সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর শ্রদ্ধা ও স্মরণে
মায়া দে
"তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে
সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে"...
সংগীত জগতের সুরসম্রাজ্ঞী স্বয়ং সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর। আসমুদ্রহিমাচল যাঁর মধুর কোকিলকণ্ঠ পিয়াসী। সুরের দেবীর সুরমূর্ছনায় কন্ঠ -মাধুর্যে বুঁদ সারা দেশ। তিনি সংগীতাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেই নক্ষত্রের পতন হলো আজ। সুরের দেবী লতাজী আজ নেই । কিন্তু তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীত সম্ভার সে তো চিরন্তন। এর মৃত্যু নেই। দেবীর মৃত্যু হয় না। বিসর্জন হয়। তিনি তো সাক্ষাৎ মা সরস্বতী। আজ তাঁর বিসর্জনে নশ্বর শরীরটা বিসর্জনে যাবে তবু গান রয়ে যাবে।
"আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীনা হতে আসিল নাবিয়া!
ভুবন মিলে যায় সুরের রননে
গানের বেদনায় যায় যে হারায়ে।"...
২৭ দিনের লড়াইয়ের মৃত্যুর কাছে হার মানলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। কোভিদ আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে গত ৮ ই জানুয়ারি ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। শনিবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আবার আইসিইউতে রাখা হয় । চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা চলে। কিন্তু রবিবার ৬ই ফ্রেব্রুয়ারী সকল সঙ্গীত পিপাসুদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান সুরসম্রাজ্ঞী। সকাল ৮:১২নাগাদ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে। পিতার নাম দীননাথ মঙ্গেশকর। মাতার নাম শিবন্তী মঙ্গেশকর। বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলে গায়িকার ছোট বোন। তাছাড়া ঊষা মঙ্গেশকর মীনা মঙ্গেশকর দুই বোন ও এক ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর একজন মারাঠি কোঙ্কিনী সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। সেই সঙ্গে একজন অভিনেতাও। বাবা চাইতেন মেয়ে শুধু ধ্রুপদী গান করুক। তাই ছেলেবেলায় বাড়িতে কে এল সায়গল ছাড়া আর কোনও গান গাওয়ার অনুমতি ছিল না।
সুরসম্রাজ্ঞীর জীবনে প্রথম নাম ছিল হেমা। কিন্তু পিতার আয়োজিত "ভাব বন্ধন" নাটকের নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করার পর তার নাম হেমার পরিবর্তে লতা রাখা হয়। সেই লতা নামেই আজও তিনি সবার হৃদয়ে।
মহাগায়িকার বয়স যখন ১৮ বছর তখন তাঁর রেডিও কেনার সামর্থ্য হয়। রেডিও কেনেন। রেডিও প্রথম খোলাতেই তিনি এই দুঃসংবাদ শোনেন যে ----কে এল সায়গল আর বেঁচে নেই। তিনি মর্মাহত হন। ঐ রেডিও তিনি আর ব্যবহার করেননি। ফেরত দেন।
লতা মঙ্গেশকর এক হাজারেরও বেশি হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন। বিদেশি ভাষা সহ ভারতের প্রায় ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষাতে একমাত্র তিনিই গান গেয়েছেন। তিনি গুবানি থেকে গজল, কাওয়ালি, ক্লাসিক্যাল ও বিভিন্ন ঘরানার গান গেয়েছেন। ১৯৩০সালে বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের লেখা মারাঠি নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। এবং তিনি ওই নাটকে গান করেন। ১৯৪২ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মারাঠি সিনেমায় প্লেব্যাক করেন । সেই বছরই হারান তাঁর বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরকে। ১৯৪৬ সালে প্রথম হিন্দি প্লেব্যাক করেন। সিনেমার নাম "আপ কি সেবা মে"। ১৯৪৯ সালে কুড়ি বছর বয়সে তার গান শ্রোতাদের মন জয় করে। দুটি সিনেমায় নায়িকার কণ্ঠে শোন যায় তাঁর গান। মধুবালার "মহল"এ ব্যাক গ্রাউন্ড সং"আয়েগা আনেওয়ালা"এবং" বরসাত " সিনেমার ন-খানি গানের প্লেব্যাক করেন তিন নায়িকার জন্য। ১৯৮৮ সালে রাজ কাপুরের নির্দেশনায় "রাম তেরি গঙ্গা মইলি"র গান এখনো শ্রোতাদের মুখে মুখে।এই গানগুলির পরিচালক ছিলেন রবীন্দ্রজৈন।১৯৫০সাল থেকে ১৯৬০সাল পর্যন্ত হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্লেব্যাক সিঙ্গার তিনি। অনিল বিশ্বাস, নওশাদ আলী মদনমোহন, এসডি বর্মণ, শ্রী রামচন্দ্র এবং লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল প্রমুখ সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। গান গেয়েছেন কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মুখোশের সঙ্গে। ১৯৬৩ সালে রামলীলা ময়দানে পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর সামনে "এ মেরে ওয়াতন কে লোগো " গানটি গেয়েছিলেন । তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৬২সালে সালের ভারত-চীন যুদ্ধে যেসব ভারতীয় সৈনিক মারা গিয়েছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্যে করে লেখা হয়েছিল এই গান।
বোম্বাই সংগীতজগতে বহু পরিচালক তার হাল্কা সুরের গান অপছন্দ করে গায়িকা হিসেবে সুযোগ দেননি। তখন ছিলেন নুরজাহান, শামসাদ বেগম রাজকুমারী সুরইয়ার কন্ঠের বিশেষ গায়কী। দেশ, বিভাগের পর নুরজাহান পাকিস্তান চলে যান। সেই সময়ে প্রথম সুযোগ আসে সুরকার গোলাম মহম্মদের চেষ্টাতে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মহাগায়িকা জয়যাত্রা শুরু করেন। ১৯৭০থেকে -৮০ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন ঘরানার গান গাইতে শুরু করেন। এই সময় লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল এর জন্য ৭০০ খানা গান গেয়েছিলেন ।১৯৭২ সালে "পরিচয়" সিনেমার জন্য তিনি পান প্রথম জাতীয় পুরস্কার। ১৯৭৪ সালে পারফর্ম করেন লন্ডনের রয়েল আলবার্ট হলে। "কোরা কাগজ" এর জন্য পান দ্বিতীয় জাতীয় পুরস্কার। ১৯৯০সালে "লেকিন" সিনেমার জন্য তৃতীয় জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৯৭ সালে এ আর রহমানের সুরে "মা তুঝে সেলাম" সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল তাঁর এই গান। ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে গাওয়া হয়েছিল এই গান।
সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর গান গেয়ে ভারতরত্ন এবং মহারাষ্ট্র রত্ন পান২০০১ সালে। পদ্মবিভূষণ (১৯৯৯),দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯) পদ্মভূষণ (১৯৬৯), ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা "লিজিয়ন অব্ অনার" খেতাব প্রদান করেন। শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫ টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন । পরবর্তীকালে তিনি ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার ও ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালে দুইবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন।
বলিউডের নাইটিঙ্গেল লতা মঙ্গেশকর। আজ রবিবার ছুটির দিন। ছুটির আমেজ। তার মধ্যেই হঠাৎ দুঃসংবাদ মুম্বাই মায়ানগরিতে। লতা মঙ্গেশকর আর নেই । অনেকে ভাবতেই পারছিলেন না। অনেকে মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন। শিল্পীমহলে, বলিউডে শোকের ছায়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে গিয়েছে ট্যুইটের পর ট্যুইটে। অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন, অমিতাভ বচ্চন, দিয়া মির্জা, শ্রেয়া ঘোষাল থেকে শুরু করে দক্ষিণের চিরঞ্জীবী, মহেশ বাবু সকলেই শোক প্রকাশ করেছেন। শচীন টেন্ডুলকার, শাহরুখ খান, আমীর খানসহ এ আর রহমান, শংকর মহাদেবান প্রমুখ সংগীত পরিচালকও শোক প্রকাশ করেছেন। আমাদের বাংলাযও সেই শোকের ছায়া অব্যাহত। অজয় চক্রবর্তী, সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র জানিয়েছেন শোক বার্তা।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্রমোদিজী কিংবদন্তি মহাগায়িকার মৃত্যুতে দু দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন। এই উপলক্ষে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। বাংলাতেও আগামী কাল অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যান্য রাজ্য সরকারও শোক বার্তা প্রকাশ করেছে।
লতাজির মত একজন লিজেন্ড যে তিনি নেই এটা মেনে নেওয়া যায় না। মেনে নেওয়া শক্ত। যতদিন সঙ্গীত থাকবে, লতামঙ্গেশকের কন্ঠ ও তাঁর গান ততদিন চিরঅমর হয়ে থাকবে।
"নয়ন সমুখে তুমি নেই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।"
2 Comments
ভীষন সুন্দর 👌
ReplyDeleteদূর্দান্ত
ReplyDelete