জ্বলদর্চি

গোপীবল্লভপুর: বৈষ্ণব ধর্মের তীর্থস্থান বা গুপ্ত বৃন্দাবন /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৮

গোপীবল্লভপুর: বৈষ্ণব ধর্মের তীর্থস্থান বা গুপ্ত বৃন্দাবন

সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের গোপীবল্লভপুর। বৈষ্ণবদের আদি তীর্থস্থান বলে খ্যাত। এখান থেকেই একসময় গোটা ঝাড়খন্ড সহ জঙ্গলমহলের কোনায় কোনায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। নানান বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বৈষ্ণবধর্মের যে  বীজ একসময় রোপিত হয়েছিল, আজ সেটাই মহীরুহে পরিণত হয়েছে। কতটা? সেটা আজ জঙ্গলমহলের ঘরে ঘরে গেলেই বোঝা যায়। প্রতিটি বাড়ির উঠোনে আছে তুলসী মঞ্চ। গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে হরিনাম সংকীর্তন। কোনও দূরদর্শন বা আকাশবাণী নয়, রাস্তায় রাস্তায় প্রচারিত হয় নগর-কীর্তন। সন্ধ্যা-সকালে ভক্তগণেরা ইষ্ট নাম জপ করেন। কণ্ঠী, রসকলি এবং ভক্তদের গলায় দেখা যায় তুলসীর মালা। এ  সব তো বৈষ্ণব ধর্মের দারুণ এক প্রভাবেরই ফল।

জঙ্গলমহলের পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ যে কোনও প্রান্তেই যাওয়া যাক না কেন, সব গ্রামেই কোথাও না কোথাও একটা হরিমন্দির বা আটচালা চোখে পড়বেই। নিত্যদিন সেখানে হরিণামের আসর বসে। এবং ফি-বছর মহা ধুমধামের সঙ্গে একবার হরিণাম সংকীর্তনের বেশ বড় রকমের অনুষ্ঠান পালিত হয়। তখন গ্রামের মানুষজন বিবাদ বিদ্বেষ ভুলে রাধা-কৃষ্ণ প্রেম নামে ডুবে থাকেন। এবং দুই হাত উপরে তুলে চৈতন্যদেবের মতোই আবেগ ও উচ্ছ্বাসে "হরিবোল" ধ্বনিতে মেতে ওঠেন।

বর্তমানে এই হরিণাম সংকীর্তন জঙ্গলমহলে আনন্দ বিনোদনের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠানও হয়ে উঠেছে। অষ্টমপ্রহর, ষোলো প্রহর, চব্বিশ প্রহর নামে পরিচিত এই হরিণামের অনুষ্ঠানগুলো। এখন তো আবার সেই অনুষ্ঠান বেড়ে পঞ্চরাত্রি ও নবরাত্রিও হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ পাঁচ রাত্রি ও নয় রাত্রি ব্যাপী চলে হরিনাম সংকীর্তনের এই অনুষ্ঠান। রামগড়ের মতো কোথাও কোথাও আবার নয়টি বেদীতে নয়রাত্রি ধরে চলে হরিণাম সংকীর্তন। সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বসে বড় বড় মেলা। প্রচুর মানুষ এই মিলন মেলায় অংশগ্রহণ করেন এবং হরিণাম শ্রবণ করেন।
গ্রামের এক ভক্ত কাকুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "এত ভারী খোলটা কাঁধে নিয়ে কীভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা বাজিয়ে যাও।"
 কাকু বলেছিলেন," সবই হরির কৃপা।" সেই সঙ্গে শুনিয়ে দিলেন দুটো লাইন----
 হরি নামের গুণে পাথর ভাসে সোলা ডুবে জলে রে...
সেই সঙ্গে 'হরিণাম' এর শক্তির যে কী মাহাত্ম্য তারও কতকগুলো তাত্ত্বিক কথা শোনালেন। সেসব ভারি ভারি কথা এখানে আর নাই বা বললাম। তবে একবার হরিণামে মনপ্রাণ ঢেলে দিলে, আবেগ নাকি তখন আর কোন বাধা মানে না। অতীত, ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন আর কোনও চিন্তা থাকে না, কেবল আনন্দ ধারা প্রবাহিত হয় সারা মন ও প্রাণ জুড়ে।


জঙ্গলমহলের অধিকাংশ গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই বেজে ওঠে খোলের বোল। করতালের ঝনঝনানি। হারমোনিয়ামের মিহি সুর। উদাত্ত কন্ঠে গাওয়া হয়, "জয় রাধা গোবিন্দ জয়" গান। গাওয়া হয়--

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

ভক্তরা গান ও নাচ করতে করতে প্রচন্ড আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে না পেরে ধুলায় গড়াগড়িও দেন। এমন সীমাহীন আবেগ অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না।

একদিকে গুপ্ত বৃন্দাবন, অন্যদিকে জঙ্গলমহলের বৈষ্ণব তীর্থস্থান রূপে গোপীবল্লভপুর নামটিরও একটি ইতিহাস আছে। কেননা এই নামের মধ্যেই জড়িয়ে আছে বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণ। শ্যামানন্দ ও রসিকানন্দ বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে দুর্জনদের নিন্দায় যখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন তখন তারা দুজনেই সুবর্ণরেখার দক্ষিণ তীরবর্তী এক নির্জন স্থানে বসবাস করা শুরু করেছিলেন। কাশবনে ভরে উঠা ওই জায়গাটির নাম রাখা হয় কাশীপুর। নামটি রাখেন রসিকের বড় ভাই কাশীনাথ। শ্যামানন্দ এখানেই রসিকের সেবায় মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। রসিকমুরারী তাদের কৌলিক বিগ্রহ গোবিন্দকে এখানেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নাম রাখেন "শ্রীগোপীবল্লভ রায়"। এই জায়গাটিকে শ্যামানন্দ গোপীবল্লভ রায়ের পুরী হিসাবে কাশীপুর এর নাম পাল্টে রাখেন গোপীবল্লভপুর। সেইসঙ্গে বলেন---

"এ গ্রামের নাম শ্রী গোপীবল্লভপুর
ইথে সাধু-কৃষ্ণ সেবা হবে পরচুর।।"

গোপীবল্লভপুর সহ জঙ্গলমহলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারে যে ঝড় উঠেছিল তাতে শুধু হিন্দু ধর্মের মানুষেরাই দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এমনটা নয়। কুড়মি, সাঁওতাল, মুন্ডা ও কোল প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব দারুণ ভাবে পড়েছিল। বিরসা মুন্ডা পর্যন্ত বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি দারুণ রকমের আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। চৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে এইসব আদিবাসী সমাজেও "হরিবোল" শব্দটা পাকাপাকি ভাবে  জায়গা করে নিয়েছে। শবদেহ সৎকার এবং বিবাহের সময় "হরিবোল" ধ্বনি উচ্চারণ এখন তাদের মধ্যেও বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে।

তবে জঙ্গলমহল জুড়ে বৈষ্ণব ধর্মের এই ব্যাপক প্রচার কাজ অত সহজ ছিল না। তার জন্য নানান বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল ধর্মপ্রচারকদের। কিন্তু তারপরেও সমস্ত বাধা প্রতিবন্ধকতা জয় করে তারা প্রচার কাজ করে গেছেন। জঙ্গলমহলে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারে যে তিনজন মানুষের ভূমিকা সবথেকে বেশি ছিল, তাঁরা হলেন-- শ্রী চৈতন্যদেব স্বয়ং, শ্যামানন্দ  এবং রোহিনীর রাজা রসিকানন্দ।

১) চৈতন্যদেব: 
অনার্য আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডের শক্ত পাথুরে কঠিন মাটি ও মানুষের মনে অহিংসা, প্রেম ও ভক্তি রসে সিক্ত করে হরিণামের জোয়ার এনেছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেব পুরী থেকে মথুরা যাওয়ার সময় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষায় জঙ্গলমহলের পাপী ও তাপীর মনে কৃষ্ণ প্রেম জাগরিত করেছিলেন---

"মথুরা যাবার ছলে আসি ঝাড়খন্ড
ভিল্ল প্রায় লোক তাহা পরম পাষণ্ড।।
নাম প্রেম দিয়া কৈল সবার উদ্ধার
চৈতন্যের গূঢ় লীলা বুঝে শক্তি কার।"
(চৈতন্যচরিতামৃত)

"হরিবোল" ধ্বনি জঙ্গলমহলের মানুষের রক্তে রক্তে, শিরায় শিরায় পরিচালিত করেছিলেন। এখানকার অনার্য ভিল জাতির মানুষের হিংস্র মনেও প্রেম জাগিয়েছিলেন  শ্রীচৈতন্যদেব---

"হরিবোল বলি প্রভু করে উচ্চ ধ্বনি
বৃক্ষলতা প্রফুল্লিত সেই ধ্বনি শুনি
ঝাড়িখন্ডে স্থাবর জঙ্গম আছে যত
কৃষ্ণ নাম দিয়া কইল প্রেমেতে উন্মত্ত।"
(চৈতন্যচরিতামৃত)

শ্রীচৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম সম্পর্কে একটু জেনে রাখা ভালো। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের তিনজন প্রবাদপুরুষ হলেন শ্রীচৈতন্যদেব, শ্রীপাদ নিত্যানন্দ এবং শ্রীমদ অদ্বৈতাচার্য। এদের মধ্যে অদ্বৈতাচার্য হলেন সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ। শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের সময় অদ্বৈতাচার্যর বয়স ছিল প্রায় পঞ্চাশের বেশি। সুতরাং বৈষ্ণব ধর্মের তিনি ছিলেন সেসময়কার নেতা। তখন জ্ঞান মার্গের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল বৈষ্ণব ধর্ম। পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে অহিংসা, প্রেম ও ভক্তিকে বেশি করে প্রাধান্য দিলেন চৈতন্যদেব। তাই শ্রীচৈতন্যদেবের রাধা-কৃষ্ণ প্রেম ধর্মের কাছে অদ্বৈতের বিশুদ্ধ জ্ঞানমার্গ ও জ্ঞান আশ্রিত বৈষ্ণব ধর্ম নতি স্বীকার করে। এবং  সত্তর বছরের অদ্বৈতাচার্য বিশ বছরের যুবক শ্রীচৈতন্যদেবের হাতে বৈষ্ণবদের নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন অবলীলায় (গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ও চৈতন্যদেব: হেমচন্দ্র সরকার)।
চৈতন্যদেব উপলব্ধি করেছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞান মার্গের দ্বারা সামাজিক ঐক্য সম্ভব নয়। কারণ তখন জাতিভেদ প্রথা ও সামাজিক বৈষম্য দারুণভাবে প্রকট ছিল। একথা অদ্বৈতাচার্যকে শ্রীচৈতন্যদেব বারবার বোঝাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। তাই একসময় বয়সে বড় অদ্বৈতাচার্যর ওপর শ্রীচৈতন্যদেব হাত তুলতেও পিছুপা হননি---

"জ্ঞান বড় অদ্বৈতের শুনিঞা বচন
ক্রোধে বাহ্য পাসরিলা শ্রীশচীনন্দন।
পিঁড়া হইতে অদ্বৈতেরে ধরিয়া আনিয়া
স্বহস্তে কিলায় প্রভু উঠানে পড়িয়া।"
                    (চৈতন্যভাগবত, মধ্য খন্ড, ১৯ অধ্যায়)

পরে অবশ্য চৈতন্যদেব এই ঘটনায় লজ্জিত ও অনুশোচিতও হয়েছিলেন। তাই রাধা ও কৃষ্ণ প্রেমকেই আশ্রিত করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম  শ্রীচৈতন্যদেব প্রচার করেছিলেন--

"সেই রাধার ভাব লঞা চৈতন্যাবতার
যুগধর্ম নাম প্রেম কৈল পরাচার"
    (চৈতন্যচরিতামৃত, আদিপর্ব)


২) শ্যামানন্দ:
জঙ্গলমহলের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং ঝাড়খণ্ডের একাধিক জায়গায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারে সব থেকে বেশি জোয়ার এনেছিলেন শ্রী শ্যামানন্দ প্রভু। উড়িষ্যার ধারান্দা গ্রামে এক কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ মন্ডল এবং মা ছিলেন দুরিকা দেবী। শ্যামানন্দের সম্প্রদায় "শ্যামানন্দী সম্প্রদায়" নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা ব্রাহ্মণ বিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। সেসময় ব্রাহ্মণেরা তাঁর ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধও ছিলেন। তাকে শূদ্র(সদগোপ) বলে ঘৃণাও করেছেন। কেবল ব্রাহ্মণ বিরোধিতার কারণেই ব্রাহ্মণরা অসন্তুষ্ট ছিলেন এমনটা নয়, শ্যামানন্দের তখন বিরাট একটা প্রভাব ছিল। সেটাও তাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল।

বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস ও গোপীবল্লভপুর সংলগ্ন জঙ্গলমহলে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে শ্যামানন্দের স্থান ছিল সবার উপরে। গোপীবল্লভপুরে আগে থেকেই বৈষ্ণব ধর্মের যে বীজ ছড়িয়ে ছিল, শ্যামানন্দের প্রভায় সেই বীজ জল-হাওয়া ও অনুকূল মাটি পেয়ে ফুলে ফলে গাছে গাছে যেন ভরে উঠেছিল।

ব্রাহ্মণ বিরোধিতা শুধু নয় জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষেরাও শ্যামানন্দের বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারকে প্রথমে সহজভাবে গ্রহণ করেননি। সেটা জঙ্গলমহলে চৈতন্যদেবের পদার্পণের সময় থেকেই ছিল। "রসিকমঙ্গল" কাব্যে সে বিবরণও আছে---

"সংকীর্তন শুনিলে মারিতে সবে ধায়।
এগুলার শব্দে লক্ষ্মী দেশ ছাড়ি যায়।।
বৈষ্ণব দেখিলে বলে "এগুলা তস্কর"।
গ্রাম হইতে খেদাড়িয়া রাখে তেপান্তর"।।

সুতরাং শ্যামানন্দেরর কাজটা যে সহজ ছিল না, রসিকমঙ্গলের বিবরণ থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। গোপীবল্লভপুর এর বিখ্যাত রাজ বংশের সন্তান রসিকানন্দকে বৈষ্ণব দীক্ষায় দীক্ষিত করেছিলেন শ্যামানন্দ। পরে দুজনে মিলে বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ার এনেছিলেন গোপীবল্লভপুর সহ গোটা জঙ্গলমহলে।

শ্যামানন্দ বৈষ্ণব ধর্মের ওপর কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। সেগুলি হল, "অদ্বৈততত্ত্ব" (অদ্বৈত প্রভুর প্রতি মাধবেন্দ্র পুরীর উপদেশ), "উপাসনা সার" ও "বৃন্দাবন পরিক্রমা"। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে শ্যামানন্দ প্রভু মারা যান। "শ্যামানন্দ প্রকাশ" ও "অভিরাম লীলা" গ্রন্থে শ্যামানন্দ সম্পর্কে নানান কথা লেখা আছে। উৎসাহীরা এই দুটি বই পড়ে দেখতে পারেন।

৩) রসিকানন্দ:

রোহিনীর রাজা বা জমিদার ছিলেন অচ্যুতানন্দ পট্টনায়ক। রসিকানন্দ হলেন অচ্যুতানন্দর পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর তিনি গোস্বামী বংশের সূচনা করেছিলেন, রাজবংশের পরিবর্তে। এর একটা ছোট ইতিহাসও আছে। বৈষ্ণব সাধক শ্যামানন্দ ও তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে রসিকানন্দ দুজনে মিলে নয়াবসান পরগনার কাশীপুরে রাধাগোবিন্দের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৩০ সালে শ্যামানন্দের মৃত্যুর পর ওই মন্দিরের গাদীশ্বর(Chief of Head Quarter) গোস্বামী রূপে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তারপর তার হাতেই গোপীবল্লভপুরে গোস্বামী বংশের সূচনা ঘটে।

১৫৯০ সালে রসিকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন, অচ্যুতানন্দ পট্টনায়ক এবং মা ছিলেন, রানী ভবানী। তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন ইচ্ছা দেবী। উড়িষ্যা ও বাংলার সীমান্তবর্তী এলাকায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে বেরিয়ে শ্যামানন্দ প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তখন রসিকানন্দের কাছে এসে যেমন শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন, তেমনি রসিকানন্দকে দীক্ষা দান করে তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রচারেও বেরিয়ে পড়তেন। কারণ রসিকের রাজ বংশের পরিচয় অনেক কাজে আসত। তবে এলাকাবাসীর অনেকেই রসিকানন্দের এই বৈষ্ণব প্রীতিকে ভালো চোখে দেখলেন না। শুরু করেছিলেন বিরোধিতা। অনেকেরই মনোভাব ছিল--

"নাহি লয় হরিণাম, না শুনে হরিকীর্তি
অতিশয় দুষ্ট কর্ম করে নিরন্তর
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব নিন্দা করয়ে বিস্তর"।।
(রসিকমঙ্গল: গোপীজনবল্লভ দাস)


প্রবল বাধা সত্ত্বেও রসিকানন্দ বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে গেছেন। রসিকানন্দের জীবনী অবলম্বনে ১৬৫৪ সালে রচিত গোপীজনবল্লভ দাসের "রসিকমঙ্গল" জীবনী কাব্যে রসিকানন্দের সেই পরিচয়ও পাই। যেমন---
উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের রাজা বৈদ্যনাথ  ভঞ্জকে বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা দিয়েছিলেন রসিকানন্দ। অহিংসার দীক্ষা দিয়েছিলেন একসময়ের সাত শ সাধু হত্যাকারী নিষ্ঠুর ভূঞা জমিদার উর্দন্ড রায়কে। উড়িষ্যার মুঘল সুবেদার আহমদকেও অহিংসা ও প্রেমের দীক্ষা দিয়েছিলেন রসিকানন্দ। সুতরাং গোটা জঙ্গলমহলে এবং উৎকলেও বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে হরিণামের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন রসিকানন্দ। তার প্রভাবও ছিল দারুণ। ১৬৫২ সালে রসিকানন্দ পরলোকগমন করেন। বালেশ্বর জেলার রেমুনা গ্রামে রসিকান্দকে সমাহিত করা হয়। এটাই ছিল নাকি তার পূর্ব নির্দেশ। কারণ তিনি শিষ্যদের সে কথা বলেই গিয়েছিলেন---

"রেমুনাতে শ্রীগোপাল চরণে
আসন করিবে মোর নিশ্চে সেই স্থানে"।।
 
এরপর রোহিনি রাজবংশই হয়ে উঠল বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গোপীবল্লভপুর এর গোস্বামী বংশ।

রসিকানন্দ কতকগুলি বৈষ্ণব গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। যেমন, "শাখা বর্ণন" ও "রতি বিলাস"।

রসিকান্দের সেই প্রাচীন মন্দির আজও রয়েছে। যদিও এখন কিছুটা সংস্কার হয়েছে। দেওয়ালে কিছু কিছু প্রাচীন ভাস্কর্যের নমুনা আছে, তবে সংস্কার করতে গিয়ে প্লাস্টারে অনেক কিছুই ঢাকা পড়ে গেছে। মূল মন্দিরে ল্যাটেরাইট শিলায় খোদাই করা আছে, বীর হনুমান। আছে ভুঁইঘর (ভজনের স্থান), আছে দোলমঞ্চ। আর আছে অষ্ট বক্রাকার রাসমঞ্চ। আছে সারিবদ্ধ ভাবে বৈষ্ণব সাধকদের সমাধি স্থল। রসিকের সময়কাল থেকে আজও এখানে শ্রীপাটের সেবা হয়ে চলেছে। বৈষ্ণব সাধুদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। এখন যিনি মহান্ত সেই গোস্বামীর উদ্যোগে প্রতিবছর দণ্ড মহোৎসবের  অনুষ্ঠানও মহা ধূমধামের সঙ্গে পালন করা হয়।

এভাবেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম জঙ্গলমহলে একটু একটু করে পায়ের মাটি শক্ত করেছেন। এবং দিন দিন এই ধর্মের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। একই গ্রামে মিশ্র জাতির বাস থাকলেও হরিণাম সংকীর্তন এর সময় জাত-পাত ভুলে, ধনী গরিব নির্বিশেষে যেভাবে এক হয়ে  উঠেন হরিণামের প্রেম গান ও ভক্তিতে, সেটাই বা কম কিসের!

তথ্যসূত্র:
১) ঝাড়খণ্ডে মহাপ্রভু: সুহৃদকুমার ভৌমিক
২) জঙ্গলমহল ও ঝাড়খন্ডী লোকদর্শন: পশুপতি প্রসাদ মাহাতো
৩) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি:২য় খণ্ড(বিনয় ঘোষ)
৪) মেদিনীপুরের ইতিহাস: যোগেশচন্দ্র বসু
৫) ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি: মধুপ দে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

2 Comments