঁরা আমার মতো সামান্য মানুষকে কাছে টেনে নিলেন, এবং কেন, বলা দুঃসাধ্য। পরবর্তী সময়ে শুধু কবিতা নয়, বিভিন্ন বিষয়েই তাঁর সঙ্গে আমার কথা-বার্তা হতো, কবিতায় কেন ইংরেজি শব্দের ব্যবহার, বা ছন্দ-জ্ঞান বিষয়ক খুঁটিনাটি। কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করতেও কখনো পিছপা হননি।

আপাতদৃষ্টিতে কাঠখোট্টা মনে হলেও আসলে বিজয়াদি একদম অন্যরকম এক মানুষ ছিলেন। খুবই স্পষ্টবাদী ছিলেন, কিন্তু যখন-তখন কাউকে বকাবকি করতেও শুনিনি। তবে তাঁর একটা মেজাজ ছিল, সেই মেজাজ বুঝতে গেলে তাঁর কবিতা পড়তে হবে। তাঁর লেখায় দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। তিনি লিখেছিলেন ‘আমরা যার সংগে নিত্য বসবাস করি/ তার নাম প্রেম নয়, উদ্বেগ। / প্রেম অতিথির মতো / কখনো ঢুকে পড়ে অল্প হেসে, / সমস্ত বাড়িতে স্মৃতিচিহ্ন ফেলে রেখে / হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। / তারপর সারাক্ষণ / আমরা কেউ আর উদ্বেগ / আমরা একজন আর উদ্বেগ / বসবাস করি / রাত থেকে দিন, দিন থেকে রাত’। 

বিজয়া মুখোপাধ্যায় মস্তিষ্ক দিয়ে কবিতা লিখতেন, তবে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে অনুভবকে মিলিয়ে দিয়ে তবেই লিখতেন। অনেক সময়ই তাঁর কবিতা বিষয়-নির্ভর ছিল। ভাষা-সচেতনও ছিলেন তিনি। বাংলা কবিতার মধ্যে অন্য ভাষার ব্যবহার বিজয়াদি ভীষণই অপছন্দ করতেন। একদিনের কথা বলি, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নতুন কবিতা 'সই'-এর আড্ডায় পড়ে শোনাচ্ছিলেন, সেই কবিতায় সংযুক্তা কিছু অন্য ভাষার শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন, বিজয়াদি সমালোচনা করেছিলেন, সপক্ষে যুক্তি দিয়ে, যেগুলি আমারও ন্যায়সংগত মনে হয়েছিল সেদিন, আমি এবং আরও কেউ কেউ বিজয়াদিকে সমর্থন জানিয়েছিলাম। যদিও পরবর্তীকালে আমার ভাবনা পরিবর্তিত হয়েছে, আমি নিজেও অন্য ভাষার শব্দ প্রয়োগ করেছি পরে, আমার মনে হয়েছে অনেক সময়ই অন্য ভাষার কিছু কিছু শব্দ অর্থপ্রয়োগে অনেক বেশি উপযুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং কবিতায় প্রয়োজনে সেগুলোর প্রয়োগ করা যেতেই পারে। কিন্তু এই বিষয়ে বিজয়াদি খুবই রক্ষণশীল ছিলেন।

বিজয়া মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত শক্তিমান কবি ছিলেন, তবে শুধুমাত্র ‘কবি’ শব্দের মধ্যে তাঁকে আটকে রাখলে চলবে না। প্রবন্ধকার হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। অনুবাদও করেছেন অনেক। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় বই লিখেছেন। তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল বিস্তৃত। তাঁর সংস্কৃত ভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা অনেকেই জানেন। শুধু ভালোবাসা নয় বা সংস্কৃতের ছাত্রী ছিলেন তাই নয়, সংস্কৃত ভাষায় তাঁর অসামান্য দখলও ছিল। আমরা পড়েছি, কবি বুদ্ধদেব বসু 'মহাভারতের কথা' লেখার সময়ে বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কাছে সংস্কৃত শিখেছিলেন। বিজয়াদি দীর্ঘদিন গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনে সংস্কৃত ভাষা শিখিয়েছেন।

বিজয়াদি একবার আমার একটি কবিতা পড়ে পোস্টকার্ড দিয়েছিলেন। চিঠির শেষে নিজের নাম লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন। আমি তো ভেবে পাচ্ছি না কে লিখতে পারে! এইসব সময় আমার আবার এমনই একদিকে দৃষ্টি হয়ে যায় যে, আমি কিছুই দেখতে পাই না, এক্ষেত্রেও ওপরে লেখা মেঘমল্লারের ঠিকানাটি আমার চোখে পড়তে অনেক সময় লেগেছিল। সেই ঠিকানা দেখার আগেই কবি অঞ্জলি দাশকে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে বিষয়টি ফোনে জানাতেই অঞ্জলি আমাকে বললেন এইখান থেকে একটি রহস্য-উপন্যাস লেখা যেতে পারে। নেহাৎ ঠিকানাটি চোখে পড়ে গেল তারপর, তাই রহস্য-উপন্যাসটি আর লেখা হলো না!

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে যতীন বাগচী রোডে মূর্তি স্থাপনের অনুষ্ঠানে বিজয়াদি সাগ্রহে এসেছিলেন, এসে মঞ্চে উঠে যতীন্দ্রমোহনের সম্বন্ধে বলার আগে আমার কথা বললেন অনেক, বলা বাহুল্য খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম আমি। বিজয়াদি কবিতায় শ্রদ্ধাও জানিয়েছিলেন – ‘আপনার নামের রাস্তা, করে থাকি নিত্য যাতায়াত / আপনার সে ‘ইলাবাস’ নামশিলা এখনও দাঁড়িয়ে / পুরনোকে ভুলে দোষ হলো কি, অনেক ভুলে গেছি / তবুও স্নেহের দাবি ডেকে নিল দুহাত বাড়িয়ে। / উত্তরাধিকার, জন্ম ও এখনও কি দাবি করে কিছু / সম্পর্ক কোথায়, সূত্র খুঁজে পেতে খুলেছি সিন্দুক / ঐতিহ্যশিকড় আলগা, অথচ এ অক্ষরের দানা / অগ্রসর করে দেয় পশ্চিমের দিকে, আত্মভুক। / মনের ভেতরে দায় কবিতার, স্থায়িত্বে যে চোখ / ভুলেছে নিদান, তার হিশেব না হলো, পুণ্য হোক’। এই কবিতায় বিজয়াদি যা লিখে গেছেন, আজ মেঘমল্লারের পাশ দিয়ে যেতে  যেতে সেই একই অনুভূতি আমার...


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

 

Post a Comment

1 Comments

  1. পড়ে সমৃদ্ধ হলাম ।ভালো লেগেছে ।

    ReplyDelete