জ্বলদর্চি

দেবী ভাবনায় সরস্বতীর উপাখ্যান /প্রসূন কাঞ্জিলাল

দেবী ভাবনায় সরস্বতীর উপাখ্যান

প্রসূন কাঞ্জিলাল


আমরা যে দেবী সরস্বতীকে হিমালয়-দুহিতা পার্বতীর কন্যা ও লক্ষ্মী-কার্তিক-গণেশের সহোদরা ভগ্নীরূপে দেখি বা জানি সেটা নিতান্তই বাঙালিদের ঘরোয়া মনগড়া গল্প, এর পিছনে কোন শাস্ত্রীয় অনুমোদন নেই। সরস্বতী -- সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার সহধর্মিণী এবং বিষ্ণুপত্নী মহালক্ষ্মী ও মহেশ্বরজায়া পার্বতীর সঙ্গে একযোগে ত্রিদেবী নামে পরিচিতা। সরস্বতী আসলে প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদসমূহের প্রসূতি।

ঋগ্বেদে বাগ্‌দেবী ত্রয়ীমূর্তি- ভুঃ - ভুবঃ - স্বঃ, জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী। বিশ্বভূবন প্রকাশ তাঁরই জ্যোতিতে। হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্জ্বলিত হয়, তখন জমাট বাধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার যায় দূর হয়ে। অন্তরে, বাইরে সর্বত্র তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি। এই জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী, তাই তিনি সর্বশুক্লা। তিন গুণের মধ্যে তিনি “সত্ত্বগুণময়ী”, অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক্শক্তির প্রতীক “বাগ্‌দেবী”। গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগ্বেদে তাঁকে নদীরূপা কল্পনা করাও হয়েছে, যিনি প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা মহার্ণব বা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। কল্যাণময়ী নদীতটে "সাম" গায়কেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণে ও সাধনে নিমগ্ন হতেন। তাদের কন্ঠে উদ্গীত সাম সঙ্গীতের প্রতীকী বীণা তাই দেবীর করকমলে। সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি “বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত” আশ্রয় করে সাধনা করতেন আশ্রমবাসী ঋষিগণ। সেই ভাবটি নিয়েই দেবী ‘পুস্তক হস্তে’, গ্রন্থ রচনার সহায়ক লেখনীটিও  তাই তাঁর সঙ্গে।

মার্কণ্ডেয় পুরাণে , শ্রী শ্রী চণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভুজা – বাণ, কার্মক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্রশস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটির কখনোই হানি ঘটেনি, কেননা তিনি “একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা” বলে মোহদুষ্ট শুভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন। উক্ত শ্রী শ্রী চণ্ডীতে মহাদেবী চণ্ডীর তিনটি রূপ কল্পনা করা হয়েছে – মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী ও মহাকালী। সরস্বতী বৈদিক দেবী। ঊষার পরেই এঁর স্থান।

ঊষা সরস্বতী চৈতন্যদায়িনী। সূর্যোদয়ের ঠিক আগে পূর্বাকাশে শুভ্র ও উজ্জ্বল আলোকাভাসই দেবী ঊষা - যিনি শ্বেতবর্ণা সরস্বতী। 'সরস্' শব্দের অর্থ জ্যোতি। তাই সরস্বতী অর্থে জ্যোতির্ময়ী। প্রথমে ইনি নিরাকার তথা জ্যোতিঃস্বরূপা ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তখন লিঙ্গ নির্ণয়ের প্রশ্ন ছিল না। পরে দেবীত্ব আরোপ করা হয়। বেদ এঁকে ধীর্ষণা, বাগ্‌দেবী, ভারতী প্রভৃতি নাম দেয়। ত্রিপদা গায়ত্রী, সাবিত্রী ও শতরূপা নামেও ইনি পরিচিতা। ইনি সরস্বৎ অর্থাৎ সূর্যের কন্যা বা পত্নী। প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসকন্যা তথা পত্নী হিসাবেও এঁর পরিচিতি আছে।

স্কন্দ পুরাণের প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টির সূচনা হয়।

গরুঢ় পুরাণে সরস্বতী হলেন শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। তন্ত্রশাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী – অং থেকে ক্ষং পঞ্চাশটি বর্ণে তাঁর দেহ গঠিত। আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে –

“শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা, 
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা ,
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।। "….

এর অর্থ দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা, তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।

দেবী সরস্বতী আসলে দেবী দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন রূপের একটি প্রকাশ মাত্র। সব মিলিয়ে সরস্বতী' নামক দেবীভাবনাটি বেশ জটিল ও দ্বিধাসংকুল।

'সরস্বৎ' শব্দের আরও একটি অর্থ হল প্রচুর জলবিশিষ্ট নদ বা নদী। বৈদিক যুগে সরস্বতী নামে বড় একটি নদী ছিল। সেই নদীর তীরে আর্যঋষিরা যাগযজ্ঞ করতেন। সরস্বতীকে ঘিরেই বৈদিক যুগের কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য,
জ্ঞান ও কল্যাবিদ্যার বিস্তার ঘটেছিল। ওই নদীর রূপেই দেবী কল্পনা। অনুষঙ্গ পদ্ম, কচ্ছপ, হাঁস। জ্ঞান ও কলার স্মারকে অধিকন্তু পুস্তক, কলম ও বীণা।

সরস্বতীচর্চায় বাংলার এক হারানো নদীর উপাখ্যান আলোচনাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক । বৈদিক সংস্কৃতিতে দেবী সরস্বতী হলেন বেদমাতা.... বিপুলা জ্ঞানের স্রোতধারা..... সেই সূত্র ধরে প্রাচীন বৈদিক সময়ে কোন একটি অঞ্চলের সবচেয়ে বিপুলা জলরাশির নদীটির নামকরন করা হতো সরস্বতী.......যে নদী তীরে হতো সেই অঞ্চলের সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশ.....তীরভূমি হয়ে উঠতো জ্ঞান অর্জনের পূণ্যভ্যমি। তাই প্রাচীন ভারতে একাধিক সরস্বতী নামের নদীর দেখা মেলে...যদিও বর্তমানের সেই নদীগুলি আজ শুধুই রূপকথা।

উত্তর-পশ্চিম ভারতের সরস্বতী নদী ধরার বুক থেকে হারিয়ে গেছে কোন এক প্রাচীন ঋক-বৈদিক কালে....কিন্তু এই বাংলার বুকে আজও কোথাও সংযোগ বিচ্ছিন্না বা কোথাও এক শীর্ন খাত রূপে......প্রায় দু হাজার বছরের বাঙালি কৃষ্টি বিকাশ যাত্রার সাক্ষী স্বরূপ.... সেই সরস্বতী নদী আজ চিরমৃত্যুর প্রহরের অপেক্ষারত।

কিন্তু একদা এই সরস্বতী নদী ছিলো দক্ষিণবঙ্গের প্রধান নদী...গাঙ্গেয় ভাগিরথীর মূল বারিরাশি প্রবাহিত হতো এই নদীখাত ধরে......বঙ্গীয় সভ্যতার ঐতিহ্য আর বিকাশের আকর ছিলো এই নদী অববাহিকা....এর তীরেই ছিলো অতিতের তাম্রলিপ্তি বন্দর এবং সপ্তগ্রাম বন্দর। এই নদীর গতিপথ বেয়ে বাংলার বনিক সম্প্রদায় পৌছে গেছে সেই সূদুর জাভা - সুমাত্রা - বোর্নিও -
শ্যামদেশ কিংবা সিংহল, যেখানে এই বঙ্গভূমির মানুষ গড়ে তুলেছিলো একান্ত তাদের নিজস্ব বসতি। আজও তাই শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ মানুষের ডিএনএ ম্যাচিং হয়ে এই বঙ্গদেশের অধিবাসীদের সাথে মিলে যায়, তামিল দের সাথে নয়।

অতীতে ত্রিবেনী থেকে ভাগিরথী নদীর জলধারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ধাবিত হতো সাগরসঙ্গমে।

যমুনার তীরে ছিলো প্রাচীন চন্দ্রকেতুগড় তথা গঙ্গাবন্দর । এই এক নদী খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের পরেই নাব্যতা হারাতে থাকে।

ভাগিরথীর প্রধান জলরাশি প্রবাহিত হতো সরস্বতী নদী খাতে । ত্রিবেনী থেকে পশ্চিমে ধাবিত হয়ে পরে দক্ষিণ মূখী হয়ে, অধুনা তমলুক (তাম্রলিপ্তি)  হয়ে, ডায়মন্ড হারবারের কাছে প্রাচীন হুগলি নদীর খাতের সাথে মিলিত হয়ে সাগরের দিকে এগিয়ে চলতো। তাম্রলিপ্তি বন্দরের জলের জোগান দিতো এই সরস্বতী, দামোদর, ও রূপনারায়নের মিলিত স্রোতধারা। 

কিন্তু পরবর্তীকালে অষ্টম-নবম শতকে এই নদী তাম্রলিপ্ত পথ ত্যাগ করে পূর্বমুখে প্রবাহিত হতে থাকে এবং বর্তমানের সাঁকরাইল (পূর্বপাড়ে মহেশতলা)  থেকে হুগলী নদী যে খাতে প্রবাহিত হয়ে সেই পথ ধরে চলতে থাকে দক্ষিনমূখে।

একটা মজার তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো, খিদিরপুর থেকে সাঁকরাইল বর্তমান গঙ্গার (হুগলী নদী) এই পথে ষোড়শ শতকের আগে কোনো নদী খাতই ছিলো না। 

সরস্বতীর এই পথ পরিবর্তন তাম্রলিপ্তি বন্দরের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেয় এবং পরিবর্ত হিসাবে উঠে আসে সরস্বতী নদীর তীরে হুগলির সপ্তগ্রাম বন্দর। সরস্বতীর তীরে হাওড়া হুগলীতে গড়ে ওঠে একাধিক বর্ধিষ্ণু গ্রাম, সপ্তগ্রাম হয়ে ওঠে বাংলার বাণিজ্যিক রাজধানী । তার বিস্তারিত ইতিহাস না হয় অন্য কোনো সময়ে আলোচনা করা যাবে। 

এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের বৈশিষ্ট্যই হলো বারে বারে নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং অতীতের কোনো স্বল্পগুরুত্বপূর্ণ নদী হয়ে ওঠে প্রধান জলবাহিকা , যেমন কোন একসময়ের ক্ষীর্নকায় কীর্তিনাশা হয়ে ওঠে বিপুলা কল্লোলিনী পদ্মা, তেমনই করে ষোড়শ শতাব্দী থেকে ভাগিরথীর মূল জলধারা ত্রিবেনী থেকে প্রবল বেগে অতিক্রম করতে শুরু করে বর্তমানের হুগলী নদীর খাতে ক্রমশ নাব্যতা হারাতে হারাতে শুরু করে সরস্বতী নদী। মধ্যযুগের উপন্যাস "মনসামঙ্গলে" তাই চোখে পড়ে চাঁদসদাগরের যাত্রা পথ হুগলী নদী ধরে এগিয়ে বর্তমানের আদি গঙ্গা পথে ধাবিত। 

সরস্বতী নদীর চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ইতিকথা চূড়ান্ত হয় , যখন ডাচ বনিকেরা খিদিরপুর থেকে সাঁকরাইল এক ট্রাইডাল খাঁড়ি পথে খাল খনন করে হুগলী নদীর জলধারা প্রবাহিত করে দেয় প্রায় মজে যাওয়া সরস্বতী নদীর দক্ষিণ খাতে, সাথে সাথে মৃত্যু পরোয়ানার সূচনা হয়ে আদিগঙ্গারও। আজও হাওড়া হুগলীতে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন প্রায় শুষ্ক সরস্বতীর খাত দেখতে পাওয়া যায়। অনেক পুকুর কিংবা ঝিলের পাড়েও শ্মশান থাকে যা সরস্বতী নদীর অংশ হিসাবে মনে করেন অনেকে।

“নিরুক্ত”কার যাস্ক - এর মতে দেবী সরস্বতী “দেবীরূপা নদীরূপা চ ” (২/২৩)। “বাক্‌”-রূপিনী দেবী বাগদেবী স্মরণে জলদা নদীও দেবীর পবিত্র নামের সঙ্গে পরবর্তীকালে সম্পর্কিত হয়েছিল। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে মহাত্মা অর্জুন ঋষির বিদুষী কন্যার নাম ছিল “বাক্”। পৃথিবীতে অলৌকিক কিছুই ঘটে না। সরস্বতীর রূপাখ্যানেও বাস্তব ভিত্তি বোঝা যাচ্ছে।

সরস্বতী শব্দের দুই অর্থ একটি ত্রিলোকা ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস্ + বর্তী = সরস্বতী, অর্থ জ্যোতিময়ী। আবার "সৃ" ধাতু নিষ্পন্ন করে সর শব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। ঋগ্বেদে আছে “অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী,”  সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব।

শুধু বৈদিক যুগেই নয়, পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে, সেখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রসবন থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্মাবৃক্ষের নিকটে, তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্মাবতরণ। ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা, যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, সরস্বতী নদীই ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি। সরস্বতী ও দূষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরেই অনুষ্ঠিত হয়। মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতানার মরুভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা হল চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ।

রাজস্থানের মরুভূমিতে বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে পরে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়, আবার বলিচ্ছপুর নামক স্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়। তান্ডীয়মহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে পক্ষপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। লাট্যায়ণের শ্রৌতসূত্র মতে, সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিতা, তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন যা কেউ দেখতে পায় না, তাকেই বিনশন বলা হয়। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাঁড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে, একমতে খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে। মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য ইহা বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে। নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে। আবার অনেকে বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী। সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী।

নারদীয়, কুর্ম, দেবী প্রভৃতি পুরাণে এবং কুলার্ণব ও সারদাতিলক প্রভৃতি তন্ত্রে সরস্বতীদেবীকে স্বীকার করা হয়েছে শিব-দুর্গার কন্যা, আবার বৌদ্ধ মতে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর পত্নী, তিনি হংসবাহিনী না সিংহারূঢ়া সে সম্পর্কে বিতর্ক আছে, থাকবেও।

অ্যাসিরীয় কাহিনীতে দেখা যায়, আইসিস্ ও নেপথিস্  এরা দুজন ভগ্নী দুটি সিংহের সামনে নতজানু হয়ে উপবিষ্ট। দুটি সিংহ ভারতের ঊষা ও দেবী সরস্বতী এবং আইসিস্ ও নেপথিস্ হলেন ভারতবর্ষীয় সন্ধ্যা ও লক্ষ্মীদেবী। কিন্তু মূল কথা এই, 'জিউস'-কন্যা মিনার্ভার মতো দেবী সরস্বতীও একাধারে জ্ঞান - শিল্প - কলাবিদ্যার জ্যোতিঃস্বরূপ বহুমান্য এক লোকবিশ্বাস।

বৈদিক যুগে সরস্বতী প্রতিমার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। পরে বৌদ্ধরা ‘বাগীশ্বরী রূপে তাঁর পুজো করেন। এই রূপে তিনি সিংহের পিঠে বসেন এবং হাতে বীণা থাকে। আবার 'বীণাপাণি’ রূপে এঁর আসন রাজহাঁসের পিঠে। দক্ষিণ ভারতে এঁর বাহন হাঁস বা সিংহ নয়, ময়ূর।

ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভূজা অথবা চতুর্ভূজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুজা সরস্বতী পূজিতা হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তক ধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসিনা।

বাহন দেবীর একদিক থেকে প্রতিনিধি, আবার বাহন দেবীর শক্তির সঙ্গে সঙ্গে মহাদেবীসত্তার প্রকাশকও বটে। সরস্বতীর বাহন হংস, যা শুভ্র ও নির্মল জ্ঞানের প্রতীক। দেবীর প্রকাশক বর্ণ শ্বেত বা সাদা। রাজহংস কেন সরস্বতীর বাহন? কেননা, জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হাঁসের সমান গতি, যেমন জ্ঞানময় পরমাত্মা সর্বব্যাপী স্থলে, অনলে, অনিলে সর্বত্র তাঁর সমান প্রকাশ। জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেও হংসের এ স্বভাব তাৎপর্য বহন করে। সংসারে নিত্য ও অনিত্য দুটি বস্তুই বিদ্যমান। বিবেক বিচার দ্বারা নিত্য বস্তুর বিদ্যমানতা স্বীকার করে তা গ্রহণ শ্রেয়, অসার ও অনিত্য বস্তু সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। হাঁস জলে বিচরণ করে কিন্তু তার দেহে জল লাগে না। মহাবিদ্যা প্রতিটি জীবের মধ্যে থেকেও জীবদেহের কোনকিছুতেই তাঁর আসক্তি নেই, তিনি নির্লিপ্তা।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বলেছেন, সরস্বতী শ্রীকৃষ্ণের মুখগহ্বর থেকে নিঃসৃত হয়েছিলেন এবং তাঁরই আদেশে তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী হয়েছিলেন। সরস্বতী তাই ‘বিষ্ণুভার্যা' এবং 'বিষ্ণুজিহ্বা' নামেও পরিচিতা।

পৌরাণিক যুগের সময়ে কোন কোন সমাজে কৃষ্ণ-বিষ্ণুর আরাধনারই যে বেশী প্রচলন ছিল, সে কথা প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় ভান্ডারকর প্রমুখরা স্বীকার করেছেন। কৃষ্ণ বা বিষ্ণু আসলে সূর্য তথা অগ্নিরই স্বরূপ, সুতরাং সরস্বতী কৃষ্ণের মুখ থেকে জন্ম নিলেও আদতে যে সূর্য বা অগ্নির রূপ এ ব্যাপারে প্রায় কোন সন্দেহই নেই। তিনি জ্ঞান-জ্যোতির প্রতীকস্বরূপা বলে শ্বেতবর্ণা। তাঁর সকল উপাচারও সাদা রঙের। সাদা ফুল, সাদা চন্দন, সাদা পদ্ম, দই, ক্ষীর, মাখন, খই, তিলের খাজা, সাদা পিঠে প্রভৃতি। হাঁসের রঙও সাদা হওয়াই উচিত। সামগ্রিক ভাবে দেবী সরস্বতীর রূপাখ্যানে পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতার ভাবকল্পনা বিধৃত আছে।

হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন সরস্বতী। গান্ধারে পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে। অনেক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে পাথরের ছোট ছোট মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, অবিকল সরস্বতী মূর্তি। মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদন ছিল। জৈনদের চব্বিশজন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন সরস্বতী। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় জৈন সম্প্রদায়েই সরস্বতীর স্থান হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীতা একজন প্রধান দেবীরূপে।

কোনও কোনও পুরাণ মতে মাঘ মাসে শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতীর পুজো চালু করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। 'মাঘস্য শুক্লা পঞ্চম্যাং বিদ্যারঞ্জ দিনেপিচ' – এ নাকি তাঁরই বিধান। এর সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা সম্ভব নয় । তবে স্বামী অভেদানন্দ মহারাজ পুরাণাদি ঘেঁটে দেখেছেন, এই দিনটিতে লক্ষ্মীর সঙ্গে স্কন্দের বিবাহ হয়েছিল। তাই তিথিটি ‘শ্রীপঞ্চমী' নামে খ্যাত। মহাভারতে বনপর্বে ‘শ্রীপঞ্চমী’ নাম কেন হ’ল তার কারণ বর্ণিত আছে। সেখানে লক্ষ্মীদেবী দেবসেনা ইন্দ্রের মাতৃস্বসার কন্যা। অসুররাজ কেশী অত্যাচার করায় ইন্দ্র কেশীকে হত্যা করেন। দেবসেনারূপিনী লক্ষ্মী তখন স্কন্দ-কার্তিকেয় এর আশ্রয় গ্রহণ করেন। দিনটি ছিল পঞ্চমী তিথি। শ্রী বা লক্ষ্মীদেবী এই পঞ্চমী তিথিতে স্কন্দের আশ্রয় গ্রহণ করায় এই তিথির নাম হয় “শ্রীপঞ্চমী"। কিন্তু কালক্রমে লক্ষ্মীর এই দিনটি সরস্বতী অধিকার নিলেন। সেটা কবে থেকে এবং কীভাবে হল তা বলা সহজে সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যপুরাণে দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সঙ্গে একটি মিতালী পাতানোর চেষ্টা অবশ্য করা হয়েছে।

সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতীসদৃশ্য দেবী বাগীশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ,  স্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে (সরস্বতী দেবী হলেও) মেয়েরা অঞ্জলি দিতে পারত না। কিছু পণ্ডিতের মতে সমাজপতিরা ভয় পেতেন হয়তো এই সুযোগে ধর্মের নামে মেয়েরা দাবি করে বসেন লেখাপড়ার স্বাধীনতা।

শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয় সাধারণ পূজার আচারাদি মেনে। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, যেমন অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ, বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল। লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল ভক্ষণ করে না। পূজার দিন লেখাপড়া নিষেধ থাকে। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করা হয়। পূজার শেষে পুষ্পাঞ্জলি। পরদিন সকালে ফের পূজার পর চিড়া ও দই মেশানো দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করে পূজা সমাপ্ত হয় ও সন্ধ্যায় প্রতিমা নিরঞ্জন দেওয়া হয়। বসন্ত পঞ্চমীতে অনুষ্ঠিত সরস্বতী পূজার পরের দিনটি বাংলায় শীতলষষ্ঠী। কোনো কোনো পরিবারে এদিন অরন্ধন পালন ও ‘গোটা-সেদ্ধ’ খাওয়ার প্রথা আছে।

সরস্বতী পুজা দিন হাতে খড়ি
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকাচার। যদিও "অনধ্যায় তিথিরিয়ম্ (শ্রীদত্তধৃতম্) সূতি " 
অর্থাৎ শ্রীপঞ্চমীতে অধ্যায়ণ করিবে না -- একথাও বর্ণিত আছে। 

"শ্রী পঞ্চম্যাং লিখেন্নৈব ন স্বাধ্যায়নং কদাচন।
বাণীকোপমবাপ্নোতি লিখনে পঠনেহপি চ।"

অর্থাৎ শ্রীপঞ্চমীতে লিখিবে না, পড়িবে না। তাই "সরস্বতী পুজা র দিন লেখাপড়া নিষেধ । ওইদিন তাই হাতে খাড়ি টাও সম্পূর্ন অশান্ত্রীয়  বলে অনেকে মনে করেন৷ হতে খাড়ি অন্য দিন আছে , তাকে বলে --- বিদ্যারম্ভ, সেটি হিন্দু ধর্ম দশবিধ সংস্কার ওর মধ্যে  একটি ৷ বিদ্যারম্ভের দিন আলাদা ভাবে পঞ্জিকায় থাকে, বাণী বন্দনার দিন বিদ্যারম্ভ করা তাই অশাস্ত্রীয় বলে অনেক পন্ডিত মনে করেন।

সরস্বতী পূজার সময় বা কাল নির্নয়ঃ----

"মাঘে মাসি সিতে পক্ষে পঞ্চমী যা শ্রিয়ঃ প্রিয়া।
তস‍্যা পূর্বাহ্ন এবেহ কার্য্যঃ সারস্বতোৎসবঃ।।"

মাঘ মাসে (কখনও কখনও ফাল্গুল মাসে; যেমন এই বছর ) শুক্ল পক্ষের পূর্বাহ্নকালিন , পঞ্চমীতিথিতে সারদোৎসব করতে হবে। এখানে সারদোৎসব অর্থে সরস্বতীপূজার কথা বলা হয়েছে যেহেতু দেবীর অপর নাম "সারদা"। পূর্বাহ্ন অর্থে দিনের সূর্যোদয় পরের তিন ঘন্টা। অর্থাৎ যদি সূর্যোদয় ৬ টায় হয়, তবে পূর্বাহ্নকাল সকাল ৬-৯ টা পর্যন্ত। অর্থাৎ এই ৯টার মধ্যে দেবী সরস্বতীর পূজা বা শ্রীপঞ্চমীকৃত‍্য অথবা লেখনী মাস‍্যাধার পূজা সমাপ্ত করতে হবে এটাই শাস্ত্রীয় নিয়ম ও বিধান। 

আমরা দেখি বা দেখে আসছি যে সরস্বতীপূজোর দিন আমরা হাতেখড়ি করিয়ে থাকি। তবে এই নিয়মটি সম্পূর্ণ ভুল একটি প্রচলিত প্রথা। 
বলা হচ্ছে,
"পঞ্চম‍্যাং পূজয়েল্লক্ষ্মীং পুষ্পধূপান্নবারিভিঃ।
মস‍্যাধারং লেখনীঞ্চ পূজয়েন্ন লিখেত্ততঃ।।"
অর্থাৎ, মাঘ(কখনও ফাল্গুনমাসে) মাসের শুক্লাশ্রীপঞ্চমীতে পুষ্প-ধূপ-অন্ন-জলাধার দ্বারা দেবী লক্ষ্মী সহ মস‍্যাধার-লেখনীর পূজা করিবে। তথাপি লিখিবে না। এখানে "পূজয়েন্ন লিখেত্ততঃ" এটির অর্থাৎ পূজা করবে কিন্তু লিখিবে না। 
অর্থাৎ হাতেখড়ি সরস্বতীপূজার দিন বা শ্রীপঞ্চমীতে নিষিদ্ধ। 

দ্বিতীয় প্রমাণ, -- 

"শ্রীপঞ্চম‍্যাং লিখেন্নৈব ন স্বধ‍্যায়ং কদাচন।
বানীকোপমবাপ্নোতি লিখনে পঠনে অপি চ।।"
অর্থাৎ শ্রীপঞ্চমীতে লিখিবে না এবং পড়িবেও না। ঐ তিথিতে লিখলে বা পড়লে সরস্বতী কোপভাজন হন। 
অর্থাৎ শ্রীপঞ্চমীতে হাতেখড়ি বা বিদ‍্যারম্ভ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।  তাহলে হাতেখড়ি কবে হবে??

পঞ্জিকায় বিদ‍্যারম্ভ বলে তারিখ দেওয়া থাকে উক্ত দিনে গনেশাদি দেবতার পূজা করে লক্ষ্মী সরস্বতী নারায়ণ সহ যথাশক্তি নিয়ম পূর্বক পূজা করে হাতেখড়ি বা বিদ‍্যারম্ভ করতে হয়। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে ত্রিপদী ছন্দে সরস্বতী বন্দনায় দেবীর প্রতি ভক্তের শ্রদ্ধার নিদর্শন মেলে সেই সময়ের বঙ্গভূমিতে।


উর দেবী সরস্বতী     স্তবে কর অনুমতি
       বাগীশ্বরি বাক্যবিনোদিনি,
শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস    শ্বেত বীণা শ্বেত হাঁস
       শ্বেতসরসিজনিবাসিনি।
বেদ বিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র     বেণু বীণা আদি যন্ত্র
          নৃত্য গীত বাদ্যের ঈশ্বরী
গন্ধর্ব্ব অপ্সরাগণ      সেবা করে অনুক্ষণ
          ঋষি মুনি কিন্নরকিন্নরী।
আগমের নানা গ্রন্থ      আর যত গুণপস্থ
          চারিবেদ আঠার পুরাণ;
ব্যাস-বাশ্মীকাদি যত      কবি সেবে অবিরত
          তুমি দেবী প্রকৃতি প্রধান।
ছত্রিশ রাগিনী মেলে     ছয় রাগ সদা খেলে
          অনুরাগ সে সব রাগিণী;
সপ্ত স্বর তিন গ্রাম      মূৰ্চ্ছনা একুশ নাম
          শ্ৰুতিকলা সতত সঙ্গিনী।
তান মান বাদ্য ভাল      নৃতগীত ক্রিয়া কাল
          তোমা হৈতে সকল নির্ণয়, 
যে আছে ভুবন তিনে    তোমার করুণা বিনে
           কাহার শকতি কথা কয়।
তুমি নাহি চাহ যারে      সবে মূঢ় বলে তারে
          ধিক্ ধিক্ তাহার জীবন,
তোমার করুণা যারে      সবে ধন্য বলে তারে
          গুণীগণে তাহার গণন।
দয়া কর মহামায়া     দেহ মোরে পদচ্ছায়া
          পূর্ণ কর নূতন মঙ্গল;
আসরে আসিয়া উর     নায়কের আশা পুর
            দুর কর অজ্ঞান সকল
কৃষ্ণচন্দ্র নরপতি     গীতে দিলা অনুমতি
          করিলাম আরম্ভ সহসা;
মনে বড় পাই ভয়     না জানি কেমন হয়
          ভারতের ভারতী ভরসা।।

গ্রন্থঋণ :
১। 'সরস্বতী’ – স্বর্গীয় অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। -
২। প্রবন্ধ “সরস্বতীর কুলের কথা" — শ্রী সুরজিৎ শাস্ত্রী। পত্রিকা – “প্রবাসী”; সংখ্যা – আষাঢ় (১৩৫৪)
৩। তান্ডীয়মহাব্রাহ্মণ, শতপথব্রাহ্মণ ও মহাভারত।
৪। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বিরচিত “অন্নদামঙ্গল কাব্য"।
৫। মার্কন্ডেয় পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, বায়ু পুরাণ, গরুড় পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এর নির্বাচিত অংশ।
৬। Dr. Wallace Budge: Book of the Dead, Vol-1
৭। Rigvedic Culture of the Prehistoric Indus (1946): Vol-I & II, by Sankarananda.
৮। Studies in the Tantras by Dr. Probodh Kumar Bagchii ...... 
৯। ইন্টারনেট ও অন্যান্য।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

4 Comments

  1. বেবী সাউFebruary 04, 2022

    খুব ভালোলাগ। গুরুত্বপূর্ণলেখা

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লেগেছে।তথ‍্যের সুষম ব‍্যবহার।যার ফলে পড়ায় আনন্দ মনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।

    ReplyDelete