যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৭
মেজমাসির বিয়ে হয়েছিল মেদিনীপুর শহরেই। মেসো রেলে ভাল পোস্টে চাকরি করতেন। শাশুড়ি ছিলেন এককথায় জল্লাদ, মেসোও তাই। দাদু খুব বেশি যৌতুক দিতে পারেননি বলে মাসিকে কথা শোনাতেন। মেসো অফিস থেকে ফিরলে মাসির নামে নানান অভিযোগ করতেন। মেসোর ছিল রঙিন জলের নেশা, তিনি কোনোকিছু না জেনে বুঝে মাসিকে মারধোর করতেন। দাদুর কানে সবই যেত, কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনা। ভেবেছিলেন একটা বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সে সুখবরও একদিন এসে পৌছাল, মেজমাসি মা হতে চলেছে। কিন্তু দুঃসংবাদ আসতেও বেশি সময় লাগল না। গর্ভাবস্থায় মেয়েদের যা হয়, মাসি কিছু খেতে পারছিলেন না, শরীরে আলস্য ভাব। তাই অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মেসো অফিস থেকে ফিরে মাসিকে ঘুমোতে দেখে এমন মার মারেন, যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ডাক্তার জানিয়ে দেন গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে, মাসি ভবিষ্যতেও আর মা হতে পারবেন না। মামারা হাসপাতাল থেকে মাসিকে বাড়ি নিয়ে চলে আসেন। মাসি আর কোনোদিন শ্বশুর বাড়িতে পা রাখেননি। মেসো দ্বিতীয় বিয়ে করেছলেন। তাঁরও কোনো সন্তান হয়নি।
দুইমামা কোর্টে দলিল লেখার কাজ করতেন। মামারা বেরিয়ে গেলে মাঝে মধ্যে মেসো মাসির সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। কোনো ভাবে মামারা জানতে পারলে খুব অশান্তি করতেন। এভাবেই চলছিল। শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার বহুবছর পর জানিনা কার পরামর্শে মেজমাসি খোরপোষ চেয়ে মেসোর নামে কোর্টে মামলা দায়ের করেন। কোর্ট থেকে খোরপোষের অর্ডার হয়। কিন্তু সে টাকা মেজমাসির হাত পর্যন্ত পৌঁছাতনা। যেহেতু মেজমাসি বড়মামার কাছে থাকতেন, তাই উনি ভেবে নিয়েছিলেন এ টাকাতে ওনার হক আছে। টাকার সবটা উনিই খরচ করতেন। এইভাবে তিনমাস চলার পর মেসো ডাক মারফৎ তালাকনামা পাঠিয়ে তাঁর পক্ষের উকিল দিয়ে জানিয়ে দেন, তিনি তিনমাস ইদ্দতকালের খোরপোষ দিয়ে দিয়েছেন, আর খোরপোষ দিতে বাধ্য নন। দাদুর অনেক কৃষিজমি ছিল। দুই দিদির কথা ভেবে মা ও ছোটমাসি সেই জমির অংশ নেননি। চারবোনের অংশ দুই মামা সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তবুও দুইমাসি বলতে গেলে অযত্নে, বিনা চিকিৎসায়, না খেতে পেয়ে এক এক করে মৃত্যুর শীতল স্পর্শে প্রাণ জুড়িয়েছিলেন। মামাদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিলনা, আজও নেই। মেদিনীপুরে বাড়ি করে বসবাস শুরু করি ১৯৮৯ সালে। তখন মাসিরা এলে যতটুকু পারতাম তাঁদের চাহিদা ও ইচ্ছে পুরনের চেষ্টা করতাম। বিছানায় পড়েথাকার সময়ও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমি পাঠিয়েছি এ কথা বলতে নিষেধ করে পাড়াতুতো এক মাসির হাতে কিছু দিয়ে পাঠালে মামিরা তাকে সন্দেহ করে বলতেন, নিজে খেতে পায়না, ও নাকি হরলিক্স, ফল দিতে এসেছে।
মায়ের বিয়ের যিনি যোগাযোগ করেছিলেন তিনি দাদুকে বলেছিলেন, মেয়ে দুটির তো বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলেটিকে ওর সেজকাকা নেবেন বলেছেন। সেইসময় বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রের দ্বিতীয় বিয়ে, ছেলেমেয়ে, এসব খুব একটা দেখা হত না। পাত্রের বংশপরিচয়, চরিত্র, রোজগার ইত্যাদি বিষয়ই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হত। মেয়ের মতামত জানারও প্রয়োজন মনে করা হত না। মা ও বিয়ের আগে ঘটকের বলা কথা জেনে ছিলেন। কোনো আয়োজন অনুষ্ঠান ছাড়াই বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হয়ে গেল। দিদিরা তখন মেদিনীপুরে মামাবাড়িতে ছিল। বাবা পরদিন দুই মেয়েকে বাজারে নিয়ে গিয়ে নতুন জামা-জুতো কিনে দিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে আসেন। নতুন মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মা ওদের আদর করে কাছে টেনে নেন। সারাদিন এখানে কাটিয়ে সন্ধ্যা বেলা হাবেলিতে ফিরে যায়(এসব কথা মেজদির কাছে শোনা)। কয়েকদিন পর মাকে বাবা বাড়ি নিয়ে আসেন। মায়ের সঙ্গে পাড়ার একজন বৃদ্ধাকে পাঠানো হয়েছিল। যে চারদিন মা গ্রামের বাড়িতে ছিলেন, কারো সঙ্গে কথা বলেননি। যা বলার সঙ্গের বৃদ্ধার মাধ্যমে বলতেন। পাড়ার লোক ভেবেছিল, মা বোবা। এভাবেই মায়ের সংসারজীবন শুরু হল। বছর দেড় পরে মেজদার জন্ম হয়। মেজদিই তাকে কোলেপিঠে করে বড় করতে থাকে। পড়াশোনা ছিল না। মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করা আর ছোটভাইকে কোলে নিয়ে ঘোরাই ছিল দিদির কাজ। বড়দি মেদিনীপুরে দাদুবাড়িতে থেকে স্কুলে পড়ত। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কারণে মেজদি ও বড়দাও অবহেলার শিকার হয়েছিল। মায়ের স্নেহ-ভালবাসা না পেলেও মায়ের কঠোর শাসন ভোগ করতে হত। যার ফলে বড়দা ছোট থেকেই দুর্বিনীত হয়ে উঠেছিল।
ইতিমধ্যে হঠাৎ করেই বড়দির বিয়ে হয়ে যায়। সে এক রূপকথার গল্প। বড়দি গ্রামের বাড়িতে এসে পাড়ার বৌ-ঝিদের সঙ্গে গরুরগাড়ি চড়ে গড়বেতা গেছল সার্কাস দেখতে। ভেদুয়া গ্রামের খান পরিবারের মহিলারাও সেদিন সার্কাস দেখতে এসেছিলেন। দুটি পরিবারেরই আগে থেকেই চেনা জানা ছিল। বড়দিকে দেখে তাঁদের খুব পছন্দ হয়। ওই খান পরিবারের জাফর খান তখন নামকরা কবিরাজ। ওই তল্লাটের সবাই ওনাকে একডাকে চিনত। তিনি তাঁর বড়ছেলে মহসিন খানের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। যারা সার্কাস দেখতে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে বড়দির বিষয়ে শুনে তিনি পরের দিনই দিদিকে দেখতে আসেন। বাবা তো প্রথমেই না করে দেন। বলেন, আমার মেয়ে ছোট, বিয়ের বয়স হয়নি। আমি এখন মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছিনা। তাছাড়া আমার মেয়ে অসুস্থ, জ্বর হয়েছে। কিন্তু উনিও নাছোড়বান্দা, একটিবার উনি দিদিকে দেখবেনই। শেষে উনি বললেন, ঠিক আছে, আমি ডাক্তার হিসেবে আপনার মেয়েকে দেখতে পারি তো? বাবা আর আপত্তি করলেন না। উনি বড়দিকে দেখে একজোড়া সোনারবালা পরিয়ে দিয়ে বলেন, আমি আপনার মেয়েকে আমার বড়বৌমা করে নিয়ে যেতে চাই। বাবা তখন বলেন, আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত নই। –আপনাকে কিছু করতে হবেনা। আমি আমার বৌমাকে শাড়ি-গহনায় সাজিয়ে নিয়ে যাব। আর বরযাত্রীরা না হয় শিলাবতীর বালি খেয়ে যাবে।
খুব ধুমধাম করে বড়দির বিয়ে হয়েছিল। পালকিতে বর ও বরযাত্রী এসেছিল। প্রচুর বোম ফাটানো হয়েছিল। খাঁড়ারপুকুরে কুমির বোম ছাড়াতে, অনেক মাছ নাকি লাফিয়ে পাড়ে উঠে গেছল। এসব গল্প বড়দের মুখে শোনা। আমার তখন জন্ম হয়নি। বড়দি দেখতে এককথায় অপরূপ সুন্দরী ছিল, অনেকটা মধুবালার মত। জামাইবাবুও সুপুরুষ ছিলেন। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, টিকালো নাক। বিয়ের কিছুদিন পরেই জামাইবাবু স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি পান।
বড়দি ১৪ বছর বয়সে এক মেয়ের জন্ম দেয়। নাম রাখা হয় ‘লাইলি’। বড়দি যখন সাত মাস বয়সে লাইলিকে মামা বাড়ি ভাত খাওয়াতে নিয়ে আসে, ঠিক তখনই, ৯ অগ্রহায়ণ আমার জন্ম হয়। বড়মাসি সেইসময় মায়ের কাছে এসে ছিলেন। মাসি আমাকে রোজ সর্ষেরতেল মালিশ করে সারাদিন রোদে শুইয়ে রাখতেন। যার ফলে আমি এত কালো হয়ে গেছলাম যে বাবা আমাকে কালীবুড়ি বলেতেন।
মেজদির বিয়ের সময় আমার বয়স বছর দুই হবে। মেজদির বিয়ে আমার মনে নেই। তবে বড় হয়ে জেনেছি এবং আরো বড় হয়ে বুঝেছি মেজদির বিয়েটা ভাল হয়নি। এরজন্য কিছুটা মেজদির ভাগ্য আর কিছুটা বাবা দায়ি। মেজদিকে দেখতে সুন্দর, ঘরের কাজে, রান্নাবান্নায় পারদর্শী, তবে লেখাপড়া বিশেষ জানত না। আসলে তখন গ্রামে প্রাইমারি স্কুল ছিল না, গ্রামের দুজন যুবক কাজলদা(অমিতাভ সিংহ) ও বনিদা (ঠাকুর) পাঠশালার মত খুলেছিলেন। সেখানেই দিদি পড়তে গিয়ে যেটুকু শেখা। একদিন কোনও খবর না দিয়ে দু’জায়গা থেকে দেখতে আসা দুই পাত্রপক্ষের মধ্যে একজনদের জল মিষ্টি খাইয়ে বিদায় করে আর একপক্ষকে মেজদিকে দেখানো হয়। অপছন্দের কারণ ছিল না। এখানেই চান্দাবিলা গ্রামে মেজদির বিয়ে হয়। জামাইবাবু শামসুদ্দিন মল্লিক মানুষ হিসেবে খারাপ ছিলেননা, কিন্তু কোনও কাজ করতেন না। সকাল বিকেল দু’বেলা সাইকেল নিয়ে গড়বেতা চলে যেতেন আড্ডা দিতে। মেজদির শ্বশুরবাড়ি নামকরা বনেদি পরিবার, প্রচুর কৃষিজমি, মস্ত পুকুর, পাকাবাড়ি, ধানের গোলা, উঠোন সবই সান বাঁধানো। তিন ভাইয়ের মধ্যে দিদির শ্বশুরমশাই ছোট। মেজ এবাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাশেই বাড়ি করেছেন। বড় আর ছোট ভাই একসাথে থাকতেন। দিদির নিজের শাশুড়ি ও বড় শাশুড়ি দুইবোন ছিলেন। বড়শ্বশুরের এক ছেলে, একমেয়ে। কয়েক পুরুষ ধরেই এই পরিবারের যিনি বড়, তিনি কাজির দায়িত্ব(সরকার নিয়োজিত) পালন করে চলেছেন। তাই পদবী মল্লিক হলেও সবাই কাজিই বলে থাকেন। দিদির জ্যাঠতুতো ভাশুর একাধারে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, কাজি ও পোষ্ট মাস্টার ছিলেন। তাঁর স্ত্রীই ছিলেন ঘরের গিন্নি। তিনি রান্নাঘর সামলাতেন আর মেজদিরা শাশুড়ি-বউ ঘরের অন্যান্য কাজ করতেন ।দিদিদের বাড়িতে কাঁসার বাসনপত্র ব্যবহার করা হত। রাতে এইসব বাসন জলে ধুয়ে উপড় করে রেখে দেওয়া হত। সকালে মেজদির শাশুড়ি সর্ষেরতেল আর শালপাতা দিয়ে মাজতে বসতেন। একরাশ বাসন যখন মেজে-ধুয়ে উঠোনে রাখা হত, সোনার মত চমকাত, রোদ পড়লে তাকানো যেতনা।
মেজদির বড় জায়ের একমাত্র মেয়ে মিনু আমার বয়সি। আমাদের দুজনে খুব ভাব ছিল। মেজদি আমাকে খুবই ভাল বাসত, এখনও বাসে। আমার সবচেয়ে আনন্দের জায়গা ছিল মেজদির শ্বশুরবাড়ি। দিদির দুইছেলে বাবার মতই হয়েছে। ভাশুরের দুইছেলে পড়াশোনা করত। দিদির ছেলেদের মাথায় কিচ্ছু ছিলনা। স্কুলের গণ্ডিটুকুও পার হতে পারেনি।
(ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments