দূরদেশের লোকগল্প—এশিয়া (ভিয়েতনাম)
চিন্ময় দাশ
মহিষের দাঁত পাটি
কথায় বলে না, তাড়াহুড়োয় যজ্ঞ নষ্ট। একবারহয়েছিল তাই। আর, নষ্ট বলে নষ্ট। হাজার হাজার বছর ধরে তার ফল ভুগে যেতে হচ্ছে আজও। আজকের গল্প সেই ঘটনা নিয়ে। কতকাল আগের কথা , জানে না কেউই। সেই যখন সবে পৃথিবী সৃষ্টি হোল, একেবারে সেই সময়ের ঘটনা।
সবে তখন পৃথিবী গড়েছেন বিধাতা। পাহাড়-জঙ্গল, নদী-নালা, মাঠ-ঘাট সব বানিয়েছেন। ছোট্ট পিঁপড়েটি থেকে আরশোলার মত পোকামাকড়। নেংটি ইঁদুর থেকে বাঘ সিংহ হাতির মত সব প্রাণী। চড়ুই থেকে ঈগল সব রকম পাখপাখালি।সব বানিয়েছেন, সব। আর হ্যাঁ, মানুষও বানিয়েছেন, মানুষ।
বানিয়ে সবাইকে রেখে দিয়েছেন নতুন বানানো পৃথিবীতে। সবাই কেমন সুন্দরভাবে মিলেমিশে শান্তিতে আছে। ভেবে, ভারি পুলক বিধাতার মনে। বসেছিলেন হাসিহাসি মুখ নিয়ে। হঠাৎই তাঁর খাবারের কথা মনে পড়ে গেল। পাঠিয়ে তো দিলাম সবাইকে। কিন্তু খাবারের বন্দোবস্ত না করলে, চলবে কী করে?
আট- দশটা দৈত্য আছে বিধাতার। এটা- ওটা ফাইফরমাশ খাটে দৈত্যগুলো। শীতের দিনে গা-হাত-পা মালিশ করে দেয় গরম তেল দিয়ে। ঝর্নার ঠাণ্ডা জল এনে গা ধুইয়ে দেয় গরমের দিনগুলোতে। কখনও বা গা ম্যাজম্যাজ করল তো, সারা শরীর ডলে দিল ভাল করে। এই সব কাজ।
একটা দৈত্যকে ডেকে পাঠালেন বিধাতা। দুটো সোনার থলে আনা হোল। একটার মধ্যে ভরা হোল ধান গম নানা রকম শাক সবজি ফল মূলের বীজ। যত রাজ্যের বুনো ঘাসের বীজ ঢোকানো হোল আর একটা থলের ভিতর।
দুটো বস্তা দৈত্যটার হাতে দিয়ে বললেন— সমতল আর জলের সুবিধা আছে, এমন জায়গাগুলোতে প্রথম থলের বীজগুলো বুনে দিবি। আর, দ্বিতীয় থলের বীজ বুনবি উঁচু- নিচু পাথুরে জমিগুলোতে।
পই-পই করে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন—কিরে, মনে থাকবে তো? কোনটা কোথায় বুনতে হবে, ভুলে যাবি না যেন। গুলিয়ে ফেললেই সব শেষ।
অনুগত চাকরের মত বারবার মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে পড়ল দৈত্যটা। স্বর্গ থেকে নেমে, পৃথিবীর পথে চলতে লাগল। হয়েছে কী, দৈত্যটা বিধাতা পুরুষের বেশ অনুগত। কিন্তু আসলে স্বভাবে সে বেশ কুঁড়ে। সব কাজই সে করে, কিন্তু বড্ড মন্থর গতিতে। অনেক বকাঝকাতেও আলসে ভাবটা কাটাতে পারেনি বেচারা। বিধাতাও দয়ালু লোক। প্রায়ই মাফ করে দেন তাকে।
সেদিন পথে নেমেই দৈত্যটার মনে হোল, আজকেই একটা মওকা পাওয়া গেছে। আমি যে আলসে নয়, সময়ের আগেই কাজ সেরে ফেলতে আমিও পারি, আজ সেটা দেখিয়ে দিতে হবে সবাইকে।
পৃথিবীতে পৌঁছে, যেখানে প্রথম হাজির হোল দৈত্যটা, নদী বয়ে যাচ্ছে কুলকুল করে। চোখ যত দূর যায়, পুরোটাই সমতল ভূমি। নুড়ি-পাথরের চিহ্নটুকুও নাই কোথাও। ভারি আনন্দ হোল দেখে। বস্তার মুখ খুলে, ঝটপট বীজ বুনতে লেগে গেল।
একেবারে দিগন্ত জোড়া বিশাল এলাকা। বস্তা যখন খালি হোল, আগের জায়গায় ফিরে এল সে। গায়ে ঘাম বয়ে যাচ্ছে দরদর করে।
দৈত্যটা আসলে তাড়াহুড়ো করছে কাজে। তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে সবাইকে নিজের কৃতিত্ব দেখাবে, এই ভাবনায়।
কিন্তু অন্য থলেটা হাতে নিইয়ে এগোতে গিয়ে, চোখ কপালে উঠে গেল বেচারার। ঘাসের বীজ গজাতে শুরু করে দিয়েছে আগের জমিতে। তার মানে, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। সমতল জমিতে ঘাসের বীজ বুনে দিয়েছে সে। কী করা যায়, কী করা যায়।
জমিতে তাকিয়ে দেখল, সবে সবুজ রঙ ধরতে শুরু করেছে মাটিতে। ঘাস ভাল করে পাতা ছাড়বার আগে, বড় দানার বীজ বুনে দিলে, ব্যাপারটা নিশ্চয় অনেকটা শুধরে যাবে। এই ভেবে, দ্বিতীয় থলে থেকে বের করে, সেই জমিতেই বীজ বুনে দিতে লাগল।
আসলে এই থলেটাতে তো ছিল দু’রকমের দানা। একদিকে ধান গম ভুট্টা সরষে মুলো নানাজাতের শাক—এই সব। আর একদিকে নানা রকম ফল ইত্যাদি। হয়েছে কী, এবারেও আবার ভুল হয়ে গেছে দৈত্যটার। ছোট দানার বীজগুলোই বুনে ফেলেছে ঘাসের মাঠে। আবার তাড়াহুড়ো করেছে, ভুল শোধরাতে গিয়ে আবার ভুল।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল তার। কিন্তু তখন আর করবার কিছু নাই। হাতে বাকি ছিল বড় দানাগুলো। উঁচু- নিচু পাথুরে জমি যা ছিল, ছড়িয়ে দিল সেই বীজগুলোই।
কাজের পর ফিরে যাবার পালা। তাকিয়ে দেখল, ঘাস গজিয়ে উঠেছে লকলক করে। তাদের বাড়বাড়ন্ত দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। ঘাসের ভিতর ধান গম বা শাকসবজির বীজ যেন পাতা মেলতেই পারছে না ভালো করে। জল বাতাস আলো কিছুই যেন জুটছে না তাদের।
কিন্তু আফশোস করা আর ফিরে যাওয়া ছাড়া, এখন আর করবার কিছু নাই।
অগত্যা ফিরেই চলল দৈত্যটা। তবে, মনে মনে ঠিক করে নিল, কিছুই বলা চলবে না বিধাতাকে। তাহলে এবার আর রেহাই নাই। এতবড় ভুল কিছুতেই মাফ করবেন না তিনি। তাছাড়া, এত দূরের একটা দেশে সে ঠিক কী করেছে, সেটা জানছেই বা কে, আর দেখেছেই বা কে। কিছু না বললেই, বিবাদ মিটে গেল।
এদিকে দিব্বি খোশমেজাজে আছেন বিধাতা পুরুষ। সব রকম জীবের আহারের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। পেটের ভাবনা রাখেননি কারও। ভেবে মন বেশ পুলকিত।
কিন্তু কাজে এমন গুরুতর ভুল হলে, পুলক কি আর বেশি দিন আয়ু পায়? কিছুদিন না যেতেই, ফ্যাসাদ হাজির। পৃথিবী থেকে একদল লোক সোজা বিধাতার দরবারে এসে হাজির। হাজারটা অনুযোগ তাদের। এতবড় মাঠ জুড়ে ঘাস গজানোর দরকারটা কী ছিল? বনের পশুদের জন্য এত দরদ! তাহলে, সে দরদ মানুষের বেলায় নাই কেন? ঘাসপাতা এমনি এমনি জন্মাচ্ছে। কিন্তু ফসল ফলানোর জন্য এত মেহনত করতে হবে কেন মানুষকে? ছোট্ট একটা শাক ফলাতে গায়ের ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। আর, বুনো ঘাস গজিয়ে উঠছে আপনা আপনি। এটা কেমন বিচার বিধাতার? চাষ করাটা এত পরিশ্রমের কেন?
হাজারো সমস্যা, হাজারো প্রশ্ন তাদের। বিধাতা পুরুষের তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সব ব্যবস্থা কেমন সুন্দর করে ছকে দিয়েছিলেন তিনি। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়।
সেই দৈত্যটাকে ডেকে পাঠানো হোল। মুখ নিচু করে সব কথা স্বীকার করে নিল সে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গুলিয়ে গিয়েছে সব।
বিধাতার এমনিতে খুব দয়ার শরীর। কিন্তু এতবড় ভুল মাফ করা যায়না। গোটা মানবজাতিকে চিরকাল ভূগতে হবে এজন্য।
বিধাতা দৈত্যটাকে বললেন—তোমার ভুলে এই সর্বনাশটা হয়েছে। তোমার চেহারাটাই যা বড়। মগজটা দেখছি অতি ছোট। তার জন্যই এই কাণ্ড। তোমাকেও এর ফল ভুগতে হবে। ফসলের চেয়ে ঘাসের বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে। কিন্তু ঘাস তো আর মানুষের কাজে আসবে না। তোমাকে আমি মহিষ বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছি। ঘাস খেয়েই বাঁচতে হবে তোমাকে। তোমার জন্য মানুষকে এত বেশি পরিশ্রম করতে হয় চাষের কাজে। তুমি সারা জীবন চাষের কাজে সাহায্য করবে মানুষকে।
ঘাস ছাড়া, ফসলের খেতে দাঁতটিও যেন না লাগাতে পারে মহিষ। সে ব্যবস্থাও করে দিলেন। সব জীবেরই দুটো করে দাঁতের পাটি আছে মুখে। তিনিই বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মহিষকে তা দিলেন না বিধাতা। কেবল নীচের মাড়িতেই একটি পাটি বরাদ্দ করলেন মহিষকে।
সেদিন থেকে সেই বিধান চলে আসছে।
আজও দেখা যায়, মহিষের মুখে একটিই দাঁত-পাটি। আজও মহিষের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে, লাঙলে জুতে দেওয়া হয়। মাঠের ফসল ঘরে আনতে হবে? মহিষকেই জুতে দেওয়া হয় গাড়িতে। অত সেবা করে সে মানুষের। তবুও, ভুল করেও যদি ফসলে মুখ দিতে যায়, কখনো, রে-রে করে তেড়ে আসে সবাই।
সেই একবার ভুল করে ফেলেছিল পুর্বকালে। আজও মন থেকে অনুতাপ যায়নি মহিষদের। দানবের মত চেহারা হলে কী হবে? স্বভাবটাকে শান্তই রাখে মহিষ। শত অত্যাচারেও হেলদোল নাই তার। মহিষ জানে, তার তাড়াহুড়োতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বিধাতা পুরুষের এত বড় যজ্ঞের আয়োজনটা। ফল তো ভুগতেই হবে তাকে।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments